মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ৮ মাঘ ১৪৩১ , ২১ রজব ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
গল্প

সেই মেয়েটি (৬ষ্ঠ পর্ব)

পি. আর. প্ল্যাসিড সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২১, ১৮:৩৩:১৪

903
  • ছবি: নিউজজি২৪

রাত ক্রমেই গভির হচ্ছিল।

  শীত বেশি বলে লোকজন সবাই ঘরের ভিতের ঢুকে পড়েছে তাই চারিদিক ঝুমঝাম নি:শব্দ পরিবেশ। এমন পরিবেশে মনি উঠোনে দাঁড়িয়ে কিছু একটা করছে ঘর থেকে তাকে দেখা না গেলেও উপস্থিতি টের পাওয়া যায় খচমচ শব্দ হওয়ায়। তাকে দেখার জন্য ভাস্কর উঠে বারান্দায় যায়। উঠোন জুড়ে ভাস্কর অন্ধকার ছাড়া কিছুই আর দেখে না। অনেকক্ষণ তাকিয়ে ভালো ভাবে খেয়াল করলে মনির অস্থিত্ব টের পেয়ে ভাস্কর মনিকে উদ্দেশ্য করে বলে, এমন অন্ধকার পরিবেশ, আমার মনে হয় বহুবছর পর দেখছি। শীতের রাতটাও বেশ ভালো লাগছে। আজকাল তো গ্রাম আর গ্রাম নেই। চারিদিকে বিদ্যুতের ছড়াছড়ি। রাতের বেলাও খুব একটা অন্ধকার চোখে পড়ে না।

  উঠোনে লাইট আছে তো। তোমার দরকার হলে জ্বালাতে পারো। আমার সমস্যা হয় না অন্ধকারে কাজ করতে। কাজ করে অভ্যাস হয়ে গেছে।

  অনেকটা সময় আকাশের দিকে একমনে ভাস্কর তাকিয়ে থাকে। তাকানোর পর আকাশে দু'একটা তারা দেখতে পায় সে। অন্ধকার ভেদ করে আকাশে তারার মিটমিট করা আলো দেখে ভাস্কর পুলকিত হয়।

  আমাদের বনানীর সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেছে আমার। আমি সত্যি কথা বলতে, ভুলেই গিয়েছিলাম। তুমি ফেইসবুকে নক না করলে আমি মনে হয় মনেই করতাম না আর তোমাদের কথা।

  মনি অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়েই কথা বলে। ভাস্করের ইচ্ছে হয় উঠোনে পা রাখার কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে অপরিচিত জায়গা ব্যথা পেতে পারে মনে করে বারান্দায় দাঁড়িয়েই কথা বলে মনির সাথে।

  তোমার এখানে কালকের প্রোগাম কী?

  আমি শুনেছি এখানে নিউজিল্যান্ডের এক ভদ্রলোক গরিবদের সেবাদানের জন্য একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। সেই প্রতিষ্ঠানটি আমি ভিজিট করতে চাই।

  তুমি কি ডাক্তার এডরিক এস বেকারের কথা বলছো?

  ডাক্তার বেকারইতো নাম মনে হয়। তাছাড়া কোনো একসময় বঙ্গবন্ধু এই এলাকায় এসে একটি গেস্ট হাউজে রাত্রী যাপন করেছিলেন। সেই গেস্ট হাউজে সিস্টার কল্পনার সাথে গিয়েছিলাম। কাল আবার যেতে চাই। এর বাইরে তোমাদের এক লোক কারিতাসের কর্মকর্তা, মাঝে মধ্যে লেখালেখিও করেন দেখি। পারলে তার বাড়িটাও ঘুরে দেখতে চাই।

  সবই আমাদের বাড়ির এই কাছেই।

  সকালে ঢাকা থেকে যে গাড়ি নিয়ে এসেছি সেই গাড়ি নিয়েই তোমাদের এই এলাকা আমি ঘুরে দেখতে চাই। বিকালে ময়মনসিংহ মনিস্টারী সিস্টারদের বাড়িতে গিয়ে সেখানে আমার এক বোন রয়েছে ওর সাথে দেখা করে আবার রাতের মধ্যে ঢাকা চলে যাবো।

  একদিনে এতকিছু দেখতে চাও, সময় কুলোবে তোমার?

  কোথাও তো বেশি সময় থাকবো না। জাস্ট চোখের দেখা দেখে গেলে বলতে পারবো যে এসেছিলাম। পরেরবার আবার যখন আসবো তখন না হয় কয়েকদিন থেকে তোমাদের গারোদের সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে যাবো। তাছাড়া তুমি আছো যেহেতু আমি কোনো কিছু জানতে চাইলে তুমি আমাকে এবিষয়ে সহযোগিতা করতে পারবে।

 তুমিতো আমাদের এই এলাকার অনেক কিছুই জানো দেখছি। কবে সেই শেখ মুজিবুর রহমান আইছিলো আর কোথায় রাত থাকছিলো তাও জানো। ভালো তো।

  ভাস্কর উঠে মনির গা ঘেঁষে তার থাকার জন্য যে ঘরে বিছানা করেছে বলল, সেই ঘরে গিয়ে আবার ফিরে আসে। মনি বলে, এখানে তুমি কার কাছে আইসিলা?

  মনি বারান্দায় আসে। এসে বারান্দার লাইট জ্বেলে আবার প্রশ্ন করে, এখানে তুমি কার কাছে আইসিলা?

  এই এলাকায় একটা মিশন আছে। আমার সঠিক মনে নেই। সম্ভবত তোমাদের এই পঁচিশমাইল বাসস্ট্যান্ডের কাছেই।

  আরে হ, পঁচিশমাইল মিশনে তো তোমাগো এলাকার ফাদারও আছে। নাম ডোনেল। চিনো তুমি ফাদার ডোনেলকে?

  আমি খুব কাছের দু একজন ফাদার সিস্টার ছাড়া কোনো ফাদারের সাথে যাগাযোগ রাখি না। তবে ফাদার ডোনেলের নামটা বেশ পরিচিত মনে হচ্ছে আমার কাছে।

  ফাদার ডোনেল অবশ্য তোমার ছোট হবে।

  আমি যখন এসেছিলাম তখন হলিক্রস স¤প্রদায়ের সিস্টার কল্পনা ছিল এখানে। এখন নেই।

  এটাতো হলিক্রসের অধিনেই।

  আমি যখন এসেছি তখন অন্য আরো কয়েকজনের সাথে পরিচয় হয়েছিল কিন্তু তাদের নাম ভুলে গেছি।

  মনি সিস্টার কল্পনার কথা শুনে লাফিয়ে উঠে যেন। সিস্টার কল্পনাকে তুমি চিনো?

  না চিনার কি আছে? ওর কাছেইতো আমি এখানে এসেছিলাম। সেবার আমি এখানে এসে নিউজিল্যান্ডের সেই ভদ্রলোকের দেখা পাই। তখন আমি অবশ্য তাঁর সম্পর্কে এতকিছু জানতাম না। পরে ফেইসবুকে হানিফ সংকেতের ইত্যাদি অনুষ্ঠানে তাকে নিয়ে করা অনুষ্ঠানের কিছু অংশ দেখে মনে হলো সময়করে একবার এসে দেখা করে যাবো।

  সিস্টারদের বাড়িতেই ডাক্তার বেকারের সাথে আমার পরিচয় আর কথা হয়েছিল। বেশ আন্তরিক ছিলেন ভদ্রলোক। ভদ্রলোককে আমি এত কাছে পেয়েও বেশি কথা বলিনি। ভেবেছিলাম পরে আবার আসবো তার সাথে দেখা করে কথা বলতে। এর মধ্যে তো মারাই গেলেন। ডাক্তারের মৃত্যু সংবাদ শোনার পর আমার খুব খারাপই লেগেছে।

  তুমি দেখেসো ওনাকে?

  দুপুরের খাবার খেয়ে সিস্টারদের সাথে বসে গল্প করছিলাম তখনই সম্ভবত পুরোনো একটা বাইক চালিয়ে আসলেন উনি। তখন তো নতুন পরচয় হওয়াতে কত কথাই হয়েছে। বলছিলেন জাপানে তাঁর বেশ কয়েকজন বন্ধু আছেন। তাঁরা তাঁকে ফান্ড দিয়ে সহযোগিতা করছেন।

  মারা যাবার পর উনার সম্পর্কে দেখছি ফেইসবুকে নানা জন নানা রকম বাজে কথা ছড়াচ্ছে। এসব দেখে মনে হয়, কিছু মানুষের জন্মই হয় মানুষ সম্পর্কে না জেনে বাজে রটনা করা। লোকটি তাঁর নিজের দেশ ছেড়ে এসে আমাদের গরিব দু:খী মানুষদের জন্য সারাটা জীবন কাটিয়েছেন এই দেশে, কোথায় তাঁর কাজের প্রশংসা করবে, তা না করে, উল্টো অপবাদ ছড়াচ্ছে তাঁর নামে। অনেকে লিখছে দেখেছি, উনি নাকি গরিবদের সহযোগিতার নাম করে ধর্মান্তরীত করছে।

  আরে দূর। উনি এমন মানুষই ছিলেন না। কত ভালো মানুষ ছিলেন উনি, তুমি জানো না। উনি চাইলে এই এলাকার সব মানুষদের খ্রিষ্টান বানাতে পারতেন। ডাক্তার তো কোনো ফাদার বা ব্রাদার ছিলেন না। খুবই সাধারণ একজন ডাক্তার ছিলেন মাত্র। এমন কিছু যদি করেই থাকতেন তাহলে এদেশের সরকার কি এতোদিন এসব দেখে নাই?

আমি আসছি যেহেতু তাঁর কবরটা অন্তত দেখে যেতে চাই। বলেই প্রশ্ন করে, তাঁর সেই প্রতিষ্ঠানটি কি অনেক দূরে তোমাদের এখান থেকে?

    তেমন দূরে না। এখানে তো পিরগাছা মিশনে তোমাদের এক আত্মীয়ও আছে। ফাদার।

  আমাদের আত্মীয় যে তুমি জানো কি করে?

  তোমার ফেইসবুকে তো সেও আছে দেখলাম। ফাদার নাকি তোমাদের বাড়ির, শুনেছি। তোমার ভাতিজা না কি যেন লাগে শোনলাম। ফাদারইতো বলেছে।

  কোন মিশনে থাকে?

   আমরা ডাক্তার বেকারের ওখান থেকে আসার সময় যাবোনে দেখা করতে। পথেই পড়বে।

  আর মি: নকরেকদের বাড়ি? তাদের বাড়ি কি অনেক দূরে?

  তার বাড়ি একটু দূরেই। তবে ময়মনসিং যাবার সময় তাদের বাড়ি হয়ে  যাওয়া যাবে। যেতে পথেই পড়বে। তার সাথে তোমার পরিচয় কিভাবে?

  একবার এক সেমিনারে দেখা হয়েছিল। শুনেছি উনি নাকি খুব ভালো কবিতা লিখেন।

  ঠিক আছে সবখানেই নিয়ে যাবো। কিন্তু তুমি যে অল্প সময় নিয়ে আইসো।

  আচ্ছা তোমাদের এখানে সকালে খেজুরের কাঁচা রস পাওয়া যায় না?

  কেনো খাবে?

  শীতকাল, গ্রামে এসে যদি খেজুরের রস না খাই তাহলে মনে হয় কেমন যেন যাত্রা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

  খুব সকালে বাজারে গেলে পাওয়া যেতে পারে।

  আমার খুব শখ শীতের সকালে কাঁচা খেজুরের রস গাছ থেকে নামিয়ে খেতে।

  দাঁড়াও, সকালে আমার ভাই বাবুলরে ফোন কইরা দেখি। ও ব্যবস্থা করতে পারতে পারে হয়তো।

  ঘরে ঢুকে মনি নিজে ঘুমানোর জন্য গায়ের শাল আলনায় নামিয়ে রেখে বলে, দুইদিন ধরে এতো বেশি শীত পড়লো যে গতরে শাল জড়াইয়াও শীত নিবারন করতে পারি না।

  মনি তার গারো পোশাক পাল্টে রাতে ঘুমানোর কাপড় পরলো। রাতের পোশাকে তাকে একদম ভিন্ন মানুষ মনে হয়। শহরে কিছু বড়লোক মহিলা আজকাল শাড়ি বাদ দিয়ে এমন কাপড় পরতে অভ্যস্ত। মনি টেলিভিশনে নাটক-সিনেমা দেখে এমন কাপড় পড়তে অভ্যস্ত হয়ে থাকতে পারে। ভাস্কর ওর দিকে তাকিয়ে আবার নিজের বিছানার দিকে যায়। পিছু পিছু মনি এসে তার বিছানার উপর মশারি টানিয়ে দিয়ে লাইট অফ করে বলে, নেও, এবার ঘুমাও। সকালে আবার দেখা হবে, গুডনাইট। বলে ঘরের লাইট একবার জ্বালিয়ে আবার অফ করে। এরপর ঘরের দরজা টেনে বন্ধ করে রেখে সে পাশের ঘরে চলে যায়।

  ভাস্কর বালিশে মাথা রাখার সাথে সাথে মশারির বাইরে মশার পোন পোন শব্দ শুনতে পায় ভাস্কর। হাত দিয়ে একটু ঝটকা মারার মতো করে মশারি দূরে সরিয়ে মশার পোন পোন শব্দ শোনা বন্ধ করার চেষ্টা করে হাত পা গুটিয়ে সে শুয়ে পড়ে। মনি পাশের ঘর থেকে বলে, রাতে কোনো কিছুর দরকার হলে ডাক দিও। ভাস্কর তার কথায় সাড়া দেয় না। চুপ করে ভাবতে থাকে, এ আমি কোথায় এলাম। বিছানা এতটাই ঠান্ডা যে, মনে হয় বিছানায় পানি ঢেলে ভিজিয়ে রাখা হয়েছে। ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে যায়।

 

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন