মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ৮ মাঘ ১৪৩১ , ২১ রজব ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
গল্প

পুঁজি

রাশেদ সাদী অক্টোবর ২৫, ২০২৪, ১৭:২০:১৪

741
  • পুঁজি

এই যে দাগটা, তলপেটের বাঁ-পাশটায় একটা দীর্ঘকায় বিছের মতো বসে আছে, এটা মজনুর একটা অপারেশনের। না, তার বড় কোনো রোগ ছিল না। এটা তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে নিজের একরকম ক্ষতিসাধন। হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন এই অস্ত্রোপচার হয় তার ইন্ডিয়ায়। পঞ্চাশহাজার টাকার বিনিময়ে। অতঃপর কিডনিটা তার নিয়ে নেয়া হয়।

মজনু আজকে এসেছিল আরেকটা কিডনি বেচতে। কিন্তু নিষ্ঠুর লোকগুলো তাতে কিছুতেই রাজি হলো না। ব্যর্থ মনোরথে সে ফিরে এসেছে।

তারা বলে দেয়, মানুষের দুটো কিডনি। তার একটা বিক্রি হতে পারে। দুটো কিছুতেই না। মজনুর খুব রাগ হয়, মানুষের কিডনি কেন দুইটা ইহতে হবে, পাঁচটা না কেন?

তারপরও সে জোরাজুরি করে। কিন্তু তারা রাজি হয় না। তবেএকটা দেশীয়সূত্র সে পেয়েছে, তারা বলেছে কিডনি নেবে তবে টাকা পরে। অর্থাৎ মজনু কিডনি দেবে, তারপর টাকা পাবে।

এটা নিয়ে মজনু দোলাচলে আছে। টাকা পেয়ে সে কিডনিটা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা কিছুতেই তাতে রাজি হচ্ছে না।

এমনিতে সে একদম ব-কলম না। নিজেকে বরং শিক্ষিত ভাবতেই পছন্দ তার। নিজেকে নিয়ে তার কিছুটা উন্নাসিক ধারণাও আছে। বিরুদ্ধবাদীসমাজে সে আটটাক্লাস পাস দিয়েছে। বই পড়ে। কবিতা লেখে। যার ফলে সবার কাতারে সে ভাবতে পারে না নিজেকে। সাধারণের থেকে কিছুটা‘ এডভান্স’! আত্ম-অভিমানী এই শব্দটা সে কোনও এক বিখ্যাত লেখকের লেখায় যেন পেয়েছে। নাইবা কেন? কিডনিকি সবাই বেচে না বেচার সাহস করে?

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, মজনু কি জানে না, কিডনি ছাড়া মানুষ বাঁচে না; অন্তত একটা কিডনি মানুষের থাকতেই হয় বেঁচে থাকার জন্য। তারপরও সে কীভাবে তার দ্বিতীয়কিডনিটাও বিক্রি করতে চায়?

হিসেব-নিকেশ না মিলা এই সিদ্ধান্ত আর মজনুকে আমরা কোনোদিন মিলাতে পারিনি, মিলাতেও যাইনি। যেখানে সবাই নিজের নিজের হিসাব নিয়েই হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে অন্যের হিসেবের জাবেদা খুলে কে বসে থাকবে?

 

গলিঘুপচির এই শহরের এক বস্তিতে থাকে মজনু। থাকে বটে এ নিয়ে তার হীনমন্যতারও শেষ নেই। ভাগ্যিস শিড়িনকে কখনো আসতে হয়নি? অবশ্য সে চায়ওনি। ফলে সেও কখনো এ প্রসঙ্গ মুখে আনেনি। বেফাঁসেও না। আসতে বলে সে কোন লজ্জায়? বস্তিতে নিয়ে আসবে? অসম্ভব! কোনোদিনও যেন তা না হয়।

তাই সে এখানে আসার প্রসঙ্গটি শিড়িনের সামনে বা পেছনে ঘুণাক্ষরেও মুখে আনেনি। এই গোটা সাতবছরে তার প্রত্যাশার কেন্দ্রে ছিল, সে একটি গোছানো জীবন পাবে। সুন্দর একটা ঘর হবে। সেখানে শিড়িনকে নিয়ে মিষ্টি একটা সংসার গড়ে তুলবে। দুটো পায়রা-পায়রিতে বাকুম-বাকুম করে জীবনটা কাটিয়ে দিবে। কিন্তু সে জীবন কোথা থেকে আসবে? অবশ্য তা নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই।

জীবনটা মজনুর। সে তারই যদি মাথা ব্যথা না থাকে, আমাদের অযথা মাথা ঘামিয়ে ব্যথা করে লাভ কী? তবে নিয়তি যেমন করে মানুষের দুর্বলতা দেখে মিচকি হাসে, তখনও কি তাই হয়েছিল? নিয়তি বুঝি খুব মনখারাপ করেছিল, আফসোস! যে সম্পর্ক নিজের ক্ষতকে আড়াল করতে এত তৎপর, তা কতই না ঠুনকো!

গত সাতবছরে মজনু অনেকবার গ্রামে গিয়েছে। শিড়িনের সাথে দেখা হয়েছে প্রতিবারই। এর বাইরে ফোনই তাদের যোগাযোগমাধ্যম। বৃহস্পতি অথবা শুক্রবার। পাঁচ-দশ মিনিট। ওদিকে শিড়িনের কত তাড়া! কেউ দেখে ফেলবে, কেউ শুনে ফেলবে বা কেউ বুঝে ফেলবে। তাহলে কত বড় সর্বনাশ হয়ে যাবে! রাখি রাখি করতে করতেই ওই পাঁচটামিনিট কেটে যেত।

মজনুর মনে হতো,পৃথিবীতে বুঝি হিসেব করেই পাঁচটামিনিট তৈরি করা হয়েছে।কল রিসিভ হলো তো শেষ।

রাখি! ও পাশের আতঙ্কিত থরোথরো গলা।

রাখবা?

হুম! বলেই কাটা শেষ।

এভাবেই চলছিল। পাঁচ মিনিটের সম্পর্ক। মিনিটপাঁচের এই কথা মজনুর জীবনের জন্য অবশ্য বিরাট কিছু। তেল বলে যাকে; চালিকাশক্তি। যা দিয়ে সে বেঁচে থাকে বা বর্তে থাকার অর্থ খুঁজে পায়। জুঝতে চেষ্টা করে প্রবল বিরুদ্ধবাদী এই জীবনের থাবার তলে গলে যেতে যেতে।

মজনু রিকশা চালায়। তার আয়ের উৎস রিকশাচালনা। কিন্তু কিছুতেই মেনে নিতেপারে না সে রিকশাচালক। একবার শিড়িন বলেছিল, তোমার হাত এত শক্ত কেন?

পুরুষের হাত যে! মজনু হেসে উত্তর দিয়েছিল।

শিড়িন মজুনর বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে বলেছিল, ব্যথা লাগে!

শিড়িনের উত্তর শুনে সে খিলখিল করে হেসে উঠেছিল।

শিড়িন তখন মুখ চেপে ধরেছিল, আস্তে। শুনবে।

নিজের রোজগারের বিষয়ে শিড়িনকে কোনো দিন কিছু জানানো হয়নি মজনুর। কেন জানায়নি? এই নিচু জাতের সাথে তাহলে যদি সে সংসার নাবাঁধে—সেই ভয়! তাহলে প্রেম করেছিল কেন? কেন বলেছিল আমার এমনই এক অনাথ মানুষ দরকার, যাকে আমি ভালোবাসা দিয়ে বড় করে তুলব। বড় হতেই তো মজনু ঢাকার এই মানবেতর জীবন বেছে নিয়েছিল। জোঁকের মতো কামড়ে ধরেছিল এই পতিত জীবন।

আবার এটাও ভাবতে হবে, এ সব আসলে কার চিন্তা? কার কথা? কার ভাবনা? এসব কি শুধুই মজনুর মনের খেয়াল? শিড়িন কিকদাচিৎ এসব ভেবেছিল? পক্ষান্তরে একই সময় আপনার মাথায় ঝিলিক দিয়ে উঠতে পারে এই প্রসঙ্গও—খেয়ালকি কেবলই খেয়াল; যা খেয়াল খুশির আসমান থেকে জন্মায়? নাকি কোনো সম্পর্ক সূত্র থেকে যায় এসবের মধ্যে? শিকড়ের কত রূপ, কত গমন-অধিগমন।

শিড়িন স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। কত কত তার স্বপ্ন! তার সাজুগুজুর শখ, স্বর্ণের গয়নার শখ। আরও কত কী? অথচ মজনু চালায় রিকশা! শখ আর সাধ্যের মধ্যে কি মিল পাচ্ছেন? কত কত প্রেমের সায়রে প্রশ্নগুলো এভাবে ডুবু পাহাড়ে ওত পেতে আছে স্বপ্ন টাইটানিক ডুবিয়ে দিতে। সাদা চোখে যা অনায়াস সাধ্য হলেও, প্রেম চশমায় যা দুর্বোধ্য; ধরা পড়ে না।

টাকা যা রোজগার মজনুর তা তো এই রিকশা দিয়েই। সেই টাকার অর্ধেকটা শিড়িনকেপাঠিয়ে দেয়। সেটায় সে এটা-ওটা কিনে। কিনে বলে, আজকে লাল রেশমি চুড়ি কিনেছি। এমন সুন্দর লাগছে! তোমাকে যদি দেখাতে পারতাম!

শিড়িনের এই কথা শুনে মজনু সত্যি সত্যি পাগল হয়ে ওঠে। তার উড়ে গিয়ে পাড়া তলি গায়ের মেয়েটার চুড়িশোভিত হাত দেখে আসতে মন চায়। কিন্তু প্রকৃতির নির্মমতায় তা আর হয়ে ওঠে না। কারণ প্রকৃতি তাকে পাখির ডানা দেয়নি, দেয়নি গতি। তার উপর দেয়নি, ন্যুনতম আর্থিক সঙ্গতি। সে ভাবে, সবই কেন তার বিরুদ্ধে যায়? তাই হয়ত তার কলম থেকে কচি ঘাসের মতো জন্মায় প্রভু, যদি হৃদয়ই দিলে, কেন এত বৈষম্য?

প্রকৃতির এই নির্মম অবিচার মেনে নিয়েই সে বিমাতাসুলভ এই বস্তি বাসের ঘানি টেনে চলে। আর মনে মনে ভাবে, ভালো একটা চাকরি হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আচ্ছা, মজনু কী পাগল! এই শহরে সে সাতবছর থাকে, তারপরও সে এমন চিন্তা মাথায় রাখে কী করে?

চাকরি সেতো সোনার হরিণ। এই শহরে বরং তারও চেয়ে বেশি। সোনার হরিণও মিলে যেতে পারে, কিন্তু চাকরি কদাচিৎ। ছোট্ট এই চড়ুইয়ের বাসার মতো একটা শহরে দেড় কোটি মানুষের বাস। তার মধ্যে অর্ধেকের বেশি লোকে চাকরি খোঁজে। সেখানে এইট পাস গ্রাম্য মজনুর অবস্থান কোথায়?

যদিও ইউটোপিয়া বলে, মজনুর একটা প্রেমের অধিকার আছে, ঘরের অধিকার আছে, ভালো একটা চাকরির অধিকার আছে। এই অধিকার বোধ তার কোথা থেকে জন্মাল? এর জন্য কি তার বইপড়া, কবিতা লেখা দায়ী? তাহলে বইপড়া কি তার জন্য ভুল ছিল? সে যে সারাদিন আক্ষরিক অর্থেই হাড়ভাঙা খাটুনির পর বই নিয়ে বসে, কলম-খাতায় ঘাম ঝরায় তার মূল্য কোথায়? বইপাঠ কি তা হলে সবার জন্য না? যদি তা না হয়, বইপাঠ তাকে ইউটোপীয় একটা চিন্তায় বন্দি করা ছাড়া কী দিয়েছে? বইপাঠ কি মানুষকে কিছু দেয় না?  সার্টিফিকেট! তাতো নেই মজনুর। আসলে সমাজ কী চায়? কী দিয়ে মানুষকে মূল্যায়ন করে? বই পড়াকে বড় কাজ বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলে কেন তাহলে? তা নইলে তো একটা রিকশা চালককে সাফল্যের ইউটোপীয় সিঁড়ির বিভ্রান্তি পেয়ে বসত না। সে মন দিয়ে রিকশা চালাতো। কবিতা রত্রি-সীমায় ভিড়ত না।

কিন্তু মানুষের প্রয়োজন তো আর বসে থাকে না বা থাকারও কথা না। প্রয়োজন বাড়ে, বাড়ে টানাপড়েন, বাড়ে ভাঙনের হিসাব। এমনই এক টানাপড়েনের শহরে হঠাৎ একদিন শিড়িন বলে, তার পঞ্চাশ হাজার টাকা লাগবে।

মজনু বলে, তুমি তো জানোই আমার অবস্থা।

শিড়িন কাঁদতে থাকে, আমার পড়ালেখা বোধ হয় এখানেই শেষ! চেয়ে ছিলাম, লেখাপড়া শেষ করে তোমার পাশে দাঁড়াবো—তা আর আমার দিয়ে হলো না। তাহলে এ জীবন রেখে কী হবে? এটা আমি কুত্তা দিয়ে খাওয়াব।

একথা শুনে মজনু যেন পাগল হয়ে যায়। শিড়িন কাঁদছে! সে আর নিতে পারে না, তুমি আর কেঁদো না, সোনামনি। আমি দিব তোমাকে, টাকা আমি দিব।

তুমি কী ভাবে দিবে? তোমার কী ভাই আছে যে, তার থেকে নিয়ে দিবে? তোমার বাবা-মাও নেই, নেই কোনো স্থাবর-অস্থাবর! কোথা থেকে দিবে তুমি? তার চেয়ে বরং তুমিআমাকে ক্ষমা করে দাও। সত্যি সোনা,আমি আর বাঁচতে চাই না।

মোবাইলের ও-পাশ থেকে একটা কান্নার আবেগ উথলে উঠতে শোনে মজুন। তার চোখ আন্ধার মারে। তার অস্তিত্ব দুলতে থাকে সমুদ্রে ঝড়ের ভেতর। নিজেকে কোনো মতে সামলে নিয়ে বলে, আরে এখানে আমি এত দিন ধরে আছি। কত বন্ধুবান্ধব আছে। তারা কত বড় বড় মানুষ। চাইলেই দিয়ে দিবে। তুমি শুধু কয়েকটা দিন সময় দাও আমাকে।

সত্যি তুমি...পারবা? সন্দেহের আতিশয্যে গলায় কথা আটকে যায় শিড়িনের।

আরে দেখই না। তোমার প্রেমিকের তোমাকে অদেয় কিছু নেই। আরে বোকা মেয়ে, ভালোবাসি না। তুমিইতো আছো আমার। আর তো কেউ নেই পৃথিবীতে। বোঝ না কেন, তোমার যেমন বাবা-মা আছে, আমার তো তেমনও কেউ নেই রে। ফলে তুমি আমার সব, সোনা।

আচ্ছা, আম্মা ডাকছে। আসি। কেমন ছাড়া-ছাড়া অনাস্থার সুর শিড়িনের।

ওকে। মোবাইল প্যান্টের পকেটে ভরে সে সামনে পা বাড়ায়। তার মুখে একটা বেপরোয়া হাসি লেপটে থাকে।

 

শিড়িন গ্রামের সাধারণ মেয়ে। বাবার কিছু ধানের জমি আছে বটে। তবে বর্গাতেও কিছুটা চাষবাস আছে। মোটামুটি টেনে টুনে সংসার চলে যায়। বড় দুই ভাই আছে, তারা বৌ-সন্তান নিয়ে ভিন্ন-খায়। বাবা-মায়ের সংসারে তাদের কোনো কন্ট্রিবিউশন নেই। বাবা-মায়ের চিন্তাটা এখন মেয়েকে সুপাত্রস্থ করা। কিন্তু মেয়েটা পড়ায় ভালো, শিক্ষকদের পিড়া পিড়িতে বিয়ে দিতে পারেনি। কিন্তু এখন তো আর পারা যাচ্ছে না। পঞ্চাশ হাজার টাকা! সেটা কী খেলা কথা। বাবার পক্ষে আর সম্ভব না। তাইতো বাবা বোবা-কালা হয়ে আছে। একটা টাকা তার কোঁচড় থেকে খসছে না। খসবে কোথা থেকে। থাকলে তো?

ওদিকে সবরুদ্দির বৌ’র কথায় থাকা যাচ্ছে না। তার কথা, মেয়ে মানুষ এতো পড়াবার কাম কী!

আসলে তোতানা, মূলত ঈর্ষা! নিজেরা পড়তে পারেনি, আরেকজন বড় হয়ে যাবে, সেটাতে জ্বলে তার। পোড়া মরিচ ডলে দেয়ার চেয়ে বেশি জ্বলুনি তাতে। একদিন তো বলেই ফেলল, নিজেদের ‘ব’ লেখতে বারোজন লাগে, মেয়েরে বানাব বেরেস্টার। দেখমু তো কত বড় বেরেস্টার বানাও মেয়েরে?

তোদের মুখে ফুলঝুরি পড়ুকরে মাগী। তাই হবে, দেখবি তোরা।

কিন্তু তা আর হলো না। বাবা এ দুঃখ রাখার জায়গা পায় না। এর মধ্যে একদিন মেয়ে এসে জানায় টাকা ম্যানেজ হয়েছে।

কীভাবে?

তারপর সব খুঁটিনাটি সে বাবাকেবলে।

 

মজনু ফোনটা রেখেই আতাকে খুঁজতে বের হয়। তার অনুসন্ধানী মন ঠিকই আতাকে বের করে ফেলে।

আতা খোলা আকাশের নিচে একটা ভ্যানে বসে আছে। গায়ে প্রিন্টের শার্ট আর পরনে কালো তবন। আঙুলের প্রতিটি পিঠে শোভা পাচ্ছে বিচিত্র পাথরের আঙটি। তাকে ঘিরে আছে কতগুলো মানুষের জটলা।

মানুষের ফাঁক দিয়ে আতার লাল টুকটুকে ঢুলুঢুলু মাতাল আধখোলা চোখ দুটো মজনুকে দৃষ্টিরসীমায় পেয়ে একবার নেচে ওঠে। কিন্তু কী এক অজানা কারণে তার দিকে আর মনযোগ দিতে চায় না সে।

মজনু জটলার কাছে এসে ডাকে, আতা ভাই!

আতা তাতে সিগারেটে একটা টান দিয়ে তার সঙ্গীদের দিকে আরও বেশি মনোযোগী হয়ে ওঠে।

সে আবার ডাকে, আ-আতা ভাই!

এবার সে মুখ ফেরায় আর তার ওপরে ফেরে তার চোখ, কিভদ্দরনোক সাহেব, বলুন, পুলিশে খবর দিছেন?  না ওসির নম্বর পাচ্ছেন না। চাইলে আমি দিতে পারি। লাগব?

‘ভাই!’ মজনুর চোখে-মুখে আকুতি ঝড়ে পড়ে। যা দেখে আতার মনটা আনন্দে নেচে ওঠে। ক্লায়েন্টের এমন বেকায়দা ভাব তার ব্যবসার জন্য শুভ সংকেত। অর্থাৎ একে যেমন খুশি তেমন চালানো যাবে।

আতা দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করে। চোখের ইশারায় বুঝে যায়, কোন ইঙ্গিতের দৌড় কতদূর। তা যদি নাই বুঝে তাহলে কী আর ব্যবসা করে খেতে পারত। বিনা পুঁজিতে ব্যবসা। লাভ যেমন, তেমন তার চাহিদা। ম্যানেজ করাটাই যা একটু ঝামেলা। তাও এখন নেই। অহরহ ক্লায়েন্ট। পারে না আত্মাটা বেঁচে দেয়। তাদেরই একজন এই মজনু।

ছোট খাটো শরীরের তামাটে রঙের এই জীবটাকে সে আগেই টোপ দিয়েছিল। তখন গিলেনি। এখন নিজে থেকে এসেছে। এ ভাবেই আসে। প্রথম রাজি না হওয়াতে বরং ভালোই হয়; এদের থেকে ব্যবসাটা আরও ভালো হয়, আপনেরা ভদ্রলোক মানুষ। থাকেন বস্তিতে। খানপানি আর হাগেন গু। মিয়া, কে না জানে, একটা কিডনিতে মানুষ দিব্যি বাঁচে। আরও ভালো মতো বাঁচার জন্য মধ্যে থেকে বেশকিছু অর্থ-কড়ি হাতে আসে। ভাইরে, আল্লায় অত গরিব না যে, মানুষরে কম দিব। সব দুইটা; একটা একটা বেশি। যাতে প্রয়োজন হলে বান্দারা বেচতে পারে। আসলে যদি বলি, এটা তো বেচাও না, দান। আপনার কিডনিতে আরেকজন বাঁচবে। এর চেয়ে বড় দান হতে পারে? আপনাদের বোঝানো আমার পক্ষে সম্ভব না। যারা বেশি বুঝে, পণ্ডিত তাদের লগে আমি কারবার করি না।আপনি যান।

আতা দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে থামে। মজনুর থেকে মনোযোগ তুলে তার জটলার দিকে মনোযোগ দেয়ার ভান করে।

মজনু তাতে উতলা হয়ে ওঠে আতার হাত চেপে ধরে, ভাই! ভাই!

আপনে কি বলতে চান গরিবরে আল্লায় ভাসায় দিবে? আতা তার বক্তৃতায় ফিরে যায়, কক্ষনো না।

এবার আতার মেয়েলি গলার স্বর আরও চিকন হয়ে ওঠে, আর এজন্যই তাকে দেয়া হয়েছে দুটো কিডনি, একটা বেচবে, আরেকটা দিয়া বাঁচবে। আপনে কন কি না অন্যায়! অপরাধ! পুলিশে দিবেন! তা দেন? বুঝলেন, আমরাও মানুষের জন্যই কাজ করি। এখানে আপনে টাকা পাবেন, ওখানে একজন বাঁচবে। তাতে আমার কী? আমি কেবল মধ্যসূত্র, বুঝলেন মজুন সাব!

আতার দেড়মনি শরীরের নাদুস-নুদুস মাংসের পিণ্ড উত্তেজনায় লাফাতে থাকে, ঝাঁপাতে থাকে। যেন এখনই হাড়ের বন্ধন খুলে ফেটে বেড়িয়ে আসবে।

আতা ভাই, রাগ কইরেন না, রাগ কইরেন না। মজনু হাতজোড় করে আতাকে শান্ত করার চেষ্টা করে, বুঝি নাই, ক্ষমা করুন। আমার একটা ব্যবস্থা করে দেন।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আতা নারাজ ভঙ্গিতে মুখ খুলেন, লন।

এখনই! হঠাৎ মজনুর আত্মা কেঁপে ওঠে।

এখনই মানে এখনই। টাকা কিন্তু পঞ্চাশ।

আপনি ষাটবল ছিলেন যে?

তখন তো আমি গিয়েছিলামরে ভাই। তাছাড়া এখন কিডনির বাজার ভালো না। বিজ্ঞানীরা কী এক কৃত্রিম কিডনি নাকি বানাইছে, সেটাই সবাই নিতাছে। ওগুলা নাকি আরও ভালো। মানুষ বেশি বাঁচে ওগুলা দিয়ে।

ভাই! মজনুর মুখআকুতিতে এতটুকু হয়ে যায়।

হলে চলেন, নই লে বাদ। মজনুর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আতা ফের জটলার দিকে মনোযোগ ফেরায়।

আচ্ছা, চলেন। টাকা কবে পাব?

এক হাতে অপারেশনের বন্ডে সই দিবেন, আরেক হাতেটাকা নিবেন। চলেন।

 

টাকা সে দিবে দিক। পরে ফিরিয়ে দেব।

না যদি তার সাথে বিয়েই না দাও, তার টাকা আমি নিব কেন?

মা রে। সব তো তোর ভালোর জন্যই। সম্বন্ধটাও ভালো। পড়াশোনাও করাবে যতদূর করতে চাস। বড় ঘর গেরস্থালি। তার উপর বাড়ির বড় ছেলে। ওই মজনুর কী আছে বল? বললামই তো যদি না করিস তাহলে আমার ফাঁস টানানো কেউ আটকাতে পারব না, বলে রাখলাম।

ওই টাকা তাহলে আমি নিতে পারব না। এত বড় অন্যায় আমি ওর সাথে করতে পারব না।

আরে টাকাটাতো আমরা নিয়ে যাচ্ছি না। ফেরত দিব।

ওফ্! এ খবর যখন ওর কানে যাবে, সে মরে যাবে।

বোকা মেয়ে, তুই যেমন অন্যরেও তাই মনে করস। সে দেখ শহরে কয়টা প্রেম করছে। যার বন্ধু এত বড়-বড়, পঞ্চাশ হাজার টাকা চেয়েই পেয়ে গেল! তার কী বান্ধবীর অভাব থাকতে পারে! বিপদে ফেলে চলে গেলে কী হবে বল? সমাজে আমাদের কোথায় জায়গা হবে? তুই বল? উত্তর দে?

হয়েছে তুমি চুপ কর। তোমার যা খুশি তাই করো। টাকা আমিনিব না।

দেখ, ছয় মাস হয়ে গেল, সে গেছে। এক বারও এসেছে? আসবেও না কোনো দিন। এতই যদি ভালোবাসে তাহলে এতদিন তোকে না দেখে থাকে কী-করে শালা ফকিন্নির পুত, ওই মজনু!

বাবা তুমি গালি দিবে না বলে দিলাম।

সেদিন আকাশ ছিল মেঘলা। বাতাসের গতি থম মেরে গুমোট হয়ে আছে। বাগানে কতগুলো কাক কা-কা যে শুরু করেছিল সেই সকাল থেকে থামার নাম নেই। শিড়িন ঘরের বারান্দায় পাটিতে বসে একটা বইয়ের পাতা নাড়াচাড়া করছিল। এমন সময় মজনুর ফোন, হ্যালো!

হুম!

কেমন আছো?

ভালো।

বাবা উঠানে বসে পাটের রশি পাকাচ্ছিল টাকুরে করে। সে রশি-টাকুর ছুড়ে ফেলে দৌড়ে এলো শিড়িনের দিকে, ইশারায় বলল লাউড স্পিকার দিতে।

আমিও ভালো। একটু অপেক্ষা করে উত্তর দেয় মজনু।

ও আচ্ছা। টাকা মানি অর্ডার করে দিয়েছি। দিয়েই ফোন দিলাম।

আচ্ছা।

আচ্ছা! তুমি খুশি হওনি?

তুমি এত টাকা কোথায় পেলে?

কেন? বন্ধুর কাছে।

ছেলে না মেয়ে বন্ধু?

মেয়ে বন্ধু! হাহা। মজনু হাসে, মেয়ে বন্ধু তো আমার জীবনে কেবল মাত্র তুমিই।

বন্ধু! আমি তোমার বন্ধু? আমি বন্ধু তোমার!

সব।

তাহলে বন্ধু বললা কেন?

বন্ধুও যে তাই! আরে আশ্চর্য, শি, তুমি এমন করছো কেন? তোমার কী কোনো সমস্যা হচ্ছে, সোনা!

থাকো তোমার বন্ধু নিয়ে, বলে শিড়িন ফোনটা কেটে দেয়।

 

তারপর মাসখানেক কেটে গেছে। একটা ব্যাগ কাঁধে ফেলে মজনুকে দেখা গেল গ্রামের টাক-পড়া স্কুল মাঠের দিকে যেতে। তারও ঘণ্টাখানেক পরে একই পথে দেখা গেল শিড়িনকে।

মেলাদিন পর গ্রামে আসছে মজনু। মুখটা তার এ কয়দিনে শুকনো তবনের ত্যানার মতো কুচকে গেছে। চোখে বাসা করেছে দুই-দুটো অপুষ্ট চড়ুই, যারা কেবল ডানা ঝাঁপটাচ্ছে। গায়ে চকচক করছে নতুন শার্ট-প্যান্ট আর জুতা। দেখলে মনে হবে ধ্বংসপ্রাপ্ত একটা আলনাকে রঙ করে পলিস করা হয়েছে—কিন্তু সেটার যে একটা পায়া নেই তা আর কিছুতেই লুকানো যায়নি। ফলে এই সুন্দর পোশাক তার গায়ে বাড়তি-বাড়তি লাগছে। মনে হচ্ছে কি যেন একটা জোর-জবরদস্তি করা হয়েছে মজনুর সাথে। কিন্তু মুখের হাসিটা কিন্তু তার এই বাহ্যবস্থার বিপরীত; তার চেয়ে বিপরীত মনের অবস্থা। দুটোতেই আনন্দের ঢেউ খেলছে। এই অবস্থার সাথে তুলনা চলে শুধু একটা পাহাড়ের; অনেক কষ্টে যার মাথায় উঠে সামনের দিকে তাকিয়ে দুই হাত পাখির মতো মেলে দিয়েছে ক্লিষ্ট আরোহী, আর তার চোখের সামনের স্তরে স্তরে খুলে যাচ্ছে পহাড়ের পর পাহাড়ের ভাঁজ।

স্কুলের পেছনে গিয়ে ব্যাগটানা নিয়ে ঘাসের উপর বসে মজনু। পোয়াতি গরুর পেটের মতো ব্যাগটা নরীদের বিভিন্ন সামগ্রীতে ফেটে যাচ্ছে। শিড়িন সাজতে পছন্দ করে কি না—তাই এসব।

মজনু একটা পিচ্চিকে দিয়ে শিড়িনকে ডেকে পাঠিয়েছে। ভাগ্যক্রমে শিড়িন তখন বাড়িতেই ছিল। সে এলো। স্কুল ঘরের ঝোপের ভেতর মজনু বসা, পাশে শিড়িন। আগের মতো গা ঘেঁষে না, কিছুটা দূরত্বে।

কেমন আছো শি?

ভালো। শিড়িন আঙুলে কানের চুল ঠিক করতে করতে বলে। তখন তার অনামিকার নতুন আংটিটা হয়ত ঝলমল করে ওঠে।

মজনু সেটা দেখে, হয়ত দেখে না। সব ঠিক আছে তো, জানতে চায় সে।

হুম। তুমি অত শুকিয়েছো কেন? কালো হয়ে গেছ?

একটু জ্বর হয়েছিল তো। তা ছাড়া কাজের অতিরিক্ত ব্যস্ততা।

কী চাকরি করছো?

ছোট্টএকটা। হোটেলের ম্যানেজারি।

বেতন কত?

পনের!

ব্যাগটা সে শিড়িনের দিকে বাড়িয়ে দেয়।

শিড়িন ব্যাগটা নিয়ে পাশে রাখে। হঠাৎ কী মনে করে মজনু উঠে দাঁড়ায়, তাহলে উঠি। বেশি দেরি করা ঠিক হবেনা। খুঁজবে তোমাকে।

শিড়িন মজনুর চোখের দিকে তাকাতে চেষ্টা করে, পারে না। সে আস্তে করে স্কুলের পেছনের ঝোপটা থেকে বেরিয়ে আসে।

মজনু স্কুল ঘরটার দেয়ালে হেলান দিয়ে আরো কিছুক্ষণ বসে থাকে। সামনে দিগন্তবিস্তৃত এক বিল। শাপলায় শাপলায় ছেয়ে আছে। শাপলার গা ছুঁয়ে মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। যা ভেতরে ঢুকে একধরনের প্ররোচনা দেয়—তা ঠিক কী ঠাহর করা যায় না।

মজনুর মাথায় তখন অন্য একটা চিন্তা খেলে যায়। কীভাবে একটা হোটেল দেয়া যায়। হঠাৎ সেই বুদ্ধিটা বিদ্যুতের মতো চমকে ওঠে, আরেকটা কিডনি তো আছে। সেটা বেচে দিলেই তো হয়। পঞ্চাশহাজার। ছোট্ট একটা দোকান দাঁড় করাতে এর বেশি তো লাগে না।

নিউজজি/নাসি 

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন