মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ৮ মাঘ ১৪৩১ , ২১ রজব ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
গল্প

অপ্রত্যাশিত তুমি-আমি

মিম্ মি মে ২১, ২০১৮, ১১:৩৯:৪২

3K
  • অপ্রত্যাশিত তুমি-আমি

তিয়ানাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম আমি আর সুনীতাদি। শিশু ওয়ার্ডের এক্সপার্ট নার্স হচ্ছে দিদি। তবে স্যালাইন দেবার জন্য তিয়ানার হাতে চ্যানেল ওপেন করতে বেশ বেগ পেতে হলো। ভেইন পাওয়া সহজ হচ্ছিল না। ওর বাম হাতে বাটারফ্লাই নিডল দিয়ে ভেইন খুঁজছিল দিদি। ছোট্ট ডান হাতটা দিয়ে শক্ত করে আমার একটা হাত ধরে রেখেছিল তিয়ানা। মুখটাতে এত মায়া জড়িয়ে আছে। হঠাৎ করে তেপান্তরের মুখটা ভেসে উঠলো চোখের সামনে। সুইয়ের খোঁচা লাগতেই জড়িয়ে ধরল আমাকে তিয়ানা। মাথার এলো চুলে হাত বুলিয়ে দিলাম। দিদির হাতে ওকে দিয়ে ডক্টরস রুমে এলাম বাকী ফাইলগুলোর কাজ শেষ করতে। ফ্রেস অর্ডার লিখতে লিখতে হারিয়ে যাচ্ছিলাম মনে মনে।
আজ থেকে প্রায় পাঁচ বছর আগে আগে এমন এক রাতে তিন বছরের তেপান্তরকে নিয়ে আমাকেও একা ছুটতে হয়েছিল হাসপাতালে। সকাল থেকে প্রচণ্ড জ্বর ছিল ছেলের গায়ে । সন্ধ্যার পরে আকাশ পাতাল জ্বর।সাপোজিটরি, প্যারাসিটামল,গা স্পঞ্জ,জলপট্টি,মাথায় পানি কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। এত দিন পরেও স্পষ্ট চোখে ভাসে সেই ঝড়ের রাতটা।
 
তখন ঈশান,আমার আর তেপান্তরের সংসার ঈশানের মায়ের বাসায়। কেন যেন চার বছরের সংসার জীবনে ঐ বাসাটাকে কখনোই আমি আমার বাসা, আমার সংসার বলে ভাবতে পারিনি। সেনসিটিভ স্বভাবের বলে ওদের ছোট ছোট অবহেলা , অপমান,অযত্নগুলো ভীষণ ভোগাতো আমাকে। কিইবা করার ছিল আমার?
ঈশানের মা যখন বাইরে যেতেন ফ্রিজ আর মিটসেফ তালা মেরে যেতেন। বুয়াকে ফোন করে বলতেন উনি বাইরে যাচ্ছেন ।তাই আজকে আসতে হবে না কাজে। এত ছোট লাগত নিজের কাছে নিজেকে।এই কথা ঈশান কে বলতেও ভীষণ লজ্জা হতো আমার। প্রথম প্রথম বলিওনি। যখন নিয়মিতই ঘটতে থাকল এ ঘটনা বলতে বাধ্য হলাম।তেপান্তর জন ব্রেস্ট ফিডিং করে। একটু পর পর ক্ষুধা লাগতো আমার।কিন্তু খাবার উপায় ছিল না।
 
বুয়া ছাড়া বাবুকে সামলিয়ে ঘরের কাজ করাও কঠিন হতো। ঈশান কে বলার পর ও বলল... আম্মার বয়স হয়েছে। হয়তো ভুল করে ফ্রিজ, মিটসেফ লক করে যাচ্ছে। তুমিও তো উনি বাইরে যাবার সময়ে বলতে পার চাবি দিয়ে যেতে। আমার কাছে নালিশ না করে। একজন শিক্ষিত মেয়ে হিসেবে এসব টুকটাক সাংসারিক ইস্যু ট্যাকেল দিতে না পারলে রোগী সামলাবে কেমনে? বিরক্ত হয়ে ই বলেছিল কথাগুলো ও।
ঈশান ছিল ওর মায়ের একমাত্র ছেলে। ওর বাবা মারা যাবার পরে ওর মায়ের ডমিনেটিং স্বভাবের একমাত্র টার্গেট হয়ে পড়ে ও। আর কেন যেন ভদ্র মহিলা আমাকে বিশেষ পছন্দ করতেন না। আমার রান্না,কথা বলা, পোশাক,হাসি, লেখাপড়া সব কিছুতেই তার সমস্যা হতো, বিরক্ত ভাব প্রকাশ পেত। সব থেকে বিরক্ত হতেন সম্ভবতঃ ঈশান যখন আমাদের বেড রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করত তখন। যদিও এই ধারণাটা খুবই কুৎসিত কিন্তু এটা সত্য।
 
ঐদিন সকাল থেকেই তেপান্তরের বমি আর জ্বর। ঈশান কে বললাম অফিসে যাবার আগে দুটো মেডিসিন দিয়ে যেতে ফার্মেসী থেকে। ও বলল অফিসে দেরী হয়ে যাবে। বুয়া যখন কাজে আসবে তখন আনিয়ে নিতে। রাগ করে বললাম ছেলের জ্বর এখন 101, বুয়া আসবে দশটার দিকে। মেডিসিনের দরকার এখন। ঈশান টাইয়ের নট ঠিক করতে করতে বলল-- আমাকে অফিসে যেতে হবে টাইমলি। ছেলের ব্যাপারে ঈশানের মনোভাব খুব অদ্ভুত ছিল।
সে ছেলেকে আদর করত।কিন্তু দায়িত্বশীল হতে চাইত না।খুব ছাড়া ছাড়া একটা ভাব কাজ করত ওর ভেতরে। কেন যেন মনে হতো... বৌ আর ছেলেকে আদর ভালোবাসা একটা অস্বস্তিকর ব্যাপার ওর জন্য ! ভাবটা এমন ছিল যেন আমি একাই সবকিছু ম্যানেজ করে ফেলব ছেলের ব্যাপারে। সে শুধু 'ছেলের বাবা' এই গর্বে গর্বিত হবে। কিন্তু এভাবে কি আসলে পরিবার হয় ?
সারাটা দিন ছেলেকে কোলে নিয়ে পরে রইলাম।ঈশানের মাকে একবার বললাম... বাবুর অনেক জ্বর ওষুধ আনা দরকার।উনি যেন শুনতেই পেলেন না আমার কথা। 
 
বুয়া সাড়ে দশটার দিকে এলে তারপর ওষুধ আনালাম। সন্ধ্যার পর থেকে বমি বন্ধ হলেও টেম্পারেচার আরো বাড়ল। ঈশান ফিরল রাত আটটার দিকে।জানালাম হাসপাতালে নেয়া উচিত। সাপোজিটরিতেও কাজ হচ্ছে না। আলগোছে সে বলল... মাত্রই ফিরলাম অফিস থেকে।তোমাদের মা ছেলের যন্ত্রণাতে তো ঘরেই ফেরাই মুশকিল। এই সমস্যা ঐ সমস্যা।
ঠাণ্ডা গলায় বললাম... সকালেই তো দেখে গেছ বাবুর জ্বর।সারাদিনে তো একটা ফোন করেও খবর নিতে পারতে ? কিছু বলেছি সেজন্য? মায়ের কাছে তো ঠিকই ফোন করতে ভুলেনি। ছেলের জ্বরটা কোন কিছুই মনে হচ্ছে না তোমার? বুঝতে পারছ ছেলে কতটা অসুস্থ? টেম্পারেচার 104 উঠেছে মেডিসিন দেবার পরেও।
তেপান্তর কে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে বলছিলাম কথাগুলো।সারাদিনের ক্লান্তি, অবসন্নতা আর অভিমানে রীতিমতো কাঁপছিলাম আমি। এক ধাক্কা দিয়ে ছেলেসহ আমাকে বিছানাতে ফেলে দিয়ে চমৎকার করে বলল ঈশান--আমি পারব না কিছু করতে। 
দড়াম করে রুমের দরজা লাগে বারান্দায় চলে গেল ও।
 
মাথা কাজ করছিল না। ভয় হচ্ছিল। অস্থির আর অসহায় লাগছিল তখন ভীষণ। বাচ্চাটা সারাদিন তেমন কিছু খায়নি। যদি শকে চলে যায়। আর দেরি করিনি।চাদর দিয়ে পেঁচিয়ে কোলে তুলে হাত ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম। নীচের সিঁড়িতে দেখা কেয়ার টেকারের সাথে। রিক্সা ডেকে দিতে বললাম।চাচা জানাল... বাইরে খুব বাতাস হচ্ছে। ঝড় হবে মনে হচ্ছে। এখন বাইরে না গেলে হয় না। রিক্সা মনে হয় পাব না।
বললাম... না চাচা যেতে হবে।বাবুর খুব জ্বর দেখেন কি পান।
 
এরপর বৃষ্টির মধ্যে ছেলেকে নিয়ে রিক্সায় চড়লাম। কোনো মতে পাতলা পর্দা দিয়ে ঢেকে চোখের জলে ডুবে সব থেকে কাছের হাসপাতালে পৌঁছলাম। বাইরে প্রচণ্ড কাল বৈশাখী হচ্ছিল সেদিন আর হাসপাতালের ভেতরে 301নম্বর কেবিনে আমার মনের ভেতরে চলছিল ভাঙচুরের তুফান। কত বার যে ফোন দিলাম তেপান্তরের বাবাকে। ফোন রিসিভ পর্যন্ত করল না সে।
ঈশান এল না ঐ রাতে।
সেদিন ই বুঝে গেলাম এই লোকের সাথে আর যাই হোক এক ছাদের নীচে বসবাস করা সম্ভব না। আমার সাথে যা করে তা তো করেই কিন্তু ছেলের সাথে করা উদাসীনতাগুলো অসহনীয় হয়ে উঠছিল। ভালোবাসা না থাকলেও হয়তো সংসার টেনে দেয়া সম্ভব। কিন্তু দায়িত্ববোধহীন অবিবেচক একজন স্বামী এবং পিতার সাথে সারা জীবন ভুল বোঝাবুঝি আর অশান্তির বোঝা টেনে নেওয়াটা ভুল ই হবে।
দরজায় নকের শব্দে ঘোর ভাঙল।
 
Yes come in বলতেই দেখলাম দরজা ঢেলে সুনীতি দিদা আর তিয়ানা বাবা ঢুকলো। তার কোলে আরেকটা বাবু, তিয়ানার ভাই হবে হয়তো।
 
(চলমান…)
 
 
 

নিউজজি/এসএফ

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন