মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ৮ মাঘ ১৪৩১ , ২১ রজব ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
গল্প

পুনর্জন্ম

আবু সাঈদ তুলু মার্চ ২৯, ২০১৭, ১৪:১১:১২

6K
  • পুনর্জন্ম

বাবার বলে যাওয়া গোপন কথাটিই বারবার কানে বাজতে থাকে। সূর্য তখনও অস্ত যায়নি। আকাশের লাল গোধূলীরক্তিম প্রকৃতি। সিদাম সন্ধ্যালগ্নের নীরবতাকে উপেক্ষা করে বৃক্ষের মতো শক্ত ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে সূর্যের দিকে মুখ করে। সূর্যের লাল আলোয় উদ্ভাসিত তার মুখমণ্ডল। চা বাগানের অপার সবুজ দিগন্ত বিস্তৃত সৌন্দর্যরাশি তাকে মুগ্ধ করে না। সীমাহীন আকাশ তাকে উদ্বেলিত করে না। কিংবা দিগন্তের গভীরতাও হারিয়ে দেয় না।

তাহলে কী এ সূর্যের মতো ঢলে পড়ার অভিলাষ সিদামের! ধূমকেতু কিংবা আতশবাজির মতো ঔজ্জ্বল্যে জ্বলে অনিমেষ হারিয়ে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর! চারদিক তখনও রক্তিম আভায় উদ্ভাসিত। সিদাম একবার তাকায় নিজের দেহের দিকে। দেহের ভিতরে হাড়গুলো ঠক ঠক করে কাঁদতে থাকে। কাঁপতে থাকে হাড়ের সাথে লেগে থাকা অপুষ্ট অস্থি-মজ্জা। কঙ্কালসার দেহের ভাঁজে যে অভুক্ততার ছাপ ফুটে উঠেছে সিদাম সেটি  টের পায়। সবুজ চা গাছের উপর দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে হালকা বাতাস। বাতাসকে কখনো বেগুনি কখনো বা চা পাতার রঙের ঢেউ মনে হয়।

 

সিদাম নিজের দেহের অভ্যন্তরে টের পায় অট্টহাসি। অনুভব করে এ হাসি তার বাবা কিংবা তার হাড্ডিসার অভুক্ত মায়ের। এ চায়ের বাগানে নামমাত্র পারিশ্রমিকে অনাহারে অভুক্তে শ্রম দিয়ে কোনো সুখ কিংবা জীবনের আনন্দ না পেয়েই এ জগত থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। নিজের অস্থিমজ্জায় যেন সেই বাবা-মায়ের অট্টহাসিই শুনতে পায় সে। আজকের সন্ধ্যাটা সিদামের কাছে জীবনের অন্যান্য সন্ধ্যার চেয়ে কেন জানি একটু অন্যরকমই মনে হয়। লাল আকাশকে ম্লান করে দিয়ে ধীরে ধীরে কালো অন্ধকারের চাদরে ঢেকে যেতে শুরু করেছে প্রকৃতি। সিদাম তখনও ঠিক দাঁড়িয়েই।

আত্মউপলব্ধির এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে থাকে ক্রমশ। যেদিন ট্রাকের মধ্যে গরুর মতো রশি ধরে দাঁড় করিয়ে তার বাবা-মাকে  বাগানের মালিক যখন এ বাগান থেকে অন্য বাগানে নিয়ে যাচ্ছিল তখন সিদামের কানে কানে বাবা-মা একটা গোপন কথা বলেছিল। সে কথাটা জীবনে কখনো ভোলেনি সিদাম। কিন্তু কী করবে সিদাম। মুক্তি পাবে কী এ নিয়তির পরিহাস থেকে? তারও যে হাড্ডি-কঙ্কালসার হয়ে ধীরে ধীরে নুয়ে পড়বে দেহ। হয়ত সেদিনের বাবা-মার মতো সিদামও তার সন্তানদের কানে কানেও বলবে সেই একই বীজমন্ত্র। কিন্তু তারাও পাবে কী পরিত্রাণ!

 

হঠাৎ সিদামের চৈতন্য ফিরে আসে। সিদাম সামনে একটি চা গাছের পাতা নড়ে-চড়ে উঠতে দেখে তাকায়। চারদিকের সব চা গাছ তখন অনেকটা স্থির। অথচ একটি চা গাছের নড়াচড়া সিদামকে মনোযোগী করে তুলে। অন্য ভাবনাগুলো থেকে মন বাস্তবতায় ফিরে আসে। সিদাম এগিয়ে যায় সামনের দিকে। হঠাৎ বুঝতে পারে চা গাছের পাতায় একটি সাপ খেলা করছে। একটু এগিয়ে স্থির দাঁড়ায় সিদাম। মনটা যেন সামনে যেতে নিঃশেষ করে। 

মাথাটা নিচু করে একটুখানি কী জানি ভাবে সিদাম। তারপর ঘুরে দাঁড়ায় নিজের ঝুপড়ির ঘরে ফেরার জন্য। অন্ধকারের চাদর তখন আরও গভীর হয়ে জড়িয়ে ধরছে প্রকৃতি। বাড়ি ফিরতে ফিরতে সিদাম পুনরায় অনুভব করতে থাকে তার অস্থিমজ্জার গভীরে বাজছে বাবা-মায়ের অনাহারের কাতরধ্বনি-অট্টহাসি।

 

নিউজজি/এসএফ

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন