মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ৮ মাঘ ১৪৩১ , ২১ রজব ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
গল্প

একলাছ হক-এর গল্প ‘অভীক যাত্রী’

 জুন ৩, ২০১৯, ১৫:৪৮:২৭

6K
  • একলাছ হক-এর গল্প ‘অভীক যাত্রী’

আকাশে ঝলমলে রূপালি চাঁদ। রাস্তার পাশে বড় ধান ক্ষেতের মাঠ। মৃদু ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। রূপালি থালার মত চাঁদ দেখে মনে হয় আজ ভরা পূর্ণিমা। শুভ্র একা একা জেগে আছে। বিছানার উপর বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কি যেন দেখছে। 

সারা দিনের পরিশ্রম ও ক্লান্তিতে তার চোখ ঘুমে বন্ধ হয়ে আসছে। তবু ও ভরা পূর্ণিমা রাতের অপরূপ সৌন্দর্য দেখে সে স্থির থাকতে পারছে না। বাইরে যেতে চায় তার মন, নিবিড় ভাবে অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে চায় সে। ক্লান্ত শরীরে আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে শুভ্র। আলতোভাবে দরজাটা খুলে ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে যায় রাস্তার দিকে। রাস্তাটি একেবারে ফাঁকা। কেউ নেই সেখানে। আর এতো রাতে রাস্তায় মানুষ থাকবেই বা কোথা থেকে। রাততো এখন ১টা। গ্রামের রাস্তায় তো আর গাড়ি চলে না যে রাতেও মানুষের চলাচল থাকে।

গ্রামের রাস্তায় চলাচলের মতো গাড়ি বলতে একটাই গরুরগাড়ি। আবার কোন কোন বাড়িতে বাইসাইকেলও আছে। যারা সাইকেল ব্যবহার করে তারা বিকেল হলেই হাতের সব কাজ সেরে বাড়িতে ফিরে যায়। রাস্তাটি বড় হলেও মানুষ চলাচল কম। তার উপর বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। বৃষ্টির পানিতে রাস্তা কাদায় একাকার হয়ে যায়। তখনতো কয়েকদিনের জন্য রাস্তা মানুষের চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। 

শুভ্র রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে দুহাত প্রসারিত করে আকাশের দিকে তাকিয়ে রূপালী চাঁদ, অসংখ্য তারা দেখছে আর বিড় বিড় করে সৃষ্টিকর্তার কাছে সৌন্দর্য সৃষ্টির কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে। আকাশের পানে চেয়ে সে যেন সব সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পেরেছে। হঠাৎ তার চোখে ধরা পড়েছে পূর্ব আকাশের দক্ষিণ কোণ থেকে একটি বড় তারকা খসে পড়ছে পৃথিবীর বুকে। সে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকে খসেপড়া তারকাটি এমনভাবে পড়ল কেন? নিজের মন থেকে উপলব্ধি করে হয়ত পৃথিবীর বুক থেকে কোন মানুষ চলে গেছে ওপারে। আর কোন দিন আসবে না পৃথিবীতে।

তাই তার নিদর্শন স্বরূপ আকাশ থেকে একটি তারকা খসে পড়েছে। শুভ্রের সরল মনের ধারণা যখন পৃথিবীতে একটি শিশুর জন্ম হয়, তখন আকাশে একটি তারকার জন্ম হয়। আবার যখন একজন মানুষের মৃত্যু হয়, তখন আকাশ থেকে একটি তারকা খসে পড়ে। হয়তো তার ধারণা সত্য। হয়তো না।

জোছনা রাতে গ্রামের কাঁচা রাস্তা দিয়ে হাঁটছে শুভ্র। চাঁদের আলোতে সে স্পষ্ট দেখছে সব কিছু। আর স্পষ্ট তো দেখবেই, ভরা পূর্ণিমার চাঁদ যে ঠিক তার মাথার উপরে। রাস্তা দিয়ে একা একা হাঁটছে সে। যদিও গান জানে না তবুও নিজের অজান্তে মাঝে মাঝে দু-একটি গানের প্রথম কিংবা মাঝের লাইন মুখে এসে যায়। তাতে কি, গান তো আর কেউ শুনতে আসছে না। সে যে নিজের গানের শিল্পী এবং শ্রোতা। নিজে নিজে গান গাওয়ার মাঝে ভাবে ঘুমাতে যাবে। আবার জানি কখন এমন একটা ভরা পূর্ণিমার রাত পাই এই সব ভেবে আর ঘরে যাচ্ছে না। একা কতো কি ভাবছে সে।

মৃদু ঠাণ্ডা বাতাসে রাস্তার দক্ষিণ পাশের ধান ক্ষেতগুলো দুলছে। বিড় বিড় করে গান গাইছে আর রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। যেতে যেতে রাস্তার পাশে জঙ্গলের কাছে চলে আসে সে। জায়গাটি জঙ্গল হলেও দেখতে খুবই সুন্দর। অনেক প্রকার গাছ-পালা ও বাঁশ ঝড়ের সমাহার সেখানে। এতো বেশি গাছপালা ও বাঁশ ঝড় অন্য কোথাও নেই। তাইতো সবাই জঙ্গলটিকে বড় জঙ্গল নামেই জানে। এর চেয়ে বড় জঙ্গল আর নেই শুভ্রদের গ্রামে। 

জঙ্গলের ভিতরে খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া কেউ যায় না। কিন্তু রাস্তার পাশে জঙ্গলের যে অংশটুকু আছে সেখানে বসে দিনের বেলায় অনেকেই সময় কাটায়। আর রাতের বেলায় তো সেখানে যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। তার উপর জঙ্গলটি নিয়ে নানা রূপকথাও রয়েছে। সেখানে গেলে এটা হয়, সেটা হয়, আরো কতো কি। শুভ্রদের গ্রামের ছোট ছেলে-মেয়ে যদি না বুঝে না শুনে ওই জঙ্গলে চলে যায় তাহলে তো তাদের বাবা-মায়ের চিন্তার শেষ থাকে না।

বাবা-মায়ের ধারণা শিশুটিতে যেন কতো কি অশরীরী ভর করছে তার ইয়ত্তা নেই। তাৎক্ষণিক শিশুটিকে বিভিন্ন গাছের পাতা ও ছাল পানি দিয়ে ফুটিয়ে গরম করে গ্রামের ধান ক্ষেতের মাঠে নিয়ে যাওয়া হতো। সেখানে তিন কোণা সম্বলিত ক্ষেতের আইলে দাঁড় করিয়ে গরম পানি দিয়ে গোছল করানো হতো। গোছল শেষে গায়ে খাঁটি সরিষার তেল মাখিয়ে রোদে বসিয়ে কবিরাজ ডেকে ঝাড় ফুঁক করানো হতো। ঝাড় ফুঁক শেষে কালো সুতোর তাবিজ বেঁধে গলায় পরানো হতো এবং তিন দিনের জন্য মাছ ও মাছ জাতীয় আমিষ খাওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ করা হতো।

শুভ্র রাস্তা দিয়ে হাঁটছে আর পূর্ণিমার চাঁদ ও অপরূপ সৌন্দর্য দেখছে। হাঠাৎ আর চোখ পড়ে জঙ্গলের দিকে। সে দেখছে জঙ্গলের ভিতরে মিটি মিটি আলো জ্বলছে। তার মনে কৌতুহল জেগে উঠে আর মনে মনে ভয়ও পায় সে। এতো রাতে মিটি মিটি আলো আসবে কোথা থেকে। তার মনের কৌতুহল ও ভয়ের অবসান ঘটাতে গিয়ে দেখতে পায় সবাই যেন ব্যস্ত। অনেক লোক এক সাথে কাজ করছে। সবাই এতো ব্যস্ত যে শুভ্রের সাথে কথা বলার মতো সময় কারো নেই। শুভ্র প্রথমে নিজেকে সামলে রাখতে পারেনি। তাদের দেখে সে ভয় পেয়ে যায়।

এতো রাতে এখানে এরা কি করছে। আর যারা কাজ করছে তাদের কাউকেই শুভ্র চিনতে পারছে না। লোকগুলো নিজের ইচ্ছা মতো কাজ করে যাচ্ছে। শুভ্র নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও তাদের সাথে কথা বলতে চায়। কিন্তু পারে না। তার সাথে কেউ কোন কথাই বলছে না। লোকগুলো যে যার মতো কাজ করে যাচ্ছে কথা বলার কোন সুযোগ তাদের নেই। লোকগুলো দেখতে এতো সুন্দর যে, এতো সুন্দর মানুষ সে আগে কখনো দেখেনি। সবার শরীরে একই পোশাক। কারো শরীরে ভিন্ন পোশাক নেই। তাদের পোশাকগুলো এতো পরিষ্কার ও স্বচ্ছ যে পোশাকের ভাঁজে ভাঁজে ফর্সা শরীরের অংশ একটু একটু দেখা যাচ্ছে। তাদের বুকের ডান পাশে একটা চিহ্ন আছে তা থেকে মিটি মিটি আলো জ্বলছে। 

শুভ্র অবাক দৃষ্টিতে শুধুই তাকিয়ে থাকে। সে দেখছে তারা কেউ মাটি কাটছে, কেউ জায়গা পরিষ্কার করছে, কেউ বাঁশ কাটছে, কেউ মাটি উঠাচ্ছে, কেউ সুন্দর করে মাটিগুলো অন্যত্র নিয়ে রাখছে, কেউ কাটা বাঁশগুলো টুকরো টুকরো করে কাটছে। এখানে যেন সবাই ব্যস্ত। শুভ্র একজনকে প্রশ্ন করে কি হচ্ছে এখানে? আর তোমরা কারা? তোমাদের তো আগে কখনো দেখিনি? কোন উত্তর নেই তাদের মুখে। শুভ্র বিষণœ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

কিছুক্ষণের মধ্যে মাটি কাটা শেষ হলো। মাটি কাটার পর জায়গাটির মাটি সুন্দর করে ভাঁজ করা হয়। মাটি কাটা গর্তটি খুব সুন্দর করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নভাবে সমান করা হয়। তখন আর শুভ্রের বুঝতে বাকি নেই যে এখানে কবর খোঁড়া হয়েছে। শুভ্র প্রশ্ন করে তোমরা কে আর এটা কার কবর? কোন উত্তর নেই তাদের মুখে। তারা নির্বাক কাজ করে যাচ্ছেই। নতুন কবরটির কাজ শেষ হলে লোকগুলো আশে পাশের পুরাতন কবর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার পর দেখা যাচ্ছে এখানে আরো ছয়টি কবর আছে। নতুন কবরটিসহ এখানে সাতটি কবর হবে- শুভ্রর প্রশ্ন এটা কার কবর?

বার বার তাদের কাছে জিজ্ঞেস করে ব্যর্থ হয়। কবর খোঁড়া, পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করা বাঁশ কাটা ইত্যাদি কাজ শেষ করে খুবই সুন্দরভাবে কবরটি সাজানো হলো। এখন শুধু অপেক্ষার পালা। সে ভাবছে এটা কার কবর? আজতো কেউ মৃত্যুবরণ করেনি। আর যদি কেউ মারা যেত তাহলে তো তাদের গ্রামের লোকজন কবর তৈরি করতো। তাহলে তারা ঐ কাজগুলো করছে কেন? এসব প্রশ্ন তার মনে তাড়া করে ফেরে। সে বার বার তাদের কাছে যায় জানতে এটা কার কবর? কিন্তু তারা কিছুই বলছে না। শুভ্রও নাছোড়বান্দা সে জেনেই ছাড়বে যে এটা কার কবর? সে বিনয়ের সাথে তাদের একজনকে জিজ্ঞাসা করে এটা কার কবর? লোকটি তার দিকে তীক্ষè দৃষ্টি দিয়ে তাকে উদ্দেশ্য করে রুক্ষ ভাষায় উত্তর দেয়- এটা তোমার কবর। 

কথাটা শুনে আশ্চর্য হয় সে। অন্য আর কোন প্রশ্ন করতে পারছে না সে। তার মনের সব ভাষা যেন হারিয়ে ফেলেছে। সারা শরীর যেন নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। সেখান থেকে ফিরে আসতে পারছে না। তার দিকে হাস্যোজ্জ্বল মুখে পবিত্র দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে সবাই। কাউকে কোন কিছু বলার ভাষা তার নেই।

মুখ দিয়ে কোন কথা বলতে পারছে না সে। হাঁটাচলার সব শক্তি হারিয়ে ফেলেছে সে। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে তার। এমন এক সময় উপলব্ধি করতে পারছে তার আপন বলতে আর কেউ যেন নেই এ পৃথিবীতে। শুভ্রর এমন নিরুপায় অবস্থায় হঠাৎ সে ঘুম থেকে জেগে ওঠে। দেখে সে চারদিকে উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে পড়ছে। ঘর থেকে সে বাইরে বেরিয়ে দেখে সব কিছু স্বাভাবিক। ঠিক আগের মতোই।

নিউজজি/এসএফ

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন