মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ৮ মাঘ ১৪৩১ , ২১ রজব ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
গল্প

বেহিসেবি জীবন

মিম্ মি নভেম্বর ৮, ২০১৮, ১৩:৫৭:৩৯

6K
  • বেহিসেবি জীবন

স্বপ্নের মতো কেটে যাচ্ছিল অনল আর তোয়ার দিনগুলো। 

তোয়া প্রায়ই বলত -আজকাল বেঁচে থাকতে এত ভালো কেন লাগে বলতো? পরিস্থিতির জন্য আমাকে খুব কঠোর কঠিন জীবন কাটাতে হয়। নরম ভাবে সহজভাবে আহ্লাদ করে কারো সাথে কথা বলার সুযোগ নেই। একটু নরম হলেই অদ্ভুত সব ইঙ্গিত আসে। আর ভালো না লাগলে এসব। ব্যাপারগুলো খুব মানসিক চাপ সৃষ্টি করে।

তাই কঠিন হয়ে থাকতে হয় আমাকে। তবে কঠিন থাকার অভিনয় করতে করতে কখন যেন এটাই আমার আসল স্বভাব হয়ে গেছে ! সহজ করে কথা এখন আর আসে না আমার।কিন্তু আমি জানি না কেন যেন তোমার সাথে সহজ ভাবে, আসল আমি হয়ে কথা বলতে আমার ভালো লাগে।’

অনল উত্তর দিয়েছিল--You are very exceptional ! This is very tough.I love ur personality more than your looks.Keep it up.l will be with you.’

তোয়া হাসতে আর বলত-এই যে নেতা সাহেব আর কতজন মেয়েকে বলেছেন এই কথা? 

অনল- তোমাকে তো সবই বলেছি। রাজনীতির সুবাদে অনেক মেয়ের সাথেই ওঠা-বসা হলেও কারো মাঝে তোমাকে খুঁজে পাইনি। আর তোমরা ব্যাপারে আমি সিরিয়াস। আই নীড ইউ। দ্যাটস ইট। ভালো ভাবে না এলে দরকার হলে কন্যাসহ কিডন্যাপ করে তোমাকে নিয়ে আসব আমার বাসাতে। আর তুমি যে আমার কাছে কতখানি প্রায়োরিটি তা টের পাবে যদি কখনো আমার কিছু ঘটে তখন।

তোয়া-কিছু ঘটে মানে কি?

অনল -তোয়াবিবি, আমার টমবয়টা আমাকে এত ভালোবেসে ফেলছিস কেন রে?

দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটছিল দ্রুতই। সামনে জাতীয় নির্বাচন। এর প্রভাব পড়ছিল জাতীয় পর্যায় থেকে জনসাধারণের ঘরেও। সাতান্ন ধারা প্রবর্তন হবার পরে কথা বলতে,লিখতে খুব সাধারণ মানুষগুলোকেও আতঙ্কে থাকতে হয়। অনল প্রায় ই বলতো-দেখ এবার দেশটা বদলে যাবে।পরিবর্তন আসবেই।

এসব শুনলে তোয়ার আনন্দ হতো না। আতঙ্কে নীল হয় যেত সে। এর মধ্যে সন্দ্বীপে নিহত রাজনৈতিক নেতা একরামের মেয়েদের- ‘আব্বু তুমি কান্না করতেছ যে.....’ ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া অডিও ক্লিপটা রীতিমতো পাগল করে দিল তোয়াকে। তোমার সাথেও যদি এ রকম ঘটে তখন কি হবে বল? 

তোয়ার এসব প্রশ্নে অনল বলতো--শুধু আমার কেন যে কারো সাথেই এমন ঘটতে পারে জান। কিন্তু এসব তো বন্ধ হতে হবে।তাই না? আর সেজন্যই তো আমাদের মিশন। আমাদের লেখা বইটা যখন আলোর মুখ দেখবে তখন অনেক অজানা সত্য দেশবাসীর সামনে উঠে সামনে। বলা যায় না রেনেসাঁও ঘটে যেতে পারে দেশে।

-কি বল এসব? তুমি কি ক্যাডার!!! তুমি না বলেছ আমাকে তুমি শুধু দেশের ইতিহাস কাগজে কলমে তুলে রাখতে রাজনীতি কর। কিন্তু তোমার কথা শুনলে এত ভয় লাগে কেন আমার? সত্যি করে বল তুমি কি অনেক বেশি ইনভলভড? মিথ্যা বলেছ না আমাকে অনল?

-না রে পাগলী। সত্যি ই বলেছি তোমাকে। 

তোয়া কে সান্ত্বনা দিলেও অনল নিজেই বুঝতে পারছিল অবস্থা খুব একটা সুবিধার না। অনেক অনাকাঙি্ক্ষত ঘটনা ঘটে যেতে পারে যেকোনো সময়ে। এমনকি দেশের ইতিহাস নিয়ে কাজ করাটাও হয় যেতে দেশদ্রোহীতার সামিল ! কিন্তু এখন আর পেছনে ফেরার উপায় নেই। কলমের থেকে শক্তিশালী অস্ত্র আর কি আছে? আজ না হোক একশ বছর পরে হলেও দেশবাসী হয়তো জানবে সত্যগুলো। সুতরাং লিখতেই হবে। এসব ভাবতে ভাবতে রক্ত গরম হয় উঠে অনলের। 

নির্বাচনের ঠিক দেড় মাস আগে হঠাৎ করে একদিন পুলিশ ওয়ারেন্ট বের হলো অনলদের যে টিমটা কাজ করছিল মিশনটার জন্য ওদের নামে। হাই কমান্ড থেকে নির্দেশ দেয়া হলো গা ঢাকা দেবার জন্য। পরিস্থিতি

ভালো না। দল থেকে সব সামলে নিয়ে জামিনের ব্যবস্থা করার আগ পর্যন্ত সবাইকে সিক্রেট প্লেসে চলে যেতে হবে। 

অনল তোয়াকে ফোনে জানাল পরিস্থিতি। বলল সিলেটে অথবা চট্টগ্রামে আসতে হবে গা ঢাকা দেবার জন্য। চট্টগ্রাম আসতে চাই। তোমার কাছাকাছি থাকা হবে অন্তত। 

ওর ধারনা ছিল তোয়া কান্নাকাটি করে অস্থির হবে। কিন্তু হঠাৎই যেন শক্ত হয় গেল মেয়েটা। খুব জোর গলায় বলল-না চট্টগ্রাম আসবে না। ওরা অবশ্যই তোমার ফোন ট্র্যাক করবে। তখন সহজেই অনুমান করে ফেলবে তুমি আমার কাছে আসতে পার। তুমি সিলেট চলে যাও। আমি মন খারাপ করব না। তোমাকে বাঁচতেই হবে অনল। আমার জন্য, আমাদের সন্তানদের জন্য, এই দেশটার জন্য।

অনল বলল- আর দুটো দিন ঢাকাতে থাকতে হবে। উপর থেকে নির্দেশ এলেই ঢাকা ছাড়ব। ফোন, সিম বদলে ফেলেছি। আর শোন তুমি অবশ্যই তোমার আমার সব টেক্সট ডিলিট করে দাও। আর ফেস বুকে আমাকে ব্লক করে দাও। তোমাকে যেন কোন রকম বিপদে পড়তে না হয় এটা আমার প্রথম কনসার্ন। আমার পরিবার আর আমার এক স্কুল বন্ধু যে আমার দেশের বাড়িতে আছে এরা ছাড়া আর কেউ তোমার কাছে কিছু জানতে চাইলে তুমি বলবে তুমি ব্যক্তিগতভাবে আমাকে জানতে না। প্রমিস কর এটাই বলবা। আমাকে টর্চার করা হচ্ছে বা এর থেকেও ভয়ংকর কোন কথা বলে তোমাকে কেউ ডাকলে একদম যাবে না। রাজনীতি তে অনেক কিছুই ঘটে। তাই তোমার সেফটি নিয়ে আমি চিন্তিত। আর আমাদের কোড ল্যাঙ্গুয়েজগুলো মনে রেখ। আমি যদি কখনো কোন মেসেজ পাঠাই ঐ শব্দগুলো থাকবে তাতে। আর আর্শিকে একদম বকবে না। ও আমাদের জান বাচ্চা।তুমি কাঁদবে না। আমি ফিরে আসব ই।

ফোনের অপর প্রান্তে তোয়ার বোবা কান্না ভাগ্যিস অনল দেখতে পেল না। শুধু শুনল তোয়া বলছে -হুমম আমি ভালো থাকব।

পরদিন সকালে অনল তোয়াকে মেসেঞ্জারে একটা ছবি টেক্সট করল। একটা কালো মাইক্রোবাস রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। তোয়া জানতে চাইলে ঘটনা কি?

অনল বলল- ঘণ্টাখানেক ধরে দেখছি গাড়িটা এখানে। তোয়া বলল- কি করবা? 

অনল-দেখি।

ঐদিন তোয়ার স্কুলে খুব ধকল গেল। একেবারেই সুযোগ পাচ্ছিল না অনলের সাথে যোগাযোগ করার। স্কুল থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হলো। সকালে স্কুল থাকে বলে তোয়াকে রাত এগারোটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তে হয়। ঐ রাতেও অনলের সাথে নয়টার দিকে কথা হলো। অনল তখন কম্পিউটার সিটিতে একটু ব্যস্ত জানাল ওকে। পরে ফোন দিবে বলল।

তোয়া অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে গেল। 

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে রেডি হয় স্কুলে যাবার পথে ব্যাগের ভেতরে মোবাইল বেজে উঠলো তোয়ার। তখনো আটটা বাজেনি। এত সকালে কে ফোন দিল ভাবতে ভাবতে হাত পা ঠাণ্ডা হয় এল তোয়ার। ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করতেই দেখল অনলের ভাইয়ের নম্বর। অনল বলেছিল নম্বরটা সেভ করে রাখতে। কখনো লাগতে পারে। ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে জানাল --আপু ভাইয়াকে আজকে ভোর রাতে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গেছে! 

আর কিছুই শুনতে পেল না তোয়া। সবকিছু ঝাপসা হয় এলো। 

ঐদিন আর স্কুল করা হলো না তোয়ার। তাড়াতাড়ি কোয়ার্টারে ফিরে এল। শুধু ঐদিন না এরপর আরো নয়দিন তোয়া পুরোপুরি বিছানা নিল। প্রচণ্ড জ্বর আর বিপি ফল করল ওর। কিছুই খেতে পারছিল না। তিনদিন পর চ্যানেল ওপেন করে স্যালাইন পুশ করতে বাধ্য হলেন স্কুলের রেসিডেন্ট ডক্টর। 

এগারোটা দিন পার হয়ে গেল মানুষটার কোন খবর কেউ দিতে পারছে না। মানুষটা কি নাই হয় গেল? মানুষটা নাই-এটা মানতে পারছিল না তোয়া। 

এদিকে স্কুল থেকে বারবার নক করছে জয়েন করার জন্য। এত লম্বা ছুটি কাটানো সম্ভব না। কিন্তু তোয়া তখন মানসিকভাবে এতটাই অসহায় যে ওর পক্ষে ক্লাস নেয়া কিছুতেই সম্ভব না। এতটা ভেঙে পড়া আশফাক মারা যাবার পরেও হয়নি তোয়ার। হঠাৎ করেই ভীষণ অভিমান হলো তোয়ার সৃষ্টিকর্তার উপর। নাওয়া খাওয়া সব বন্ধ তার। শরীর চলছে না। মাথাও না। জিদ করে সে বলল --আর কত পরীক্ষা নিবা তুমি আমার? তুমি তো জানতা কতটা পবিত্র ছিল আমাদের সম্পর্কটা। বিয়ের আগ পর্যন্ত অনল আমার হাতটা ধরবে না বলেছিল। তুমি জানতা না এসব? আমরা তো বিয়ে করতাম ই আর কিছুদিন পর। কেন তুমি বারবার আমার জীবন থেকে মানুষ কেড়ে নাও? কেন?

হঠাৎ কি হলো তোয়া রিজাইন লেটার লিখে প্রিন্সিপালকে মেইল করলো। তারপর ব্যাগ গোছাতে বসল। চাকরি বাকরি সে আর করবে না। 

বিধাতা তখনো হেসে যাচ্ছেন তাঁর পাগলী বান্দার কাজ দেখে.....। (চলবে)

নিউজজি/এসএফ

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন