শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ , ১১ শাওয়াল ১৪৪৫

সাহিত্য
  >
গল্প

নিয়ামতের ঈদ

রওশন রুবী জুন ১৪, ২০১৮, ১৭:১২:০২

3K
  • নিয়ামতের ঈদ

নিয়ামতের আঙুল এফোঁড় ওফোঁড় করে ঢুকে আছে জুতো সেলাইয়ের মোহর। ওর মনে গলছে ব্যথার ঝর্ণা। যার আভাস চোখে-মুখে। তার পেছনে সারের দোকানের মালিক মনিহর। নিয়ামতের উফ্! শব্দটি শুনে ওর দিকে তাকিয়ে দৌড়ে এসে নিয়ামতের আঙুল মুঠোয় চেপে ধরে সর্বশক্তি দিয়ে মোহর ধরে একটান দেয়। মাগো বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকারে প্রকৃতিকে স্তব্ধ করে দেয়। কিছু শালিক তার মাথার উপর কৃষ্ণচূড়ার শাখে শাখে উড়ছিল। ওরা নিশ্চুপ হয়ে অপলক চিৎকার রত বালকের দিকে তাকিয়ে আছে। ভবের মায়া বুঝে সাধ্যি কার? কত মানুষ মুখ ফিরিয়ে চেয়ে চলে যাচ্ছে। আর পাখিগুলো নিস্তব্ধ চেয়ে রইল। 

মনিহরের হাত ভেসে যাচ্ছে রক্তে। তিনি ভেবে পাচ্ছেন না কচু-গেচু খাওয়া গরিবের ছেলের গায়ে এত রক্ত এলো কোথা থেকে? মনিহর গলা বাড়িয়ে মুদি দোকানি সিরাজকে ডাকলেন। সিরাজ এসে অবস্থা বেগতিক দেখে নিয়ামতকে কোলে তুলে নেয়। মনিহরকে বলে, আঙুল ধরে রাখুন। তারপর চলুন পায়ে পা ফেলে। এই বাজারে একমাত্র ঔষধ ব্যবসায়ী কানুলাল। চা বিক্রেতাকে বলে এক কাপ কড়া লিকারের চা দিস্ তো কাদের। সেই মুহূর্তে দোকানে ঢুকে মনিহর, সিরাজ নিয়ামতকে কোলে নিয়ে। কানুলাল কী হয়েছে জানতে চায়। সব শুনতে শুনতে চিকিৎসা দেয় নিয়ামতের। টিটেনাস ইনজেকশান দিয়ে; প্রয়োজনীয় ঔষধগুলো খাইয়ে শুইয়ে দেয় ভেতরে রুগীর। ওর নিমিষেই তন্দ্রা চলে আসে। কেউ তার খোঁজ নিতে আসবে না জানে সবাই।

ছমাস বয়সে মা তাকে একা ফেলে যখন চলে গিয়েছিল, তখন বাবা শোকে দুঃখে মরে মুক্তি পেলেও মুক্তি পায়নি শিশু নিয়ামত। মানুষের অবহেলা অবজ্ঞাকে নিয়তির পরিহাস মেনে নিয়ে রোদে শুকিয়ে, বৃষ্টিতে ভিজে দিনাতিপাত করছে। ঘরহীন মানুষের ঘরের অভাব হয় না কখনও। তাই নিয়ামতের ঘরেরও অভাব নেই। কখনও স্কুল বারান্দায়, প্লাটফর্মে, ফুটপাতে, কোন দোকানের টুলে ঘুমিয়ে বা বসে রাত পার করে দেয় নিয়ামত। সে জানে না মায়ের ভালোবাসা কেমন? শুধু দুদিন হাটবার ছাড়া বাড়ি বাড়ি ঘুরে জুতো সেলাই করে। সেলাই করতে করতে বাড়ির ভেতরের মেয়ে মানুষদের সে গভীর শ্রদ্ধা ভরে দেখে। সে ছোট বলেই তার সামনে কঠিন পর্দা প্রথা ভেঙেও বেরিয়ে আসতে দ্বিধা করে না কেউ কেউ।

সে ভাবে এরাই কেউ তার মা; যে তাকে ফেলে চলে এসেছে। সে খুব কম দামে তাদের জুতো সেলাই করে দেয়। জুতা সেলাইয়ের পর ওরা তাকে যত্ন করে খাওয়ায়। তখন সে অনুধাবন করে মায়ের ভালোবাসা মানেই স্বর্গীয় সুখ। চোখ ভিজে উঠতে চায় সে সময়। সে তখন খাবারের জল দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলে। মেয়ে মানুষেরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলে, কি হইল খাওনের মাঝখানে মুখে জল দিলা ক্যা। ও কিছু বলে না। নলার পর নলা ভাত গিলে কান্না গোপন করে। যে কান্না মায়ের ভালো লাগেনি; সে কান্না কাউকে দেখাতে চায় না।

রাতে দোকান বন্ধ করার আগে কানুলালের দোকান থেকে বেরিয়ে কাছেই সহপাঠি মৃণালদের বাড়ির খড়েরগাদায় আশ্রয় নেয়। সে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়লেও নিয়মিত স্কুলে যেতে পারে না। মৃণালের কাছে পড়া দাগিয়ে নেয়। মৃণালের মা, বাবা একজন মুচি তার ছেলের সহপাঠী এটা ভালো ভাবে নিতে পারে না। স্পস্টই তারা বলে, তুমি যখন তখন ওকে জালাতন করতে এসো না। আজও ওদের বাড়িতে আসতো না। শুধু আর এগুতে পারছে না বলেই এই বাড়িতে ঢুকেছে। গভীর রাতে কাঁপুনি দিয়ে জ¦র এলো। খড়েরগাদার গরমেও গা গরম হচ্ছিল না। কি করবে বুঝে উঠতেও পারছে না। হাতের ব্যথা সন্ধ্যার দিকে বুঝা না গেলেও এখন ফেটে যাচ্ছে পুরো হাত। পেটের মধ্যে খিদে নড়ে চড়ে উঠে। কিছু ভালো লাগছে না। রাত আর কত বাকি, কে জানে।

রাত পোহালেই ঈদ। সবাই যাবে নতুন পোশাক পরে; মিষ্টান্ন খেয়ে ঈদের নামাজ পড়তে। নামাজ পড়ে এসে বাড়িতে পলাও, রোস্ট, রকমারি সুস্বাদু খাবার খাবে। বাড়ি বাড়ি ঘুরতে যাবে। কিন্তু এই হতভাগার কপালে সে সব নেই। কে দেবে তাকে নতুন জামা, জুতো। কে দেবে ফিরনি পলাও। মৃণালদের বাড়ির দুবাড়ি পর হালিম কাকুদের বাড়ি। একদিন কানুলাল ডাক্তার নিচু স্বরে হালিম কাকুকে দেখে বলেছিল, নিয়ামত  ঐযে, ঐলোকটা যাচ্ছে না! ওর বাড়িতে তোর মা আছে। কানুলাল রসিকতা করত দশ বছর বয়সী নিয়ামতের সাথে। তাই রসিকতাই ভেবে নিল, যেদিন হালিম কাকুর বাড়ি গিয়ে পরীর চেয়ে সুন্দর তার বউকে দেখতে পেল। নিশ্চিত হলো কানুলাল কাকু মজা করেছে। মৃণালের বাবা জ¦রের ঘোরে পড়ে থাকা নিয়ামতকে সকালে খড়ের গাদায় অবিষ্কার করে বলেন, আহারে সোনার টুকরা ছেলেকে রেখে পাষাণ হালিমের সাথে সুখে সংসার করছে কি করে? আজ এই জ¦রে যদি ছেলেটা মরে যায়!

ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার হালিম নিহার। আরাম আয়েশ ছাড়া কিচ্ছু বোঝেন না। ওর কথা টাকা পয়সা থেকে কি হবে যদি সুখ ভোগ না করি? সুখকে কিনতে হয়; ভোগ করতে হয়; দখল করতে হয়। সে সুখকে নিত্যদিন কিনে বাড়ি যায়। সুখ কিনতে গিয়ে প্রতিদিন যা উপরি কামাই হয় তা থেকে খরচ করে। তার নিত্য দিনের কেনা সুখের মধ্যে থাকে বউ তান্নার জন্য একটা গোলাপ। মেয়ে তিতিরের জন্য চকোলেট। নিজের জন্য দু‘প্যাকেট বেনসন। বাড়ি ফিরে তান্নার খোঁপায় গোলাপটা গুঁজে দেন হালিম। প্রতিরাত দুটো অব্ধি টিভি দেখা, পেপার পড়া শেষ করে বিছানায় এলিয়ে থাকা পরীটাকে দেখে মনে পড়ে একে দখল করেছে প্রবাসী জহুর আমিনের ঘর থেকে আট ভরি সোনা, পাঁচ শতক জায়গা; নয় লাখ টাকাসহ। খুব ভালোবেসে সব কিছু বউয়ের নামে করে দিয়ে ছিল বোকা জহুর। হালিমের ফুফুদের প্রতিবেশি ছিল এই জহুর। পরীকে আনবার আগে কারণে অকারণেই ফুফুর বাড়ি যেত হালিম।

ঈদের সকালে হালিম নিহারের অন্দর মহলে যখন আনন্দের হুল্লোড়; তখন বাহিরের উঠোনে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে টলমল পায়ে দাঁড়ায় নিয়ামত। কাঁধে জুতো সেলাইয়ের ব্যাগটি। হালিম নামাজ পড়তে বেরিয়ে তাকে দেখে হাসে। বলে, আজও জুতো সেলাই করতে এলি! ওর মুখটা নিকৃষ্ট কীটের মত লাগে নিয়ামতের। যে সন্তান থেকে মাকে আলাদা করে; সে কীট ছাড়া কী? হালিমের পিছু পিছু বেরিয়ে আসা তার পরী বউ বলে, আহারে! আজকের দিনে একটা নতুন জামাও নেই তোর! খেয়েছিস কিছু? সে পরীর মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে।

বুক ভর্তি অভিমান গলা আর চোখ ফেটে বেরুতে চায়। সে কান্না চেপে কষ্টে না বোধক মাথা নাড়ে। তান্না ভেতর থেকে পলাও, রোস্ট, ডিম ভাজা, সালাদ নিয়ে বাহিরে আসে। বলে, ধর খেয়ে নে। নিয়ামত স্বাদ চাখতে চায় মায়ের হাতের খাবারের। কিন্তু শরীরটা কেমন অবস হয়ে আসে। খাবারের স্বাদ চাখতে তান্নার হাত থেকে খাবার নিতে এগিয়ে গিয়ে তার পায়ে হাত ছোঁয়ায়। অপ্রস্তুত তান্না চমকে দু‘পা সরে যেতে যেতে বলে, ছিঃ! ছিঃ! ছুঁবি না! ছুঁবি না! জাত-পাত নেই, আদর করলেই তোরা মাথায় উঠিস্। লাফিয়ে উঠায় তার হাত থেকে খাবারের প্লেটটি পড়ে নিয়ামতের শরীর আর মাটিতে লুটপুটি খায়। মাটি থেকে সেই খাবার তুলে খেতে খেতে তার চোখ গলে জল নামে। পৃথিবী ঘোলা হয়ে আসে। সে লুটিয়ে পড়তে পড়তে চিৎকার করে, যদি চিনতে আমাকে মাগো! তান্নার কানে কথাগুলো তীর্যক বিঁধে। সে ছলছল চোখে কোলে তুলে নিতে চায় নিয়ামত কে। নিয়ামত গোঙায় ছুঁ-বে না! ছুঁ-বেই-না!

নিয়মিতের জ্ঞান ফেরার পর সে দেখে তার মাথার পাশে বসে আছে তার মা।

 

 

নিউজজি/এসএফ

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন