মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ৮ মাঘ ১৪৩১ , ২১ রজব ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
গল্প

মায়ের দেওয়া ডিভোর্স

শিরিন ফেরদাউস মার্চ ৮, ২০১৮, ১৬:১৪:০৮

9K
  • মায়ের দেওয়া ডিভোর্স

আমার জন্মের পর বাবা খুশি হতে পারেনি। মুখ ভার করে দাওয়ায় বসে হাঁক দিয়ে আঁতুড় ঘর থেকে মাকে ডেকে বলল ঐ জমিলার মা হুনছো?তোমার এই বার বার মাইয়া পয়দা করা আমার আর গায়ে সয় না। আমারে একটু শান্তি দিবা? এতগুলা মাইয়া জন্ম দিয়া আমার ঘর ভইরা দিসো। আমারে পোলা কবে দিবা কও? হয় মরো নয় এই মাইয়া মাইরা ফালাও। এরে আমি ভাত কাপড় দিতে পারুম না।
 
আমার মা নীরবে চোখের জল ফেলেছেন, বাবার কথার জবাব দিতে পারেননি। পরপর পাঁচটি কন্যা সন্তান জন্ম দিয়ে মা ও লজ্জায় মাথা নত। বাবার মন খুশি করা মায়ের সাধ্যে পড়ে না। তবুও মা পোয়াতি হলেই নাকি সারারাত মোনাজাত দিয়া বসে থাকত আল্লাহ তুমি আমারে একটা পোলা দাও আমার স্বামীরে খুশি করো। কিন্তু মায়ের দোয়া কবুল হয়নি। আল্লাহতালা আমার মায়ের কোলে পর পর পাঁচটি কন্যা সন্তান দেন।
যা হোক আমাদের দিন কেটে যাচ্ছিলো। ঘরভর্তি আমরা পাঁচবোন সারাদিন প্রজাপতি হয়ে উড়তাম। বাবা যে আমাদের আদরস্নেহ করেননি তা কিন্তু নয়। স্নেহ করতেন বুকে দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে রেখে। আমার বাবা ছিলেন একজন অল্পশিক্ষিত দোকানদার। কিন্তু বাবা আমাদের পাঁচবোনকে লেখাপড়া করিয়েছেন। যখন যা দরকার দিয়েছেন। তবে মাকে সারাজীবন বাবা সুযোগ পেলেই গালিগালাজ করেছেন চাপা স্বরে। কেনো মা তাঁকে ছেলে সন্তান দিতে পারেনি।
 
আমরা পাঁচবোনই বাবার এ গোপন দুঃখ জানতাম। তবুও আমাদের বাবাইতো। বাবা বাবাই। আমার চারবোন বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে দেখলে ও আমি বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে নিতে পারিনি। আমি সবসময় খেয়াল করেছি হাজার আদর স্নেহ দ্বায়িত্ববোধের ভেতরও কোথায় যেনো আমাদের প্রতি একটা অবহেলা করতো বাবা। আমরা কোনো অন্যায় করলে আমাদের যে বকাঝকা করতেন তাতে কোথায় যেনো একটা জেদ মেশানো থাকতো। আমার বিষয়টি ভালো লাগতো না। যেদিন থেকে আমি এ সত্যটি বুঝতে শিখি সেদিন থেকে বাবার সাথে আমার সম্পর্কের অনেকটা দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়।
আমরা পাঁচবোন আজ প্রতিষ্ঠিত। ভালো রোজগার করি। বাবা মা বৃদ্ধ। আমাদের কাছেই থাকেন। বাবা ঠিকমত হাঁটাচলা করতে পারেন না। আমরা পাঁচবোনই বাবা মাকে যথেষ্ট সেবাযত্নে রাখি। কখনও একবিন্দু অবহেলা করি না। মানে আমার বাবার শেষ বয়সে ছেলের উপর নির্ভর করার যে মানসিক প্রবণতা থেকে দীর্ঘশ্বাস পড়তো তার কোনো শূন্যতাই আমরা রাখিনি। তবুও আমার বাবার যেনো লুকানো দীর্ঘশ্বাসটি দমিয়ে রাখা যেতো না।
 
একদিন বাবা বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমার মাকে চাপা গলায় বড় চোখে শাসন দেখায় কুৎসা দেয়- ‘পারিস নাইতো আমারে একটা ছেলে দিতে! বান্জা মাইয়া লোক। মা ও চাপা গলায় উত্তর দেয়- ‘ছেলে জন্ম দিই নাই বলে আমি বান্জা? পাঁচটা মাইয়া যে জন্মদিলাম এগুলো কি সন্তান নয়? বাবা উত্তর দেয় আজকাল খুব মুখের উপর কথা বলতে শিখছো। বেকুব মহিলা। ১০০ মাইয়া সন্তান জন্ম দিলেও মাতৃত্বের কোনো তৃপ্তি নাই। মাতৃত্বের তৃপ্তি পাইতে হলে ছেলে সন্তান জন্ম দিতে হয়।’
আমার বোকা সোকা মা সেদিন অগ্নির মত জ্বলে উঠেছিলো। মা ৬৫ বছর বয়সে সেদিনই ডিসিশান নিলো আমার বৃদ্ধ বাবাকে মা ডির্ভোস দেবেন। আমি ছাড়া আমার অন্য বোনেরা এই কথা শুনে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। মাকে বুঝাতে গেলো। মা এই বুড়ো বয়সে কি আবল তাবল ভাবছো। কিন্তু আমার মা তার সিদ্ধান্তে অনড়। তিনি বাবাকে ডিভোর্স দেবেনই।
 
মায়ের সিদ্ধান্ত একেবারে পাকাপোক্ত। তাই মা আমাকে বললেন তুই কি আমাকে একটু সহযোগিতা করবি? শুনেছি ডির্ভোস দিতে হইলে আগে উকিলের কাছে যাইতে হয়। আমারে নিয়া যাবি? আমি মায়ের চোখের দিকে তাকালাম। আমার মায়ের চোখ দুটি জ্বলছিলো দাউদাউ করে।
মা যেনো আজ তার সারাজীবনের অপমানের জবাব ছুঁড়ে মারবেন। আমি মায়ের হাত ধরে বললাম চলো মা আমি তোমায় নিয়ে যাবো। মা আমার হাত ধরে ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। আমি আর মা পাশাপাশি গাড়িতে বসে আছি। যেতে যেতে আমি ভাবছি, ছেলে সন্তান মানুষ কেনো চায়? নির্ভরতার জন্যে? না পুরুষ জন্ম দেওয়ার বীরত্ব দেখানোর জন্যে?
 
 

নিউজজি/এসএফ

 

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন