মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ৮ মাঘ ১৪৩১ , ২১ রজব ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
গল্প

অপ্রত্যাশিত তুমি-আমি

মিম্ মি মে ১৪, ২০১৮, ১৩:১৯:৫০

9K
  • অপ্রত্যাশিত তুমি-আমি

শেষের দিকে রোজ গায়ে হাত তুলতো ঈশান। যখন চুপ করে থাকতাম তখনো। আবার যখন চিৎকার করতাম আমিও ওর সাথে সমানতালে গলা মিলিয়ে তখনো। একদিন হাসপাতালে পর্যন্ত যেতে হলো। ঈশান নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে হাত ধরে নিয়ে গেল ইমার্জেন্সিতে। বাবা'র বয়সী ডাক্তার পরম মমতায় কপালের কাটা জায়গাটা ড্রেসিং করে দিতে দিতে বললেন… মামনি বাথরুমে সাবধানে যেতে হবে।যে বাথরুমে তুমি পা পিছলে পড়ে এতটা ব্যথা পাবে প্রয়োজনে সেই বাথরুমটাই বদলে ফেলতে হবে।

আমি বলব না ঈশান আমাকে ভালোবাসতো না।

ভালো তো ও আমাকে কখনো কখনো নিজের থেকেও বেশি বাসতো। আমি ঠিক বুঝতে পারতাম।

কিন্তু কেন যেন শেষ পর্যন্ত আমাদের টিউনিংটা আর হলো না। সুরটা কেটেই গেল ! ভুল বোঝাবুঝি আর ইগোর পাহাড় জমে কখন যে হিমালয় সমান দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে দুজনের মাঝে টেরই পাইনি কেউই।

অথচ এই আমরা দুজনই কি পাগলামীটাই না করেছিলাম এক সাথে, এক ছাদের নীচে,এক বিছানায় থাকব বলে। তখন মনে হতো বাবা মাসহ পুরো পৃথিবী আমাদের দুজনের শত্রু। তাবৎ পৃথিবী আমাদেরকে দূরে রাখতে যেন সংকল্পবদ্ধ ছিল। শুধু আমরা দুজন চেয়েছিলাম এক হব আমরা। আমি তো কথা দিয়েই ফেললাম... বিয়ে যদি কোন দিন করি তো তোমাকেই করব। নতুবা একে একাই থাকব। ঊনিশ বছর বয়সে ব্রক্ষপুত্রের তীরে বসে প্রিয় মানুষটির হাত ধরে বলা কথাটা ত্রিশ বছর বয়সে এসে কি ভীষণ বোকা বোকা লাগছে।

ঈশানও বলেছিল... ডাক্তার বৌই চাই আমার। যত বছর লাগে লাগুক।পড়া শেষ কর। আমি অপেক্ষা করব।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত কথাগুলো আর রাখা হয়নি দুজনের কারোই।

ঈশানকে ছাড়া একা থাকা আমার হয়নি। ঈশানের জায়গায় নতুন মানুষ যোগ হয়েছে জীবনে। ঈশানের প্রতি আমার সমস্ত অনুভূতিটুকুকে মেনে নিয়েই আমার সাথে থাকার প্রতিজ্ঞা করেছে সে। যদিও এখন আর প্রতিজ্ঞাতে ভরসা করি না আমি। তবে এটুকু বুঝি এই মানুষটা আর যাই করুক আমাকে হারাতে চায় না নিজের প্রয়োজনেই। মানুষটার জীবনের চরম শূন্যতাময় সময়ে তার সাথে পরিচয় হয় আমার।প্রেম ভালোবাসার প্রশ্নই আসে না তখন। আমরা দুজনেই ঘর পোড়া গরু। সুতরাং সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় দুজনেই পাই। কিন্তু নিয়তির বিধান ঠেকাবে কে?

তিয়ানার বাবার প্রেমে পড়তেই হলো আমাকে শেষ পর্যন্ত।তিন বছরের ছোট্ট তিয়ানা আমার রোগী। মা মারা যাবার ঠিক সতেরো দিনের মাথায় হাসপাতালে এসেছিল বাবার কোলে চড়ে।

টানা তিনদিন ধরে নাইট ডিউটি করে মাথা পাগল পাগল অবস্থা সেদিন আমার। অবশ্য কি আর করা ? বৌদ্ধ পূর্ণিমা, শবেবরাত, পহেলা মে সবকিছু মিলিয়ে বেশ বড় ছুটি মেলায় কলিগদের অনেকেই পরিবার নিয়ে আউটিং গেছেন। আমার তো সে অর্থে ঝামেলা তেমন নেই। একমাত্র সন্তানকে নিয়ে হাসপাতালের কোয়ার্টারে থাকি। একজন খালা আছে বাসা আর বাবুকে দেখে রাখার জন্য। পোস্ট গ্রাজুয়েশনের জন্য লেখাপড়া করি। সেই সাথে হাসপাতালের ডিউটি ডাক্তারের জবটা। এর মর্নিং টা,ওর ইভনিং টা,তার নাইটটা করে দেবার অনুরোধ ছিল।

হাসপাতাল আমার কাছে উপাসনালয়ের মতো। ভালোই লাগে থাকতে।আজকেই শেষ নাইট। কাল সকালে থেকে পাক্কা একদিনের ছুটি। 

দশটার মধ্যে নাইট রাউন্ড শেষ করে ফাইল নিয়ে বসলাম ফলোআপ লিখতে। ফ্রেস অর্ডার লিখতে হবে কয়েকটা ফাইলে। প্ল্যান হচ্ছে দশটার মধ্যে রুটিন কাজগুলো শেষ করে ফেলা। তারপর ডিনার শেষ করে লেখাপড়া করব খানিকটা। কোয়ার্টারে ফোন দিয়ে শুনলাম বাবু ডিনার শেষ করেছে। খালা ঘুম পাড়ানি গান শোনাচ্ছে। আমাকে গুড নাইট পাপ্পি দিয়ে সে বলল... মা সকালে কিন্তু তোমার হাতে ব্রেক ফাস্ট করব।

দুটো ফাইলের ফলোআপ লেখা শেষ করতেই সিস্টারের ফোন ম্যাডাম নীচে আসেন ইমার্জেন্সিতে। পেসেন্ট এসেছে।

আজ এতগুলো বছর পরেও আমার স্পষ্ট মনে আছে গোলাপি রঙের ফ্রক পরা এলোমেলো চুলের একটা পরী বাচ্চা দুচোখে টলমল জল নিয়ে বাবার গলা জড়িয়ে বসেছিল ইমার্জেন্সিতে। ভদ্রলোককেও ভীষণ বিভ্রান্ত দেখাচ্ছিল।

মেয়ে বাচ্চা বরাবরই ভীষণ পছন্দের আমার।যখন ইন্টার্ন ছিলাম শিশু ওয়ার্ডে ডিউটির সময়ে প্রতিটা বেড ছিল আমার মুখস্থ।সবগুলোর গাল টিপে না দিলে হতো না আমার। বাচ্চাগুলোও কেন যেন খুব ভালোবাসতো আমায়। তখন সবাই ভেবেছিল pediatrician হব আমি।আমারও ন্যাক ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তা আর হয়নি।ঈশানের সাথে বিয়ের পর থেকেই অশান্তি হচ্ছিল বলে লেখাপড়ায় মন দিতে পারিনি। চার বছরের সংসার জীবনটা ঝগড়া করতে করতেই শেষ হয়ে গেল কখন যেন। ছেলে তেপান্তর জীবনে না থাকলে এতো দিনে হয়তো মরেই যেতাম।

তিয়ানা মা যাবার পর থেকে কিছুই খাচ্ছে না। ঘুমিয়ে গেলে ফিডারে করে দুধ দিলে সেটুকু খেয়ে নিচ্ছে ঘুমের ঘোরে। মা বাবার বেড রুমে ঢুকছে না। ভয় পাচ্ছে। মা কই জানতে চাচ্ছে বারবার। বাসার বাইরে যেতেও ভয় পাচ্ছে।আজ সারাদিন কিছু খায়নি। টয়লেটে হচ্ছে না ঠিকমতো। সন্ধ্যা থেকে গা গরম। থার্মোমিটার দেখলাম 103 ডিগ্রী। চোখ দেবে গেছে।চোখে কোলে কালি।চামড়া পুরো শুষ্ক হয়ে আছে। কোনো মতে চোখ খুলে আছে। খুবই দুর্বল।

এত দেরী করে কেন এনেছেন বাচ্চাকে কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করলাম ভদ্রলোককে। 

মুখ কাঁচুমাচু জবাব দিলেন... আসলে কী করব না করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সব কিছু এত হঠাৎ করে ঘটে গেল। দুটো বাচ্চা নিয়ে হিমসিম খাচ্ছি আমি। অবস্থা কি বেশি খারাপ মেয়েটার ?

ওর দিকে তাকিয়ে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিয়ে নার্সকে বললাম চ্যানেল ওপেন করতে। কুইক।

ভদ্রলোককে জানালাম আমি পেসেন্ট কে ভর্তি করে নিচ্ছি।সকাল পর্যন্ত থাকতে হবে। ডিহাইড্রেসনে ভুগছে বাচ্চা। ফ্লুইড দিতে হবে।

উনি জানালেন ওনার আরো একটা বাচ্চা আছে। ছেলেটা বাসায় কেয়ার টেকারের কাছে আছে এখন। আর কেউ নেই বাসায়। উনি কি ঐ বাচ্চাকে হাসপাতালে নিয়ে এলে আমরা এলাও করব কিনা ?

হঠাৎ করে কেমন যেন মায়া লাগলো লোকটার জন্য। বেচারা স্ত্রী মারা যাওয়াতে ভালোই বিপদে পড়েছে বোঝা যাচ্ছে।

বললাম ঠিক আছে। আপনি মেয়েকে ভর্তি করে নার্সের কাছ থেকে কাগজ নিয়ে মেডিসিনগুলো দিয়ে যান । আমরা চিকিৎসা শুরু করি।রোগী কেবিনে শিফট করা হবে। তখন আপনি ছেলেকে নিয়ে আসবেন। আমি বলে দিচ্ছি ডাবল বেডের কেবিন দেবার জন্য। আপনাদের থাকতে সুবিধা হবে তাতে।

অসংখ্য ধন্যবাদ ডক্টর বলে ভদ্রলোক অদ্ভুত ভাবে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন হ্যান্ড সেইক করার জন্য।

সাধারণত আমাদের দেশে রোগী বা রোগীর লোকেরা লেডি ডক্টরের সাথে হাত মেলায় না। তাই আমি একটু ভেবাচেকা খেলেও সামলে নিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলাম। বললাম... চিন্তা করবেন না । আমি মেয়েকে দেখছি। আপনি ছেলেকে নিয়ে চলে আসুন।

স্পষ্ট কৃতজ্ঞতা ফুটে উঠলো তিয়ানার বাবার চোখে। 

(চলমান…)

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন