শুক্রবার, ৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১ , ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫

সাহিত্য
  >
গল্প

কফি বালিকা

অতনু দাশ গুপ্ত মার্চ ১১, ২০২২, ১৫:০৬:২০

983
  • ছবি: ইন্টারনেট

বাসের জন্য অপেক্ষা করতে করতে হাত ক্রমশ জমে আসছিল। গ্রীষ্মের শেষে বসন্তের আমেজে সেজেছে প্রকৃতি। গাছের পাতাগুলোয় এই সময় তিন রকমের রং চোখে পড়ে—সবুজ, হলুদ আর লাল। প্রকৃতির সৌন্দর্যকে হয়ত কখনো কোনও সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা যাবে না। সিডনি শহরের স্নিগ্ধতার কোনও তুলনাই হয় না। এটা অষ্ট্রেলিয়ার অপেরা হাউজের সিডনি না, কানাডা, নোভা স্কসিয়ার সিডনি। নয়টা প্রদেশের মধ্যে নোভা স্কসিয়া দ্বিতীয় কনিষ্ঠ। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে শুধু সিডনিই না, প্যারিস, লন্ডন,  ইর্য়ক সবই আছে এ দেশের ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশে।

পাহাড় ঘেরা, আটলান্টিক সমুদ্রের কোল ঘেঁষে অপরূপ সৌন্দর্যের লহর তোলা এই কেপ ব্রেটন দ্বীপকে বলা হয় মৃত্যুর আগে অবশ্যই দর্শনীয় দশটা জায়গার মধ্যে একটা। 

বাস এসে গেছে। এক নম্বর বাস। এই বাসে চেপে আমাকে ডরচেস্টার মানে মেইন বাস স্টপ থেকে পাঁচ নম্বর বাসে উঠতে হবে। গন্তব্যস্হল নর্থ সিডনি। ডেভেনপোর্ট রোড আসতেই  চোখের দৃষ্টি তাকে না খুঁজলেও মনের অনুরণন যাকে স্মরণ করছে সে-ই চড়ে  বসল বাসে—হারপ্রিত।

আজকে দুপাশে  চুলের ছোট বেনি করেছে। মেসেজ করে বললাম,‘আমি তোমার পেছনে’ ! মেসেজ পড়ে  কিছুটা অবাক হয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে। আমি হাত নেড়ে ইশারা জানালাম পেছন থেকে। নিজের জায়গা থেকে খানিকটা সরে গিয়ে পাশে বসতে বলল। আজ ধূসর বর্ণের জ্যাকেট পড়েছে  আর মাথায় নীল রঙের টুপি। ঠোঁটে ডিপ রেড লিপস্টিক। পায়ে সিলভার কালারের জুতো জোড়া মনে হয় হাডসন বে থেকে কেনা। আমরা ইউনিভার্সিটিতে ক্লাসমেট আর ওয়ালমার্টে কলিগও।

ডরচেস্টার পৌঁছে  পাঁচ নম্বর বাসে উঠে বসলাম দু’জনেই। ওর গতরাতের গল্প শুনিয়ে যাচ্ছে আর আমি শ্রোতা। আমাদের গল্প শুরু হয় কিন্তু শেষ হওয়ার আগেই গন্তব্যে পৌঁছে যাই।

ওর বাসে চড়তে ভয় লাগে। বলে, যখন বাস উপর থেকে নিচের দিকে নেমে যায় তখন মাথা বোঁ বোঁ করে ঘুরতে থাকে। এখানকার রাস্তাগুলো কিছু কিছু জায়গায় বেশ ঢালু আবার কিছু জায়গায় সমতল। আমার কেমন লাগে জিজ্ঞেস করাতে বললাম, আমার তো বেশ মজাই লাগে। মনে হয় উড়ছি। কখনও খুব উঁচুতে আবার কখনও নিচের দিকে নেমে যাচ্ছি। দারুণ লাগে!

পৌঁছে যে যার যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আমাদের ডিপার্টমেন্ট আলাদা। ও ক্যাশিয়ার আর আমি সেলসফ্লোর এসোসিয়েট।

ওর ডিউটি পড়েছে এগার নাম্বার রেজিস্ট্রারে। ওখানে কাস্টমারের ভিড় সবসময়ই কম থাকে। ওয়ালমার্টে প্রবেশ পথ দুটো—এগার নাম্বার রেজিস্ট্রারের দিকে দুই নম্বর প্রবেশ দ্বার হওয়ায় ওদিকে খুব একটা ভিড় হয় না। ও অধিকাংশ সময়ই ওখানে একা দাঁড়িয়ে বোর হয়ে যায়,  তাই আমাকে আশপাশে দেখলেই ডাকে। আমি টুকটাক কিছু বলেই চলে যাই নিজের কাজে। কখনো সখনো ওর পানির ক্যান, পেপসির বোতল অন্য কোথাও রেখে চলে আসি। আর ও খুঁজতে থাকে হন্যে হয়ে, দূর থেকে তাকিয়ে কাণ্ড কারখানা দেখি! অবশ্য এমন জায়গায় রাখি যেন কিছুক্ষণ খোঁজার পর পেয়ে যায়। তখন চেহারায় যে ভাবখানা ফুটে ওঠে তাতে স্পষ্টত দেখতে পাই আমাকে ওই সময় সামনে পেলে ও কী করত?

আজ কাজ শেষে ফেরার পথে বাস সময়ের আগেই পৌঁছে গেল। সময় আছে দেখে নামার পরই ওকে বললাম, চল টিম যাই। টিম হর্টনস। কফি চেইন সুপারশপ। পুরো কানাডা জুড়েই এক নামেই পরিচিত ও দারুণ  জনপ্রিয় এ কফিশপ।

রাস্তা পার হওয়ার সময় বাসটা আমাদের অপেক্ষায় রইল। তো ওটা দেখে যাওয়ার পথে মজা করে ওকে বললাম, ‘আমি তো ইউনিভার্সিটির ভবিষ্যৎ এ্যামপ্লয়ি। সম্মান করে কথা বল। দেখ, ড্রাইভারও জানে কাকে সম্মান করতে হবে। এজন্যই আমাদের রাস্তা ছেড়ে দিল।’

ও হেসে বলল, ‘ওটা সবার জন্যই করবে। তোমাকে দেখে অপেক্ষা করতে ওর বয়েই গেছে!’ এরপর মুখ ভেংচি কেটে বললো, ‘দেখ লুংগি! কিতনা পোটেনশিয়ালস হ্যায় আপ মে?’ (দেখে নিব, তোমার কতটা পোটেনশিয়ালস আছে?) আমি ইউনিভার্সিটিতেও জব করি। তাই ইতোমধ্যেই অনেকের চক্ষু শূলে পরিণত হয়েছি। ব্যাপারটা বেশ মজার লাগছে আমার!

পাঞ্জাবি মেয়ে হলেও ওর বাবার চাকরির সুবাদে ভারতবর্ষের অনেক শহর ঘোরা হয়েছে। ভদ্রলোক পেশায় ছিলেন আর্মি ইঞ্জিনিয়ার। পশ্চিমবঙ্গ, গুজরাট, রাজস্তান, জম্বু—কাশ্মীর আর ওর বাবার আর্মি ইউনিটে বেশ কিছু পরিবার ছিল তামিল ভাষাভাষী। কাজেই ও নিজেকে ঠিক পাঞ্জাবি বলে পরিচয় দেয় না। আমাদের কথোপকথন হয় হিন্দিতে। আর মাঝে মধ্যে আমি বাংলায় অনেক কিছু বকে ফেলি যা শুনে ও বাংলা-হিন্দি মিশিয়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করে। আর আমি ওকে শুধরে দিই। ইতোমধ্যে একটা কথা ভালোভাবেই রপ্ত করেছে—‘উলটোপালটা বকবে না !’ সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে—আমার ভারতীয় বন্ধুগণ মানে সে পাঞ্জাবি  হোক বা গুজরাটি বা মালায়ালি হোক—নির্ভুলভাবে বাংলায় একটা কথাই বলতে জানে—‘আমি তোমাকে ভালোবাসি!’ এটা বলতে ওদের কোনও ভুল হয় না!

আমরা দশ মিনিটের মাথায় পৌঁছে গেলাম টিম হর্টনস এ। এইটুকু পথ হাঁটতেই দুজনেই ঠাণ্ডায় জমে ক্ষীর। কাজেই এখন গরম কফির অর্ডার দেয়ার পালা।

টিম হর্টনস, জর্জ স্ট্রিট। ঢুকেই বাম পাশের টেবিলে চারজনের বসার জায়গা হলেও সাথে থাকা ব্যাগ আর জ্যাকেট পাশের চেয়ারে রেখে যে যার মতো বসে পড়লাম।  তেমন একটা ভিড়ভাট্টা না থাকায় বসতে কোনও অসুবিধাই হলো না। বামপাশের সিটিং  অ্যারেঞ্জমেন্টে দুই ধরনের বসার ব্যবস্থা রয়েছে—প্রথমদিকের চারটা টেবিল বাদে বাকিগুলো দুইজনের জন্য। সামনের দিকে এবং ডানদিকের কিছুটা অংশ জুড়ে আছে ফ্যামিলি সিটিং-এর ব্যবস্থা। আমরা মূলত প্রবেশপথের বামদিকটায় বসে আছি তার অপর পাশেও বসার ব্যবস্থা রয়েছে। ডানদিকের ওপাশের ওয়াল এলইডিতে কাস্টমারেরা টিভি দেখছে। পুরো সেটিংসটা মূল প্রবেশ ফটকের অপর পাশের ছোট্ট একটা জায়গা জুড়ে। মেইন ডোর হয়ে ঢুকে একটু এগুতেই অর্ডার দেয়ার ফ্রন্ট ডেস্ক। ওখানে লাইনে দাঁড়িয়ে অর্ডার দিতে হয়। বসে লক্ষ্য করছিলাম কিছুটা সময় লেগে যাবে ওই লাইন ছোট হতে।  আজকে দিন কার কেমন কেটেছে এসব নিয়েই টুকটাক কথা চলছিল। হারপ্রিতের আজকের মেনু—ফ্রেঞ্চ ভ্যানিলা উইথ এক্সপ্রেসো শট সাথে স্ট্রবেরি মাফিন। আর আমি নিলাম হট চকলেট। ও বলছিলো—বেশ ক্ষিদে পেয়েছে! কিন্তু পরে আর কিছু নিতে চাইল না। দুজনে একসাথেই অর্ডার নিয়ে ফেরত এলাম।

খাওয়া শুরু করার আগেই বলে নিল আজকে শেয়ার করতে পারবে না ও। আমি কিছুটা হতবাক হয়ে তাকাতেই বলে, ‘নাও; আমি তো এমনিতেই মজা করছিলাম!’

ছোট বেলার কথা বলছিলো—এক রাতে তিন বোন মিলে হাঙ্গামা বাঁধিয়েছে। ফ্যানের বাতাসের কাছে কে শোবে এ নিয়ে চলছিল তর্ক। খাটের বামপাশের দিকে ফ্যানের হাওয়া সবসময় বেশি আর ওই জায়গা নিয়েই কাড়াকাড়ি। বেশ হট্টগোল করার এক পর্যায়ে ওর বাবা পাশের রুম থেকে বেরিয়ে এসে  প্রথম থেকেই যাকে পেলেন তাকে বেশ কয়েকটি  সজোরে চপেটাঘাত করে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় ওর ছোট্ট বোন আমতাআমতা করে বললো, ‘পাপা, মোটি তো ইধার হ্যায়!’ ওর বাবা মারতে এসেছিলেন হারপ্রিতকেই কিন্তু অন্ধকার ঘরে যাচ্ছেতাই মারলেন আদরের বড় মেয়েকে কারণ ও বাবার উপস্থিতি টের পেয়ে আগে থেকেই বিছানা থেকে সটকে খাটের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল।  একে তো রাতের অন্ধকার!  রুমের লাইট নেভানো। আর ওরা তিনবোন সবসময় শুতো পালাক্রমে প্রথমে হারপ্রিত, ছোট, এরপর বড় বোন। কাজেই ইন্জিনিয়ার সাহেবের অনুমান ঠিক থাকলেও এ যাত্রায় তার ভুল করার মাশুল দিতে হলো বড় মেয়েকে। বেচারি! মার খেয়ে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে লাগল।

ফ্রেঞ্চ ভ্যানিলায় চুমুক দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলার এক পর্যায়ে বলে, ‘মুখ থেকে হাত সরাও, দেখতে পাই না। কথা বলার সময় চোখাচোখি না হলে কথোপকথনের আগ্রহ চলে যায় আমার!’

আমি ওর কথায় কিছুটা অবাক হলেও তড়িৎকর্মা হলাম। বাইরে তাকিয়ে আমি দেখছিলাম বাইক রাইডাররা সবাই টিম হর্টনসের সামনে জটলা পাকিয়েছে। এরা মুলত একদল বাইক চালক যারা দল বেঁধে একসাথে ঘুরে বেরায় পুরো গ্রীস্মকালীন সময়টা জুড়ে। প্রথমবারের গ্রীস্মের ছুটিতে যখন ক্লাস শেষে (গ্রীস্মকালীন কোর্সের)   ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরছিলাম তখন বাস থেকে এই বিশাল গ্রুপকে দেখি আর ভাবছিলাম এই গুন্ডাগুলোকে পুলিশ অ্যারেস্ট করছে না কেন? পরে কানাডিয়ানদের সাথে গল্প করার সুবাদে জানলাম এরা সখের বশে ঘুরে বেরায় আর কোথাও এক জোট হয়ে আড্ডা দেয়। যেমন—সখের বাইসাইকেল চালকরা যেরকমভাবে আমাদের দেশের এক জেলা থেকে আরেক জেলায় ঘুরে বেলায়।

ওদিকে গল্পের ঝাপি খুলে বসেছিল হারপ্রিত—স্কুটি চালিয়েই যেত কলেজে। আরেকদিন নাকি এক ছোট্ট কুকুরের বাচ্চাকে মেরে দিয়েছিল। না, সেরকম কিছু হয়নি। ধাক্কাটা লেগেছিল বেশ সজোরেই কিন্তু দৈব বলে বেঁচে যাওয়া পাপিটি শুধু  কাউ কাউ করতে করতে সরে গেল। আর ও একরকম হাফ ছেড়ে বাঁচল।

ক্লাসের পরে প্র্যাকটিক্যাল নিয়ে পড়েছিলাম সমস্যায়। গণিতের মারপ্যাচ কখনোই মাথায় ঢুকলো না। ওকে বললাম দেখিয়ে দিতে। বিকাল পাঁচটা। যথাসময়ে এলো। হলদে রঙের সোয়েটারের সাথে ব্লু জিন্স। আজকে চুল খোলা রেখেছে।  জিজ্ঞেস করায় জানালো, আধ ঘণ্টা আগেই স্নান সেরেছে, তাই চুল পুরোপুরি শুকায়নি। ওকে না জানিয়েই  ক্যান্টিনে গিয়ে নিয়ে আসলাম কফি—এটা অবশ্য নরমাল কফি—দুধ আর চিনি দিয়ে। কে জানে পছন্দ হবে কি না ? লাইব্রেরিতে বসে আছি। আর প্র্যাকটিক্যালের টুকটাক অঙ্ক দেখিয়ে দিচ্ছে। পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে কফিতে  চুমুক দিচ্ছে। ওর মোটা মোটা ঠোঁট একবার ভিজছে আর কফির কাপে ওর লিপস্টিক এর দাগ রেখে যাচ্ছে। পুরোটা শেষ করে আমায় বলে,‘আমার রেড লিপস্টিক আছে না পুরোটাই গেছে?’ পড়ার পাট চুকিয়ে গেলে বললাম, ‘চলো, বাজার করতে হবে। ওয়ালমার্ট যাই।’ হারপ্রিত  বলল, ওরও কেনাকাটা আছে। ইউনিভার্সিটি থেকেই বাসে চেপে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে।

এত বিশাল ওয়ালমার্টে  জিনিসপত্র খুঁজে পাওয়াটাই তো একটা ধাঁধা। সঙ্গে কেউ থাকলে সময়টা কেটে যায় বেশ। শপিং শেষে বাইরে এসে হিম শীতে জমে যেতে লাগলাম।  বাসের তো দেখা নেই! ও বললো হেঁটেই যাওয়া যাক! ঠিক করলাম হেঁটেই যাব। কিন্তু মাঝপথে এসে বলতে লাগল আর হাঁটতে পারবে না। দেখলাম আসলেই দুধের অতবড় ক্যান নিয়ে কষ্টই হচ্ছে বেচারির। ট্যাক্সি কল করলাম। সাত মিনিটের ব্যবধানে হাজির ড্রাইভার। হারপ্রিত দূর থেকেই এক পলক দেখেই বলে দিল—‘আরে, এটা তো অমর!’ আমি আর অমর একসাথেই জয়েন করি ওয়ালমার্টে। ওর ব্যবহার বরাবরই খটমটে আর আজকে আমাকে দেখল এক মেয়ের সাথে। রাগ গেল আরও বেড়ে কিন্তু ভদ্রতার গ্যাঁড়াকলে পড়ে বেচারা কিছুই করা তো দূরে থাক আমাদের দুজনকেই সসম্মানে বাসায় পৌঁছে দিল।

নর্থ সিডনি যাওয়ার পথে একটা লেক পড়ে—পোটল লেক। ওইদিন রৌদ্রস্নাত দিন ছিল না মোটেই আর আকাশের মেঘের সাথে দূরের পোটল লেকের দিগন্তের রেখা লীন হয়ে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে। এসব আমার দৃষ্টিগোচর না হলেও হারপ্রিতের কৌতুহলী চোখ ঠিকই খুঁজে নিল। দূরের বাড়িগুলোকে ছবির মতো মনে হয়। অধিকাংশ বাড়ির সামনে চেয়ার সাজানো রয়েছে। আরাম কেদারায় বসে বাইরে লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে কফির গ্লাসে একটা হালকা চুমুক দেয়ার অভিজ্ঞতাকে এক বাক্যে বলে বোঝানো যাবে না। অনেক বাড়ির সামনে পোশা কুকুর খেলছে আপন মনে। দূরের মুনরো পার্কে ছেলেমেয়েরা ফুটবল খেলায় মেতে উঠেছে। যেন লাইভ ম্যাচ চলছে! তার পাশে সারিবদ্ধভাবে নোঙর করা  জেলেদের জাহাজ। কোনোটা  নীল, কোনোটা কমলা, বা হলুদ, আবার কোনোটা সবুজ রঙের। হরেক রকমের রঙের পশরা সাজানো রয়েছে।

আমরা বেশ খোশগল্পে মজে ছিলাম। ও বলল পারলে একটা ছবি তুলে দাও। আমি তেমন কোনও আগ্রহ না দেখালেও ও বারবার বলতে লাগল ‘কিতনা সুন্দর হ্যায়’!  তারপর জায়গা ছেড়ে একটু উঠতেই বলে, ‘রেহনে দোও’। (লাগবে না) 

যাওয়ার পথে যে রাস্তাটা পড়ে সেটা একদম লেকের কোল ঘেঁষে। যদি একটু এদিক ওদিক হয় তাহলে সোজা সাগরে সলিল সমাধি! হ্যাপির সাগরের দিকে তাকিয়ে বলে ওই খাদের কিনারা ওর মনের কোণে লুকিয়ে থাকা অজানা ভয়কে ইশারায় ডাকে। ওর কেমন জানি ভয় ভয় করে! আমি ওকে এই বলে আশ্বস্ত করলাম বাসে থাকতে ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। বরং বাসের সাথে ধাক্কা লেগে অন্য যে কোনও গাড়ি অথৈ সাগরে হারিয়ে যেতেই পারে! আমাদের কিচ্ছু হবে না!

সুমন এপ্লাই করেছে পাসপোর্ট রিনিউয়ের। আমরা একসাথেই থাকি। তাই যেতে হবে পোস্ট অফিসে। কাগজপত্র জমা দেব। দুজনেই গাড়িতে চেপে ডাউনটাউন সিডনির পথে রওয়ানা হয়েছি। মাঝে হারপ্রিতের কল, ফোন রিসিভ করে শুনলাম একদম শুদ্ধ বাংলায় জিজ্ঞেসা করে—‘কোথায় আছ তুমি?’

বললাম—আমি তো ডাউনটাউন যাই। কেন? কী হয়েছে?

হারপ্রিত—না, এমনি! শিফট আছে? 

আমি—না, আজ তো নেই। তোমার?

হ—না, নেই! কী করছ?

আ—সুমনের একটা দরকারে এসেছি।  ওর কানাডা পোস্টে কাজ আছে।

হ—মুঝে সামাঝ নেহি আ রাহি হ্যায়! ( আমি বুঝতে পারছি না)

বুঝলাম ওর  বাংলা ভাষার স্বল্প ভাণ্ডার শেষ হয়েছে! 

আ—ওকে! সুমন কা কাম হ্যায়, ইসলিয়ে কানাডা পোস্ট মে অায়ে হ্যায়।

হ—সাম কো ফ্রী হো?

আ—হম... ক্যায়া হো গ্যায়া??

হ—কফি পে চ্যালে?

আ—ওকে! চলতে হ্যায়।

সময় ঠিক হলো সন্ধ্যা সাতটায়। আমার একটা কাজে ইউনিভার্সিটিতে যেতে হয়েছে।  বাসের লাইনে দাঁড়িয়ে শীতের শুভ্রতার পরশে রোমাঞ্চিত আমি ! সারিবদ্ধভাবে অসংখ্য বুটের ছাপের দাগ পড়ে আছে বরফের চাদরে ঢাকা রাস্তায়। আগের ছাত্র—ছাত্রীরা লাইনে দাঁড়ানো দেখে স্কুল জীবনের পিটি ক্লাসের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।  পার্থক্য এই যে, ওখানে দাঁড়াতে হতো কাঠফাটা রোদের নিচে আর এখানে ঠিক তার বিপরীত! সূর্যদেবের অপার অার্শীবাদে কড়া রোদে পুড়ে মাথা চুয়ে ঘামের ফোটা মাটিতে পড়ত টপ টপ করে আর এখানে মহেশ্বরের কৃপায় হিমালয়ের আভাস পেতে পেতে হিম ঠাণ্ডায় জমে বরফ হয়ে যাচ্ছি! ফেরার পথে বাসে উঠে বসে ভাবছি, ও কোথায়?  ফোন দেয়ার কথা ভাবতে ভাবতেই জ্যাকেটের পকেটে হাত রাখা মাত্রই মুঠোফোন বেজে উঠল। ওর ট্যালিপ্যাথির জোর আছে। কেন এমন বলছি ?  যখনই ভাবছি কল করব তখনই যদি সেই ব্যাক্তির কল চলে আসে, এটাকে বলে ট্যালিপ্যাথি! আজ এ নিয়ে নয়বার এমন হলো। এত স্বল্প সময়ে অন্য কারও সাথে এমন হয়েছে বলে মনে হয় না।

সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। টিম হর্টনস—গ্র্যান্ডলেক রোড। আজকে পৌঁছে যে টেবিলে বসলাম, ওখানে গুড়ি গুড়ি খাবারের দানা পড়ে আছে। টিস্যু ন্যাপকিন খুঁজতে লাগলাম। ও এসবের ধার ধারে না, পাশের চেয়ারে ব্যাগ রেখে বসে পড়ল। টেবিল পরিষ্কার করে জ্যাকেট খুলে চেয়ারে বসতেই আমার নীল টি শার্টের দিকে চোখ ওর। বেশ আবদার করে বলল, অমন টি শার্ট  চাই! এটা ইউনিভার্সিটি থেকে দিয়েছে। অফিসিয়াল টি শার্ট। বিভিন্ন দিনে ভিন্ন ভিন্ন উপলক্ষকে সামনে রেখে টি শার্টের প্রচলনটা তেমন নতুন কিছু  না। তাই আরেকটা জোগাড় করা প্রায় অসম্ভবের পর্যায়েই পড়ে। যারা অফিসে কাজ করে এগুলো শুধু তাদের জন্যই। যার সোজাসাপ্তা মানে হলো এমন আরেকটা  টি শার্টের দেখা পেতে অপেক্ষা করতে হবে আগামী বছর পর্যন্ত। কথা বলার এক পর্যায়ে চোখে পড়ল ওর ফোনের কার্ড হোল্ডারের অবস্থা শোচনীয়। যে জায়গায় চারটার বেশি কার্ড রাখা যাবে না, সেখানে ও রেখেছে আটটা। বললাম, কিছু কার্ড কমিয়ে ফেলো। না হলে আমও যাবে, ছালাও যাবে।

সামনের টেবিলে বুড়ো—বুড়ীর কথা কাটাকাটি চলছে। দেখে বললাম, ‘দেখো, তোমার দাম্পত্য জীবন কেমন যাবে’।

ও বলল, ‘এমন কাউকে বিয়ে করব যে আমার সম্পর্কে তেমন কিছু জানবেই না। ঝগড়ার প্রশ্ন আসছেই না’।

আজকের মেনুতে ছিল—ক্রিসপি চিকেন র্যাপ্ট, স্ট্রব্যারি মাফিন আর যথারীতি ওর ফ্রেঞ্চ ভ্যানিলা উইথ এ্যাক্সপ্রেসো শট। আমি ফ্রেঞ্চ ভ্যানিলা, চকলেট মাফিন, চকলেট কুকিস।

খেতে বসে যখন কফিতে বিস্কুট ডুবিয়ে খাচ্ছি,  তখন জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি মিষ্টি খেতে বেশি পছন্দ কর?’

আমি—কই? না তো! আজকের মেনুটাই এমন নিয়েছি। কী ভাবছ? গ্র্যাডুয়েশনের পর কোথায় যাবে?

হা—না, তেমন কিছুই ভাবিনি। ওয়ালমার্টের পর যে কোনও কল সেন্টারে ট্রাই করব। বাকি বিষয় নিয়ে কিছু ভাবছি না এখন, পি. আর (পারমানেন্ট রেসিডেন্সশিপ)। আমার তেমন কোনও টেনশন নেই। আর তুমি কী ভাবছ? 

আ—দেখি, কী হয়? একটা কিছু ব্যবস্হা হয়ে যাবেই! হ্যালিফ্যাক্সের দিকে চলে যাব ভাবছি। আর এরপর? বিয়ে? বয়ফ্রেন্ড? কেউ আছে?

হা—না, নেই! বাবা যা বলবেন, তাই করব।

আ—মানে? তোমার বড় বোনের বিয়ে কি এভাবেই হয়েছে?

হা—না, ওর বয়ফ্রেন্ড আছে। বিয়ে এখনও হয়েছে কই? সাত বছর প্রেম করার পর ও প্রথমবারের মতো আমার জামাইবাবুর বাড়িতে গেলো সবার সাথে পরিচিত হতে। আর ওর অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর ছিল না।

আ—কেন?

হা—দিদি ক্যাসুয়েল ড্রেসে চলে গিয়েছিল। ওর হবু শাশুড়ী জিজ্ঞেস করে বসল, ‘ তুমি কি এভাবেই চলাফেরা কর?’

ওকে চাকরি থেকেই যেতে হয়েছিল, তাই সম্ভব হয়নি। কিন্তু ওনারা বিষয়টা ভালোভাবে নেননি। প্রথমে ওদের বিয়ে হয়ে যাক। তারপর বাবা নিশ্চয়ই আমার জন্য পাত্র দেখবেন। আমি সময় নেব বছর খানেক। তারপর বিয়ে হবে।

আ—আচ্ছা, বুঝলাম। মানে বাবার কথাই শেষ কথা। নিজের কোনও পছন্দ নেই? তোমার পছন্দের ছেলেকে কি উনি মেনে নেবেন?

হা—হ্যাঁ, নেবেন। তবে উনি সবসময়ই একটা কথা বলেন,‘জীবনের প্রতি পদক্ষেপ নেয়ার আগে অন্তত একবার আমার মাথার পাগড়ির কথা মনে রাখবে’! তাই ওনার কথার অবাধ্য হয়ে আমি কোন কাজ করতে পারব না।

শিখ সম্প্রদায়ের পুরুষ অনুগামীরা নিজেদের পাগড়িকে জীবনের এক অাবশ্যিক অনুসঙ্গ করে আজীবন চলেন। একজন শিখকে চেনার উপায় হল—পাঁচটি ‘ক’—কেশ , কারা (ডানহাতে পরার বিশেষ বন্ধনী) , কৃপাণ (ছোট তরবারী), কাশেরা (বিশেষ ধরনের অন্তর্বাস ) এবং কঙ্গ (পাগড়ির সাথে থাকা চিরুনী)। শিখরা সাধারণত চুল কাটেন না। শুধু তাই নয়, তারা দাড়ি বা চুলের ওপর কাঁচি চালান না এবং এটাকে তারা সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস বলে মনে করেন। পাগড়ী তাদের দীর্ঘ কেশরাশিকে ধুলাবালি থেকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা দেয়। প্রধানত তারা সাদা, কালো এবং নীল রংকে প্রাধান্য দেন। লাল রঙের পাগড়ী পড়া হয় শিখদের বিয়েতে। এখানে আসার পর আমার প্রথম রুমমেট ছিল জগদ্বিপ,  ও মাথায় পাগড়ি পড়তে পাক্কা আধ ঘণ্টা সময় নিত। তা যা-ই হোক, পরীক্ষা হোক, পার্টি হোক আর ক্লাসেই যাওয়া হোক। পাগড়ি পরায় ওর আনুগত্য ছিল সত্যিই মনে দাগ কাটার মতো একটি বিষয়!

এখন কফি বালিকার কথোপকথনে ফেরত আসি—

আমি— আর ধর কেউ যদি তোমাকে ভালোবেসে ফেলে, তখন কী করবে?

হা—তাকে বুঝিয়ে বলব কেন এটা সম্ভব না।

আমি—কিন্তু ওই ছেলে যদি তোমার প্রতি কমিটেড থাকে তাহলে কী হবে ?

হা—এক্ষেত্রেও ওকে ঠাণ্ডা মাথায় বুঝিয়ে বলতে হবে। আর কিছু করার নাই।

আ—মানে তোমার কাছে সত্যিকারের ভালোবাসার কোনও মূল্য নেই ?

হা—ও মা ! এমন আমি কখন বললাম? আছে, অবশ্যই আছে। আমি অবশ্যই তাকে মনে কষ্ট দিয়ে বা সে দুঃখ পাবে এমন কিছু কখনও করব না। যদি সেই ব্যক্তি সত্যি আমাকে মনেপ্রাণে ভালোবেসে থাকে তাহলে আশা করি, সে আমার অবস্থাটা বুঝতে পারবে।  

এরপর আরও অনেক বিষয় নিয়ে কথা হলেও ওর এই কথাগুলোই মনে গেথে রইল।

পরের দিনে আমার ডিউটি পড়ল পেটস এ। মানে যে  ডিপার্টমেন্টে গৃহপালিত পশু—পাখির খাবার এবং যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া যায়।

আমি যথারীতি কাজে ব্যস্ত সময় পার করছি। দেখলাম আমার প্রফেসর ম্যালিসা কোনও কাজে ওখানে এসে হাজির। হঠাৎ ম্যালিসাকে এত কাছ থেকে শপিং করতে দেখার অভিজ্ঞতা এই প্রথম। তাই কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওদিকে কোনও জিনিস খুঁজতে এল রুচি আর হারপ্রিত। আমাদের দুজনকে কথা বলতে দেখে ওরাও শেষ গল্পে যোগ দিল। বেশ জমে উঠল আমাদের কথাবার্তা। তবে এভাবে ডিউটি করার সময় গল্প করাটা খুব একটা সমিচিন না। তাই ম্যালিসা অন্য কাজের কথা বলে চলে গেল। রুচি ও চলে যাচ্ছিল। ওদিকে কফি বালিকা আমার কাছে এসে বলল , ‘এসেছ কখন ? কিছু জানালে না যে ?’ আমি বললাম , ব্যস্ত ছিলাম। তাই সময় পাইনি। ও চলে গেল তখনই কিন্তু মনে হচ্ছিল ওকে কিছু  কথা বলার ছিল। যাক, কী আর করা? এই ভেবে যখন কাজে মন দিয়েছি তখনই ম্যাসেজ এসেছে— ‘রেজিস্ট্রার নাম্বার ছয়ে আসো আর হাই বলে যাও!’

কিছু মুহূর্ত মনে অকারণে স্হায়ী হয়, এখন এমনই একটা মুহূর্তের কথাই বললাম। জীবনে কারও উপস্থিতির প্রত্যাশা ছিল তখন আর তাই হয়ে এসেছিল হারপ্রিত। ওর জীবনে আমার উপস্থিতিও তেমনই কিছু। এখনকার কঠিন বাস্তবতার সময়ে কারও কাছে বিশ্বাস অর্জন এবং তা রক্ষা করা দুটোই বেশ কঠিন কাজ। আবার এটাও ভাবা ঠিক নয় যার প্রতি আমার অগাধ বিশ্বাস, সে তার মূল্যায়ন সেভাবেই করবে। জীবন অনেক বিচিত্র ঘটনাচক্রের আবর্তে থাকার জায়গা আর প্রতি পরতেই জড়িয়ে আছে মায়ার রহস্যময়তা! কাজ থেকে ফিরে রাতে ক্লান্ত হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই রাজ্যের যত চিন্তা এসে ভিড় করছিল মনের জানালায়। আর ওটা খুলে দিতেই মনে হলো প্রতিটা মুহূর্ত আমার সাথে খোশগল্পে মজে উঠেছে। 

সাউথবার। উইটনিপিয়ারের এ জায়গা থেকে সিডনি পোর্ট  আর নর্থ সিডনি পোর্ট দেখার দৃশ্য অসাধারণ। ছোট্ট এ শহরের আর কোনও জায়গা থেকে দুই প্রান্তের দৃশ্য দেখা যায় কি না জানা নেই। এর পরেরবার আসলে হারপ্রিতকে অবশ্যই বলব। আজকে কি ওর জব আছে? ফোন দিয়েও ওকে পাওয়া গেল না। হয়তো ব্যস্ত। খুব একটা ভাবলাম না এ নিয়ে আর। সোজা চলে গেলাম সাউথবারে সূর্যাস্তের সময়টায়।

কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে ওকে ফোন করলাম কিন্তু ফোনে রিং বেজেই চলল। কেউ রিসিভ করছে না। কেন রিসিভ করছে না তা চিন্তা করতেই দেখি ওই ফোন দিয়েছে কিন্তু ফোনের কন্ঠস্বরটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। 

ওপাশ থেকে বেশ দরাজ কণ্ঠের এক পুরুষ বলে উঠলেন ‘আই  অ্যাম পুলিশ ইন্সপেক্টর রেইলি ম্যাকনিল। মে আই নো হু আর ইউ?’

সেকেন্ডের মধ্যেই আমার  কাছে সম্পূর্ণ  পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে গেল।

তারপরও যতটা সম্ভব নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, ‘আই এ্যাম হারপ্রিতস ফেন্ড’

পুলিশ ইন্সপেক্টর—মে আই নো হাউ ডু ইউ নো হার?

আ—ও আমার ক্লাসমেট আর আমরা একসাথেই ওয়ালমার্টে কাজ করি।

পু—তুমি কি পুলিশ স্টেশনে আসতে পারবে? তোমার সাথে কথা ছিল।

আ—হ্যাঁ, অবশ্যই কিন্তু কী হয়েছে জানতে পারি?

পু—আজকে দুপুর তিনটে নাগাদ নর্থ সিডনি যাওয়ার পথে পোটল লেকের পাশে একটা গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটেছে। সাদা রঙের হুনডাই কার অপর দিক আসা আরেকটা গাড়িকে সাইড দিতে গিয়ে খাদে পড়ে যায়।

আ—মানে? ও এখন কোথায়?  

পু—আমাকে দুঃখের সাথে জানাতে হচ্ছে যে ওই গাড়ির কোনও যাত্রীই জীবিত নেই! 

আমি আর কোনও কথা বলতে পারলাম না। শুধু স্যরি বলার পর দেখা করব বলে ফোনটা রেখে দিলাম!

মুহূর্তের মধ্যেই সূর্যাস্তের লালাভ রেখাগুলো যেমন মিলিয়ে যেতে যেতে ক্রমশ চারিদিকে আঁধার ঘনিয়ে আসছিল তেমনি আমিও স্তব্ধ হয়ে গেলাম! কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেললাম। মনে হলো কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করে দেয়া মুহূর্ত আমায় সবেগে গ্রাস করছে। 

ওর কথাগুলো কানে ভেসে আসছিল, ‘ডানদিকের ওই গভীর খাদটা না আমার খুব ভয় করে। মনে হয় এই বুঝি পড়ে গেলাম!’ বাঁ চোখের কোণে ক্রমশ জমতে থাকা লোনাজলের বিন্দু গড়িয়ে পড়লো।

কিছুই ভাবতে পারছিলাম না। গলা শুষ্ক হয়ে আসছে আর পানির পিপাসার তীব্রতা অনুভূত হচ্ছে। আমাদের স্বপ্ন সময়ের বর্ণিল স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভেসে আসতে লাগল। হারপ্রিতের সেই অমলিন হাসি আর কফিতে চুমুক দেয়ার ফাঁকে কাপে লেগে থাকা লিপস্টিকের গাঢ় দাগ আরও প্রগাঢ় হতে লাগল চোখের সামনে। কেন এমন হয়? কেন প্রিয় মানুষগুলো নিমিষেই হারিয়ে যায়?

‘সময় তুমি বড় নিষ্ঠুর! আমার স্বপ্ল সময়ের সুখের নীড়ে হানা দিয়ে সব দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছ!’

ভাবতে ভাবতে ঘামে ভিজে আসছে আমার টি শার্ট। আর তখনই মুঠোফোনটা আচমকা বেজে উঠল!

ওপাশ থেকে পরিচিত কণ্ঠস্বর বলল, ‘গুড মর্নিং, কোথায় আছে তুমি?’ (আছোকে ওরা আছে ই বলে)

বললাম, ‘এইতো বাসায়, কী হয়েছে?’

‘আমার শিফট আছে। এগারোটা থেকে। মুঝে ছোড় দো গে? (আমায় একটু নামিয়ে দিয়ে আসবে?)।’

বললাম, ‘হ্যাঁ, ঠিক আছে! আসছি।’

ফোনটা রাখার পর দেখলাম আমার পুরো গেঞ্জি ঘামে ভিজে চুপসে গেছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্নানটা সেরে নিলেই ভালো হয়। ওদিকে কেউ অধীর আগ্রহে আমার ড্রাইভের অপেক্ষায় আছে!

নিউজজি/নাসি 

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন