মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ৮ মাঘ ১৪৩১ , ২১ রজব ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
গল্প

মুক্ত বিহঙ্গের হাতছানি

হাসানুজ্জামান জুলাই ৩, ২০১৮, ১৩:১১:১১

6K
  • মুক্ত বিহঙ্গের হাতছানি

ছুটির দিন। অলস দুপুর। সরকারী কর্মকর্তা রেবেকা পারভীন তার ঘরের বারান্দায় রাখা চেয়ারে গাঁ এলিয়ে বসে আছে। না, কেন যেন একটা অস্বস্তি তার মনে ভর করেছে। কিছুই ভাল লাগছে না। আবার উঠে পড়েন। বইয়ের আলমারীর কাছে গিয়ে দাঁড়ান। একটা বই এর দিকে নজর যায়। বইটার নাম ‘জীবন সায়াহ্নে”। বইটা আগে পড়েছেন কিনা মনে করার চেষ্টা করেন। কিছুই মনে পড়ে না। বইটা হাতে নিয়ে পাতা উল্টাতে উল্টাতে বারান্দায় এসে বসেন। এমন সময় কানে ভেসে আসে বাউল সুরের একটা গানের কলি-

‘ভিক্ষা দাও গো মা জননী ভিখারি এসেছে দ্বারে

ফিরায়ে দিলে ফিরে যাব, দাঁড়াবো না কোন অধিকারে।

দু দিনের এই দুনিয়াতে

ধরা পড়েছি হাতে নাতে

ছাড়াতে গেলে পারিনা ছাড়াতে অপঘাতে মরি বারে বারে।

বাউলের দিকে না তাকিয়েই রেবেকা পারভিন কাজের মেয়েকে হুকুম করে, ‘সোহাগী বাউল কে ভিক্ষা দিয়ে এস। সোহাগী একটা পাত্রে কিছু চাল নিয়ে এগিয়ে যায়। বাউলকে চাল নিতে বলে। বাউল মৃদু হেসে বলে এভাবে তো আজ চাল নেব না মা। আজ  এসেছি গুরুর আদেশে সাইজির বানী প্রচার করতে। ‘আগে সাইজির বানী শোনাবো পরে ভিখ্ নেব। এই বলে সে লালনের গান গাইতে শুরু করে- 

‘ মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।

মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই মূল হারাবি।

দ্বিদলে মৃণালে,

সোনার মানুষ উজলে।

মানুষ গুরুর কৃপা হলে,

জানতে পারবি।

মানুষে মানুষ গাঁথা,

দেখ না যেমন আলোক লতা।

জেনে শুনে মুড়াও মাথা,

জাতে উঠবি।

মানুষ ছাড়া মন রে আমার,

দেখবি রে সব শুন্যকার।

লালন বলে, মানুষ আকার,

ভজলে তরবি।

বারান্দায় বসে রেবেকা পারভিন গানটা শুনছিলেন। ভালই লাগছিল। এর আগে এগান রেডিও টিভিতে অনেক বার শুনেছেন কিন্তু এমন তো লাগেনি।

গান শেষ হলে সোহাগী ভিক্ষার পাত্র নিয়ে এগিয়ে যায়। বাউলও তার কাঁধের ঝোলা মেলে ধরতে যাবে এমন সময় রেবেকা মৃদু স্বরে বলে ‘সোহাগী তাকে এদিকে আসতে বল। সোহাগি বাউলকে বলে, ‘আপনাকে খালাম্মা ডাকে। বাউল বলে, ‘তাই বুঝি?” তার পর বারান্দার দিকে পা বাড়ায়। আস্তে করে প্রশ্ন করে, ‘কিছু বলবেন মাতাজি?” রেবেকা বলে, ‘আপনার নাম কি? থাকেন কোথায়?” বাউল সামনে এগিয়ে এসে অন্য দিকে নজর করে বলে, ‘আমার নাম তো জননী দুইটা। এ লাইনে যখন দীক্ষা নিয়েছি তখন গুরু আমার নাম দিয়েছেন দয়াল শাহ্। আর আমার পিতৃ প্রদত্ত একটা নাম ছিল যা এখন প্রায় ভুলতে বসেছি। সেটা হলো নুরুজ্জান। সংক্ষেপে সবাই নূর বলে ডাকতো। জানতে চেয়েছেন? থাকার তো কোন ঠিক ঠিকানা নাই। কথায় বলে না ‘যেখানে রাত সেখানে কাত” আমরা বাউল মানুষ তো এই আর কি।

রেবেকা অপলক নেত্রে বাউলের দিকে চেয়ে থাকে। কিন্তু কিছুই ঠাহর করে উঠতে পারে না। কারণ সারা মুখ খানি দাড়ি-গোঁফ আর চুলে একাকার। তবে নামটা খুব চেনা চোনা মনে হয়। হ্যাঁ মনে পড়ছে আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে সে যখন কেসি কলেজের ছাত্রী ছিল এ নামের একজনকে চিনতো এ কি সেই নূর? যে এখন দয়াল শাহ্ বাউলের চেহারায় তার সামনে দাড়িয়ে।

এবার বাউলকে রেবেকা সরাসরি প্রশ্ন করে বসে, ‘তুমি কি সেই নূর? যে কেসি কলেজে পড়তো? লেখালেখির অভ্যাস ছিল? নিয়মিত স্থানীয় পত্রপত্রিকায় যার লেখা প্রকাশিত হতো?” এক নিশ্বাসে এত গুলো প্রশ্ন ছুড়ে দেয় রেবেকা।

এবার মুখের দিকে চোখ তুলে চাই বাউল, ‘বলে তুমি কে?”

রেবেকা বলে, ‘তুমি বল দেখি আমি কে?”

দুজন দুজনের দিকে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। কেউ কোন কথা বলে না বা ভাষা খুঁজে পায় না। এক সময় নীরবতা ভেঙে বাউল কথা বলে ওঠে, ‘তুমি সেই রেবেকা না?”

: এতক্ষণে চিনতে পেরেছো তা হলে?

: চেনার চেষ্টায় তো করিনি এতক্ষণ। চিনবো কি করে? বলে, বাউল।

রেবেকা কিছুটা বিস্ময়ের সুরে বলে, ‘তোমার সে আগের স্বভাব এতটুকুনও পরিবর্তন হয় নি বলে মনে হচ্ছে। 

: আগের কোন স্বভাব?

: ‘এই যেমন কাউকে জানার বা বোঝার চেষ্টা না করে নির্বিকার ভাব দেখানো।

রেবেকার এ কথায় বাউল যেন নিজেকে অসহায় বোধ করে। কথার মোড় ঘুরিয়ে চলে যেতে চায়। 

রেবেকা বলে, ‘প্রায় পঁচিশ বছর পরে দেখা আর তুমি চোরের মত পালিয়ে যাবার জন্য পথ খুঁজছো। একটু বসে গেলে কি বিরাট কোন ক্ষতি হবে?”

:কি যে বল তুমি? আমার তো লাভ ক্ষতির আশংকা নেই। আমি তো পথের বাউল। যার ঘরই নেই তার আবার ঘর পোড়ার ভয় কি?

রেকোর ইঙ্গিতে সোহাগী চা নাস্তা এনে হাজির হয়। রেবেকা তা পরিবেশন করতে করতে প্রশ্ন করে, ‘তা হলে তোমার ছেলে মেয়ে কয়টি আর তুমি এ পথে এলে কেমন করে?”

নূর কোনো ভনিতা না করে সংক্ষেপে উত্তর দেয়, ‘বিয়ে আর করে উঠা হয়নি। তাই ছেলে মেয়ের কোন প্রশ্নই আসে না। কিন্তু এবার তোমার কথা জানার লোভ সামলাতে পারছি না।

রেবেকা হঠাৎ কেমন যেন অন্য মনস্ক হয়ে যায়। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ‘আমার সবই ছিল। অনেক কিছু পেয়েছি তবু বর্তমানে নিজেকে বড় অসহায় বোধ করি। 

নূর বলে, ‘তোমার কথা তো আমি কিছুই বুঝলাম না। তোমার সবই ছিল অনেক কিছু পেয়েছো আবার বলছো অসহায়।

তখন রেবেকা এক নাগাড়ে বলে যায় তার জীবনের ফেলে আসার দিনগুলির কথা, ‘ইন্টার পরীক্ষা দেবার পর তোমার সাথে আর দেখা হয়নি। মনে মনে তোমাকে কত খুঁজেছি। পরে রাজশাহীতে চান্স পেয়ে সেখানে ভর্তি হয়ে পড়া শেষ করেছি। সরকারী ভাল চাকরিও পেয়ে গেলাম। বিয়ে করে পুরো সংসারী হয়ে গেলাম।

নূর জানতে চাই, ‘সন্তানাদি হয় নি?”

: তাও হয়েছে । দুটি ছেলের মা আমি। তারা পড়াশুনা করছে।

: তাদের বাবা কোথায়? তিনি কি করেন?

প্রশ্নের উত্তর দেবার আগেই রেবেকার স্বাভাবিক মুখাবায়ব বিকৃত হয়ে যায়। সে ডুকরে কেঁদে ওঠে। নূর হকচকিয়ে যায়। সান্ত্বনার বানী খুঁজে পায় না। হতভম্বের মত খানিক তাকিয়ে থাকে রেবেকার দিকে। এক সময় নিজে সামলে নিয়ে বলে আমাকে ক্ষমা করো সত্যি আমি কষ্ট দিতে চাই নি।

রেবেকাও নিজেকে সামলে নেয়। বলে, ‘তোমার আর কি দোষ? তুমি তো আর কিছুই জান না।

এভাবে নীরবে কিছু সময় পার হয়। রেবেকায় নীরবতা ভেঙে প্রথম কথা বলে। বলে, ‘আমার ছোট ছেলের বয়স যখন দু’বছর তখন ঢাকা যাবার পথে রোড এক্সিডেন্টে সে মারা যায়। যেন আমার সুখের সংসারে এক ভয়াবহ আয়লার আবির্ভাব ঘটে। সেকেন্ডের মাঝে সব কিছু সয়লাব হয়ে যায়।

একথা শোনার পরে নূর আবার নীরব হয়ে যায় কি বলবে কিছুই বুঝতে পারেনা।

এবারও রেবেকায় কথা বলে। বলে, ‘আমি কেবল নিজের কথায় বলে চলেছি তোমার কথা তো কিছুই বললে না।

নূর বলে, ‘আমার আর কি কথা? সেই ইন্টার পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি গেলাম কিছুদিন পর বাবা মারা গেল। পরীক্ষার রেজাল্ট হলো। এক সাবজেক্টে ফেল করি। লেখা পড়া আর এগুইনি। শুরু হলো ছন্নছাড়া বাউন্ডেলে জীবন। আজ এখানে তো কাল সেখানে। আর সে কারণেই এ জীবনে আর বিয়ে করা হয়ে উঠে নি। তবে বেশ আছি। বাউল বেশে পথে পথে ঘুরি আর সাইজির বানী প্রচার করে বেড়াই। তাইতো আজ তোমার সাথে আজ পঁচিশ বছর পর দেখা হলো। তা হলে আজ আসি।

রেবেকা আবেগ আপ্লুত হয়ে বলে, ‘আমি তোমাকে ঠেকাবো না। তবে আমার একটা অনুরোধ আছে তুমি রাখবে?”

: হ্যাঁ বল অবশ্যই রাখার চেষ্টা করবো।

: অনুরোধ তেমন কিছু না। আমি জানতাম তুমি এ সময় গান লিখতে। তোমার নিজের লেখা একটা গান আমাকে শোনাবে।

এ আর এমন কি কঠিন কাজ? গানই তো আমার চলার পথের সাথী। গানের মাঝেই তো বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা পায়। গানই তো ভাব জগতের প্রধান আকর্ষণ। তবে বলে রাখি তোমরা যারা সংসারী মানুষ তাদের এই গান ভালো নাও লাগতে পারে। 

নূর উঠে দাড়ায়। এক তারায় সুর বাঁধে তার পর শুরু করে-

‘বাড়িতে রাখে না কারো মরণের পরে

হিন্দু মরলে নেয় শ্মশানে, আর মুসলমানের নেয় কবরে।

ফ্লাট বাড়ী করছে কেহ মনে বড় আশা

ঝড় বাদলে করবে বসত নিয়ে ভালবাসা

মরণ বেটা বাধায় লেটা হানা দেয় সুখের ঘরে।

খাট পালঙ্ক ফুল বিছানা, ছাড়তে হবে ভাই

পরপারের ডাক আসিলে কারো খাতের নাই

রাজা বাদশাহ ফকির মিছকিন সবাই সমান চরাচরে।

অধম বলে দম ফুরালে দেহমূল্যহীন

সবাই তোমার ভুলে যাবে গেলে কিছুদিন

সেদিন কেউ হবে না সংগের সাথী শুধু একায় যাবে সফরে।

গান শেষ করে নূর রেবেকার দিকে তাকাই। দেখে রেবেকা যেন অন্য জগতে চলে গেছে। নূর মনে মনে হাসে। তার পর বলে আজকের মত আসি। 

রেবেকা নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, তুমি তো বেশ আছো। আমার সব থেকেও কিছুই নেই। আমি বড়ই হতভাগী।

নূর বলে, সেদিক থেকে আমি বড়ই ভাগ্যবান। আমার কোনো পিছুটান নেই। ঠিক যেন মুক্ত বিহঙ্গের মত। সারা আকাশ আমার দখলে। একথা বলে এক তারায় সুর তুলে সামনের দিকে পা বাড়ায় নূর।

রেবেকা সে পথের দিকে অপলক চেয়ে থাকে। বলে চেষ্টা করে নূর তুমি কি আমাকে তোমার সাথী করে নিবে কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারে না।

নিউজজি/এসএফ

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন