মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ৮ মাঘ ১৪৩১ , ২১ রজব ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
গল্প

লেখক ও প্রকাশক

রাশেদ আহমেদ সাদী আগস্ট ৩, ২০২২, ১৭:০৯:৫৪

6K
  • রাশেদ আহমেদ সাদী

মুখোমুখি হলেই তার পেছনের গল্পটা আমার মনে পড়ে আর অদ্ভুত অনুভূতিতে আমার হাত-পা অবশ হয়ে আসে। সৗমিত্র চট্টোপাধ্যায় সিনেমার ডায়লগে মজুমদার অ্যান্ড সন্স পাবলিকেসন্সের মালিক হয়ে যেমন বলেন, লেখক আর প্রকাশক স্বামী-স্ত্রীর মতো। গল্পটি মোটেও তেমন না। 

চাইলেও এড়িয়ে যাওয়া যায় না তিনি তেমন একজন লেখক। তবে তাকে সেই গল্পটির প্রেক্ষাপটে দেখতেই আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। যেন তিনি তা—যা ওই গল্পটি অথবা সেই গল্পটিসহ তিনি। যদিও সেদিনই জানতাম কোনো একদিন আমি গল্পটি পৃথিবীর সবাইকে জানিয়ে দেব। হয়তো তিনিও জানতেন। জেনে-বুঝেই সেই মধ্যরাতে তিনি আমাকে হাতে ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন নিজের ভেতরকার অন্ধকারতম কমরায়। বড় মানুষরা বোধ হয় নিজেদের সীমাবদ্ধতাটা ধরতে পারেন আর সেই বন্ধন নিজে টপকাতে না পারলেও হাতের একটা ঢিলে তা অতিক্রম করার প্রয়াশ পান। আমি হয়তো তার সেই ঢিল। যাই হোক না কেন, আজকে মনে হচ্ছে আমার সেই দিন। যেদিন গল্পটি পৃথিবীর মানুষের সামনে প্রকাশ পেয়ে যাবে।

তিনি (লেখক) মুখটাকে তার অসংস্কৃত পাথর বললে ভুল বলা হবে না। গালজুড়ে গুটিবসন্তের দাগ। প্রাকৃতিক খামতিকে তিনি গুণ দিয়ে পুষিয়ে নিয়েছেন। যে কারণে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে অক্ষম, তিনি সে করণেই মানুষের দৃষ্টিকে আকৃষ্ট করতে পেরেছেন। যদিও শারীরিক সৌন্দর্য বলতে যা বোঝায় তার কিছুই নেই তার মধ্যে। চোখে পড়ার মধ্যে ডান কানটা নেতিয়ে পড়েছে নিচের দিকে। চোখ দুটোর ডানটা স্নায়ু সমস্যাজনিত করণে ছোট হয়ে আসে আর পাপড়ি কাঁপে। নাকটা কেউ মুখের মধ্যে নির্দয়ভাবে শক্ত হাতের তালুতে থেবড়া মেরে বসিয়ে দিয়েছে। উপরের ঠোঁট গোঁফের রহস্যে ঘেরা—অনেকের কাছে বিশেষত আমাকে এক বান্ধবী বলে ছিল, এসব গোঁফ মেয়েদের ঘোর অপছন্দ। গায়ের কাপড় যেমন তেমন ইস্ত্রি করা, শ্রীহীন এবং তিনি স্ত্রীহীন একজন খ্যাতিমান লেখক। এক কথায় প্রকাশকরা তার কাছে ধর্না দেয়। গল্পটি তার।

বলা ভালো পোড় খাওয়া জীবন থেকে নেয়া একটা ঝামা। তা যাই হোক, এক বড়ভাই বলেন, শেষতক কাহিনীকে গল্প হয়ে উঠতেই হয়। সেক্ষেত্রে এই লেখক রূপকথার কথকঠাকুরও বটেন। আমি চেষ্টা করব সেই কথকঠাকুরের বায়ানে গল্পটি শুধু বলে যেতে। কারণ তার মুখে কাহিনী যেমন জমে মজে উঠবে, অন্য কারো কাছে তা আশা করাও ঠিক না। ভূমিকা আর না বাড়িয়ে বরং তার মুখেই শোনা যাক তার জীবনের গল্প। শুধু বলে রাখি এই গল্প প্রকাশের পর তার সঙ্গে আমার দেখা হবে, আর কোনো দিন হয়তো কথা হবে না। আরেকটি বিষয় গল্প যদি আপনাকে খুশি করতে না পারে (আমি বলতে চাচ্ছি যদি আপনাকে কোনো একটা উপলব্ধি না দিতে পারে) তার সম্পূর্ণ দায়ভার আমার, যদি পারে তার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব সেই লেখকের।

জীবনে অগণিত ঘাত-প্রতিঘাতে ঝামা হয়ে ওঠা সেই লেখক শুরু করলেন, ‘সবে লেখাটেখা প্রকাশ শুরু করেছি। তখনও সদ্য তরুণ। তুমুল-চুমুল চর্চার মধ্যে আছি।’ (এখানে বলে রাখি, লেখক বয়ানের যোশে মাঝে মাঝে আজব আজব শব্দ প্রয়োগ করবেন। যার কোনো অর্থ নেই। এই যেমন তুমুলের পর ‘চুমুল’ শব্দটি। এ শব্দ হয়ত হিব্রু বা ইদিস ভাষার কোনো অভিধানে থেকেও থাকতে পারে। বাংলা ভাষায় কচিৎ মিলবে না। এক তরফে বয়ানে যোশের প্রতিফলন হিসেবে ধরে নেবেন।) লেখক তার পাথুরে মুখের লালচে দাঁতে হাসি ধরে রেখে বলতে থাকেন, ‘তারও মেলা আগে, সেই শৈশবে একটা ছড়া লেখার মধ্য দিয়ে খাতা-কলমে সাহিত্যে হাতেখড়ি। এর মধ্যে লেখার স্বপনে আমি ঘুমাতে পারি না। সবসময় মন শুধু প্রকাশের জন্য আইঢাই করছে। হ্যাঁ, শব্দটাকে বলা যায় গ্যাঁড়া-চ্যাঁড়া, বই প্রকাশের জন্য প্রথম প্রথম প্রতিটি তরুণ লেখকই কেমন ডানা ঝাপটাতে থাকে। সেটা আমার বিকারের পর্যায় গিয়ে পৌঁছল। কিন্তু কে ছাপবে আমার মতো অজ্ঞাত লেখকের বই? তোমাকে মনে রাখতে হবে, তখনকার আমি এই আমি নই। আমার সেই ঘোর লাগা সময়ে আমি একজন নারী প্রকাশকের কথা জানলাম, এক লেখক মারফত। তিনি নাকি তরুণদেরকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন।’

আমি ফোড়ন কাটি, ‘কীসে?’

লেখক যখন হাসেন চোখের কাঁপুনি বেড়ে যায়। বাম চোখ স্বাভাবিক হওয়ায় ডান চোখের অস্বাভাবিকতা প্রকট হয়ে ওঠে। কাঁধ ঝাঁকিয়ে চোখ কাঁপিয়ে তিনি বলেন, ‘নানা, ওতে তরুণদের ভাত কোনো কালেই ছিল না। নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে-কিলিয়ে দেখ না?’

আমি তার ঠেস দিয়ে কথাটার অর্থ বুঝি। বুঝে হাসি, কিছু বলি না।

‘তারপর শোন’, তিনি গোঁফে তা দিয়ে বলতে থাকেন, ‘লেখক মহোদয়, যার কাছে আমি প্রকাশকের সন্ধান পেলাম, তিনি ওই প্রকাশকের চুটিয়ে প্রশংসা ঝাড়লেন। ধরে ধরে সুখ্যাতি করলেন যে তার এই এই গুণ। আজও আমি জানি না সেটা কি প্রকাশকের গুণের কারণে, না তার সৌন্দর্যের জন্য।

বিশেষত তার তরুণপ্রীতির কথা জোর দিয়ে বললেন। কয়েকটা উদাহরণও তুলে ধরলেন, যে তরুণনাম্নী বয়স্কদের তখনও চিনি না আমি। (পরে জানতে পারি তাদের মধ্যে চল্লিশোর্ধ্ব তরুণও ছিলেন, সে তিনি নিজেই।) এসব শুনে প্রকাশোন্মুখ আমার নাচুনি বুড়ি শিবনৃত্যে তাল দিল। আর তর সয় না! টকটক করে একদিন ঘেমে নেয়ে উপস্থিত হলাম গিয়ে সেই প্রকাশনীতে। 

ছোট-বড় বইয়ের তাকপরিবৃত হয়ে বসে আছেন তিনি। দুজন লোক দুদিকে মুখ বেজার করে বই গোছাচ্ছে। তিনি কী একটা লিখছেন অখণ্ড মনোযোগে। যিনি আমার হবু বই, অর্থাৎ প্রথম সন্তানের মা হতে যাচ্ছেন; তাকে আমি খুঁটিয়ে দেখব বলে ঠিক করলাম।

আমার চেয়ে বয়সে খুব একটা দূরত্বের নন। এই বছর চারেকের বড় হবেন। তবে মুখ বলছে আমার সমবয়সি; তার চেয়েও ছোট। তুমুল স্টাইলিশ। মখমলের একটা কালো ব্যান্ড বাম হাতে পেঁচানো। ববকাট একগুচ্ছ চুল বারবার মুখে এসে পড়ছে। ডানহাতে লিখতে লিখতেই বামহাতের আঙুলের ডগায় আলতো করে কানের পেছনে গুঁজে দিচ্ছেন। আবার অমনিই একটু ঝুঁকছেন সামনের দিকে, হুড়মুড় করে চুলের গোছা এসে পড়ছে মুখে। আবার সরাচ্ছেন। বিরতিহীন অক্লান্ত চুলের খেলা আর মুখে কৃত্রিম বিরক্তিভাব—যতটা কাছের তাতটাই দূরের করে রেখেছিল তাকে। আশঙ্কায় আমার বুক ঢিপঢিপ করছিল। মনে হচ্ছিল, আমি রোজহাশরের মাঠে শেষ বিচারের চূড়ান্ত কপিটি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি; আমার পাণ্ডুলিপি। কেন যেন এ অনুভূতি হলো আমার!

লেখার ফাকে বারকয়েক তাকালেন ইতিউতি। আমার চোখে চোখাচোখি হলো। যতবার চোখে চোখ পড়ল ততবার আশা-নিরাশার দোলাচলে আছাড়ি-পাছাড়ি করা নৌকা আমার প্রায় উলটে যাবার জোগাড় হলো। তার সে তাকানোটা লেখার মধ্যে চিন্তার হেঁয়ালি কি না তা ভাবার মতো পরিস্থিতিতে তখন আমি ছিলাম না। আজ মনে হয় সেটা তাই ছিল।

মাথার ঝাঁকুনি আর আঙুলের ঈশারায় কিছু একটা বললেন তিনি। অতঃপর আগের মতো নিজের কাজে ডুবে গেলেন। যেন চটপটিময় এক বেলা, যা তিনি নিজের মনে কাটিয়ে দিচ্ছেন। এসবই তখন আমার কাছে নতুন কিছু। বিস্ময়ের চাটনিতে ভয়ের বিস্কুট। তার চেয়েও বড় আশা-নিরাশার ঢেউ। যা ক্রমাগত আমাকে দোলাতে থাকে। 

মনে হচ্ছিল খুব জরুরি কোনো লেখা, এ ভাবে লেখাটার উপর ঝুঁকে আছেন। পরনে মাড় দেয়া কালো সুতি শাড়ি, স্লিভলেস ব্লাউজ আর কালো হাইহিল। শাড়ির ভাজগুলো এমন করে মাপা মাপা হাতে বিন্যস্ত, যেন ধরলেই প্রতিটি ভাজ থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে আসবে লালচে কবিতার মাতাল কতগুলো পঙক্তি। বেরিয়েই ছুটোছুটিতে অস্থির করে তুলবে চারপাশ। শাড়িটি পরতে বিউটিপার্লারে নিশ্চয় তিনি কম করে হলেও তিন-চারশ টাকা খরচ করেছেন। 

কালো হাইহিল পরা একটা পা অন্য পায়ের উপর কায়দা করে তুলে রেখেছেন। মখমলে মোড়ানো জুতোর পিঠে জরির কাজ লাইটের আলোয় ঝিকমিক করছে। তিনি চুল খুলছেন আর লিখছেন। তার নিষ্কলঙ্ক বাহুর কোমল ঝলকানিতে কখন আমি আমার নিজের কথাই বিস্মৃত হলাম। 

আমি তখন দোকানের দুটো কাঠখোট্টা কর্মচারীর কথা ভাবাছিলাম। আমি যদি তারা হতাম, খোদার কসম, অমন বিমর্ষ মুখে বসে নখ খুটতাম না। ভাবছিলাম, পাশে এমন রূপপরী রেখে অমন নিরাসক্ত বেজার মুখে মানুষ বসে থাকে কীভাবে? আর কী আশ্চর্য উদাসীন নিরস তারা! মিথ্যে বলব না, এসব ভেবে তখন অভাগা কর্মচারী দুটোকে গালমন্দ করছিলাম মনে মনে। 

এতো কিছু হয়ে যাওয়ার পর যেন এইমাত্র তিনি আমাকে দেখেছেন, এভাবে ফের ফিরলেন আমার দিকে। এ সময় তার কণ্ঠ শোনা গেল; না বলে বলি বেজে উঠল, ‘আপনার কি চাই?’ বললাম সকালে কথা হয়েছে আপনার সঙ্গে। ‘ও, আপনি-ই তাহলে?’ গলার স্বরটা হ্রস-ইতে এসে কেমন যেন তরবারির মতো বেঁকে গেল। তাতে এপাশেও কাটে, ওপাশেও কাটে—মালুম হয় না। তার প্রশ্নের উত্তরে আমি শুধু সম্মতিসূচক মাথা নাড়াতে পারলাম। অমন সুন্দর মানুষের গলায় অমন একটা খুনে তরবারি! এ সময় হয়ত আমার চোখ বড় হয়ে গেল, নাকে জমল ঘাম। বিস্ময়ের সসে ভয়ের বিস্কুটের এককোনে ছোট্ট একটা কামড় দিয়ে মনে হলো, হ্যাঁ, এটা তাকেই মানায়। পৃথিবীতে তো কত কিছুতেই কত কী মানিয়ে যায়, তাহলে সুন্দরী মুখরা রমনীকে তরবারি সংযুক্ত গলায়ই মানাবে না কেন তিনি যদি আবার হন প্রকাশক!

‘হুম, বসুন।’ দ্বিতীয়বার তার কণ্ঠ বাজল। একে এক কথায় শুখা সময়ের রুখু মাটির ঢিল বলে মনে হল। পিঠে লেগে দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়, আবার মনে হয় দিক তো আরও কয়েকটা, ব্যথাটা কেমন আপন আপনও লাগে। তবে কে যেন বলেছিল, মানুষকে প্রথম দেখায়, দুটো কথায়—এভাবে বিচার করা ঠিক না। কারণ মানুষ যেহেতু যন্ত্র না, বরং কত ধরনের আছে যন্ত্রণা—সে তো ওই মানুষ বলেই। সবসময় মানুষের মন এক রকম থাকে না—ফলে নিজের বিরুদ্ধে তার পক্ষে এই ঠ্যাঙা ধরলাম। অবশ্য ফোনে যখন কথা হলো সকালে, বইয়ের কথা শুনলেন, উনি বলেছিলেন, ‘আসুন না একদিন।’ আমন্ত্রণে বিলম্ব না করে সেদিনই গিয়ে হাজির হয়েছিলাম। সেটা ঠিক হয়েছিল কি না—তা নিয়েও পরে ভেবেছি আমি। তখন মনে হয়েছিল, দুয়েক দিন পরে গেলে ঘটনাটা হয়ত অন্য রকম ঘটতে পারত। ব্যাপারটা হয়তো ছেচড়ামিসুলভ হয়ে গেছিল। কিন্তু না, এখন মনে হয়, আমাকে আসলে এ ঘটনার সম্মুখীন হতেই হতো আর সেজন্য তখন যাওয়াটাই আমার জন্য ছিল সময়োচিত কাজ।’ 

লেখক উঠলেন। ফ্রিজ থেকে পিজা আর বরফ নিয়ে এলেন। সোফায় হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে দিয়ে আয়েস করে বসে বললেন, ‘তখনও কিন্তু আমি বিশশ্বাস করিনি।’

আমি জিজ্ঞাস করলাম, ‘কী বিশ্বাস হলো না?’

‘ওই রুখু ব্যাপারটা; তার সঙ্গে রুক্ষতা যেন যায় না। তাকে প্রথম দেখে মনে হয়েছিল, তিনি এক ঝর্ণাধারা, যার কুলকুল বয়ে গিয়ে প্রকৃতিকে তৃপ্ত করাই স্বভাব। ব্যপারটা বুকের ভেতর বুলেট নিয়ে বসে থাকার অস্বস্তি দিচ্ছিল। মনে হলো, এ আমার জলের সঙ্গে তেল মেশাতে সচেষ্ট অতি স্পর্শকাতর মনের ভুল। মনেরটাই আমি ধরছিলাম, কারণ কানের ধরলে—হয়তো আমার কানই আমার আমার সঙ্গে বিশ্বাস ঘাতকতা করছে—এটা ভাবার বিপদ হলো সেক্ষেত্রে আবার ডাক্তার দেখাও, ওষুধ খাও। নানা ঝকমারি। তা ছাড়া সেই লেখক মহোদয়ও যে বললেন, এর চেয়ে গুণধর প্রকাশক হয় না!’

‘তো?’

‘সেই গুণধর লেখক কি আমার সঙ্গে মিথ্যে বলবেন? বলেই-বা তার লাভ? হতে পারে ওই সময় লেখকের মাথায় কবিতার প্রেতাত্মা ভর করেছিল আর প্রকশাক ভদ্রমহিলা তার সামনে ভেনাসের রূপে উপস্থিত হয়েছিলেন। কবির হৃদয়ভূমি তো, সেখানে কখন কী হয় বলা মুশকিল। তবে ততক্ষণে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, আমার সঙ্গে সুন্দরী প্রকাশক কথা বলতে তেমন আগ্রহী নন।’

‘কীভাবে বুঝলেন?’

‘কারণ তিনি আমাকে ওই প্রশ্নের পর নিজের কাজে আবার মগ্ন হয়ে গেলেন। মগ্নতার ফাঁকে কাজের লোকদুটোকে এটা—ওটার নির্দেশ দিলেন (গলার সুরে সেই আদিম তরবারি)। ফের মগ্ন হয়ে গেলেন নিজের কাজে। এমন মগ্ন হয়ে কাজ করছেন তিনি, আমি তার কাজের দিকে তাকিয়ে আছি। এক সময় মনে হলো, আমি নেই। আমার অস্তিত্ব ব্লটিং পেপার মুছে নিয়েছে। একটা বিন্দুও রেখে যায়নি। একমাত্র আছেন তিনি, তার অস্তিত্ব। 

এ ভাবে কেটে গেলে বেশ কিছুক্ষণ পর তিনি উঠলেন। বেরিয়ে যেতে যেতে দোকানের বছর ষোলোর ছেলেটাকে বললেন, ‘উনাকে চা খাওয়া।’ আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘আপনি চা খান। এই আমি আসছি। অবশ্য বসে অপেক্ষা করে বিরক্ত হাওয়ার চেয়ে পাণ্ডুলিপি রেখে চলে যেতে পারেন।’ অর্থাৎ তিনি চলে যেতে বলছেন আমাকে। তার ফিরতে দেরি হবে। তাহলে কেন বললেন, ‘এই আসছি?’ আমার মাথায় প্রশ্নগুলো গোল্লাছুট খেলতে লাগল। ভদ্রমহিলার সঙ্গেই আমি ওঠে দাঁড়ালাম। বিনয়ে যেন এখনই তার পায়ে পড়ব—এমন একটা ভাব নিয়ে সামনের দিকে নুয়ে পড়লাম। মহিলা তার অপর কর্মচারীকে (নিরস বলে গাল দিচ্ছিলাম যাকে) ডেকে বললেন, ‘মাসুদ, ইনি একটা পাণ্ডুলিপি দিবে। রেখে দিও। কী বললাম বোঝা গেল?’ কথাকটা যেন চর্ব্যচোস্যহীন ভাবে আখের ছিবড়ার মতো ম্যাশিন থেকে বেরিয়ে এলো। ‘জি।’ মাঝারি উচ্চতার দীর্ঘ কপালের মাসুদ কথার উত্তর দিয়ে ফের নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল। প্রকাশক আর কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা বেরিয়ে গেলেন।’

‘বেরিয়ে গেলেন আর আপনি বসে থাকলেন?’ আমি বিস্ময়ে সোজা হয়ে বসলাম। লোহার চেয়ারে একটা ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ হলো।

‘হ্যা, বসলাম, চা খেলাম, পাণ্ডুলিপি দিলাম। তবে ততক্ষণে যাদের কাষ্ঠং বলে গাল পাড়ছিলাম, তাদের কাছে মনে মনে আমি আকণ্ঠ অনুতপ্ত। তবে প্রকাশক চলে গেলেও তরবারি চালনার সেই মহান দায়িত্ব অপর্ণ করে গেলেন এদের উপর। তারাও সেই রুক্ষতার গুরু দায়িত্ব পালনে যেন তার মালকিনকে টেক্কা দিল।’

‘পাণ্ডুলিপি দিলেন আপনি?’ আমি আমার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না এভাবে তার দিকে তাকালাম। 

‘হ্যাঁ। তারাতো পাণ্ডুলিপি নিয়ে প্রায় জোর করেই তাড়িয়ে দেয়। আমি তো চা ছেড়ে আসার পাত্তর নই। চা-টা খেয়েই বেরুলাম। এরপর কখনো-সখনো এসে খোঁজ নিই। কখনো তাকে পাই, কখনো পাই না। অবশ্য পেলেই যে খুব একটা লাভ হতো—তা না। যাই, চা খাই। জিজ্ঞেস করলে বলেন, ‘হবে হবে। অত তাড়া কীসের?’ এ কথার পর চুপ হয়ে যাই। অগ্রগতি বলতে এইটুকুই। লাভের মধ্যে ওই চিনি ছাড়া লাল চাটুকু আর তার সঙ্গে রুখু কথার ঢিল। 

লক্ষ করেছি, আমি যখন তার ওখানে থাকি, তার রুক্ষতার পারদ যেন বেড়ে যায়। তিনি যাকে যাই বলুন না কেন, কথাগুলো কাঁটা হয়ে আমার গায়ে বিধতে থাকে। কেন যেন মনে হয় আমাকেই বলছে। তবু আমি যাই, বসে থাকি। দয়া করে বইটা যদি রেব করে। মিথ্যে বলব না, শেষ দিকে তো যাওয়া ঘনঘন পড়ত।

একদিন গিয়ে দেখি সুন্দরী প্রকাশক রুদ্রমূর্তি ধারণ করে বসে আছেন। জীবন্ত আগ্নেয়গিরি আরকি। যেন জায়গায় ভস্ম করেন দেবেন। খুঁজছিলেন কোথায় উগড়ে দেবেন ভেতরের টগবগ করতে থাকা অসম্ভব লাভা। আমাকে পেয়ে সেই পথ দেখলেন তিনি!

‘আগ্নেয় গিরির লাভা!?’ আমি বললাম, ‘পরিষ্কার হলো না আমার কাছে।’

‘হ্যাঁ, লাভা, বজ্রপাত সব একসঙ্গে। আগ্নেয় গিরির লাভার স্রোতের সঙ্গে বজ্রের চৌদ্দগোষ্ঠীর যত রাগ সব আমার উপর উগড়ে দিলেন তিনি। হতে পারে এর জন্য কোনো রকম প্রস্তুতি ছিল না আমার, হতে পারে তখন আমার মনটা ছিল আন্তন চেখবের সেই কেরানির মনের মতো, যে এক ধমকে অক্কা পায়।’ 

‘কী বলেন ভাই?’

‘সেদিনও অন্যান্য দিনের মতোই চলছিল তার চুল খেলা। তবে চোখছিল রক্তাভ, ঠোঁট কুচকে কালো হয়ে আছে, কোনো রঙের ছোঁয়া নেই। নাক ফুলটায় মুক্তো আর জুতোর জরিতে বিদ্যুৎ খেলছে। সব আজ লাল—শাড়ি, ব্লাউজ, জুতা আর বামহাতের ব্যান্ড। সৌন্দর্যের এই উপসর্গগুলোই আজ যেন আঘাতের পূর্ভাবাস হয়ে এসেছে।’

‘বললেন কী উনি?’ অধৈর্য হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম। আমি তখন পুরোপুরি গল্পে মজে গেছি।

‘সে সব কি আর বলা যায়, পাগল? আমার সামনের টেবিলে পাণ্ডুলিপি ছুড়ে দিয়ে বললেন, ‘নিয়ে যান। বারবার এসে বিরক্ত করবেন না তো। এটা কী ভূমি অফিস পাইছেন? আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়েছি তো! আপনার বই যে আমি ছাপব, কেন ছাপব? কিনবে কে আপনার বই? একবার ভেবেছেন? বাজার চলতি বই, যে লেখককে সবাই চেনে, এমন প্রমিনেন্ট রাইটারের বই-ই তো চলে না। তা আপনি কোন চেটের বাল?’ আমার নাক বরাবর তার সুঢৌল আঙুল তাক করে তিনি বললেন। আঙুলের মুক্তো বসানো রিং চিকচিক করছিল। আমি ছিলাম পথরের মতো নিরব।

‘আপনাদের জ্বালায় তো দেখি একটা কিছু করেও খাওয়া যাবে না। যতসব গার্বেজ নিয়ে...।’ একটু থামলেন, শ্বাস নিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন, ‘আর আসবেন না, প্লিজ। এই নিন আপনার পাণ্ডুলিপি। নিয়ে যান।’ সুন্দরী প্রকাশক তার সুন্দর সুন্দর হাত দুটো প্রণামের মতো বুকের কাছে তুলে ধরে ক্ষমা চাইলেন। 

‘এসব বলল আপনাকে!’ আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি।

‘হ্যাঁ, আমাকেই বলল। তুমি ভুলে যাচ্ছ কেন, এখন তুমি যা আমি তখন তাও না। ফলে...।’ চোখের কাঁপুনি থামিয়ে, গোঁফে দুবার তা দিয়ে তিনি  নিজের বুকের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন, ‘অথচ নিজেকে তখন মনে করি পৃথিবীর অন্যতম লেখক। যা লিখছি বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। বরং ভয়ে থাকি, না চুরি হয়ে যায় আমার লেখা অমূল্য রত্ন ভাণ্ডার।’ নিজেকে নিয়ে এখন ক্রিটিসাইজ করছেন লেখক। যাই করুন-না কেন তিনি, সত্যি তো হলো, প্রতিটি লেখককেই এই বেদনাময় তারুণ্য পার করতেই হয়। 

চোখের পাপড়ি কাঁপিয়ে বেটে পা দুটো সোফার ওপর তুলে জমিয়ে বসেন। বলতে থাকেন, ‘বুঝতো ওইটুকুন বয়সের লেখা, কি প্রিয়ই না হয় একজন নবীনের কাছে। আমারও ছিল। আমি ঠোঁট চেপে, বুড়ো আঙুল অনামিকা আর মধ্যমার ভেতর ভরে শক্তহাতে ধরে থাকলাম। সমস্ত শক্তি দিয়ে মুঠো কষে বেরিয়ে এলাম প্রকাশনী থেকে। (কয়েক দিন আগেই কোনো এক পত্রিকার স্বাস্থ্য পাতায় পড়ে ছিলাম, বমি এলে এভাবে আঙুল শক্ত করে চেপে ধরলে বমি ফেরানো যায়।) আমি শুধু চাচ্ছিলাম, কেঁদে না ফেলি। হ্যাঁ, যে করেই হোক কান্না থামাতেই হবে আমাকে। 

পাণ্ডুলিপিটা নিয়ে ইঁদুরের মতো বেরিয়ে এলাম রাস্তায়। বাইরে তখন পিচগলানো কার্তিকের রোদ। এমন একটা স্বপ্নের মৃত্যু হলো, যেন বুকের উপর বসে কেউ জবাই করে দিয়েছে। আর কার্তিকের রোদ সেই রক্ত চেটে চেটে খাচ্ছে। 

রাস্তার শেষ মাথায় মরীচিকায় দুলছে ফুটপাথের একটা চা-বিড়ির দোকান। সেখানে পানি খেলাম, চা খেলাম (বললাম চিনি ছাড়া কড়া লিকারের হবে)। এর পর একটা সিগারেট জ্বাললাম।

—‘কোনটা দেব?’ দোকানদার মামা বলল।

—‘দেন একটা’ আমি বলি। যেহেতু তখনও আমি সিগারেট খাই না, তাই জানিও না কোনটার কী নাম, কত দাম আর কী চরিত্র।

দোকানদার আমাকে একটা গোল্ডলিফ দিল। চতুর্থ সিগারেটটা হাতে পথ হাঁটছি আর প্রাণপণ নিজেকে সামলাচ্ছি। দমকে দমকে কাশছি। এ সময়টায় মাথা চক্কর দিল আর পৃথিবীটা দুলে উঠল। ফুটপাথে বসে পড়লাম। চারপাশটা তখন চোখের সামানে ঝড়ের মুখে জলের ওপর ভাসছে। ধীরে-ধীরে সব কিছুর ওপর কালি জমছে। এক সময় সব কিছু গোল-গোল হয়ে মুছে যেতে থাকল। হড়হড় করে পেটের নাড়িভুড়ি বেরিয়ে এলো। ফুটপাথেই বমির উপর শুয়ে পড়লাম। মনে হচ্ছে আমার ভেতর, তারও ভেতর হিংস্র চার পাওয়ালা জন্তু দাবড়ে বেড়াচ্ছে আর দাঁতে-নখে ক্ষত করে যাচ্ছে। মগজটা নাক দিয়ে বেরিয়ে এলো—এমন এক অনুভূতি। অসহ্য যন্ত্রণা। সেও এক মরে যাওয়া। ফুটপাথে বমির ওপর মৃত্যু। 

এ সময় কোনো এক পথচারী তুলে নিয়ে একটা ফুটপাথের চায়ের দোকানে বসাল। পানি দিল। খেলাম। দোকানের কাঠের বেঞ্চে সামনের দিকে বস্তার মতো ঝুঁকে বসে থাকলাম। কতক্ষণ কে জানে? হয়তো এককোটি নক্ষত্র বছর। 

এই ঘটনার পর আমি লেখালেখি পুরোপুরি ছেড়ে দিলাম। পুরো দু’বছর পুরান ঢাকার লেদ ম্যাশিনের ভেতর একটা নাট হয়ে থাকলাম। এ সময় না ছিল পড়া, না ছিল লেখা। পড়ার মধ্যে অনার্সের একাডেমিক পড়া খুব পড়া হলো। কল্পনারও বাইরে তার ফল বেরুল। মাস্টার্সে ভর্তি হলাম। এখানেও কিছুদিন কেটে গেল। পড়ছি কিন্তু পড়ছি না। 

যে দিন যখন সময় পাই লাইব্রেরিতে চলে যাই। গিয়ে পড়ি। সেদিনও লাইব্রেরিতে পড়ছিলাম। অবশ্যই একাডেমিক পড়া। ইচ্ছা করেই সাহিত্যের বইগুলো যে দিকে রাখা সেদিক গিয়ে বসি। সাহিত্যের বইগুলো থাকে আমার পেছনে, তাকে তাকে থরে থরে সাজানো। আমি সেসব ছুঁয়েও দেখি না। পড়ি মাস্টার্সের পড়া। এও নিজেকে কষ্ট দেয়ার একটি কৌশল মাত্র। অবশ্য পড়ার বিকল্প কোনো জায়গাও নেই। মাস্টার্সের পড়াও যদি আমাকে কোনো রকম আনন্দ দিত! জোরপূর্বক পড়ি। একে বলা যায়, নিজে নিজে নিজের চামড়া ছাড়িয়ে নুন দেওয়া আর কি। সেদিন পড়ার ফাঁকে আনমনে একটা পত্রিকার পাতা উলটাতে গিয়ে চোখে পড়ল। সেই বিজ্ঞাপনটা। উপন্যাস চেয়ে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। লিখতাম কবিতা, তাও সে দুই বছর আগের কথা, এখানে দেখলাম উপন্যাসের বিজ্ঞাপন। যেমন দেখি তেমনই উলটিয়ে রেখে দিই। লাইব্রেরি থেকে সেদিন আরও আগে আগে বেরিয়ে পড়ি। বুকে কেমন একটা কম্পন। জানি না কেন অমন হচ্ছিল। ভূমিকম্প যেভাবে পৃথিবীর পট পরিবর্তনের জন্য দায়ী, এও হয়তো তাই এবং তাই ছিল বলে আজ আমি বোধ করি।

লাইব্রেরি থেকে বেরিয়েই এক ঘোরের ভেতর আমি চার-পাঁচ দিস্তা কাগজ আর কলম কিনে ফেললাম। লিখতে শুরু করে দিলাম আমার লেদ ম্যাশিনের জীবন। অবশ্য গল্পের নায়ককে আমার চেয়ে বেশি ভাগ্যবান করলাম এবং তার একজন প্রেমিকা সৃষ্টি করলাম; যা আমার কোনো কালেই ছিল না। মেয়েটার ডাগর ডাগর চোখ, যার ববকাট চুল সব সময় মুখের টোলের উপর এসে পড়ে।

‘নাসরিন।’ আমি টুক করে শব্দটা ঢুকিয়ে দিলাম। 

হ্যাঁ, আমার প্রথম উপন্যাসের নায়িকা। যাক ওকে রাখি। কারণ ওকে কখনো আমার কাল্পনিক মনে হয় না আর। তাকে নিয়ে কথা বলতে শুরু করলে আরেক কেলেঙ্কারি। যা হোক মূল গল্পে আসি, নিজেকে কষ্ট দেওয়ার ব্যাপারটা আর থাকল না। এ সময় আমার ভাবনা ছিল, সবাই আমাকে কষ্ট দেয়, আমি কেন দিই না? অন্যে কষ্ট দিতে পারলে, নিজেকে কেন নিজে কষ্ট দেব না? নিজেকে বোঝাতাম, আমি তো আর অন্য কাউকে কষ্ট দিচ্ছি না, নিজেকেই দিচ্ছি। অবশ্যই দেব। এসব ভাবতাম আর কম খেতাম, কম হাসতাম, কম কথা বলতাম, বেশি বেশি কাজ করতাম আর বেশি বেশি একাডেমিক পড়া স্বল্প আলোতে পড়তাম। স্রেফ নিজেকে কষ্ট দিতে। কিন্তু উপন্যাসটায় হাত দিয়ে আমার যেন কী হয়ে গেল। কষ্টগুলো গলে গলে একটি উচ্ছল নদীতে পরিণত হলো। আমার সব বই যেহেতু কেজি দরে বিক্রি করে দিয়ে ছিলাম। তাই লাইব্রিতেই কিছু কিছু সাহিত্য পড়তে শুরু করলাম। সঙ্গে সঙ্গে মাস্টার্সের পড়াও কমে কমে বাতিল হয়ে গেল। ‘ছন্নছাড়া মহাপ্রাণ’ শরতবাবুর জীবনীটা এক নিঃশ্বাসে শেষ করলাম, পড়লাম যজ্ঞেশ্বর রায়ের দস্তয়ভস্কির জীবনী, ভিঞ্চির জীবনী। আমার ভেতর কী এক স্রোত বইতে লাগল। সর্বব্যাপী সে স্রোত। কুলভাঙা, প্রমত্ত সে স্রোতে আমি গা ভাসিয়ে দিলাম। আমার ছোট্ট নৌকা তরতর করে এগিয়ে চলল।

ভেতরে ভূকম্পনটার পর পরিবর্তনটা এতো প্রকট ছিল যেন নিজেরই কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। ফলে কিছুটা দ্বিধা, কিছু অনীহা যে হলো না—তা না। সত্যি বলতে কি প্রথমে বিজ্ঞাপনটা দেখে অযথা যেমন কেঁপে উঠেছিলাম, লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে ততটাই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সেটাই হয়তো হলো শাপে বর। অত্যন্ত বিরক্তি নিয়ে খাতা-কলমগুলো কিনে ফেললাম। সবতাতেই ছিল সেই অচেনা এক ঘোর। সেই ঘোর থেকে আমি আজও বেরুতে পারিনি জানো। আমার মনে হয়, প্রতিটি সাধাকেরই তা থাকে। তো, লেখার সরঞ্জামাদি নিয়ে বাসায় গিয়ে গোছল করলাম, খেলাম—এর মধ্যে খাতা-কলম মনের মনিকোঠায় জ্বলজ্বল করছিল। কিছুতেই তাদের মুছতে পারছিলাম না। চোখে আশ্চর্য সুন্দর কিছু দেখে লেগে থাকার মতো। যেন প্রথম দেখা কোস্টার হাইওয়ের কোনো দৃশ্য। এ এক ধরনের তাড়না। মাঠে লাফিয়ে চলা বলের পেছনে যেভাবে কৈশোর ছুটে যায় অনেকটা তেমন। 

রুমে একগুচ্ছ মানুষের মাঝখানে আমার বিছনা। ময়লা চাদর আর তেল চিটচিটে বালিশ। খাতা-কলম নিয়ে সেখানেই বসলাম। জির্ণ বালিশ হলো আমার লেখার টেবিল। খাতাতে কলম লাগাবার আগ মুহূর্তে হাঠাৎ নিজেকে দিশে হারা মনে হলো। কী লিখব? কলম-খাতা নিয়ে কয়েক মুহূর্ত উবু হয়ে বসে থাকলাম। হঠাৎ করেই মনে হলো, আমি বসে নেই, লিখছি। যেন কোনো প্রোগ্রামিংয়ের ফলে যান্ত্রিকভাবে আমার কলম চলতে শুরু করেছে।

কলমটা খাতায় রাখলাম আর হঠাৎ লিখতে শুরু করলাম, ‘লোকমান লোকটা দেখতে যেমন সুন্দর, তার চেয়েও তার সুন্দর প্রাপ্তিযোগ; অর্থাৎ যাকে আমরা নিয়তি বলি। কিন্তু এইসব সুন্দরের ভিড়ে লোকমান হাঁপিয়ে উঠেছে। অর্থাৎ না পাওয়ার বেদনাটা কেমন, তার জানতে মন চায়।...’ লেখা চলছে আমার আগে আগে, আমি তার পেছনে চলছি।

সেদিন দুপুরের পর কাজেও গেলাম না। বসে বসে লিখলাম। লিখছি, লিখছি আর লিখছি। খাতা শেষ। কিনতে বেরুতে মন চাইল না। লেখা খাতার উলটা পিঠে লিখতে শুরু করলাম। তাও শেষ হলো। 

এখন আমি বারান্দায় বসে লিখছি। রাত নিঝুম। কোনো দোকান খোলা নাই। সবাই বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। বারান্দার অল্প আলোর লাইটটা জ্বালিয়ে আমি লিখছি। ফের খাতা শেষ, কলমও শেষ। ব্যাগ ঘেঁটে পুরনো খাতা আর একটা পেন্সিল পেলাম। সেই কবিতার খাতাগুলো। বই বিক্রি করে দিলেও লেখাগুলো কেন যেন আমি বয়ে বেড়াচ্ছিলাম তখনও। এতো রাগের পরও সেসব হাতছাড়া করিনি, কেন? 

সেই খাতার খালি জায়গাগুলো লিখে ভরিয়ে ফেললাম। সকাল হয়ে এলো। তখনও আমি লিখে চলেছি। সেই অবর্ণনীয় সর্বব্যাপী স্রোত আমাকে ভাসিয়ে নিচ্ছিল, যা হিমালয়কেও ভাসিয়ে নিয়ে সমুদ্রে ফেলে দেয়। এমন উসাহ আমি কোথায় পেলাম জানি না। উৎসাহ যেন উৎসবে পরিণত হয়েছিল।

পর দিনও আমি কাজে গেলাম না। তার পর দিন, তার পর দিন, তার পর দিনও। লেখা ডাকে পাঠিয়ে তারপরই আমি কাজে গিয়ে ছিলাম। প্রথম দিন লিখে নাস্তা করে ঘুমাতে গেলাম। ঘণ্টা তিনেক যেতে-না-যেতেই ঘুম ভেঙে গেল। উঠে দুপুরের ভাত খেয়ে আবার বসে গেলাম। চলল বিকেল পর্যন্ত। আমার সহকর্মীরা মনে করল আমার পরীক্ষা এসে গেছে। তাই অমন কলম-খাতা নিয়ে দিনরাত বসে আছি। মালিকও তাই জানল। চুক্তি অনুযায়ী সেও তেমন একটা ঘাটাল না। 

বিকেলে নীলক্ষেতে দিয়ে এলাম লেখাগুলো টাইপ করতে। যাকে দিয়ে আমি টাইপ করিয়ে থাকি, তিনি নেই। তাই পাশের একজনকে দিলাম। তাগাদা দিয়ে এলাম আগামী কালই আমার লাগবে। সেদিনও কাজে গেলাম না। কী হচ্ছে এসব ভেবেই বাকি দিন কেটে গেল। পরদিন লাইব্রেরিতে এসে পত্রিকার বিজ্ঞাপনের কাটিং নিলাম। পত্রিকার কাটিং নিয়েছি কি অমনি লাইব্রেরিয়ান দৌঁড়ে এলেন। সাদা শাড়ি পরা ছোটখাট ভদ্রমহিলা হায়হায় করে উঠলেন—করছেন কী, করছেন কী? তার ভাব দেখে মনে হলো, কংগ্রেসে ফাটল ধরিয়ে আমি মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পক্ষে শেষ ভোটটা দিয়ে দিয়েছি। 

আমি তাকে জিনিসটা দেখালাম। তবু সে তার শাড়ির গোছা ছাড়লেন না। তপনের মতো সামনের অংশ তুলে ধরে আমাকে জেরায় জেরবার করে দিলেন। আমি চুপ করে, যতটা পারা যায় কম উত্তর দিয়ে সেখান থেকে সটকে পড়তে চাইলাম। ভদ্রমহিলা যেন শেকড়-বাকড়ে তত আমাকে পাকড়াও করার তালে থাকলেন। অবস্থা বেগততিক দেখে মুখে সেলাই পড়ে নিলাম। উনি যা বলেন, আমি হু-হা করি। তবু যখন উনি জনগণের সম্পদে এভাবে কাচি চালাতে পারি না আমি বলে ওয়াজ অব্যাহত রাখলেন। ততক্ষণে নিজেকে আমি কুতুব মিনারে পরিণত করে ফেলেছি। এমনকি চোখের তারাটা পর্যন্ত নড়াই না। শেষতক নাছোড় বান্দা আমাকে ছাড়বেন বলে মনোস্থির করলেন বোধ হয়। বললেন, অমন আর করবেন না, প্লিজ, তা না হলে আমাকে অন্য ব্যস্থায় যেতে হবে। আমি তার বক্তব্যের সমাপ্তির নিশান লক্ষ করে নিজেকে কৃতজ্ঞ ভাবলাম। কোনোদিকে না তাকিয়ে লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে এলাম। অতঃপর সোজা বাসায়। সেই লাইব্রেরির ত্রি-সীমায় আর কোনোদিন আমি যাইনি।

বাসায় বয়ামের ভেতর কতগুলো বিস্কুট ছিল সব খেয়ে একটা ঘুম দিলাম। উঠলাম পর দিন সকালে। ইতোমধ্যে দোকানের মালিক এলো। কতক্ষণ মালিকত্ব ফলাল। বললাম, আমার পরীক্ষা। (দোকানের মালিকের সঙ্গে আগেই কথা ছিল, পরীক্ষা এলে আমি কাজ করব না, বেতনও দিতে হবে না তখন।) তবু দোকান মালিক চিল্লাপাল্লা করে চলে গেলেন, ‘তায়লে তুমি হালা খালি পরিক্কাই দিপা। তায়লে তাই দ্যাও। আর কামে আহোন লাগব না। তোমার পরীক্ষা তুমি আগে জানাইবা না মিঞা? তায়লে আমি লোক দেইখা রাখতাম একখান। এই কাজের তাগাদায়... তুমি হালা হারামি আছো, এমন চুপটুপ থাকলে কি অইব।’ আরও কি কি বলতে বলতে দোকান মালিক চলে গেল।

বিকেলবেলা নীলক্ষেত গেলাম। কম্পোজারদের এ এক মহাসমুদ্র। কেবল খটখট শব্দের প্রতিধ্বনি। যার ভেতর ছোট একটা কথাও ডুবে যায়। কত উকিল, মোক্তার, লেখক, ছাত্রের আশ্রয় এই নীলক্ষেত। সকলের মতোই আমারও একজন পরিচিত টাইপ রাইটার এখানে আছেন। আটশাট শরীরের মাঝারি উচ্চতার তামাটে গায়ের রঙ। টাইপ করতে করতে যেন তিনি একটা কম্পোজারের ভাস্কর্যে পরিণত হয়েছিলেন। মুখটা অভিব্যক্তিহীন একটা পাথরের টুকরো। তা হলে কী হবে, কাজে তিনি এতো ভালো যে, আমরা তাকে নিজেদের মধ্যে রকেট বলে ডাকতাম। আসলে তার নামই আমরা জানতাম না। তাই তিনি আমাদের কাছে রকেট ভাই। রকেট ভাই নাকি বাড়িতে গেছেন। দেখলাম উনার টেবিলটা কাগজ দিয়ে মোড়ানো। 

তার পাশের জনকে ফাইলটা দিয়ে এসেছিলাম। তিনি বয়সে অনেকটা আমাদের কাছাকাছি হবেন। তারও তামাটে গায়ের রঙ। উচ্চতা ছয়ফুটের মতো। গায়ে মাংসের ছিটেফোটাও নেই বললে চলে। তিনি রকেটের মতো অত দ্রুত গতিতে টাইপ করেন না ঠিকই, কিন্তু তিনি কথা বলেন, হাসেন। রকেট ভাইর একবারে বিপরীত মেরুর লোক। বেশি দিন হয় না, তিনি এখানে আসন পেতেছেন। ইতোমধ্যে নিজের আমুদে স্বভাবের ফলে কাস্টমারদের আকৃষ্ট করতে পেরেছেন। আমরা যদিও রকেট ভাইকে দিয়েই কাজ করাই। এবার বাধ্য হয়েই এই লম্বুমানকে দিতে হয়েছিল। 

তার আপ্যায়ন ছিল মনে রাখার মতো। তিনি আমাকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। দারুণ উচ্ছ্বসিত হয়ে চায়ের অফার দিয়ে বললেন, ‘ভাই, দারুণ, দারুণ! লেদ ম্যাশিনের যন্ত্রজীবন ছেড়ে লোকমান যখন পালাল। সে ইটকাঠের শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যাচ্ছে। তার সেই প্রায় বিস্মৃত ভিটেবাড়িতে। তখন সে নদী পার হবে। মাঝনদীতে ঝড় উঠল। মাঝি দারুণ দক্ষতায় তাদের পাড় করল। সেই সময় মাঝির কথা বুকে একদম ছুরি চালিয়ে দেয়, বুকটা এফোড়-ওফোড় করে দেয়:  ‘নৌকায় যহন পারাপারের জুন্য যাত্রী উঠে, তহন হেই আর অন্য কেউ না; তিনি তহন আমি, আমার নিয়তি; আমার ভাগ্য; আমার ঈশ্বর। আমার শেষ নিঃশ্বাস আর তার নিরাপত্তা একতারে বান্ধা।’ 

কিন্তু খারাপ লাগে কখন জানেন, যখন বাড়ি গিয়ে লোকমান দেখে সেখানে বাড়ি-ঘরের চিহ্নমাত্র নেই। নদী তার সব চিহ্ন নিজের গর্ভে নিয়ে গেছে। ভাই, আমি জানি এর বেদনা। আমি যে পদ্মার পারের মানুষ। আমারও সব নিয়ে গেছে সে। লোকটার চোখ ছলছল করে ওঠে। আমি তাকে জড়িয়ে ধরি। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমার ঠুনকো আত্মবিশ্বাসের  ভূমিতে একটা শক্তপোক্ত গাছ আমি টের পেলাম। পরদিন সকালেই পাঠিয়ে দিলাম বিজ্ঞাপনের সেই ঠিকানায়। আমার লেখা প্রথম উপন্যাস।’

শুরু হলো নতুন পথচলা। কবিতার মেঠোপথ বাদ দিয়ে, গদ্যের পাহাড়ি বন্ধুর পথে অবিরাম চলা। সময় গড়ায়। ততদিনে পদ্মা-মেঘনা-যমুনায় অনেক জল গড়িয়েছে। একের পর এক বই বেরুচ্ছে আমার। প্রকাশকদের আদর-আপ্যায়ন বাড়ছে জ্যামেতিক হারে। যেন পুতুলের রশি; আমি হাত চালচ্ছি তো, তাদেরও হাত চলছে। ততদিনে তাদের অত্যাচার আমি উপভোগ করতে শরু করেছি। এসব ব্যপারে শক্ত হতেও অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু যত শক্ত হই, দেখি তারা তত নমঃ নমঃ। ফলে ব্যাপারটাকে পুরোপুরি আমি নিজের নিয়ে হাতে এলাম।

প্রকাশকদের দীর্ঘ সিরিয়াল লেগেই আছে। লেখক জীবনে এ স্বাদ কচিৎ কেউ পায়। এ যেমন উপভোগ্য, তেমন অত্যাচারেরও। তার উপর প্রকাশকদের অনেকেরই পুরো টাকা দেয়া হয়ে গেছে, কারো অর্ধেক, কেউ-বা নিয়ে এসে ঘুরেও যাচ্ছে। বই দেয়া যাচ্ছে না। অবশ্য ঘুরে গেছে। এমন খুব কম। এটি আমি সচরাচর ঘটতে দিতে চাই না। কচিৎ হয় এমন। তবে সম্মানি দেয়নি এমন প্রকাশক সিরিয়ালে খুঁজে পাওয়া যাবে না। যদি বলি অনেক দেরি হবে, তাও খুশি। দেরি হোক স্যার, তবু দেন। আচ্ছা ঠিক আছে...বলে আমি এমন ব্যস্ততার ভান করি তাতে আর বুঝতে বাকি থাকে না আমার কী চাই। তারপর ব্যাগ থেকে থরে থরে নোটগুলো বের করেন তারা। আমার বসার ঘরের সেক্রেটারিয়েট টেবিলটায় সাজিয়ে রাখেন। বলি, এবার যান। তিনমাস বা ছয়মাস পর একবার ফোন দিয়ে মনে করিয়ে দিবেন। প্রকাশক মহোদয় ‘আচ্ছা ঠিক আছে স্যার’ বলে হাতে পথ মেপে সামনে থেকে চলে যান। আমি তাদের দেখে অবাক হই! এই ব্যবসায়ী বাঙালিরা যেন ইহুদিরও বাড়া। সে বই বেচলে কী হবে, টাকা ছাড়া কিচ্ছুটি চেনে না, টাকাটাও কিন্তু ভালো মতো গুনতে পারে না। সাংস্কৃতিক উন্নয়নের লক্ষ্য তো আরও পরে। 

সে সময় আমি ফুল টাইম রাইটার। টাকা আসছে, উড়াচ্ছি। লিখছি, পড়ছি, লিখছি। ব্যস্ত সময়। এমন একদিন। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল। লেখাপড়া সব থামিয়ে দিয়ে ঝুম বৃষ্টি দেখছিলাম। বারান্দায় এসে বসেছি। বাসার সামনে একটা সাদা প্রিমিও এসে দাঁড়াল। দৌড়ে একজন ভদ্রমহিলা বাসায় ঢুকে পড়লেন। তার রূপ আর কাপড়ের এক ঝলক আমি দেখলাম মাত্র। বৃষ্টির সৌন্দর্য শোভাতে যা এক বিদ্যুৎচমকই বটে। টাপুরটুপুরের এ মহিমাকে যা আরও বাড়িয়ে দেয়। বৃষ্টির দিনের কামনাকে তাড়িত করে আর একজন একাকী মানুষের নিঃসঙ্গতা পাহাড়ের মতো এসে গায়ে ঠেস দিতে থাকে। মনে মনে ভাবলাম, অহনাকে একবার ফোন দিলে হয়। সে আজ আসতে পারবে কি না? অহনা আমার বেতনভুক্ত কম্পোজার। তুমি তাকে দেখেছ। মনে করেছিলাম লেখক গল্পের তালে ভুলেই গিয়েছেন আমার কথা। হাঠাৎ তার সম্বোধনে নড়েচড়ে বসলাম। তিনি আবার আগের মতো মগ্ন হয়ে গেলেন গল্প বলায়— 

‘অহনা আমার এই নিঃসঙ্গ ফ্ল্যাটের একমাত্র জিব, যার তারুণ্যে জেগে ওঠে আমার টাইপরাইটার। সে দুদিন হলো ছুটিতে আছে। 

তার অনুপস্থিতিতে যেন পেদরোপামামোর সেই মৃত্যুপুরিতে পরিণত হয়েছে রোমান আর মোগল স্থাপত্য কলার মিশেলে তৈরি পুরনো এই বাসার দ্বিতীয় তলা। এখানে আমি থাকি তো আমার ছায়া হয়ে; যেখানে আমিটাই নেই। আমার উপরে আর দুটো তলা। নিচের তলায় গ্যারেজ। দ্বিতীয় তলার পুরোটা আমার। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার জন্য। এখানে বই নিয়ে আমার একার বসবাস। এ ছাড়া মাঝ বয়স্ক এক বুয়া এসে রান্না করে দিয়ে যান। মাঝেসাঁঝে কোনো রাত নারীর আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেই বিধস্ত নগরীরর মতো সব আবার অন্ধকারে ডুবিয়ে দিয়ে চলে যায়। আমার এই বইয়ের গুহা। 

‘এই আমি?’ নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করি, ‘এভাবেই কী জীবন চলে যাবে?’ প্রশ্নের জবাবে বাতাসের ঝাপটায় বৃষ্টির কতগুলো ছাট এসে চোখে-মুখে মায়ার পরশ বুলিয়ে যায়। 

কত দিন হলো কোনো সত্যিকারের মায়ার পরশ নেই এ জীবনে। কতদিন বলতে, আদৌ কি ছিল? মা-বাবার বিচ্ছেদের পর দুজন দুই সংসারে। আমাকে নিয়ে তাদের সে কী টানা হেঁচড়া। বাবা বলে আমার কাছে থাকবে, মা বলে আমার কাছে। আদালতের রায়, দুজনের কাছেই থাকবে, ছয়মাস করে। যেন আমি একটা পুতুল। আমার কোনো ইচ্ছে নেই। যেমন তেমন করে খেলে গেলেই হলো! বিশ্বাস করো, মানুষের নিষ্ঠুরতা আমি দেখেছি।

বৃষ্টির ছাট বেড়ে গেলে বারান্দা থেকে ভেতরে চলে এলাম। দেখতেই পাচ্ছ পুরো ফ্লোরটা নেহাত ছোট না। দুটো ফ্লাট আমি এক করে নিয়েছি। তিনটা থাকার ঘর এক করে লাইব্রেরি করেছি। একটা ডাইনিং আর একটা ড্রয়িং রুম—তাও বইয়ে ঠাসা। ঘুমাই এক রুমে। অন্য রুমে লিখি। ড্রয়িং রুমে মেহগনি কাঠের পুরনো ধাচের কিছু আলমিরা, সোফা বসিয়েছি আর সেগুনের টেবিল চেয়ার—এসব আমার ইচ্ছাকৃত। মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার এক ধরনের দেয়াল এগুলো। দেয়াল জুড়ে, বইয়ের তাক। তাকের উপর সুলতান আর রামকিংকর বেইজের পেন্টিং আর স্কাল্পচারের কিছু মিনিয়েচার—এসবে তুমি কি নিঃসঙ্গতার গন্ধ পাও না? অবাক হবে জেনে, এই কিছুদিন হলো এক মাদ্রাসা ছাত্র আমার নামের একটি ক্যালিগ্রাফি গিফট করে গেছে, ওই দেখ সেটাও শোভা পাচ্ছে দেয়ালে। 

আমি মাদ্রাসা ছাত্রের কাজে অবাক হয়েছি। আমার সাহিত্য নাকি পর্নগ্রাফি বলে অনেকে প্রত্যাখ্যান করেছে। আমি বলি শোন, তারা আকাট মূর্খ; শিল্পের ‘শ’ বুঝে না। অথচ এই ছেলে আমার লেখার পাড় ভক্ত। ‘কমলার দেহে নাকি মধু আছে’ বইটি আমি তার নামে উৎসর্গ করব বলে ভাবছি। তো, বারান্দা থেকে এসে এখানে, এই সোফায় বসেছি কি কলিং বেল বেজে উঠল। এই অসময়ে কে বেল বাজায়! বেজেই চলেছে। 

ওদিকে মাত্রই এক ভদ্র মহিলা বাসায় ঢুকল। এর মধ্যে কি কোনো যোগসূত্র থাকতে পারে? আমি ভাবলাম। ‘দারোয়ানই বা কোথায় গেল?’ প্রশ্নটা মাথায় আসতেই দরজার দিকে যেতে যেতে আমি তাকে ফোন দিলাম। লোকটাকে বলা যায় আমার বিশ্বস্ত দোসর। আছিরুদ্দিন। নাকের মাঝ বরাবর একটা তেরচা করে কাটা দাগ জোঁকের মতো বসে আছে। জিজ্ঞেস করলে বলেছিল, রাজনীতিক ‘পরতিপক্কের’ প্রতিহিংসার শিকার।  

—কোথায় তুমি? 

—সার, চাইর তলার ম্যাডামের জুন্য পরাটা কিনতে হোটেলে আইছি। আয়া বৃষ্টিতে আটকায়া গেছি। কিছু কি লাগব সারের?

—ও আচ্ছা। না, লাগবে না। তুমি এলে এদিক একটু এসো তো।

—জি সার।’ বুঝলে এই একমাত্র লোক, আছির, যার কাছে এখনও আমি ‘সার’। হাহাহাহহা।

তারপর শোন, ফোনটা রেখে হাতের কাছে একটা ফতুয়া পেয়ে গায়ে চাপিয়ে নিলাম। তাওয়ালটা শক্ত করে কোমরে পেঁচ দিয়ে বেঁধে দুয়ার খুললাম। ববটাকাট স্লিভলেস ব্লাউজ পরা ভদ্রমহিলাটি দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার দিকে চেয়ে মুখটা বাঁকিয়ে নৈকট্যের একটা অভিব্যক্তি উপহার দিলেন। তাকে আমি ভেতরে আসার আমন্ত্রণ জানালাম।’

‘সোজা ভেতরে?’ অনেক ক্ষণ বাদে আমি তাকে প্রশ্ন করলাম।

‘হ্যাঁ, তাকে সোফায় বসিয়ে দিলাম।’ লেখক বলল।

‘এভাবে একজন আগন্তুক নারীকে ঢুকিয়ে নিলেন নিজের ব্যাচলর বাসায়?’ আমি ঠেস দিয়ে কথাটা বললাম। নেহায়েৎ একটু মজা করার জন্য। লেখক কিন্তু সেভাবে নিলেন না।

মুখে নিরাভরণ বিরক্তি দেখিয়ে আমাকে থামিয়ে দিলেন, তোমাদের সেই আদ্যিকেলে সংস্কার আর গেল না! শোনই না আগে, তার আগে বাম হাত দিওনা তো। এটা আমার খুব না-পছন্দ।’ 

‘আচ্ছা বলুন।’ মানুষ নিজের জন্য যা পছন্দ করে না, অপরের জন্য তা করতে দ্বিধাও করে না। এ ভাবে থামিয়ে দেয়াটা কিছুতেই আমারও পছন্দ হলো না এবং আমি চুপ বলতে একবারে নিরব হয়ে গেলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, আর একটা কথাও বলব না, তার কথা শেষ হলে চুপ করে বেরিয়ে যাব। কিন্তু এ লেখক তো সেই কিংবদন্তির কথকঠাকুর। যাকে বলে কথার জাদুকর। অপমানও করবেন, আবার নাচিয়েও ছাড়বেন। কারণ তিনি নিজে যে নাচতে জানেন। 

‘আরও চলবে?’ লেখক আমার গ্লাসে ঢেলে দিতে দিতে বললেন। আমি কিছু বললাম না। তেতো পনীয়টার অনেকটা গলায় ঢেলে দিয়ে কপাল কুচকে ফেললাম। তিনি পরিতৃপ্তির সঙ্গে তার গল্পে ফিরলেন—

দরজার সামনে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি হলেন সেই সুন্দরী প্রকাশক, একদিন যিনি আমাকে তাড়িয়ে দিয়ে ছিলেন। ধারণা করেছিলাম সেই ভদ্রমহিলাই হতে পারেন। তাই নিশ্চিত হওয়ার জন্যই তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। লেখকের আচরণে এতটাই অসন্তুষ্ট হয়েছিলাম যে, তিনি যখন নিশ্চিত করলেন যে, আগন্তুক সেই প্রকাশক ভদ্রমহিলা—তারপরও আমি অবাক হলাম না বা হওয়ার ভাবটা লুকালাম। কে না জানে কথককে শাস্তি দেয়ার জন্য এটিই সবচেয়ে উত্তম মাধ্যম। গল্পের ভাঁজে সাড়া না দিয়ে প্রস্তরিত হয়ে থাকা। কিন্তু কতক্ষণ এভাব লুকিয়ে রাখা যায়। শত হোক শহরের এক খ্যাতনামা লেখক, যার কাছে আমি আসি—মানে তাকে আমি ভালোও বাসি। কিন্তু মুখ মনে হলো আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে।

‘হ্যাঁ তিনিই,’ তিনি বললেন। আমার মুখের অভিব্যক্তিতে তাকে সন্তুষ্ট মনে হচ্ছিল। লক্ষ করলাম, তিনি কথাটায় আরও জোর দিতে পুনরায় বললেন, ‘হ্যা সেই প্রকাশকই। তাকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে আমি কফি বানিয়ে আনলাম।

কফিতে চুমুক দিয়ে আলাপ শুরু হলো। তখন লেখক হিসেবে আমি যেমন খ্যাতি পেয়েছি, প্রকাশক হিসেবে তিনিও কিছু কম নন। কুশলাদি জিজ্ঞাসাবাদেই অনেকটা সময় কেটে গেল। প্রথম কথাগুলো কেমন যেন ছাড়া ছাড়া, ছেড়া ছেড়া শরতের মেঘের মতো হলো। কথা থই খুঁজে ফিরছিল, পাচ্ছিল না। 

কথার সবচেয়ে নিরপাদ আশ্রয় হাস্যরসের দিকটি। কথার মোড়টি যদি এদিকে ঘুরিয়ে দেয়া যায়—তাতে কার্যও সিদ্ধি হয় আবার আনন্দ হয়; অথচ টেরও পাওয়া যায় না। যখন এই দরজাটি উন্মোচিত হলো তখন আর কথা নিয়ে চিন্তা করার কিছু থাকল না। কথার পিঠে কথা বসে একটা সাঁকো তৈরি করল। যা মানুষদের নিয়ে যায় এক মজারুর সমুদ্রে। যেখানে কবুতরের মুখ ফসকা একটা খড়ের কুটোও কামনার রূপ নেয়। সোফায় পড়ে থাকা আমার লাল টুকটুকে জাঙ্গিয়াও হয়ে যায় আলোচ্য বিষয়।

হাস্যরসের এক পর্যায়ে প্রকাশক মহদয়া বললেন, আপনার সবকিছুতেই রঙটা খুব টুকটুকে। সে আপনার বাসার জালনার পর্দা থেকে নিয়ে লেখার নারীদের পেন্টি-ব্রা-চুড়ি; এমনকি আপনার ওই যে জাঙ্গিয়াটা—তাও টকটক করছে।

আপনার শাড়িটা খয়েড়ি হলেও ব্লাউজটা কিন্তু লাল টুকটুক করছে আর লালের প্রতি আমি এক ধরনের উত্তেজনা বোধ করি। আমার কথায় প্রকাশক হাসলেন। বললেন—

আচ্ছা আমাকে বলুন তো—এই বিশাল সাম্রাজ্যের তো একজন সাম্রাজ্ঞীরও প্রয়োজন আছে, তাই নয় কী?

—অবশ্যই।

—তাহলে আনছেন না কেন?’

—‘আসুন।’ আমার কথা শুনে প্রকাশক হু-হু করে হাসেন। আমিও হাসি।

তিনি ছিলেন সদ্য পাথর ফেটে বেরিয়ে আসা ঝর্ণার মতো স্বছন্দ, দুর্বার আর কল-কাকলিময়। কোনো জড়তা ছিল না তার মধ্যে। হঠাৎ প্রসঙ্গ পালটে ফেললেন তিনি। বললেন— 

—তাহলে কেমনে চলে বলুন?

—চলে না তেল দিন।

—তেল তো আপনার কাছে। আপনি দেবেন।

‘তাই নাকি? আমি এক্ষণই দিতে পারি।’ প্রসঙ্গটির যৎ সামান্য মায়াবি পর্দা ছিল, আৎকা একটা হাওয়ার ঝাঁপটে তাও উড়ে গেল:

—এখন তেল দিতে পারি কেবল আমি। পরেরটা দেবেন আপনি।

—সেটা কেমন?

আপনি কি জানেন, এই লাল টুকটুকে ঠোঁটের একটা চুমুর বিনিময়ে কত কত নামি লেখক নিজের স্বত্বটা পর্যন্ত আমার কাছে বেচে দেওয়ার অনুরোধ-উপরোধ করে। নিন একটা চুমু দিন আর একটা বই দিন আমার প্রকাশনার জন্য।’ বলে প্রকাশক হাসিতে ফেটে পড়ল। সে মোহ কাটিয়ে ওঠা আসলে কোনো পাথরের পক্ষেও অসম্ভব। হাসির দমকে মুখে চুল ছড়িয়ে পড়েছে, চিতল মাছের মতো বুক লাফাচ্ছে। মনে হয় খপ করে গিয়ে ধরি। 

আমি তাদেরই একজন। আমি বললাম।

—তাহলে কবে দেবেন? মেলা আছে সামনে...

—আমার মেলা ভালো লাগে না। একলা...

আবার সেই হৃদয় মথিত করা হাসি। সে হাসিতে যোগ দিয়েছে তার কাঁধ, বাহু, উরু, তলপেট আর পায়ের আলতারাঙা আঙুল। আমার চোখ তার উপর আঠার মতো লেগে থাকে। সরে না। এমনকি পলক পড়ে না পর্যন্ত। তুমি তো জানো, আমার ডান চোখটা কাঁপে, সেই কাঁপুনি পর্যন্ত মনে হলো বন্ধ হয়ে গেছে। যেন কিছু হারিয়ে ফেলার ভয়ে আছি—এভাবে আমার চোখ তার শরীরের বাক-বিভঙ্গ হিসেব করে চলেছে। 

সুন্দরী প্রকাশক হেসে আমার পাশ ঘেষে এসে বসেন। আমার উরুতে তার হাত। মৃদুচাপ দেন। মুখের খুব কাছে মুখ এনে বলেন,

‘দেবেন বই?’

‘দেব।’  সুন্দরীর নিঃশ্বাসে আমি পুড়ে গিয়ে বলি, দেব। তবে আরও কাছে এলে।

‘মেয়েরা এর বেশি কাছে আসে না। বাকিটা পুরুষের টেনে নিতে হয়।’ সেই ধোঁয়াওঠা নিঃশ্বাস ফেলে বলেন তিনি। সে আগুনে আমি মুহুর্মুহু পুড়ে দগ্ধ হওয়ার জন্য উতলা হয়ে পড়ি। কিন্তু তিনি ধীরস্থির। অভিজ্ঞ।

সমস্ত আগলই ইতোমধ্যে আমার সমুখে খুলে বসেন। আমি তাকে আরও কাছে টানি। ঠোঁটে ঠোঁট স্থাপন করি। তার অভ্যস্ত ঠোঁট আমার আনাড়ি ঠোঁট নিয়ে খেলা করে। পিচ্ছিল জিব আমার মুখে পুরে দেন। তার অসহ তাপে আমি নিজেকে তর্পণ করতে প্রস্তুত হই। 

বাংলা সিনেমার এ এমন এক সময় যখন বেল বেজে উঠবেই! অবশ্য আগেই আমি গার্ডকে বলেছিলাম। তবু তো ব্যপারটা বাজে এবং বাজে আবার বাজে আবার বাজে। বাজতেই থাকে। কী মুশকিল! বাধ্য হয়েই দুয়ারের দিকে যেতে হয় আমাকে। বিরক্তি নিয়ে  দুয়ার খুলে জলিলকে দেখি সে ভিজে নেয়ে এসেছে। এভাবে তাকে দেখে মুখের বিরক্তিভাবটা লুকিয়ে ফেলি, হাজার হোক আমার দোসর সে। খুব সিরিয়াস মোডে বলি, ‘কিছু খাবার এনে দাও আর এক বাক্স কন্ডম।’ ব্র্যাকেটে বলে রাখি ওর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা এমনই। জলিল মুখে সিরিয়াসনেসটা আরও তিনগুণ বাড়িয়ে চলে যায়। যেন কোনো গুরুত্বপূর্ণ মিশনে তাকে পাঠানো হচ্ছে, সেখানে তার মৃত্যুও হতে পারে। তবু মিশন সফল করেই সে ফিরবে। আর এ জন্যই তাকে আমার এত পছন্দ। বোধ হয় তাকে আমার দোসর বলারও কারণ এই। কারণ আমি লোকটা কখনোই সিরিয়াস না। আর সিরিয়াসনেসটা যে একটা ভড়ং তাও আমি জানি। এটা আয়েশি মানুষের এক ধরনের মুখোশ।

আছিরের কাছ থেকে ফিরে এসে দেখি সবুজের মায়াজালে জড়ানো বনের আসল রূপ বেরিয়ে এসেছে। পৃথিবীর ভেতর লুকিয়ে থাকা ভয়ানক এক কঙ্কাল। সুন্দরী প্রকাশক বিছানায় ছলম ছেড়ে বসে আছেন। দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে একহাতে ভর দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে এক ধরনের কামুক হাসি দিচ্ছেন। তার স্তন এক তৃতীয়াংশ পানিভর্তি পলিব্যাগের মতো পেটের দিকে ঝুলে পড়েছে। তলপেটের ভেতর একখামচা মেদ লদলদ করছে। চাপা দিয়ে রাখা উরুর ফাঁকে উকি দিচ্ছে একগুচ্ছ চুল। ঠোঁটের সেই জৌলুস ইতোমধ্যে ম্লান হয়েছে আমারই অত্যাচারে। এ যেন কিউবিক চিত্রকর্ম। এসব দেখে আমার কেমন যেন পেট থেকে সব উলটে এলো। আল্লার কসম, দৌঁড়ে বাথরুমে গিয়ে আমি বমি করে দিলাম। পেটে যা ছিল সব উগড়ে দিলাম। খুব ক্লান্ত বোধ করছি। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে তাকে দ্রুত কাপড় পড়ে ফেলতে বললাম। সময়টাকে তখন আমার কাছে এক পাথরের পাহাড়ের মতো মনে হলো। মনে হলো কিছু ধরার জন্য আমি শূন্যে হাত-পা ছোড়াছুড়ি করছি। তখন একটা ভেজা শরীর আমাকে কষ্ট দিচ্ছিল, যে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে কষ্ট পাচ্ছে। 

আমার এমন কেন হলো? মনে হলো আমার ভেতরের অচেনা একটা মানুষ নড়ে উঠল। কথা বলে উঠল—অনেক, অনেক হয়েছে। এবার কাপড় পরে নিন। দ্রুত বেরিয়ে যান। আমাকে কামনা করছে—এমন এক নারীকে আমি বললাম!

আমার কথা শুনে তিনি উঠে দাঁড়ান। তার মুখে অবিশ্বাসের হাসি। আমার দিকে এগিয়ে এসে আমাকে ধরাতে হাত বাড়িয়ে দেন। আমি তার থেকে দূরে সরে যাই। আরও কড়া করে তাকে কাপড় পড়ে ফেলতে তাড়া দেই। বলি, ছোঁবেন না। চোখের পলকে কাপড় পড়ে ফেলুন। তখন আমার চোখে আগুন ঝড়ছে। আগ্নেয় লাভা বেরুচ্ছে নাকে-কানে।

‘কি হলো আপনার?’ সিগারেটের ধোঁয়ার দেয়ালের ওপারে তার বিস্ময়াহত মুখে দেখি—সৃষ্টি হতে থাকা কোনো এক আবেগ যেন সেখানে থ মেরে গেছে।

‘যা বলছি তাই করুন।’ আমার কথা তখন দুধারি তরবারি। তাতে এপাশ কাটে ওপাশও কাটে। 

কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে আমার দিকে চেয়ে থাকেন তিনি। কাপড় পরে ফেলতে আবার তাকে তাড়া দিই, কী হলো, পরুন। কী  বিচ্ছিরি, যাচ্ছে তাই...।

তিনি বিছনা থেকে কাপড়গুলো একটা একটা করে নিয়ে পরতে থাকেন আমার দিকে পেছন ফিরে। যতই আমি ধোয়ায় ঢেকে দিতে চাই তার সুডৌল পাছা, চিত্তাকর্ষক পিঠ; ফের আমাকে প্রলুব্ধ করে। পিঠের খাঁজটা একটা পাহাড়ি ঝর্ণার মতো তরতর করে এসে নিতম্বের খাঁজে ঠেকেছে। মন চায়, সেই পথে একটি জলবিন্দু হয়ে গড়িয়ে পড়ি।

কিন্তু ততক্ষণে নিজের যেহেতু একটা নৈতিক অবস্থান স্থির করে ফেলেছি, তাই এ কাজ থেকে আমি নিজেকে বিরত রাখি। বরং দ্রুত বাথরুমে চলে আসি। দরজা লাগিয়ে দিই আর সেই পাহাড়ি ঝর্ণার কথা মনে করে হস্তমৈথুন করি। সেখানেই আমার জৈবিক জন্তুর সাময়িক মৃত্যু রচিত হয়। পেচ্ছাব করে বিরক্তির বোঝা কাঁধে চাপিয়ে বেরিয়ে আসি। এতে ওই নারীর সামনে সদ্য নেয়া আমার নৈতিকতার গোড়া শক্ত হয়। জৈবিক জন্তুর মৃত্যুতে নৈতিক বৃক্ষ পানি পায়। 

বাথরুম থেকে বেরিয়ে শোবার ঘরে গিয়ে দেখি ভদ্রমহিলা হয়ে তিনি সোফায় বসে আছেন। মুখের সমস্ত উচ্ছ্বাস, দীপ্তি নিমেষে মুছে গেছে। আমি তার দিকে মানিব্যাগ থেকে কতগুলো নোট বের করে বাড়িয়ে ধরি। তিনি বোধ হয় এতটা অবাক আর কখনো হননি, এভাবে আমার দিকে তাকান। পলক পড়ে না। ছলছল করে ওঠে চোখ। মুখে ম্লান একটা হাসি। চোখ নামিয়ে নেন। 

পার্স হাতে নিয়ে হাতব্যাগটা কাঁধে করে তিনি ওঠেন। আমি তাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিই। খুট করে শব্দ। হালকা বাতাসের একটা ঘূর্ণি তুলে দুয়ার খুলে যায়। তিনি বেরিয়ে যান।

দরজা লাগাতে না লাগাতেই আবার বেল বেজে ওঠে। আবার ফেরেন তিনি। তাকান আমার দিকে, বলেন—‘দেবেন বই?’

‘অবশ্যই দেব। তবে তার জন্য দেহ না, সম্মান নিয়ে আসবেন।’

নিউজজি/নাসি 

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন