মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ৮ মাঘ ১৪৩১ , ২১ রজব ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
গল্প

পাথর সময়!!!

রেজওয়ানা আফরোজ মার্চ ৮, ২০১৮, ১১:৫৭:১২

6K
  • পাথর সময়!!!

২০০৩ সাল, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমদিন। দুরুদুরু বুকে মমতাজউদ্দীন কলাভবনে পা রাখলাম। যে দিকেই তাকাই সব অচেনা মুখ। মা বলে দিয়েছেন চোখকান খোলা রেখে চলতে। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ক্লাসরুমে ঢুকলাম।

আজ আমাদের ওরিয়েন্টেশন ক্লাস। ডিপার্টমেন্টের স্যার’দের সাথে পরিচয় হলো। আর ১৫ দিন যেতে না যেতেই ক্লাসের সবাই কেমন করে যেন আপন হয়ে গেল। পুরোদমে চলতে লাগলো বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। ক্লাস, আড্ডা, পরীক্ষা, বন্ধুদের জন্মদিন সব মিলিয়ে চরম ব্যস্ত জীবন। 

ক্যাম্পাসে ঢুকলেই মনে হতো আপন জগতে প্রবেশ করলাম। অচেনা অজানা একটা পরিবেশ কিভাবে যেন জীবনের অংশ হয়ে গেল। কিন্তু জীবনের এই অংশ-ই যে আজীবন আমাকে তাড়া করে ফিরবে আমি তখন স্বপ্নেও ভাবিনি। স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয় আমার কাছে আজীবন একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে রইল!

১ম বর্ষের পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলো। রেজাল্ট দেখে তো আমি মহাখুশি। আমার আজীবনের স্বপ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবো। আমি গুটি গুটি পায়ে আমার স্বপ্নের দিকে এগুচ্ছি। ২য় বর্ষের ক্লাস শুরু হলো। মন দিয়ে ক্লাস করছি। তবে একজন শিক্ষকের ব্যাপারে আমার কেমন যেন খটকা লাগতে লাগলো যিনি ১ম বর্ষেও আমাদের ক্লাস নিয়েছেন। ওই স্যার ক্লাসে আসার পরপরই আমাকে দাঁড়াতে বলতেন। প্রথমে আমি ভাবতাম আমার রেজাল্ট ভালো হবার জন্য স্যার বোধহয় আমার প্রতি বিশেষ মনোযোগী। আমার মা’কেও বিষয়টা বলায় মা-ও আমাকে তাই বললেন। কিন্তু স্যারের এই মনযোগ যে ধীরে ধীরে অন্যরকম কিছু ইঙ্গিত করছে তা বুঝতে আর আমাদের ক্লাসের কারোর বাকি রইলনা। স্যার কারণে অকারণে আমাকে তার রুমে ডাকতেন।

টিউটোরিয়াল পরীক্ষার সময় হঠাৎ এসে সবার সামনে আমার হাত চেপে ধরতেন। স্যার হয়তো কোনো কনফারেন্সে বিদেশে গিয়েছিলেন। দেশে ফিরেই ক্লাস ভর্তি স্টুডেন্টদের সামনে তিনি আমাকে তার রুমে ডাকতেন কারণ বিদেশ থেকে তিনি আমার জন্য অনেক কিছু নিয়ে এসেছেন, আমাকে সেগুলি দিবেন। আমি বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছি হঠাৎ লক্ষ্য করতাম স্যার আমার দিকে এক্স-রে-এর মত দৃষ্টি নিয়ে অপলক তাকিয়ে আছে। এভাবেই চলছিল...

এক ধরণের আতঙ্কে আমার দিন পার হচ্ছিল। একদিন স্যার আমাকে তার রুমে যেতে বাধ্য করেন। ফেল করার ভয় আমারও ছিল। আমি আমার একজন বন্ধুকে আমার সাথে যাবার জন্য অনুরোধ করি। সে বলে, সে যাবে কিন্তু বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে। আসলে সবাই ভয় পেত যদি স্যার তার সাবজেক্টে ফেল করিয়ে দেয়। তাই আমি আমার বন্ধুর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকার প্রস্তাবেই রাজি হয়ে যাই। আমি খুব ভয়ে ভয়ে স্যারের রুমে ঢুকি। স্যার আমাকে বসতে বলেন। আমি বসি। তিনি প্রায় আমার গা ঘেঁষে আমার পাশে বসেন। যে কারণে আমাকে ডেকেছিলেন তার ধারেকাছেও কোনো কথা তিনি বললেন না। আমি চলে আসতে চাইলে তিনি আমাকে ঘরের দরজা বন্ধ করতে বলেন। সে সময়ের অনুভূতি আমি আসলে লিখে প্রকাশ করতে পারবো না। 

সময় যেন হঠাৎ থেমে গিয়েছিল। দুই চোখ শুধু ঝাপসা হয়ে উঠছিল।আমার মাথা কাজ করছিল না। আমি কোনো কিছু আর না ভেবে দৌড় দিয়ে রুমের বাইরে আসি। আমার বন্ধু আমাকে স্বাভাবিক হতে বলে আর কাউকে ঘটনা জানাতে নিষেধ করে। সেদিন আমি আর কোনো ক্লাস করতে পারিনি। বাড়ি এসে মা’কে সব বলি। মা বুঝতে পারেন না কি করা উচিত! একদিকে আমার পড়ালেখা, আরেকদিকে আমার জীবন। দেখতে দেখতে আমার ২য় বর্ষের পরীক্ষা শুরু হয়ে যায়। ২য় দিন ছিল পরিসংখ্যান পরীক্ষা, ফার্স্টক্লাস পাবার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। আমার সব কমন ছিল। স্যার ছিলেন রুমের দায়িত্বে।

এক ঘন্টা যাবার পর হঠাৎ করে স্যার আমার পাশে এসে বলেন, আমি নকল করছি। একজন ম্যাডামকে দিয়ে আমার বডি সার্চ করাল এবং আমার খাতা কেড়ে নিল। যেহেতু বডি সার্চ করে কোনো কিছু পাওয়া যায়নি তাই ১৫ মিনিট পরেই আমাকে খাতা দিয়ে দেয়া হলো। কিন্তু

আমাকে আমার পরীক্ষার সিট চেঞ্চ করতে হলো এবং ৪ ঘণ্টার পরীক্ষায় একাধিক বার আমাকে সিট চেঞ্চ করানো হলো। আমার মনে হয় যারা আমার লেখাটি পড়বে তারা অনায়াসেই বুঝবে এরপর আমার পরীক্ষা কেমন হতে পারে !

আমি আর না পেরে বাড়ি এসে মা’কে এর একটা সমাধান করতে বলি। আমার ডিপার্টমেন্টের একজন স্যার মায়ের ছাত্র ছিলেন। মা আমাকে তার কাছে নিয়ে যান। সব শুনে স্যার বলেন, ঐ স্যার এর আগেও ছাত্রীদের সাথে এরকম ঘটনা ঘটিয়েছে কিন্তু প্রমাণের অভাবে ডিপার্টমেন্ট তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। স্যার বলেন, চেয়ারম্যান স্যারের সাথে কথা বলে তিনি আমাদের জানাবেন, আমি যেন নিশ্চিন্তে পরীক্ষা দিই। পরদিন সন্ধ্যায় চেয়ারম্যান স্যার বাড়িতে ফোন করে মা’র সাথে কথা বলেন আর বলেন অভিযোগ জানিয়ে ডিপার্টমেন্টে একটা দরখাস্ত করতে। আমি ও মা মিলে দরখাস্ত জমা দিবার সিদ্ধান্ত নিই। তবে মা স্যারকে আমার নাম প্রকাশ করতে নিষেধ করেন। স্যার রাজি হয়ে যান। আমরা বুঝতে পারি সামনে অনেক কঠিন সময় আমার জন্য অপেক্ষা করছে কিন্তু আমার মনে হলো মা সঙ্গে আছে আমার ভয় কি.....

একটা বিষয় ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারিনি যে, এখানে আমার ডিপার্টমেন্টের কতিপয় শিক্ষকের ইচ্ছে পূরণের হাতিয়ার হয়ে গেছি অলরেডি তখন আমি।

প্রতিটি কর্মস্থলেই গ্রুপিং থাকে যা এখানেও ছিল। যার কারণে এই ঘটনার পর অতি প্রিয়ভাজন শিক্ষকেরও আমি অপ্রিয় হয়ে উঠি। কিছু শিক্ষক আমাকে সমর্থন জানায় আর কিছু শিক্ষক আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকায়। এমন কি কিছু সহপাঠী’র মধ্যেও আমার  প্রতি এক ধরণের উদাসীনতা লক্ষ্য করি আমি, যদিও অধিকাংশ সহপাঠী-ই আমাকে সমর্থন জানিয়েছিল। কিন্তু সে সমর্থনের ধরণটি ছিল মৌন। আর এই মৌনতার ধরণ টি ছিল চূড়ান্ত প্রশ্নবোধক। প্রতিদিন ক্লাসে গিয়ে ওদের চোখ-মুখ আর কথা বলার ধরণ দেখে আমার মনে হতো হাজার প্রশ্ন ওরা আমার দিকেই ছুঁড়ে দিচ্ছে। ডিপার্টমেন্টের যারা সিনিয়র ভাই, আপা’রা ছিল তারা এমন সহানুভূতির দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসতো যে বুঝাই যেত সবই দেখানো।

যারা জুনিয়র ছিল তারা যে স্পষ্টতই আমাকে নিয়ে ফিসফিস করত আর আমি যেন দেখে না ফেলি এমনভাবে আমাকে আরেকজনকে আঙুল দিয়ে চিনিয়ে দিত। এসবের চেয়ে সামনে এসে সরাসরি প্রশ্ন করাটাই আমার জন্য বোধহয় সম্মানজনক ছিল বেশি। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন যারা নতুন ভর্তি হতো তারাও আমাকে একবার হলেও দেখতে আসতো। অন্যান্য ডিপার্টমেন্ট থেকেও যে আসতো না তা নয়। বলতে গেলে আমি তখন সার্কাসের জীব ছাড়া আর কিছুই না। ডিপার্টমেন্ট বিভিন্ন কমিটি গঠন করে বার বার আমাকে ডাকতো বিভিন্ন প্রশ্ন করে তথ্য উদ্ঘাটন করার জন্য।

দু’জন স্যার নিয়মিত আমার বাড়ি আসতে লাগলো। তারা আমাকে বিভিন্ন ভাবে রণে ভঙ্গ না দিবার জন্য বুঝাতে লাগলো আর আমিও তাদের কথায় ভীষণভাবে প্রভাবিত হতে লাগলাম, মনে হতে লাগলো আমার অসম্ভব শ্রদ্ধেয় শিক্ষক’রা নিজে বাড়ি এসে আমাকে এভাবে মানসিক সাহস দিচ্ছেন, এটা ক’জনের ভাগ্যে হয়! আমি খুব গর্বিত আর সম্মানিতবোধ করতে লাগলাম। কিন্তু এসবের পিছনে যে ডিপার্টমেন্টের কিছু শিক্ষকের ইচ্ছা পূরণের গল্প লুকিয়ে আছে সে কথা আমরা একটুও আন্দাজ করতে পারিনি। এখানে স্বার্থ না বলে ইচ্ছা বলার পেছনে একটা কারণ আছে।

একজন চরিত্রহীন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ডিপার্টমেন্ট শুধুমাত্র প্রমাণের অভাবে এতদিন পর্যন্ত কোন এ্যাকশন নিতে পারেনি। বহু ছাত্রী তার লালসার শিকার হয়েছে কিন্তু সাহসের অভাব আর মান সম্মানের ভয়ে তারা কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। আর আজ যখন আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি তখন আমার ডিপার্টমেন্ট কোনভাবেই সুযোগটা হাতছাড়া করতে চায়নি। আসলে তখন আমার সমস্যার চেয়ে ডিপার্টমেন্ট তার নিজেকে নিয়েই অধিক ব্যস্ত ছিল। আমাকে সামনে দাঁড় করিয়ে তারা যে কোন উপায়ে সেই শিক্ষককে ডিপার্টমেন্ট থেকে তাড়াতে চাইছিল। শেষ পর্যন্ত হলোও তাই। কিন্তু রঙ চং বাড়িয়ে সমস্তটুকু এসে পড়লো আমার উপর।

আমার সাথে যতটুকু হয়েছিল ঠিক ততটুক্ইু আমি বারবার লিখিত এবং মৌখিকভাবে বলেছি। এতটুকুও বাড়িয়ে বলিনি। কিন্তু পরে আমি বুঝতে পারি এর বাইরেও আরো কিছু বলা হয়েছিলো যা ছিল সম্পূর্ণ আমার অজানা। স্যারকে সাসপেন্ড করা হলো। এরপর ওই স্যার স্টাডি লিভের ব্যবস্থা করে পি.এইচ.ডি করতে মালয়েশিয়া চলে যায়।

আমার মনে হতে লাগলো আমার সহপাঠী’রা কেন যেন আরো বেশী করে আমাকে এড়িয়ে চলছিল দু-একজন ছাড়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের দামাল দিনগুলি আমার কাছে ক্রমেই অসহনীয় হয়ে উঠছিল। আমি ক্যাম্পাসে যাওয়া কমিয়ে দিলাম। আমি ততদিনে বুঝে গিয়েছিলাম আমার সমস্ত স্বপ্ন শেষ। আমার কিচ্ছু ভাল লাগতোনা। প্রচণ্ড ঘেন্না হতো ডিপার্টমেন্ট এর সে সমস্ত শিক্ষকদের প্রতি যারা আমাকে তাদের গুটি হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করেছেন। একসময় সিদ্ধান্ত নিই ওখানে আর নয়, আমি অনেক দূরে কোথাও চলে যাব। কিন্তু পরে মনে হয়, চলে গেলে সবার মনে হওয়াটাই সত্য বলে প্রমাণিত হবে। আমার পক্ষে এই পরাজয় মেনে নেয়াটা কোনভাবেই সম্ভব না। নিজের ভেতরের সব খারাপ লাগা, সমস্ত বৈরি পরিস্থিতিকে মাটি চাপা দিয়ে নতুন করে আবার পড়ালেখা শুরু করি কিন্তু চাইলেই কি আর অতীত ভোলা যায়?

এভাবে প্রায় ১ বছর কেটে গেল। ততদিনে বাড়ি থেকে আমার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়েছে। আমি চাইলেও বাবা-মার শান্তির কথা চিন্তা করে আর 'না' করতে পারিনা।

একদিন খুব সকালে আমার একজন বন্ধুর ফোনে ঘুম ভাঙে। ও আমাকে বলে মালয়েশিয়াতে স্যার ১৬ তলার বারান্দা থেকে পড়ে মারা গেছেন। ওর বলার মধ্যে এমন কিছু ছিল যাতে মনে হলো স্যারের মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী। স্তব্ধতা কাটিয়ে উঠে রোজকার মত ক্যাম্পাসে গেলাম। বাস থেকে নামা অবধি ক্লাসে যাওয়া পর্যন্ত এবং ক্যাম্পাস থেকে বাড়ি আসা পর্যন্ত চেনা অচেনা প্রত্যেকেই আমাকে এই খবরটা দিতে ভুলল না।

এর মাঝে কেটে গেছে ১২ টি বছর। এই ১২ বছরে আমি এক মুহূর্তের জন্যও আমার অতীতটাকে ভুলতে পারিনি, ভুলে থাকার চেষ্টা করেছি মাত্র। এখন আমার মেয়ের বয়স ১০ বছর। মাঝে মাঝে আমার মেয়েকে নিয়ে আমি ওর স্কুলে যাই। একদিন মেয়েকে ক্লাসে দিয়ে বাইরে বসে আছি। হঠাৎ করে সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চরিত্র নিয়ে গল্প শুরু করল। আমিও শুনছি। একজন এসময় সেই স্যারের নাম নিয়ে কথা তুলল যার সারমর্ম করলে দাঁড়ায়, স্যারের চরিত্র একটু আধটু খারাপ ছিল বটে তবে তার মৃত্যুর জন্য ওই মেয়েটাই দায়ী। আর আমি সেই মেয়েটি সেখানেই উপস্থিত অথচ এত বছর পরও আমার বলার কিছুই ছিলনা। খুব ইচ্ছে করছিল চিৎকার করে ওদের বলি-

‘‘ বিশ্বাস করো আমি দায়ী নই.....’’।

কোনো অপরাধ না করেও আজ পর্যন্ত অপরাধের বোঝা বইছি আমি। মাঝে মাঝে ভীষণ ক্লান্ত লাগে, বুঝতে পারি না কি করলে, কোথায় গেলে একটু শান্তি পাবো আমি...

সত্যি কি অভিশপ্ত আমি.....???

লেখক- প্রভাষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, শাহমখদুম কলেজ, রাজশাহী।

নিউজজি/এসএফ

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন