রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১ , ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫

সাহিত্য
  >
প্রবন্ধ

হৃদয়ে দোলা দিয়ে ওঠে সঞ্জয় সরকারের, “পরশ পিপুল”

ইনামুল হক অক্টোবর ২২, ২০২৩, ১৩:০৯:০৭

535
  • হৃদয়ে দোলা দিয়ে ওঠে সঞ্জয় সরকারের, “পরশ পিপুল”

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সঞ্জয় সরকারের গল্পগ্রন্থ “পরশ পিপুল”। নয়টি গল্পের সমাহার ঘটেছে গ্রন্থটিতে। প্রতিটা গল্পে যেন জীবন দান করা, গল্পগুলোই কথা বলবে পাঠকের মনের। পাঠকমন গল্প পড়তে পড়তে হারিয়ে যায় নতুন জগতে, গল্পের সাথে মিলিয়ে নিজের জগতের একটা গল্প তৈরি করে। গল্পগুলোতে দেখা যায় প্রকৃতিপ্রেম, স্মৃতিকাতরতা, অস্তিত্ববাদের টানাপোড়েন এবং স্বার্থসিদ্ধির জন্য তৈরি করা শব্দ, কাটাতার আর সাম্প্রদায়িকতার আড়ালে পৈশাচিক আনন্দ।

গল্পকারের গল্পের বড় একটা অংশজুড়ে পাঠক স্মৃতিকাতরতায় ভুগবে। গ্রামীণ প্রকৃতির ছোঁয়ায় ফিরে যেতে হবে পৃথিবীর আদিম সভ্যতায়। যেই আদিম সভ্যতার ভিতরে দিয়ে ভোঁ-ভোঁ করে ডাক দিয়ে ছুটে চলে গল্পের অন্যতম চরিত্র  ছোটনের বাবার  অলৌকিক মটর সাইকেল । যা নিয়ে তিনি ছুটে চলেন গ্রামের পরে । যিনি ব্যস্ত থাকতেন তার আপন সংসার নিয়ে। যিনি মগ্ন থাকেন তার দোকান, হাতুড়ে ডাক্তারি আর পরিবারের যাবতীয় কাজ নিয়ে। মটরসাইকেলে উঠলে যিনি উড়ে বেড়াতেন পঙ্খিরাজ ঘোড়ার মতো। কিন্তু একদিন দুম করে থেমে যায় গতি। যাকে মৃত্যু না বলি, বলি তিরোধান। স্তিমিত হয়ে পড়ে মোটর সাইকেল। দোকান ভর্তি ওষুধের পাত্রগুলো পড়ে থাকে জীর্ণ আর ধুলোমলিন থাকায়। এরপর সুন্দর করে লেখক বর্ণনা করেছেন “অথচ  বাবা এসব প্রতিদিনকার কাজকর্ম ছেড়ে কোথাও স্বস্তি পেতেন না। তার রেখে যাওয়া কিছু কাজ সময়ের সাথে চলছে, কিছু থেমে গেছে। মূলত গল্পকার অতীত স্মৃতি মন্থন করেছেন এখানে। তার বর্ণনায় “যে নক্ষত্র সারারাত জ্বলে জ্বলে ভোর আকাশে ফ্যাকাশে হয়ে মিলিয়ে গেছে দিনের আলোতে শুধু তার দেখা নেই। চেয়ারের হাতলে হাত রেখে বাউল করা দুপুরবেলা গান গেয়েছে—'বনমালী গো তুমি পরজনমে হইয়ো রাধা’। সুরটা আছে, গায়কের হয়েছে বিসর্জন।”

এমনি অলংকারপূর্ণ শব্দ লেখক যোজিত করেছেন “পরশ পিপুল” গল্পে। যেখানে গল্পকার হারিয়েছেন তাঁর বাবাকে। প্রকৃতি প্রেমিক অসুস্থ বাবাকে ডাক্তার দেখাতে মুম্বাই শহরের স্মৃতি মন্থন করেছেন লেখক। বাবার সাথে কাটানো সময়টুকু এবং ছোটবেলা থেকে বাবার কাছে বসে পড়ালেখা করা সব নানা স্মৃতিতে বুঁদ হয়েছেন পরশ পিপুল গল্পে। সব থেকে রোমাঞ্চকর ব্যাপার হলো। লেখক তাঁর বাবাকে আগলে রেখেছেন পরশ পিপুল গাছের মাধ্যমে। যে পরশ পিপুলের বীজ তারা পেয়েছিলো মুম্বাইয়ে। সব কিছু হারালেও বাবার পছন্দের পরশ পিপুলের বীজ লেখক হারায় নি এবং সেগুলো যত্ন করে রোপণ করে বাড়ির আঙ্গিনায়। সেই পরশ পিপুল দেখলেই লেখকের স্মৃতিতে ভেসে ওঠে বাবার চেহারা। গল্পকারের এখানের ভাষাগুলো বেশ কড়া। যেগুলো একেবারে হৃদয়ের গভীরে ক্ষতের সৃষ্টি করে দেয়। প্রতিটি পাঠকমনকে দোলা দেবে এবং একটু হলেও দুঃখে হৃদয় হাহাকার করে উঠবে। লেখকের বর্ণনা, “তোমার ছেলের তো এখন অন্তর অসুখ। জিয়ল গাছের আঠার মতো ঝরে পড়ে কান্না। তোমার সুপুরি বাগানের সুপুরি ঝরে পড়ে শীতে। নারিকেল গাছ থেকে মধ্যরাতে টপটপ করে উত্তুরের শিশির পড়ে। মায়ের হাতে লাগানো হলুদগাঁদার শরীর ভিজে থাকে ভোরবেলা। সকাল সকাল সিদ্ধভাতে তোমার প্রিয় লাউপাতা মাতিয়ে রাখে বাড়ি। সেই চৌদ্দ পুরুষের গ্রাম আর বাড়ি আমার। ও বাড়িতে আর কে থাকে? থাকে কিছু তোমার সংসারের গাছগাছালি আর একদম একাকী ‘মা’। আমাদের বাড়ির পুব আকাশে শীতের মিষ্টি সূর্য ওঠে মায়ের মতোন একাকী। তিস্তার খোলা প্রান্তর থেকে ভেসে আসে হিমেল হাওয়া। ঢেঁকিশাকে ভরে গেছে তোমার সুপুরি বাগান। তুমি কি দেখতে পাও তোমার শ্মশানে ছড়ানো সরিষার দানা ফুলে ফুলে হলুদ করে তুলেছে শ্মশানের শোক। তুমি বলতে গৃহস্থের ঘরবাড়ি থাকতে হয়, গোয়ালে গরু থাকতে হয়, ঘরে বীজ ধান থাকতে হয় আর বাপ-দাদার ভিটেমাটি থাকতে হয়, অমাবস্যায় তাঁদের নামে আকাশপ্রদীপ জ্বালতে হয় ।"

গল্পকারের প্রতিটি গল্পেই আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের দেখা পাই। এই মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তের মানুষের সংসারের টানাপোড়েন এই গল্পকে সরস করে তোলে। গল্পগুলো জীবন্ত হয়ে  ঘোরাঘুরি করে আমাদের সমাজ আঙ্গিনায়। যেখানে চাওয়া না চাওয়ার ভিতরে এক হাহাকার কিংবা অবিশ্বাসের ছোঁয়ার ভিতর দিয়েই সংসার  তার আপন গতিতে অবলীলায়  চলে যাওয়ার যে গতিধারা সেটাই দেখি।

“লিভ টুগেদার” গল্পে আমরা দেখি আদিত্য আর মধুলতার সংসারের পাওয়া না পাওয়ার  বিশ্বাস অবিশ্বাসের জগতে হাবুডুবু খেতে থাকা সমাজকে, কিংবা দাম্পত্য জীবনের সব থেকে সুখের শব্দ আমাদের সন্তান নামক শব্দটা বলতে না পারার যন্ত্রণা। এমনি জীবন ব্যাবস্থার ভিতরে আদিত্য মধুলতা বিয়ে করেছিলো “সন্তানহীনতার অদ্ভুত শর্তে।” আদিত্যের ভাবনায় সন্তান আসবে, সে এই পৃথিবীর নানা সব জটিল প্রশ্নের গোলকধাঁধায় পড়বে তার কি দরকার। জীর্ণকায় লিকলিকে শরবত বিক্রেতার সুস্বাস্থের গল্প কিংবা “মাম, হোয়াট ইজ দেবতা” প্রশ্নের সম্মুখীন করতে চায় না আদিত্যের সন্তানকে।

কিন্তু! কিন্তু এসব চিন্তার ভিতরেও টান পড়ে অন্য কিছুর। আদিত্য ভাবে তারা একদিন পুরাতনের কাতারে গিয়ে দাঁড়াবে, তারা যখন পানসুপারি বেটে খাবে তখন তাদের সন্তানেরা তাদের সেই নতুনের জায়গা দখল করবে। মধুলতার পছন্দের আইসক্রিম যখন বার্ধক্যের কারণে সে আর খেতে পারবে না তখন তার সেই ধারা অব্যাহত রাখবে তাদের সন্তান। পৃথিবীর তাবৎ সন্তান দাঁড়াবে এ্যাসেম্বলিতে দাড়িয়ে গাইবে, “মাগো অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে....। হয়ত অঘ্রাণের ভরাক্ষেত আমাদের সন্তান অঘ্রাণের ভালোবাসা ভেবে নেবে।” তাই তো তারা সন্তানহীনতার বন্ধ্যাত্ব থেকে মুক্ত হতে অদ্ভুত শতর্কতায় দলিত করে মিলিত হয় গভীর আলিঙ্গনে।

“শিমুল সন্তান” গল্পেও আমরা দেখি মধ্যবিত্তের অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের নির্মম পরিণতি। প্রকৃতির ঐশ্বর্যের আবাসস্থল মুকুলের বাড়ি। যার বাড়ির মধ্যে লটকনের গাছ, বুনো জাম, ছাতিম, জলপাই, ডেউয়া, ডুমুরের গাছে সারাক্ষণ চড়ুই শালিক ঝগড়া করে। যে মুকুল সময় করে গাছেদের সাথে কথা বলতে আসে তাদের মন ভালো করার জন্য। এত গাছ গাছালি মুকুলের স্ত্রী ভাবে সোফা বানাবে তখন সে শোনায় ছেলে শিমুলের গল্প” শোনো শিউলি এবার মেহগনির পাতা বের হচ্ছে দেখেছো। কি কচি সবুজ। তোমার কোলে যখন শিমুলের জন্ম সেদিনকার ছবিটা বের করে দেখো এর পাতায় ওর মুখ ভেসে উঠবে।” কিন্তু এই বৃক্ষপ্রেমী মুকুলকে সংসারের অনটন আর ছেলে শিমুলের সুস্থতার জন্য শিমুলগাছ টাকে কেটে ফেলতে বাধ্য করে।

প্রকৃতি আর গ্রামীণ পরিবেশের সাথে গল্পকার যেন একাত্মা পোষণ করেছেন। “শিমুল সন্তান” গল্পে গল্পকার  প্রকৃতিঘেরা যে বাড়ির বর্ণনা দেন তা যেন, শত বৎসর ধরে সাধনাকৃত বাড়ি। এই একটা গল্প দিয়েই লেখকের প্রকৃতি প্রেম সম্পর্কে ধারণা হয়ে যায়। এ বাড়ি যেন গাছ-গাছালি আর পাখিদের মিলনকেন্দ্র  যেমন গল্পে দেখি “নারিকেল গাছে ঠিক মাঝখানটাই দেশি জাম। জামের মৌসুমে সারাদিন বুলবুলি জাম খাবে। টপটপ করে পড়বে টিনের চালায়” গল্পের নায়ক মুকুলের সন্তান এই গাছ-গাছালি। তাদের সাথে সে প্রতিদিন সময় করে কথা বলে, তাদের দুঃখ কষ্টের কথা শোনে। মুকুলের দুঃখ কষ্ট ও তাদের সাথে বলে মন খুলে। শিমুল গাছের সাথে আলাপচারিতায় দেখি “কেমন আছিস শিমুল? তোর তো এখন ভালো লাগছে অনেক। তোর তো এখন পেট ভর্তি ফুল। লজ্জা করছে না তোর? কত পাখি এসে তোর ফুলে ঠোঁট ছোঁয়াচ্ছে।” এমনি প্রকৃতি প্রেম দেখা যায় গল্পকারের প্রতিটি গল্পে।

“স্বল্প মাত্রায় জন্মবিরতিকরণ পিল” গল্পেও দেখি লেখকের কলম ঘুরেছে নিসর্গ প্রেম বর্ণনায়। তিনি গল্পের ভিতর দিয়ে আবার নতুন গল্প তৈরি করেছেন। সহজ-সরল ভঙ্গিতে রসালো করে তুলেন গল্পগুলো। নিসর্গের বর্ণনায় আমরা  দেখি “রাতে বনমরিচের গায়ে লুকিয়ে জোনাকি বেহিসেবি জ্বলতে থাকে নিকটেই মরা তিস্তা থেকে সবুজ ধানক্ষেতের বাতাস অবলীলায় বয়ে চলে।”

এই ধরণির আনাচে কানাচে এখনো সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ ছোটে, এখনো নিজ স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ধর্মের ব্যবহার কিংবা রং, আচারের ভিন্নতার কারণে উপজাতি নাম দিয়ে  রক্তে মাংসে গড়া কিছু মানুষকে ভিন্ন চোখে দেখে আসছি। আর তারই প্রতিফলন ঘটেছে “মধু মিষ্টান্ন ভান্ডার” গল্পে। দেশ ভাগের সময় ও যে মধু এদেশের মুসলমানদের আদর ভালোবাসা আর সম্প্রতির উপর  আস্থা রেখে ওপার যায় নি। সেই মধুদার মিষ্টান্ন ভান্ডারের মিষ্টির গুণাগুণে পেরে না উঠতে পেরে, আধুনিক প্রযুক্তির ভেজাল দিয়ে তৈরি “বনফুল” মিষ্টির দোকানের কর্মচারীরা মধুদার উপর ধর্মে আঘাত আনার অভিযোগ এনে আক্রমণ করে মধুদার দোকান ও মধুদার উপর।

অন্যদিকে “কানুরাম কুজুরের জীবন-যাপন” গল্পে আমরা আবার দেখি ওরাওঁদের উৎসব-পার্বণ। যেখানে তারা সবাই মিলেমিশে আনন্দ উৎসব পালন করেন।

এসব গল্পর চরিত্রায়ন  উঠে এসেছে আমাদের সমাজ বাস্তবতায় প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া কাহিনী থেকে। “পরশ পিপুল” বইয়ের গল্পগুলো মনের কুঠিতে পরশ দিয়ে যায়। প্রতিটা গল্প যেন পাঠকের ভাবনার জগতে নতুন করে এক গল্প তৈরি করে দেয়।

নিউজজি/নাসি

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন