মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ৮ মাঘ ১৪৩১ , ২১ রজব ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
গল্প

রওশন রুবী’র ঈদের গল্প ‘বদলে যাওয়া’

 জুন ৩, ২০১৯, ১৪:১১:৪৫

6K
  • রওশন রুবী’র ঈদের গল্প ‘বদলে যাওয়া’

পোশাকের ভেতর রাজা প্রজার তেমন ব্যবধার থাকে না। মিতুলতা জানে বলেই আশ্রম আর ঘরের পার্থক্য খোঁজে না। 

ঈদের মাত্র দশদিন বাকি। এসময় যখন ছেলেরা, তাদের বউসহ এবং একমাত্র মেয়ে তাকে খুব যত্ন করে তৈরি করছিল; বুক একটুও টলেনি। ঈদের আনন্দঘন মুহূর্তে তারা জন্মদাত্রী মাকে চায় না। এমন নির্দয় সন্তানের জন্ম যখন তার পেটে হয়েছে, তখন এদের দেয়া দুঃখও তাকে সইতে হবে। তাই

বড় বৌমা দুধের মগ এগিয়ে দিলে বলা আসেনি,

-কাব্যের খাবারে আমার লোভ নেই। তাছাড়া চুরি করে করে তো অনেক খেয়েছি মা। আজ বিদায়ের দিন নাইবা খেলাম। ওকে দাও। ও কেবল বেড়ে উঠছে।

কাটা ফলের থালা থেকে ফল মেঝ বউমা মুখে তুলে দিচ্ছিলো যখন বলা হয়নি,

-থাক বউমা ঐসব। অনেক খেয়েছি। শরীরে শক্তি আর রক্তের কমতি নেই। এগুলো তোমরা খেয়ে নিও। বুড়ো মানুষ এতো শক্তি দিয়ে কী করবো?

ঝটা ধরা চুলে তেল চিরুনি চালানো মেয়েকে বলতে ইচ্ছে হয়নি,

-মা, আদিখ্যেতা থাক। ওটুকু আঁচড়ে নিতে পারবো। বাকি দিনগুলো যে নিজেকেই করতে হবে কাজটা। তোর মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে এতে। যা যা নিজের কাজে যা। ছেলে মেয়ে সামলা। ওযে কম ঝক্কির কাজ নয় সেতো আমি জানি।

বড় ছেলে যখন জড়িয়ে ধরে ছিল অভিনয় হোক বা আবেগে। বলা আসেনি,

-দূরে থাক বাবা। গা থেকে এখনো কৃষাণির গন্ধ মোছেনি। তোর দেওয়া বিদেশি সাবানেও খারের গন্ধ দূর করতে পারেনি। বডি-স্প্রে করে দিতে বল পূর্বের মতো বউমাকে। 

মেঝ ছেলে পা ছুঁয়ে সালাম করলেও বলতে পারেনি,

-বাবা পায়ে এখনও চর্মরোগের ক্ষত। ছুঁয়ে দিস না। এটা ছোঁয়াচে। আক্রান্ত হতে পারিস। 

তারপর তারা বাড়তি যত্ন শুরু করলেও বলতে পারেনি,

-এসবে অভ্যাস নেই। অসুস্থ লাগে। দম আটকে আসে। এসব থাক ঈদের সময়টুকু সবাই সঙ্গে থাকি। আমাকে আরো কিছুদিন রেখে দে।

যখন আরমান হোসেন বেঁচে ছিলেন। তখন সংসারে মিতুলতার কদরও ছিল। নিত্যদিন নুন থেকে পাতা-লতা কেনা সংসার ছিল তাদের। তবু সুখের অন্তঃ ছিল না। দু'ছেলে, এক মেয়ে পুতুলের মতো আনন্দে নেচে, গেয়ে, খেলে গরিবের আঙিনায় কিরণ ছড়াতো।

স্বপ্ন বপন করতো ওদের মধ্যে আরমান হোসেন আর মিতুলতা। স্বপ্নরা সজীব হয়ে উঠেছে। সেই সজীব স্বপ্নে পরান ভরে শ্বাস নিতে পারেনি আরমান হোসেন। মরে বেঁচেই গেছেন। নয়তো আদরের সন্তানদের অবহেলার তীরেই নিঃশেষ হয়ে যেতেন। তারপর আশ্রয় হতো বৃদ্ধাশ্রমে।

ধান কাটতে গিয়ে বিষধর সাপের কামড়ে চলে গেলেন। আহারে মানুষের অকাল মরণ। পাথরও গলে পড়ে ব্যথায়, মায়ার কামড়ে। গলে পড়ে মিতুলতা মনে হলে প্রতিবার। সন্তানেরা মৃত ব্যক্তির জন্য গলে কিনা সৃষ্টিকর্তা ভালো জানেন। কখনো মিতুলতা দেখেনি তারা স্মৃতির দিনগুলো স্মরণ করতে করতে হাঁফিয়ে উঠেছে। বরং কখনো সখনো সে বলতে চাইলে তাকে থামিয়ে দেয় কেউ না কেউ ‘পরে শুনবো’ বলে।

স্বামীকে হারিয়ে তিন সন্তান নিয়ে মিতুলতার চরম দিন যায়। সমাজের মানুষেরা উপকারের অন্তরালে লোভের লকলকে জিহ্বার বেষ্টনীতে আটকে ফেলতে চায় মিতুলতাকে। সে পাত্তা দিতো না কাউকে। নিজের মতো করেই চলতো। সে জানে দুর্বলকে চিরকাল সবল গিলে খায়। কিন্তু হত-দরিদ্ররা সব কিছু চাইলেও পারে না। মিতুলতা কীটের কামড় সয়ে সয়ে এগিয়ে যায়।

বড় ছেলে ইমন হোসেন আজ ভূমি কর্মকর্তা। সরকার গাড়ি দিয়েছেন। সেই সাদা গাড়িটা নিয়ে একদিন মিতুলতার তকতকে উঠোনে দাঁড়ায় ইমাম হোসেন। নিজের চোখেও কেমন ধাঁধাঁ লাগে রক্তকে চিনতে। চোখ জুড়িয়ে যায় মিতুলতার। সে দৌড়ে গিয়ে তার আঁচলে ছেলের কপালের, মুখের ঘাম মুছে দিতেও সঙ্কুচিত হয়। ইমন হোসেন মায়ের বিব্রত মুখ দেখে দুধ সাদা দাঁত বের করে হাসেন। মিতুলতা লজ্জায় অস্থির হয়ে উঠেন। 

এভাবেই ছেলে মেয়েদের সাফল্য তাকে খুশির পাশাপাশি লজ্জিতও করে। মিতুলতা বোঝে তারা অভাবী জন্মদাত্রীকে সমাজের কাছে পরিচিত করতে বিব্রত বোধ করে। তাই সে তাদের ঘরের কোন এক রুমে নিজেকে বন্দী করে রাখতো। কদাচিৎ ভুল বসত কারোর সামনে বেরিয়ে পড়লে তারা চলে গেলে রক্তচক্ষুর ঝাঁঝ সইতে হতো।

সেই ঈদ গেল। কোরবানের ঈদও গেল। মিতুলতাকে তারা আর কোনদিন তাদের কাছে নিয়ে যায়নি। তার আকাঙ্ক্ষার চোখগুলো পথ চেয়ে চেয়ে ঘোলা হয়ে উঠে। পরিচিত পদধ্বনি শোনবার জন্য কান চঞ্চল হয়। কেউ নেয়নি বা ঈদের দিনও দেখতে আসেনি তাকে। কেটে গেছে এখানে প্রায় দু'বছর।

আবার ঈদ এসেছে। মাত্র আর দিন-পাঁচেক বাকি। এখানে যে দায়িত্বে আছেন তিনি বলে গেলেন, 

-মিতুলতা তোমাকে দেখতে তোমার বড় ছেলে আর বউমা আসছে। 

শুনে চুপ করে বসে রইল মেঝের দিকে তাকিয়ে। সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ দেখা দেবে না। যেমন, ক'দিন আগে আসা মেঝ ছেলে, মেয়ের সাথে দেখা দেয়নি। 

কেন দেখা দেবে? সে ওদের কী? কী আছে তার কাছে? তার যে মমতা আছে তা বড়বেলায় চায় না তার কোন সন্তান। ওরা সমাজের আইকন। দরিদ্রতাকে দু'হাতে ঠেলে যে মা মানুষ করেছে। ওদের ঘরের পরিচ্ছন্নতায়, উচ্চ সমাজে সেই মায়ের ঠাঁই মেলেনি। 

মিতুলতা ওদের অর্থ দিয়েও চলতে চায় না। তাই আশ্রমে রান্নার কাজটা নিয়েছে। ওদের দেওয়া অর্থগুলো ফেরত দিলে অনর্থক হবে। সেগুলো ফেরত না দিয়ে, যার যার নামে ডিপোজিট করে রেখে দেয়। 

আজ রান্নার ফাঁকে চোখে জলছবি ফোটে। আহ্! ছেলে মেয়েরা যখন ছোট ছিল; কষ্টে শিষ্টে একটি করে সস্তা নতুন জামা কিনে দিতো আর একটা আতর। ওরা যখন ওসব পরে মিতুলতাকে সালাম দিয়ে দাঁড়াতো তখন বাঁশ কেটে গচ্ছিত রাখা টাকা থেকে পাঁচ টাকা করে তাদের হাতে দিত। ঐ টাকা পেয়ে মহাবিশ্ব পাওয়ার মতো আনন্দ করতে করতে তারা ঈদে যেত। আর মিতুলতা ঘরে পোষা বড় মোরগটা জবাই করে ইরি চালের ভাত রান্না করে রাখতো। ওরা ফিরে আত্মতৃপ্তিতে খেয়ে ঘুরতে যেত।

আর তো দু'দিন বাঁকি ঈদের। তারা কী কেউ তার অভিমান বুঝবে না? অভিমান ভাঙিয়ে তাকে নিতে কোনদিন আসবে না? কোনদিন কী অনুভব করবে না মা ছাড়া পৃথিবী অন্ধকার! মানুষের প্রকৃত আশ্রয় মা! 

কেমন হাফর লাগে মিতুলতার। বুকে মমতার পাথরটা টলে উঠে। গড়িয়ে পড়ে মিতুলতার শরীর। 

স্পন্দহীন শরীরে পাশে বসে অন্যরা ফোন করে। ও-প্রান্ত থেকে আসবো, আসছি করে করে দেড়দিন পরেও কেউ এলো না। 

হায় বদলে যাওয়া! হায় সন্তান! হায় ব্যস্ততা!

নিউজজি/এসএফ

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন