মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ৮ মাঘ ১৪৩১ , ২১ রজব ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
গল্প

দস্তখত

অতনু দাশ গুপ্ত নভেম্বর ২২, ২০২৪, ১২:৪৩:০৮

208
  • ছবি: ইন্টারনেট

শ্যামল আর অস্মিতার কোর্টে জরুরি সাইনের প্রয়োজন। প্রবাসে স্থায়ী নাগরিকত্বের আবেদন করবে শ্যামল। সব কাগজপত্র মোটামুটি তৈরি । এখন বাকি খুবই গুরুত্বর্পূণ  দলিলের এফিডেভিড ম্যাজিস্ট্রেটের একখানা মূল্যবান স্বাক্ষর। দিন ধার্য করা হয়েছে সোমবার৷

কয়কেদনি বন্ধের পর কোর্ট খুললে যা হয় তা-ই হয়েছে।  সবখানে হযবরল চলছে।

সব সিঁড়িতেই এমন গা ঠেসাঠেসি  ভিড় মনে হয় যে নগরীর সব মানুষ বোধ হয় এখানে চলে এসেছে ! সিঁড়ি দিয়ে উঠে নামতেই ওদের গলদঘর্ম অবস্থা হয়ে গেল। সব ঘেমে নেয়ে চুপসে গেছে।

ওদের উকিল মশাইয়ের নাম সাইদুল। শ্যামলের র্পূবপরিচিত।

সে ওইদিন এক ডজন কেসের অজুহাত  অন্য কোর্টে চলে গলে। এতে শ্যামলের মাথা বেজায় গরম! পইপই করে বারবার  আগেই বলেছিল, “তুমি কিন্তু সাথে থেকো। আমরা এসব কোর্ট কাচারির কছিু বুঝি না”। কিন্তু মোক্ষম সময়ইে সে উধাও। এক কেরানিকে  দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছে।

শ্যামল কোর্টে এর আগে আসেনি অস্মিতাও না। সাইদুল এর আগইে ওই লোকের সাথে শ্যামলের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। ওইদিন আচমকা ও চলে যেতেই ভিরমি খেল।

শ্যামল— এই শুনছ? ওই কেরানির চেহারা তো ভুলে গেছি।

অস্মিতা— মানে তোমাকে না ও দেখিয়ে  দিল!

শ্যামল— হ্যাঁ, কই তেমন কাউকে তো ভতেরে গিয়ে দখেতে পলোম না।

অস্মিতা— দেখি, সরোতো একটু। আমি দেখে আসছি।

 

এই যে  ভাইয়া, আমরা বাইরে আছি!

জ্বি, আচ্ছা।

অস্মতিা  ভতের থেকে ফিরে এসে—

তুমি না একটা কী! চেহারাও মনে থাকে না। রাতে ঘুম হয়েছিল তো?

চলো, চার তলার বারো নাম্বার কোর্টে অপক্ষো করতে বলেছে।

শ্যা— ক’টা বাজবে কিছু বলেছে?

অ— না,  বলেনি। আমায় ভালো করে দেখে নাও! ভেতরে গিয়ে সবার ভিড়ে আমাকেও ভুলে বসবে!

সকাল নয়টা সতেরতে গাড়ি থেকে  নেমে ওরা উকিলের সাথে কথা বলার আগে খেয়ে নিয়েছে। আর এখন বাজে এগারোটা সতের।

সঠিক কয় ঘণ্টা অপক্ষো করতে হবে জানা নেই। যথারীতি কোর্টের কার্যক্রম শুরু হল। বেশ গাম্ভীর্যর্পূণ হাবভাব নিয়ে নিজ এজলাসে এসে বসলেন বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট । এনার বয়স ত্রিশোর্ধ্ব নয়।

প্রথমে ওরা বাইরেই দাঁড়িয়ে রইল। অস্মিতা  একটু বসতে চাইল। ওপাশে সূর্যের তীব্র আলো ঝলসে পড়ছে দেখে শ্যামলকে একটু ভেতরের দিকে সরে আসতে বলল। শ্যামল বাইরে বসার ব্যবস্থা করতে চাইল কিন্তু ও বসল না। শ্যামলের নীল রঙের ফতুয়া ঘামে ভিজে গায়ের সাথে লপেটে গেছে। আর অস্মিতার হালকা সবুজাভ জামাটায় ঘামের হাল্কা ছোপধরা দাগ দেখা যায়। বগলজোড়ার নিচের দিকে পুরোই ভেজা। ওড়নার আঁচল দিয়ে বাতাস করে যাচ্ছে। ব্যাগ থেকে বের করে শ্যামল পাতলা বইটা দিল।

কিছু কেসের মীমাংসা হওয়ার পর ভেতরে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তেরি হলে কোর্ট চেম্বারের পেছনের দিকের একটা বেঞ্চে অন্যান্য মহিলাদের সাথে বসার জায়গা করে অস্মিতাকে ভেতরে ডাকল। অবশেষে বসার ব্যবস্থা হল। কছিুক্ষণ পর দূর থেকে শ্যামল দখেতে পেল অস্মিতা বেঞ্চে মাথা  নিচু করে ঠেকিয়ে বসে পড়েছে। বেচারি ভালোই নাজেহাল হয়ে পড়েছে। অপক্ষো করতে লাগল ওর মাথা তোলার! ব্যাগে রাখা পানরি বোতলটা এগিয়ে দিল ধীরে ধীর। অস্মিতা বেশ তৃপ্তি নিয়ে পানি খেল। ওকেও খেতে বলল।

হরেক রকমের কেসের সুরাহা হতে লাগল। এখন ঘড়িতে সময় ১.৩০। এরই মধ্যে সাইদুল এসে হাজির। খোঁজ খবর নিয়ে সে অপক্ষো করতে বলা ছাড়া আর কিছু বলল না। একটা বসার জায়গার ব্যবস্থা করে শ্যামলকে বসিয়ে দিল।

অস্মিতা পাশে বসা ভদ্রমহিলাবর্গের সাথে কথা বলছে। সবাই হরেক রকমের সমস্যা নিয়ে আদালতের কাঠগড়ায় হাজির। বেশ আগ্রহ নিয়ে গল্প করছ। একদিকে শ্যামলের কোর্ট চেম্বার থেকে বরে হয়ে যাওয়ার ব্যস্ততা অন্যদিকে অনেকটাই নির্ভার প্রাণোচ্ছল অস্মিতা। সময়ের গতি এগিয়ে চলেছে, অস্থিরতা ক্রমশ  বাড়ছে শ্যামলের।

এক সময় সটান গিয়ে উকিল মশাইকে বলেই বসল, “দেখ সাইদুল, তিনটার মধ্যে কাজ হয়ে গেলে থাকব, না হয় চলে যাব। এটাই শষে কথা।"

সাইদুল— ভাই, এমন কেন করেন? সকাল থেকে এতক্ষণ বসে রইলেন। আর কছিুক্ষণ বসেন। আমরা তো আর ম্যাজিস্ট্রেটকে জোর করে কাগজে সাইন করাতে পারব না। তার যখন সময় হবে করবে।

শ্যা— এটা তো কোনও কথা হতে পারে না! একজনের ইচ্ছায় সবকিছু হয় এখানে। বাকি মানুষের কি সময়রে কোনও দাম নাই?  কাজ তো আমাদরেও আছে, না কি? সে যা চায়, তা-ই তো চলছে এখানে।

আর কোনও কথা নাই! তিনটা বাজলে চলে যাব।

 

ভারি গলায় বকা মেরে, বলতে গেলে সকাল থেকে সম্মানিত ম্যাজিস্ট্রেট মহাশয়রে উপর জমতে থাকা ক্ষোভের আগুন উগরে দিল সাইদুলের উপর। বেশ কাচুমাচু হয়ে সামনের দিকের একটা বেঞ্চে গিয়ে বসল সাইদুল। দেখে মনে হবে কোনও কেসের গো-হারা উকিল সাহেব।

বেলা সাড়ে তিনটার একটু পরইে ম্যাজিস্ট্রেট আবার চেয়ারে আসীন হলেন। বেশ গম্ভীর পরিবেশে আরও কিছু জটিল মোকদ্দমার আপাত সমাধান দিয়ে তিনি ভেতরের কক্ষে চলে গেলেন। শ্যামল ভেবে পায় না বারবার এই লোক কোথায় উধাও হয়ে যায়?  আর তাদের ডাক কেন আসে না। কছিুক্ষণ আগেও কেরানি এসে এক গাদা কাগজ বিভিন্ন জনকে বুঝিয়ে দিয়ে গেল। সব আশার গুড়ে বালি। শ্যামল-অস্মতিার ডাক আসেনি। শ্যামল আড় চোখে ওকে দেখছে, কখনো বেশ আগ্রহ নিয়ে পাশের মহিলাদের সাথে আলাপ জুড়েছে, তো কখনো বেশ মনোযোগ দিয়ে কেসের অবস্থা বোঝার চষ্টো করছে। চেহারায় তার বিন্দুমাত্র অস্থিরতা, ক্লান্তির ছাপ নেই।

শ্যামল তিনটা বাজতেই বৌয়ের পাশে গিয়ে বসল। ওর পাশের সিট ফাঁকা হয়েছে।

 

শ্যা— চলো, চলে যাই! আজ আর আমাদের সিরিয়াল আসবে না। পরে কখন আসবে কেউ জানে না!

অ— সকাল থেকে এতক্ষণ যখন বসে ছিলাম, তখন শেষটা দেখেই যাব।

শ্যা— আরে! সেটা কাল এসে দেখা লাগবে হয়ত!

অ— তোমার তো সবকিছুতেই শুধু পেসিমিস্টিক চিন্তা ভাবনা!

সাইদুল কী বলল?

শ্যা— ও আর কী বলবে? সাইদুল যে কেরানি ঠিক করে দিয়েছিল তাকে একবারের জন্যও দেখেছ?

অ— না তো!

শ্যা— সেটাই ভাবছি। ব্যাটা গেল কই? পয়সা নিয়ে চম্পট হয়ে গেল কি না!

অ— কেন জানি মনে হচ্ছে ওদের বোঝাপড়া ঠিকঠাক হয়নি!

শ্যা— সেটাতো একদমই। না হলে একবার হলেও সে আসত। আমি মোট চারজন কেরানিকে এতক্ষণ দেখলাম শুধু আমাদের ওই লোক বাদে। টাকা মনে হচ্ছে সে ঠিকঠাক পায়নি।

অ— আচ্ছা। সমস্যা নেই। সকাল থেক বসে যখন আছি, এর একটা সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত যাব না।

শ্যা— ক্ষিদে লেগেছে। চলো, চলো যাই!

অ— বা রে!  এমন একটা ভাব যেন ক্ষিদে তোমার একার পেয়েছে।  সাইদুলরে চেহারা দেখেছ? ওরও তো পেয়েছে।

ওকে জিজ্ঞেস করে এসো, যাও।

শ্যা— আরে, ও ঠিকই আছে। ওর অভ্যাস আছে এসবে।

অ— এই, ওই সামনে দখেতে পাচ্ছ যে লোককে হাতকড়া পরিয়ে দাঁড় করিয়েছে তার জন্য এই চৌদ্দজনের উকিলের দল কাজ করছে। পাশে দেখ, ওই টুপি পরা ছেলেটা ওনারই ছেলে। ওর চুলের কাট দেখেছ?

শ্যা— হ্যাঁ, এটা জানি। আমি ওই জায়গার একটু পাশইে দাঁড়িয়ে ছিলাম। দেখে ওই লোকের হাতে হাতকড়া! আর ছেলেকে কানে কানে ফুসফুস করে কী যেন বলে যাচ্ছিল। তবে এটা জানতাম না এত বড় একটা উকিলের গোষ্ঠী তার পক্ষে কোমর বেঁধে  নেমেছে। তুমি জানলে কী করে?

অ— ওই যে উকিল এখন কথা বলছেন, তিনি নাম, পরিচয় সবকিছু এই লোকের নামে বলেছেন। মানে ওখানে দাঁড়িয়ে উকিল কিন্তু ওই লোককে রিপ্রেজেন্টে করছে। কারণ আসামি তো কথা বলবে না। তখন দেখলাম, ওনার ফলোয়াররা আশপোশে জড়ো হয়ে গেল। একটা লক্ষ্য করার মতো বিষয় এই যে, ওই লোকের ছেলের চুলের কাট দেখে মনে হচ্ছে গত সপ্তাহইে এটা দিয়েছে। কোর্টের মতো একটা জায়গায় আসার আগে এমন কাট দেওয়াটা কতটা স্বাভাবিক ব্যাপার?

শ্যা— মোটেও না!  এমন করে কেউ কোর্টে আসে?

অ— সে-ই তো।

শ্যা— হায় রে! এখন যে আরও কয় ঘণ্টা লাগাবে কে জানে?

সারাটা দিন গেল রসাতলে।  আমাদের ব্যাংকেও যাওয়া হল না।

অ— তুমিই কি একা বসে আছ নাকে? পাশের সারির তৃতীয় বেঞ্চে দেখো, এই পিচ্চি দুইটা কিন্তু কাপল।

দেখেছ?

শ্যা— হ্যাঁ, ওদরেকে তো বাইরেই লক্ষ্য করেছি।

অ— আমার অনেক কিউট লাগছে দুজনকেই। পরিবার মানছে না, বোঝাই যায়।

শ্যা— কিছুক্ষণ আগে তোমার পাশের মহিলার সাথে আরকেজন মহিলার লেগে গিয়েছিল, সে কে?

অ— ওই মহিলাকে তো বাইরের জন্যই শাসিয়ে গেল।

শ্যা— কী একটা অবস্থা!  জানালা দিয়ে হাতাহাতি শুরু করে দিল? কোর্টের মধ্যে? তুমি সরে আসনি কেন? মারামারি লেগে গেলে?

অ— আরে ধূর! কিছু হবে না। আমি তো সাইডে ছিলাম। দেখলে না পুলিশ তাড়িয়ে দিল। এত ভয় পেলে চলবে মিস্টার?

 

শ্যামল আস্তে আস্তে অস্মিতার হাতে হাত জড়িয়ে—

শ্যা— এই, আর কতকাল এভাবে বসে থাকব?

অ— যতকাল কেসের সুরাহা না হচ্ছে। কতজনই তো বসে আছেন। সবার কাগজ ভেতরে আটকে। বসো তো!

আমাদের এখান থেকে  বের হওয়ার সময়টা যদি একটা দেড়টার মধ্যে হয়ে যেত তাহলে ঠিক ছিল। এখন যখন এত দেরি হয়েছে,  বসে শেষটা  না দেখে যাব না। এতক্ষণ কি তাহলে খালি হাতেই ফিরে যাব এজন্যই বসে ছিলাম?  অবশ্যই না!

শ্যা— আহ!

অ— এত র্দীঘশ্বাস কেন জনাব?

শ্যা— বৌ, দুপুর থেকে অভুক্ত হয়ে বসে আছ। কিছু খাওয়াতেও পারছি না। ভালো লাগছে না।

অ— তুমিও তো বসে আছ। আমার কথা বললে হবে? সাইদুলও আমাদরে জন্য বসে আছে। বেচারা সকাল থেকে অনকেবার দৌড়াদৌড়ি করল! কাজ করাতে পারছে না এই যা! তবে সে চেষ্টা করছে।

শ্যা— আরকেটু পানি খাবে?

অ— না!  তুমি খাও। তোমার চেহারা শুকিয়ে গেছে। গরমে বেশি কষ্ট হচ্ছে?

শ্যা— না,  আর কী! এমন গরম এবার ব্রিসবেনে সামারেও ছিল। এর বেশি হয়ে গেলে হয়ত সমস্যায় পড়তাম।

অ— ব্যাগে বিস্কুট আছে না? খেয়ে নাও না!

শ্যা—নাহ্। একেবারেই অন্ন-ভোজন। বাকি কিছুতেই রুচি নেই।

 

ভেতর থেকে কেরানি আবার এসে হাজির হয়েছে এক বস্তা ফাইলের বোঝা নিয়ে।  নাম হাঁক দিয়ে ডাকছে৷ সাইদুল হুড়মুড় করে ছুটে গেল সামনে। এবারও প্রায় সব নাম ডাকা শেষ! ও বসে কছিুক্ষণ এপাশ ওপাশ ছুটোছুটি করে শষেমেশ শ্যামলকে ডাকল।

 

অ— কী বললো ও? কবে আসবে?

শ্যা— ও কিছু জানে না। আমাকে তো আরও ঘুষ দেয়ার জন্য ডেকেছে।

অ— তা তো জানিই। এজন্যই তখন বলছিলাম ওদের বোঝাপড়াতে শুরু থেকেই সমস্যা ছিল।

শ্যা— গড়বড় করবেন উনারা—আর ভুক্তভোগী হব আমরা!

অ— কোর্ট চেম্বারটার আশপাশের দেয়ালগুলো দেখেছ? প্রতি কোণায় মাকড়শার জালের বিস্তার দেখতে পাচ্ছি। আইনের মারপ্যাঁচের মতো!

শ্যা— আচ্ছা!  মনে পড়ে এই মাকড়সার জালের কথা দিয়েই কিন্তু আমাদের প্রথম আলাপ শুরু হয়েছিল? ম্যাসেজ করেছিলাম!

অ— কেন নয় জনাব? অবশ্যই আছে।

শ্যা— তখন আর এখনকার আমার মধ্যে তফাৎ দেখ?

গালে হাত দিয়ে চোখ মিটিমিটি করে অস্মিতা।

অ— ঠিক জানি না! হবে হয়ত!

শ্যা— কী বলছ? তুমি না জানলে আর কে জানবে বল!

অ— হুম!  কত আগ্রহ, না? দেখব এত জানার আগ্রহ কতদিন থাকে?

শ্যা— যতদনি  বেঁচে আছি, থাকবে। কোনও সন্দেহ নেই।

অ— দু, দু’টো ঈদরে ছুটি গেছে বেশিদিন হয়নি। অথচ এতগুলো ফাইলের দস্তাবেজ, আলমারিতে কেউ হাতও দেয়নি। ওই সময় সাফসাফাইয়ের নামে কী যে হয় কে জানে?

শ্যা— কী আর? পান-সিগারেট ভোজন।

অ— ম্যাজিস্ট্রেট বারবার আসে আর কই উধাও হয়ে যায়?

শ্যা— পেছেন তার রুম আছে নিশ্চয়ই। ভেতরে কোথাও হবে। কত ভেতরে কে জানে? ওইখানে তো এক কেরানি ছাড়া আর কারও যাওয়ার উপায় নেই।

অ— কাল সকাল-সকালই আমরা বের হয়ে যাব। ফাস্ট আওয়ারে ব্যাংকে গেলে আমাদের কাজটা তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে।

শ্যা— আর তাড়াতাড়ি? দেখো! কাল আবার কোন কাগজের চক্করে পড়ি?

অ— এই! তোমাকে ডাকছে!

 

“শ্যামল আহমেদ আছেন?  শ্যামল আহমেদ?

অস্মিতা দত্ত আছেন? অস্মিতা?”

 

শ্যামলকে সাইদুল ডেকে নিল একপাশে।

কেরানির হাতে ওদের ফাইল। ভদ্রলোক শ্যামল, অস্মিতা দুজনকেই  ডাকলেন।

‘স্যার আপনাদের ভেতরে ডাকছেন।’

যখন থেকে কেরানির ফাইলের বোঝা নিয়ে বের হয়ে আসে। ওই জায়গার ঠিক পেছনেই ম্যাজিস্ট্রেট মহাশয়ের কক্ষ। উনার পারসোনাল অফিস-রুম ওটা।

 

শ্যামল ভতেরে চলল। পছেনে অস্মিতা।

 

ম্যাজস্ট্রিটে— আসেন, আসেন।

বসেন আপনারা।

আপনাদের বিয়ের অরিজিনিাল সার্টিফিকেটটা আছে?

আমি কোনো কিছু যাঁচাইয়ের জন্য দেখাতে বলছি না কিন্তু।

এটা ফর্মালিটিজ। তাই একবার দেখতে চাইছি।

শ্যা— হ্যাঁ, স্যার। কোনও সমস্যা নেই। এখুনি আনছি।

শ্যামল ব্যাগ বাইরে রেখে এসেছিল। ওটা চটপট আনতে গেল।

ম্যা— ওটা একটু দেখান।

শ্যা— (ব্যাগ থেকে ফাইল বের করে সার্টিফিকেটটা এগিয়ে দিল)

 

সার্টিফিকেটাট একবার দখেই এফিডিভেডের তিন পাতায় এক এক করে সটান দস্তখত দিলেন ম্যাজিস্ট্রেট।

ম্যা— আপনারা তো বাইরে এপ্লাই করবেন?  না? আপনি কোন দেশে আছেন যেন?

শ্যা— অস্ট্রেলিয়া স্যার।

ম্যা— কোন শহরে? কয় বছর হল ওখানে?

শ্যা— আমি ব্রিসবেনে স্যার।  এই তো সাড়ে পাঁচ হতে চলল।

ম্যা— আপনি তো পি আর,  না?

এখন কি উনার জন্য করবেন?

শ্যা— হ্যাঁ, স্যার। এখন ওর জন্য করছি।

ম্যা— এখন ইমগ্রিশেনের কী অবস্থা ওখানে?

শ্যা— স্যার,  এখন ওরা আরও কিছু স্ট্রমি বের করেছে। আগামী মাসেই কিছু আপডেট আসার কথা। আমাদের কমিউনিটি বেশ ভালোই করেছে ওখানে।

ম্যা— আপনি কী জব করছেন?

শ্যা— স্যার, আমি একটা ইউনভার্সিটির অ্যাডমিনে আছি।

ম্যা— বাহ!  বেশ। তো কবে যাচ্ছেন?

শ্যা— আমার তো আগামী সপ্তাহেই ফ্লাইট। এখন ওর কাগজপত্র গুছিয়ে নিয়েছে প্রসেসিং হতে যতদনি লাগে। এরপর ওকে নিয়ে যাব।

ম্যা— ওকে ! বেস্ট অব লাক।  ভালো থাকবেন।

শ্যা— আপনিও স্যার।

 

বেশ হাসিমুখেই দু’জন পাশাপাশি বের হয়ে এল। অস্মিতার হাসি দেখে শ্যামল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বাইরে দাঁড়ানো সাইদুলের মুখেও সকাল থেকে এত হতাশা মিশ্রিত চাহনির বদলে একটা হাসি ফুটে উঠেছে।

 

অস্মিতা— তো?  জনাব? কাজ হল?

শ্যামল— হ্যাঁ, অবশেষে!

তাদের দু’জনেরেই দেখা পাওয়া গেল! 

সাইদুলের কথামতো ওরা সাইন করা ফাইল নিতে তিন তলায় চলে গেল।

 

অ— ভেতরে যখন আমি একা। তুমি তো ব্যাগ আনতে বাইরে গেছ। আমাকে কিন্তু বারবার করে বসতে বলেছেন এবং সেটা বেশ সম্মান দেখিয়েই বলছেন। উনি কিন্তু চাইলেই আমাদের সাথে কোনও কিছু না দেখিয়েই এমনিতেইে সাইনের পর বের করে দিতে পারতেন। সেটাতো করেননি বরং খুব সম্মান দেখিয়ে কথা বলেছেন।  আমার কিন্তু এটা খুব ভালো লেগেছে।

শ্যা— হ্যাঁ, তার ব্যবহার আমাদরে প্রতি নিঃসন্দহে প্রশংসনীয় ছিল। এটা আমার মনে থাকবে। খুব শান্তভাবে সসম্মানে কথা বলেছেন। তবে এটা আমার প্রবাসী বাংলাদেশি হওয়ার কল্যাণে কি না?  কে জানে?

অ— এই যে! তোমার না শুধু এক ধরনের চিন্তা!

শ্যা— আচ্ছা, আচ্ছা।  সে আসলইে ভালো ব্যবহার করেছে। আমি তো একটু মজা করছি।

 

অস্মিতা কোর্টের বাকি দালানকোঠাগুলো বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখছে। এখন দূর থেকে বাকি অট্টালিকা বেশ শুনশান লাগছে। সকালবলোর সেই মহা হট্টগোল পেরিয়ে ওরাও যনে একটু হাফ ছেড়ে বেঁচেছে! ওদের দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর নিজেদের ঘরগুলোও একসময় পিনপতন নীরবতায় ডুবে যাবে। সেটা অস্মিতা ভাবতেই বুকের ভেতরটা কেমন যেন হুঁ-হুঁ করে উঠল। ফিরে হয়ত আসবে, তবে সেটা অতিথি পাখির মতো, স্বদেশি নয়! মাটির ঘ্রাণ পেতে ইচ্ছে করবে, কিংবা মায়ের আঁচলের ছোঁয়া। সবকিছুই কল্পনায় দেখতে হবে, বাস্তবে নয়।

 

অ— এই তুমি মিটমিটি করে কী এত কথা বলো?  হুম?

নিজে নিজে ঠোঁট নেড়ে নেড়ে কোর্টে সারাদিন কথা বলেছ।

কী বলছ শুনি ?

শ্যা— অনকে কথা। সত্যকে ছুঁতে চাই। তাকে খুঁজি।

বাসায় চলো, সব খুলে বলছি।

 

সারাদিন সাইদুলের প্রচণ্ড ঠান্ডা মাথার মস্তিষ্ক শ্যামলকে অবাক করেছে! এতবার ধৈর্য হারিয়ে কথা কাটাকাটির মধ্যেও ও কেমন জানি শান্ত, অবিচল, সংযত থেকেছে। দারুণ পেশদারতে্বর পরিচয় দিল। শ্যামল আর অস্মিতাকে বিদায় দিয়ে চেম্বারের দিকে রওয়ানা হল সাইদুল। ওর খাওয়া-দাওয়ার জন্য পাশের রেস্টুরেন্টে চলে গেল। ভাত, ডাল, সবজি, রুই মাছ—আজ এই ছিল ভোজনের পদ।

অনকে ক্ষিদে পেলে তেমন একটা আর তৃপ্তি নিয়ে খাওয়া হয় না শ্যামলের। অস্মিতা সেদিক থেকে একদম ঠিকঠাক।

সবকছিু সেরে বের হতে হতে প্রায় ছয়টা দশ বাজে তখন। উবারে গাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না। প্রচণ্ড যানজটে নাজেহাল অবস্থা পুরান ঢাকার র‍্যান্কিং রোডে। অস্মিতা রাস্তা পার হয়ে অন্য দিক থেকে গাড়ি দেখতে বলল। ওরা সামনের দিকে এগিয়ে চলল। গন্তব্যস্হলে যাওয়ার যানবাহনের কোনও সুরাহা করতে পারল না অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও। শ্যামল এক রিকশাওয়ালাকে ডাকল।  রাজি করিয়েছে প্রায়। অস্মিতাকেও ডাকল। কিন্তু ও প্রথম প্রথম দেখতেই পেল না।

 

শ্যামল রিকশায় উঠে বসল—এই ভাই, তুমি ওইদিকে যাও। ওই আপুর কাছে।

রিকশাওয়ালা—ভাইয়া, আমার মনে হয় আপু যাইব না! উনি তো অন্য দিকে তাকায় আছে।

শ্যা— ধূর মিঞা! কী বলো? আরে তোমারে যা বললাম তা কর তো!

ছোট্ট করে ঠোঁট নাড়িয়ে বলল, “আমার বৌকে আবার কই পাঠাও মিঞা?"

অস্মতিা উঠে বসল। প্রথম ডানদিকে বসে পড়েছিল। শ্যামল আবার নেমে সরে এসে ওর বামদিকে বসল।

অ— মানে কী?

শ্যা— কেন? জানো না? সেফটি রুল অব রিকশা—লেডিস অন লেফট সাইড!

অ— বাপের জন্মেও এ কথা শুনিনি। কই থেকে কী কী নিয়ে আসো না? কোনও ঠিক ঠিকানা নাই!

 

গন্তব্যের দিকে ধীরে ধীরে যানজট পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে রিকশা। আরও একটা রিকশা নিয়ে শাহবাগের দিকে যাবে ওরা। ওখান থেকেই পরর্বর্তী জায়গায়। কাল ওদের ব্যাংকে কাজ আছে। শ্যামল ভাবছিল ব্যাগে সব কাগজপত্র ফটোকপি করা আছে কি না? তখনই মনে পড়ল কয়েকটা আইডি ফটোকপি করতে হবে। অস্মিতা শ্যামলকে লক্ষ্মী-ট্যারা চোখে দেখছে। ও ঠোঁট জোড়া নড়ছে কি না!

ব্যাংকেও ওদের অনকে সাইনের প্রয়োজন। ওই সাইন তাদের আর আজকের মতো তৃর্ষাত, ক্ষুর্ধাত  করে তুলবে না, ঘড়ির কাটার সময়ও হয়ত থমকে দাঁড়াবে না! শ্যামলও বিড়বিড় করে কিছু বলবে না। অস্মিতাও আড়চোখে বরকে দখেবে না।

নিউজজি/নাসি

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন