মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ৮ মাঘ ১৪৩১ , ২১ রজব ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
গল্প

অসংলগ্ন স্মৃতি

শামীমা শওকত ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৯, ১৪:৫২:০৫

6K
  • অসংলগ্ন স্মৃতি

আমার চারপাশে প্রশ্নের ভিড়। ঐ যে দেখছ টেবিলে নীল নেট দিয়ে ঢাকা বলতে পার ওটা কি? ওটার নিচে একটা বাটি তাতে ঢেঁড়স ভাজি, আমি করেছি। সাদার উপর কাল প্রিন্টের যে ড্রেসটা আমি পরেছি এটাতে আমাকে বেশ মানায়। ও বলছিল ইদানীং আমি নাকি তরকারিতে লবণ বেশি দেই, না হয় একেবারে দেই-ইনা। 

আমার বাথরুমের মগটার রঙ লাল, যদিও বাথরুমে আমি সবকিছু সাদাই পছন্দ করি। এই যে সারাক্ষণ আমার দেয়াল ঘড়িটা টিক টিক শব্দ করে যাচ্ছে এতে আমার ভয়, এ শব্দ কোথায় যে আমাকে নিয়ে যায়! মৃত্যুপুরী থেকে যেন আমি ফিরে আসি। ভয়ে আমি ঘেমে উঠি। আচ্ছা এই যে আমি প্রায়ই ঘেমে নেয়ে উঠি এটা কি আমার ভয় পাওয়ার আগে হয়,না পরে?

না না না সরে যাও আমার কাছ থেকে। কেউ কাছে এসো না আমার। মাথায় আমার প্রচণ্ড ব্যথা। হৃদয়ে হাজারো প্রশ্ন। কারা তোমরা আমার দিকে প্রতিনিয়ত এভাবে তাকিয়ে থাক! ফিরিয়ে নাও তোমাদের চোখ। করুণ চোখে তাকিয়ে থেকেও লাভ নেই, আমি তোমাদের একটু ছুঁইয়েও দেখতে পারবো না। কারণ তোমাদের মলাটে ধুলো জমেছে। তারপরও পড়তাম যদি আমার সব উত্তর খুঁজে পেতাম তোমাদের পাতায় পাতায়।

ইস দেখ দেখ এই যে সারি সারি খেলনাগুলো সাজানো, এত সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে কে? কে আবার -জানোইতো তোমরা। আর লালের পিছনে যে নীল রঙের পুতুলটা দাঁড় করিয়ে রেখে গেছে ওটা আমি ওভাবেই রেখে দিয়েছি। এই দেখ প্রতিটা বুকশেলফের সামনে একটুখানি যে খালি জায়গা তাতে আলপনা করে রেখেছে। না দেখলে বিশ্বাসই করবা না কি চমৎকার ছবি আঁকতো আমার সোনা মানিক। এই যে প্রতিটা আলপনার গায়ে ডলার বসিয়েছে। কোথায় পেয়েছিলি তুই এই ডলারগুলি? আমার ঘরে তো কখনো জামায় বসানোর ডলার ছিল না! কেমন করে তোর ছোট মাথায় এত বুদ্ধি এল!

স্কুল থেকে ফিরে কত সুন্দর করে জুতোমোজা গুছিয়ে রাখতি। নিজেই কলম দিয়ে হাতে আঁকতি আর খেলা শেষ হলে বলতি ছিঃ ছিঃ মুছে দাও! ঘসে ঘসে না উঠানো পর্যন্ত কিছুতেই থামতি না। লাল হয়ে যেত হাতের চামড়া। তোর কি একটু ব্যথাও লাগত না! তুই ঘুমিয়ে গেলে কত যত্নে তোর সেই লাল হওয়া হাতের চামড়ায় লোশন মেখে দিতাম, চুমু খেতাম। তোর নরম তুলতুলে ছোট্ট শরীরটাতে হাজারো চুমু দিয়েও আমার তৃষ্ণা মিটত না ক্যান বাবা!

আহ এই যে ছোট ছোট লাল চেকের ছোট্ট পাঞ্জাবীটা, তোর এই পাঞ্জাবীটা বুকে জড়িয়ে রাখি। আহ এটাতে তোর ঘ্রাণ! হাজারো প্রশ্ন আমার বুকে। তোর শরীরের ঘ্রাণ আমার আজন্ম চেনা, স্নানের পরে তোর শরীর বেয়ে গড়িয়ে পরা প্রতিটা মুক্ত দানার মত জলফোটা আমার চেনা। তোর ভেজা চুল, ভরাবালতির পানি নিয়ে দাপাদাপি তারপর স্নান শেষে তোয়ালে জড়ানো তোর ঘরময় ছোটাছুটি, পেছনে আমি। আরেকটু মুছে দেই, একটু দাঁড়া সোনা। তারপর যখন তোয়ালেটা খুলে পরত শরীর থেকে ন্যাটো তুই দাঁড়িয়ে যেতি, দাঁড়িয়ে যেতাম আমিও, বাহ কি সুন্দর আমার সোনা মানিকটা! বাদামের খোসার মত গায়ের রঙ! দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরতি। আর আমি তোকে কোলে নিয়ে ছুড়ে দিতাম আকাশে!

অনেক প্রশ্ন যে আমার! একটু একটু করে তোর বেড়ে ওঠা, তোর শরীরের প্রতিটা অঙ্গ-পতঙ্গের নড়াচড়া..... অন্যরকম এক খুশির বান বয়ে যেত আমার হৃদয়ে। তোর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে কেটে যেত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কোথা থেকে নিয়ে এলিরে এত মায়া? না না না চোখ লাগবে, চোখ ফিরিয়ে নেই অন্যদিকে, কোন মায়ায় কোন যাদু বলে আবার তাকাই তারপর নিজের মনেই হেসে উঠি। অবুঝ তুই, তুইও হেসে উঠিস আমার সাথে। খেলা চলে দু'জনের মধ্যে। ছ'মাসের ছেলে আর মা'র সাথে।

কেন এত প্রশ্ন আমার? কখন তুই ফিরবি স্কুল থেকে অধীর অপেক্ষায় থাকতাম। এইতো দরজার বাইরে তোর ছোট ছোট পায়ের মৃদু শব্দ, এক্ষুনি কলিং বেল... তার আগেই দরজা খুলে ফেলা। আমার সোনা মানিক এল যে! জড়িয়ে ধরে তোর শরীরের ঘ্রাণ নিতাম। এখনো আমি সেই ঘ্রাণেই ডুবে আছি। ইস কেন প্রশ্নগুলো এত উতলা করে? বরাবরই আমি জড়িয়ে ধরে রাখলে ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করতি। কতদিন আমি তোকে দরজা খুলে ধরতেই পারিনি। তার আগেই তুই ভোঁ দৌড় ঘরের মধ্যে। দরজার পিছনে, পর্দার আড়ালে, সোফার চিপায়। আমিও এমন ভাব করতাম যেন তোকে ধরতেই পারছি না।

প্রতিদিনের মত সেই দিনও স্কুল থেকে ফিরলি। দরজা খুললাম, তোর মুখটা দেখেই বুকের ভিতরে কোথায় যেন একটু কি হল, মুহূর্তেই আবার ভুলেও গেলাম। জড়িয়ে ধরলাম তুই পালানোর চেষ্টা  করলি না সেটে থাকলি শরীরের সাথে। কি মানিক টিফিন খাওনি আজ? বন্ধুর সাথে ঝগড়া হয়েছে? কোন কথা নেই। আমার শরীরের সাথে লেগে থাকা তোর শরীর ভাষাহীন। দেখতে পাচ্ছি না পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মুখটা।

আমিও দরজাতেই দাঁড়িয়ে থাকলাম তোকে জড়িয়ে ধরে। আমাকে ছেড়ে আস্তে আস্তে... প্রশ্নগুলি গিজগিজ করছে মাথাভর্তি... শ্লথ গতিতে কয়েক পা না যেতেই- উহ্ মাথাটা আমার ছিঁড়ে যাচ্ছে...! ঢোলে পড়লি ঘরের মধ্যে। তীরবেগে গিয়ে কোলে তুলে নিলাম। বন্ধ আঁখি, বাক্যহীন মুখ নিয়ে নিথর দেহখানা স্থান নীল আমার কোলে। স্পন্দনহীন। আর্ত-চিৎকারে জ্ঞান হারালাম... তারপর যখন চোখ খুললাম, কখন জানি না দেখলাম আমার সামনে অসংখ্য থমথমে মুখ। সবার চোখ আমার দিকে। আমার চোখ খুঁজছে আমার মানিককে। কোথায় সে? নেই কেন আমার পাশে? কোনো উত্তর নেই কেন? তোমরাকি সবাই বোবা হয়ে গেছ? আকাশে বাতাসে চিৎকার করে প্রশ্ন করেছি কোথায় আমার মানিক সোনা, কোথায় আমার বুকের ধন? কোনো উত্তর পাইনি।

প্রশ্নরা কুড়ে কুড়ে খায় আমায়। আমার ময়নার ছোট্ট মাটির কবরটির গায়ে বুক ঠেকিয়ে ফিসফিসিয়ে কত কথা বলেছি। শুধু একটি মাত্র প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাইনি, তুই কেন এখানে ঘুমিয়ে?

দিব্যি কাজকর্ম করছি। রান্না করছি, রান্নাঘরে আঁচল ধরে তুই। যেমনি থাকতি আগে। প্রশ্ন করি কি হয়েছিল বাবা? দোলনা থেকে পরে গিয়েছিলি? কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল তোকে? স্লিপারের লোহার সাথে মাথায় আঘাত লেগেছিল? রোদে খেলেছিলি? সবাই যে বলে তোর ডান পাশের কপাল থেকে কানের নিচ পর্যন্ত নীল হয়েছিল। কথা বলিস না কেন? উত্তর দে? উত্তর দিতে পারিস না হতচ্ছাড়া, তবে ছাড় আমাকে।

এমন করে কেন মাথার ভিতরে??? বুকটা ফাঁকা লাগে কেন? এই যে লাল ছোট ছোট চেকের ছোট্ট পাঞ্জাবীটা এটা আমার ছেলের। বয়স হয়েছিল ৫ বছর।

নিউজজি/এসএফ

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন