মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ৮ মাঘ ১৪৩১ , ২১ রজব ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
গল্প

বৈশাখ ও মুঠোমুঠো মুগ্ধতা

রওশন রুবী এপ্রিল ১১, ২০১৯, ১৮:৪৫:২৮

6K
  • বৈশাখ ও মুঠোমুঠো মুগ্ধতা

কতবার বলেছি দাবি নেই, দাবি নেই, তবু কাল থেকে অনুশ্রী দিদি মুহূ মুহূ ফোন দিচ্ছে। ফোনটা বন্ধ করে রাখতে পারছি না। বিপ্লব সাহেব সিভিল ইজ্ঞিনিয়ার। বড় ভাইয়ের ক্লোজ ফ্রেন্ড। মাঝে মাঝেই ফোন করেন। খোঁজ খবর রাখেন। বাড়িতেও এসেছে অনেকবার। তিনি ফোন করবেন বলেছিলেন। ভদ্রলোক ফোন করে ফোন ব্যস্ত পেলে মুখে কিছুই বলবেন না। কিন্তু দ্বিতীয়বার ট্রাইও করবেন না। এই ভদ্রতার আড়ালে থাকা মানুষগুলো নিয়ে পদে পদে বিপদ। আমরা জটফট অভিব্যক্তি বলেদেই এবং তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেই। এরা প্রথমে ধারণ করে; পরে বিশ্লেষণ করে। মূলত তাই নিয়ম। ওরাই ঠিক। 

কাল সকালেই বৈশাখ শুরু। সকালে সবাই কতো হইহুল্লোড় করবে। আর আমার রঙ নেই। শুধুই বিবর্ণতা। ফিকে নয় প্রগাঢ় আঁধারে সমর্পিত হওয়া।

আমার শুধু মনে হয়  কখনো নিজের কাছে নিজের দাবি থাকে না কারোর। তাই অনুশ্রী দিদিকে বলি,

-দাবি নেই কোন। মৃনময়ের জন্য কিছু করেছি। এটা নিজের জন্য করা। এ ফেরত যদি নেই। যদি তার পরিজনের কাছে এটা তুলে ধরি। তবে বড্ড অন্যায় হবে। অনুশ্রী দিদি তোমরা এ বিষয়ে আমার কাছে আর জানতে চাইলে আমি বলবো, কিছুই করিনি। তখন কী করবে? প্রমানতো করতে পারবে না কিছু। বন্ধুর জন্য বন্ধু কিছু করলে তা ফেরত নিতে করে না। এটা কর্তব্য। এতে করে হয়তো মৃনময় মানসিক ভাবে কিছুদিন শান্তিতে ছিল। 

অনুশ্রী দিদি মৃনময়ের  পাড়াতো বোন। কলেজ শিক্ষিকা। এখনো দেখা হয়নি আমাদের। ফোনে ফোনে কথায়ও একটা কেমন টান। ভালো লাগে। মায়া হয়।

মৃনময়ের সাথে পরিচয় প্রায় বছর পাঁচেক। আর প্রেম চলছে দুবছর এই বৈশেখে আমাদের বিয়ে ঠিক করেছি দুজনেই। ওর বাবা একরোখা মানুষ। মানতে চাইবে না বলেছে ও। মা মাটির মানুষ। তিনি খুব স্নেহের সাথেই  আমাকে বলেছেন,

-তুই আমার পাগলটার বউ হবি।

ভরসা ছিল এটুকুই। 

মৃনময় দেখতে তেমন ভালো নয়। তবে উচ্চ শিক্ষিত, স্মার্ট, সুরুচি পূর্ণ একটি ছেলে। ও প্রথম প্রপোজ করেছিল দু'বছর আগে বৈশাখেই। বৈশাখ মাসটার সাথে আমার বোধ হয় বিশেষ যোগাযোগ আছে। জন্ম হয়েছে বৈশাখে বলে নামটা বৈশাখী। প্রেম, বিয়েও বৈশাখ মাসে। মৃনময়ের মায়ের সাথেও কথা হয় বৈশাখে। 

বয়স বাড়ছে কি কমছে তা নিয়ে মাথা ব্যথা ছিল না। চিরকাল আমি বাবার মতো কাজ পাগল আমি। কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে থাকতে বেলা গড়িয়ে যায়। পড়া লেখা শেষ করে বাবার বিজনেসে ঢুকেছি। সেই থেকে এই জীবনে বৈশাখের রঙ আর লাগেনি। মৃনময় প্রথম সেই রঙ লাগালো। সে ডুবে থাকা থেকে বের করে জীবনের অন্য রঙ দেখালো। 

ওর মধ্যে একটা আফসোস কাজ করতো, কারণ এতো পড়া শোনা করেও সে বড় কোন চাকরিতে ঢুকতে পারেনি বলে। ওর বাবার ওপেনহার্ট সার্জারি, বোনের বিয়ে, মায়ের পিত্ত থলিতে পাথর অপসারণের সময় কিছু টাকা ও আমার কাছে থেকে নিয়েছে। যা ওকে বলেছি শোধ করতে হবে না। তবুও ওর আত্মীয় অনাত্মীয়রা মানছে না। জানি না তারা জানলো কি করে? নাকি মিছেই আগবাড়ি বলে বন্ধুত্বকে হালকা করছে? অথবা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কথা বের করতে চাইছে?

হবে হয়তো কিছু। ওসব নিয়ে মাথা ঘামাতে ইচ্ছে করছে না।

গত দু'সপ্তাহ আগে ওকে জ্বরে আক্রান্ত করলো। ডেঙ্গুর মারাত্মক কবলে হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো। ওর মতো একটা স্টং মানুষকে সামান্য জ্বরে কাবু করে ফেলবে এটা ভাবা যায় না। তবু তাই হলো। আমি প্রতিদিনই একবার দেখা করতে যেতাম। তবে কখন যেতে পারবো তার ঠিক ছিল না। এটা অবশ্য ওর বাবার উপর নির্ভর করেই হতো। তিনি অফিসের কাজে আজ এখানে কাল ওখানে ঘুরে বেড়ান। ঘোরা ঘুরির মধ্যেও ছেলের অসুখে তার অবহেলা নেই। তার বন্ধু ডাঃ আরমান হোসেন ও তানভীর সোহেলের তত্ত্বাবধানে রাখলেন মৃনময়কে। তারা প্রাণ দিয়েই বন্ধুর সন্তানকে চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছিলেন। মৃনময়ের মা আর ছোট বোন কন্টিনিউ থাকছে ওর সাথে। তারা জানে আমার কথা। তাই যখন মৃনময়ের বাবা আসবার সম্ভাবনা থাকে না তখন ডেকে পাঠাতো। আমি ছুটে গেলে তারা রুম থেকে বেরিয়ে যেতো। তখন সে আমাকে নানান কথা বলতো। বলতো জীবনের কথা, স্বপ্নের কথা। সেই সাথে বলতো 

-ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে চলে যাচ্ছি। তুমি ভালো থেকো। আমার জন্য দোয়া করো।

আমি বলতাম

- মনোবল হারাচ্ছো কেন? এর থেকে বড় অসুখ হয়েও মানুষ বাঁচে। এসব রোগের চিকিৎসা আছে। তুমি ভালো হয়ে উঠবে। আর কয়দিন পরই বৈশাখ। সেদিন আমরা বিয়ে করবো। তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাও।

-চেষ্টা করছিতো। যেভাবে ডাক্তারেরা বলছে আমি সেভাবে চলছি। সামান্য এদিক ওদিক করছি না। শুধু তোমার জন্য।

-জানি  আমি। আমিও কেমন শূন্য হয়ে যাবো তুমি না থাকলে। এ শূন্যতার অবসান হোক। 

-তোমাকে যে বৈশাখের পোশাক গিফট করলাম। পছন্দ হয়নি?

-ওমা কি কথা শোন! তোমার পছন্দ খারাপ? তুমি তো সেরা। যাও কাল পরে আসবো। 

-তুমি তো এমন করো না। পেলেই পরে আমাকে ছবি তুলে পাঠাও।

-তুমি আমাকে পাঠাও না? এবার যে তুমিও পারনি! 

-হুম! ঠিক বলেছো। শরীরটা মানছে না। কেমন যেন অস্থির লাগে, দূর্বলও। 

-সব ঠিক হয়ে যাবে দেখো! আমি রোজা করেছি। সিলেট মাজারে মানত রেখেছি। রোজ আল্লাহ্'র কাছে কত মিনতি করছি। তিনি তোমাকে ভালো করে দিবেন।

-আমি জানি বৈশাখ, আমি সব অনুভব করতে পারি। তুমি আছো বলেই আমার সুন্দর ছুঁয়ে থাকা। 

-তাহলে চোখে জল কেন বলো?

-ভালো হচ্ছি না যে! যদি তোমার থেকে আমাকে জম পৃথক করে দেয়?

-তুমি এমন কথা বলতে পারলে? সেই কবেকার ছেঁড়া ছেঁড়া আমাদের হাজারও অভিমান মনে আছে? সব শেষ করতে কতো যুদ্ধ হতো মনের সাথে। তারপর মুঠোমুঠো বিস্ময় ছড়িয়ে আমরা হেসে উঠতাম। নির্মম করাতে কাটতাম তখন কতোদিন আর রাতের ডানা। মনে পড়ে?  উপমাটা ভালো হয়নি তাই হাসছো বুঝি? আমি ছাই পারি না ওসব। শুধু গুলিয়ে যায়।

-আরে নারে পাগল! হাসছি সেই আনন্দময় মধুর দিনের কথা ভেবে।

-একটা প্রকৃত মানুষই তো খুঁজেছি। পেয়েছি। ভালো  হয়ে যাও। আমরা পাড়ি দেব চড়াই উতরাই।

- সমস্ত জীবন আমরা এভাবে থাকতে পারবো বৈশাখ?

-কেন নয়? আমি যখন ভালোবাসি এভাবেই ভালোবাসি; ভালোবাসবো। তোমার সমস্যা?

-একদম নয়। তবু মনে হয় বলি ভালো থেকো। মনে রেখো।

সপ্তাহের মাথায় মৃনময়ের শ্বাস বিকেল মাড়াতে মাড়াতে   চলে গেলো আকাশ থেকে আকাশের পর। সবাই শোকাহত হলো। 

যা ফিরে আসবে না তার জন্য অপেক্ষা করা বোকামো। তবু আমি অপেক্ষায় আছি সে আসবে। সে আসবেই। সে চলে যায়নি। চলে গেছে একথা যে বলছে তাকে বিরক্ত লাগছে। আমি জানি সে ফিরবে।

অনুশ্রী দিদি মিছেই খোঁচাখুঁচি করে জানতে চায় ওর সাথে লেনদেনগুলো। আমার দাবি দাওয়া। সে কিকরে বুঝবে ক্ষত'র চেয়ে অর্থ বড় নয়। যদি কোটি কোটি টাকা দিয়ে ওকে ফেরানো যেতো? যদি ফিরানো যেতো! তবে ফিরিয়ে আনতাম। 

আজ বৈশাখের শুরু। পথে ঘাটে ঘরে ঘরে উৎসব। আমার ভালো লাগছে না কিছু। ঘর অন্ধকার করে পড়ে আছি সকাল থেকেই। বিপ্লব সাহেব ফোন করেছেন বহুবার। মন খারাপ থাকলে ভালো কথাও বিরক্ত লাগে। তাকে এখন বেহায়ার মতো লাগছে আমার। বমি বমিও লাগে মাঝে মাঝে। মা ঘরে ঢুকে আলো জ্বাললো। তীব্র আলোর ছটায় চোখ ঝলসে উঠে। মায়ের পরনেও নতুন পোশাক। কপালে টিপ, ঠোঁটে মেরুন লিপিস্টিক, চোখে আইলাইনার; চুলে একগুচ্ছ গোলাপ। সাদা শাড়ি মেরুন পাড়ে মাকে অপরূপা লাগছে। তিনি কাছে এসে বসলেন। বললেন

-আর কতো? এবার ওঠ। সকাল থেকে বহুবার ডাকলাম। উঠলি না। পান্তা ইলিশও খেলি না। উঠ গোসল কর। তৈরি হয়ে নে। চল পান্তা ইলিশ খেয়ে

আমরা তোর ফেবারিট আইসক্রিম খেতে যাবো। ওঠ! ওঠ না!

-না মা! আমাকে আমার মতো থাকতে দাও। 

এসময় রুমে ঢুকলেন বিপ্লব সাহেব। তার হাতে একটি বক্স আর একগুচ্ছ রজনীগন্ধা। মা তার সালাম নিয়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। তিনি রজনীগন্ধাগুলো টেবিলে রাখলেন। বক্স খুলে বের করলেন মুঠো মুঠো প্রজাপতি। সাদা লাইটের আলোয় তারা মনের খুশিতে উড়ছে। সেগুলোর দিকে তাকিয়ে আমি মুগ্ধ হই। তিনি হাসেন। হাসিটা অবিকল মৃনময়ের মতো।

      =০= সমাপ্ত =০=

নিউজজি/এসএফ

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন