মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ৮ মাঘ ১৪৩১ , ২১ রজব ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
গল্প

অপ্রত্যাশিত তুমি-আমি

মিম্ মি মে ২৮, ২০১৮, ১৪:৫৩:০৯

6K
  • অপ্রত্যাশিত তুমি-আমি

নার্স সুনীতা দি ফাইল আমার হাতে দিয়ে বলল... ম্যাডাম পেসেন্ট এখন স্ট্যাবল। টেম্পারেচার নর্মাল। ফ্লুইড রানিং চলছে। ঘুমাচ্ছে সে।

-আচ্ছা। টেম্পারেচার চার্ট মেইনটেইন করবেন। সকালে CBC আর Urine R/M/E করতে দিবেন।

ফাইলটা হাতে নিয়ে তিয়ানার বাবা কে বসতে বললাম।

জিজ্ঞেস করলাম... আপনার ছেলে?

কোলের পিচ্চি হুড়মুড় করে বলে উঠল-- তুমি ডাক্তার আন্টি ? ইনজেকশন দিয়ে দিবে তিয়ানা কে? কেন দিবে? হাসপাতাল পচা। আম্মুকে লুকিয়ে রেখেছে। এখন তিয়ানাকেও ।

চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল সে।

ভদ্রলোক সামলানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে 'এক্সকিউজ মি' বলে ডক্টরস রুমের বাইরে চলে গেলেন।

সুনীতা দি তখনো দাঁড়িয়ে। বললেন...

কি অবস্থা দেখছেন ম্যাডাম। ভগবানের লীলা বোঝা দায়। এত সুন্দর দুটো বাচ্চা রেখে মা মইরা গেল। বাপ তো দুইদিন গেলেই ফের বিয়ে করবে । কি হবে বাচ্চা দুইটার ?

কপট রাগী গলায় বললাম... দিদি ভদ্রলোক কি আপনাকে বলেছে পাত্রী দেখতে ? খালি নেগেটিভ কথা বলেন। বিয়ে তো নাও করতে পারে। আর করলেই বা আমাদের কি। এত অপ্রয়োজনীয় কথা বলেন না !

সুনীতা দি... ম্যাডাম এই জীবনে তো আর কম পুরুষ মানুষ দেখলাম না । বৌ থাকতেই ছোঁক ছোঁক করে। রোগী নিয়ে আসা বেটাছেলেগুলার তাকানো দেখছেন না ? আর এর তো বৌ মরছে। ভাগ্যবানের বৌ মরে বুঝলেন ম্যাডাম। প্রবাদে আছে 'মা মরলে বাপ হয় তালুই'।

-দিদি কি হচ্ছে এগুলো ? খুব হয়েছে ভবিষ্যৎ বলা।এখন ওয়ার্ডে যান। যা একটা নাইট শুরু হলো আজ। দেখেন আরো কি ঘটে। আমি এশারের নামাজ পড়ে ক্যান্টিনে যাব একটু। চা খেতে হবে । আপনি এদিকটা সামলান।

এশার নামাজ পড়ে মোনাজাত শেষ করে জায়নামাজে বসেই তেপান্তর কে বুকের জড়িয়ে ধরে তিন ফুঁ দিয়ে দেই প্রতিদিন । কেমন যেন শান্তি লাগে। মনে হয় সব বালা মুসিবত থেকে ছেলেটা রক্ষা পেয়ে গেল। নাইট ডিউটি থাকলে নামাজ শেষে ফোন দেই। আজ তো দেরী হয়ে গেছে। বারোটা বাজে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলাম। এতক্ষণে ঘুমিয়ে গেছে বাবাটা আমার।

মনটা অস্থির লাগে ছেলেটার জন্য। বাস্তবতা এত কঠিন হয় কেন যে হয় ! নাইট ডিউটি থাকলেই মন খারাপ হয়ে যায় বাবাটার। ডিনার করে না ঠিকমতো।পানি খায় না।মায়ের কনুই না ধরলে আর ছোট ছোট আঙুলে চুল পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে চুলের গন্ধ না নিলে নাকি তার ঘুম পায় না।

আমার নিজেরও কি ছাই ভালো লাগে তেপান্তর কে ছাড়া। তারপরও কর্তব্য বলে কথা। চাকরিটা আছে বলেই না টিকে আছে।

হঠাৎ করে মনে হলো যার জন্য নামাজ পড়তে দেরী হয়ে গেল তাকে ফুঁ দিয়ে আসি। তিয়ানার মায়া কাড়া মুখটা চোখের সামনে ফুটে উঠলো। গায়ে ওড়নাটা ভালো করে জড়িয়ে তিয়ানা কেবিনের দিকে এগুলাম।কেবিনে সাধারণত সিস্টারকে সাথে নিয়ে যাই আমি। কিন্তু এখন সুনীতা দিদি কে সাথে নেয়া যাবে না কিছুতেই। এমনিতেই দিদি হচ্ছে পুরো হাসপাতালের বিবিসি। অস্বস্তি নিয়েই কেবিনের দরজায় টোকা দিলাম। মনে মনে চাচ্ছি ভেতরের সবাই যেন ঘুমিয়ে থাকে। দুবার টোকা দেবার পরে রেসপন্স না পেয়ে দরজা ঢেলে ভেতরে ঢুকলাম। নিজেকে নিজেই বলছি ---- "আরে টুপুর ব্যাপার না। ডাক্তার তো যেকোনো সময়েই রোগীর বেডে যেতে পারে ফলোআপ দিতে। এত আন ইজি ফীল করার কি আছে? আজব তো! বি স্মার্ট বেবি।"

লম্বা করে একটা দম টেনে নিয়ে পা ফেললাম ভেতরে। সাইড টেবিলের নীল বাতিটা জ্বলছে। তিয়ানা ওর বেডে ঘুমিয়ে। ফ্লুয়িড চলছে তখনো।সোফাতে তিয়ানার বাবা বসে বসেই ঘুমাচ্ছেন।কোলে মাথা রেখে ছেলেটাও ঘুম।

যাক বাবা বাঁচা গেল !

পা টিপে টিপে তিয়ানা বেডের কাছে এলাম।কপালে হাত দিয়ে টেম্পারেচার ফীল করার চেষ্টা করলাম।মুখটাতে এত আদর বাচ্চাটার। চুল এলোমেলো করে দিয়ে তিন ফুঁ দিয়েই ফেললাম চোখ বন্ধ করে। টেনে ধরা দমটা ছেড়ে চোখ খুললাম। চোখ খুলেই ভড়কে গেলাম। সামনে দাঁড়ানো তিয়ানা বাবা।

ডক্টর কোন সমস্যা তিয়ানার ? ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন করলেন।

আমার তো আত্মা কেঁপে যাওয়া অবস্থা।

"রোগীকে ফুঁ দিল চিকিৎসক"... শিরোনাম দেখতে পেলাম প্রথম আলোতে।

নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম... না না আমি জাস্ট রুটিন ভিজিট করতে এলাম। ভালো আছে বাবু।ঘুমাচ্ছে। আপনারাও রেস্ট নিন। অনেক ধকল গেল।

-থ্যাঙ্কস। তৃণও খুব বিরক্তি করছিল তখন। সরি সেজন্য। বললেন তিনি।

-না না অসুবিধা নেই। বাচ্চারা এমন করতেই পারে। কোন সমস্যা হলে নার্সেস স্টেশন জানাবেন। আসছি বলে কেবিন থেকে বের হলাম।

যাক বাবা ফুঁ পর্ব শেষ। ফিক করে হেসে উঠলাম আপন মনে।

(চলমান…)

 

 

নিউজজি/এসএফ

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন