মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ৮ মাঘ ১৪৩১ , ২১ রজব ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
গল্প

সেই মেয়েটি (৩য় পর্ব)

পি. আর. প্ল্যাসিড আগস্ট ২৪, ২০২১, ১৬:০৫:৪৯

3K
  • সেই মেয়েটি (৩য় পর্ব)

মাটির রাস্তা। অনেক বছর ধরে ভাস্কর এমন মাটির রাস্তায় হাঁটেনি, তারমধ্যে আবার ঘুটঘুটে অন্ধকার। অপরিচিত রাস্তায় এক কদম এগিয়ে আবার থেমে যায়। বাচ্চা দুটির পথ চলায় কোনো সমস্যা হয় না। ওরা দুজন লাফিয়ে পথ চলছে। এই পথে সকাল বিকাল, আলো-অন্ধকার, ঝড়-বৃষ্টিতে হরহামেশা হাঁটে ওরা। যেকারণে ওদের কাছে মুখস্ত এই পথ। ভাস্করের বেলায় তা নয়। পুরো পরিবেশই অপরিচিত তার কাছে। তাই একমিনিটের পথ চলতে তার পায়ে বাঁধা লাগে বারবার। একবার থেমে প্রশ্ন করে, তোমাদের বাড়ি আর কত দূর? মনি হাতের টর্চ জ্বালিয়ে সামনের দিকে একটু উঁচু করে আলো জ্বেলে বলে, আরে, ঐতো সামনের বাড়িটাই। কেনো, হাঁটতে তোমার খুব সমস্যা হচ্ছে নাকি?

  কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে। কি ঘুটঘুটে অন্ধকাররে বাবা।

  আরে রাস্তায় কোনো কিছু নেই। একদম সমান রাস্তা। ওরা দেখছো না কত সহজভাবে হাঁটছে। সমস্যা হলে এই নেও টর্চ, তোমার সুবিধা মতো জ্বালিয়ে পথ দেখে তারপর হাঁটো।

  ভাস্কর সামনে হাঁটার সময় মনি টর্চ একবার জ্বালিয়ে আবার অফ করে। তখনই হয় যত সমস্যা। চোখে কেমন আলো আঁধারের খেলা। পথ চলায় অন্তরায় হয় তার। তাই একবার থেমে দাঁড়ায় ভাস্কর এরপর মনির কাঁধে হাত রাখে ভাস্কর। বাচ্চা ছেলেদের মধ্যে ছোট ছেলেটি বলল, দাদু তুমি কি ভয় পাও?

  ছেলেটির মুখে দাদু ডাক শুনে ভাস্কর ভাবে, মনি তাহলে বুড়ি হয়ে গেছে। আসলে অনেকগুলো বছর কেটে গেছে তাদের পরিচয়। সেই সাদা সালোয়ার তার উপর ফুলের ছাপা কাপড়ের তৈরী কামিজ আর বুকের উপর হলুদ রঙের ওড়না। মাথায় ছিল ঝাঁকড়া চুল। পরিচয় পর্বে ভাস্কর মনিকে এমনটাই কচি খুকির মতো দেখেছিল। এখন যে সেই খুকিটি আর খুকি নেই তা বাচ্চা ছেলে দুটির ডাক শুনে মনে করে সে।

সেই যে বনানী মেজর সেমিনারির চার দেয়ালের ভিতর সবুজ ঘাসের উপর পাশাপাশি বসে গল্প করা চঞ্চল প্রকৃতির মেয়েটি তার মনের এবং চোখের আড়ালে এতবছর থেকে একসময় বেড়ে উঠল। যুবতি হয়ে বিয়ে হলো, সন্তান হলো তাদের ঘরে, আবার নাতি নাতনিও হয়েছে। ভাস্করেরও যে বয়স বাড়েনি, তা কিন্তু নয়। তবে ভাস্করের মন যেন সেই আগের জায়গাতেই থেমে আছে। যে কারণে মনি ম্রং নামটি শুনে প্রথম ম্যাসেঞ্জারে কথা বলার সময় মন তার একটু আধটু আনচান করছিলো। আজ তাকে দেখে এবং তার সাথে নাতিদের দেখে নিজেও মনির মতো বুড়ো হয়ে যায় মনের দিক থেকে। মনেমনে বয়সের কথা চিন্তা করে ভাস্কর প্রশ্ন করে, এই আচ্ছু, তোমার নাম কি?

  ছেলে দুটি হে হে হে করে হেসে প্রশ্ন করে, দাদু তুমি গারো ভাষা জানো?

  কেনো দাদু?

  এইযে তুমি আচ্চু বললা?

  জানি বলেইতো বললাম।

  মনি জানতে চাইলো, তুমি আবার এই আচ্ছু শব্দ জানো কো-ত্থেকে?

  আমি ছোটো সময় তোমাদের গারো পাহাড়ি এলাকায় অনেক এসেছি। আমার আপন এক জ্যাঠা ছিলেন, ফাদার। তিনি তোমাদের গারো এলাকাতেই থাকতেন। গারো সবাই আমার ফাদার জ্যাঠাকে শুনতাম, আচ্ছু ডাকতো। সেই থেকে এই আচ্ছু ডাকটা মনে রেখেছি।

  গারো এলাকা বলতে কোথায় এসেছো?

  বললাম তো, আমার জ্যাঠা ছিলেন ফাদার। তিনি তার পুরোহিত জীবনের শুরু থেকেই শুনেছি গারো এলাকায় থেকে তাদের শিক্ষার আলো দিয়েছেন।

  তা তো বোঝালাম, গারো এলাকার কোথায় ছিলেন উনি?

  ভালুকাপাড়া, রানিখং, বিরোইডাকুনী আরো কতসব এলাকার নাম, আমার মনে নেই। আমি যে সময়ের কথা বলছি, সেসময় জ্যাঠা থাকতেন ভালুকাপাড়া মিশনে। এটা সম্ভবত ১৯৭৫ সালের শুরুর কথা। জ্যাঠার ওখানে গিয়ে আমি একমাস সময় ছিলাম। সে সময় জ্যাঠার জুবিলি করার প্রস্তুতি চলছিল। সেসময় গারোদের দেখতাম অনেকে পুকুর ঘাঁটে ল্যাংটা হয়ে গোসল করতো। আমার কাছে কেমন লাগতো তখন বিষয়টি দেখে। তাছাড়া অনেকে আবার ল্যাংটি পড়ে চলাফেরা করতো।

  সেতো অনেক আগের কথা। তখন গারোরা এখনকার মতো ছিল নাতো। এখনতো কতো পরিবর্তন হয়েছে আমাদের গারো লোকদের।

  নাতি দুজন বেশ পাকা। ল্যাংটা বলায় খিলখিলিয়ে হাসলো। হেসে বড় নাতিটি বলল, এখন গারোরা আর ল্যাংটা থাকে না। ছোটো নাতিটাও তার ভাইয়ের কথার রেশ ধরে বলল, দাদু, আমি ল্যাংটা থাকি।

  ভাস্কর আবার প্রশ্ন করে, - আচ্ছু, তোমার নাম কি?

  একজন উত্তর দেয়, আমার নাম কিং মৃ আর ডাডার নাম জিসান মৃ।

  ডাডা না, বলো দাদা।

  আবার বলে, ডাডা।

  তোমার বয়স কত?

  জানি না।

  ওরা যা দুষ্টু হয়েসে না। তুমি ওদের সাথে কথা বলে পারবাই না। বাড়িতে গেলে দেখবা কি করে ওরা তোমাকে নিয়ে। সারাদিন আমাকে এই দুইটায় পাগল বানিয়ে ছাড়ে। আমি আর পারি না ওদের সাথে। মনি বলল।

  ওরা কি তোমার ছেলের ঘরের নাতি নাকি মেয়ের ঘরের?

  ছেলের ঘরে। কি করে ওর বাবা-মা, বাড়িতেই থাকে নাকি ঢাকায় থাকে?

  ছেলে ঢাকা গাড়ি চালায়। আর ওদের মা ওদের রেখে চলে গেছে।

  চলে গেছে বলতে? মনি কি বলছে পরিষ্কার হবার জন্য ভাস্কর আবার একই প্রশ্ন করতে যেয়েও প্রশ্ন করে না।

  বড় নাতি উত্তর দেয়, দাদু ওর বয়স চার। ও এখনো স্কুলে যায় না।

  এরমধ্যেই বাড়ির আঙিনায় এসে উপস্থিত হয় তারা। উঠোনে এসে উপস্থিত হলে একটা কুকুর দৌড়ে কাছে এসে এমন ভাবে ঘেউ ঘেউ করতে শুরু করে তা দেখে ভাস্কর ভয় পেয়ে কিছুটা জড়োসড়ো হয়ে যায়। ভাস্করকে ভয় পেতে দেখে মনি কুকুরটিকে সামলাতে এগিয়ে যায়। ভাস্কর তখনো ভয়ে কাচুমাচু করতে থাকে। ভাস্করকে ভয় পেয়ে কাচুমাচু করতে দেখে কিং আর জিসান হাসে। দুজনই বলে, তোমাকে ও চিনে না তাই এমন করছে। চিনলে দেখো এমন আর করবে না।

  মনি একটা ছোটো ঘরে কুকুরটাকে টেনে নিয়ে ভিতরে এসে ভাস্করকে বলে আসো ঘরে এসে আগে বিশ্রাম নেও। বলে সে বড় একটি ঘরের সামনে আসে। ঘরের সামনে এসে বারান্দায় গ্রীলের গেইট খুলে ভাস্করকে ভিতরে যেতে আহবান জানায়। ভাস্করের ঘরে যাবার আগেই কিং আর জিসান ভিতরে গিয়ে বারান্দার লাইট জ্বালায়। পিছু পিছু মনি ঘরে এসে সোফায় বসতে বলেই প্রশ্ন করে, আগে ভাত খেয়ে নিবে নাকি পরে খাবা? তোমার জন্য চ্যু তৈরী করেছি। এখনো ভালো করে হয় নি। এটা বানাতে আসলে অনেক সময় লাগে। তুমি যে সময় আসার কথা বলেছ, এত অল্প সময়ে চ্যু আসলে ভালো হয় না।

  ভাস্কর বলল, আমি অনেক আগে একবার জলছত্র এসেছিলাম। বলেই আবার বলে, সেই কবে আমি জলছত্র এসেছি। সবকিছু এখন আর ভালো মনে নেই। তবে তখন আমি মনে হয় ক্লাস নাইনে বা টেনে পড়ি। সঠিক মনে নেই। জলছত্র মিশনের সিস্টার মালতীকে চিনো? ওর ভাইয়ের নাম সিলভেস্টার সাংমা না কি যেন। আমার দুই বছরের সিনিয়র ছিল স্কুলে। আমরা নাগরী এক সাথে হোস্টেলে থেকে পড়ালেখা করেছি। যদিও সে ছিল ব্রাদার লাইনে কিন্তু মেট্রিকের আগে ব্রাদার লাইন থেকে বের হয়েগিয়েছিল। একবার ওদের বাড়ি এসেছিলাম সিস্টার মালতীর সাথে। সিস্টার মালতী তখনও সিস্টার হয়নি। আমার এক বড় বোন তখন ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজে সিস্টার মালতীর সাথে পড়া লেখা করতো। কি এক উৎসবে যেন এসেছিলাম ওদের বাড়ি। তাও সঠিক মনে নেই আর। অনেক অভিজ্ঞতাই হয়েছিল সেসময় আমার তোমাদের এই জলছত্র এসে। তখনই আমি প্রথম এই চ্যু খাই। চ্যু খেয়ে তো আমি পুরো নেশা হয়ে গিয়েছিলাম। তোমাদের গারোদের রান্না খারি খেয়েছিলাম প্রথম মনে হয় ওদের বাড়িতেই। খুব স্বাদ হয়েছিল।

  আগে অবশ্য এই খারি ভালুকাপাড়া মিশনেও খেয়েছি। তখন খেলেও আমার কাছে অতটা মনে নেই। তবে সিলভেস্টারদের বাড়িতে যে খেয়েছি তা এখনো আমার বেশ মনে পড়ে। যদি পারো, তাহলে তুমি আমাকে কালকে খারি রান্না করে খাওয়াবে। মনি একটা বড় বাথ টাওয়েল এনে সামনে বাড়িয়ে ধরে বলে, নেও, ওখানে বাথরুমে গরম পানি রাখা আছে, হাত মুখ ধুইয়ে ফ্রেস হয়ে নেও আগে। এরমধ্যে তোমার জন্য আমি খাবার রেডি করছি।

  ভাস্কর টাওয়েল হাতে নিয়ে বলে, ঘরে লুঙ্গি থাকলে একটা লুঙ্গি দেও। কাপড় বদলাই আগে।

  মনি পাশের ঘর থেকে একটা বড় কাপড় এনে দিয়ে বলল, এটা পরো।

  ভাস্কর সেটি হাতে নিয়ে দেখে গারো মেয়েরা নীচে যে কাপড় পরে তারই একটি এটি। এমনকি মনি তখন এমন একটি কাপড়ই পরা ছিলো। তাই কাপড় হাতে নিয়ে পুরো কাপড়ের ভাজ খুলে দেখে মনির দিকে তাকায় ভাস্কর।

  এরপর কাপড়টি দুই হাতে পেচিয়ে কাঁধে রেখে সে প্যান্টের ব্যাল্ট খুলতে থাকে। প্যান্ট খুলে তা সামনে কাপড় রাখার আলনায় রাখে। এরপর কাঁধের মধ্যে টাওয়েল ঝুলিয়ে কোমরে পেচানো কাপড় কিছুটা উপরদিকে তুলে পায়ের পাতা চুলকায়। এরপর ভাস্কর ভিতরের ঘরে যেখানে ফ্রেস হবার জন্য পানি দেওয়া রয়েছে সেখানে যায়। মনি বলল, গরম পানি দিয়েছি দেখো। এখানকার পানিতে কিন্তু হাতই দিতে পারবানা তুমি, খুবই ঠান্ডা।

  ভাস্কর বাথরুমে গিয়ে দেখে বড় এক বালতিতে পানি দিয়ে তার মধ্যে গিজার ডুবিয়ে রেখেছে। সেটা তুলে পাশে অন্য একটি খালি বালতিতে রেখে গরম পানি দিয়ে হাতমুখ ভালোভাবে ধুইয়ে নেয়। এরপর বসার ঘরে ফিরে আসার সময় দেখে কিং আর জিসান বিছানায় বড় এক কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। বিছানার পাশে একটু দাঁড়িয়ে থেকে ভাস্কর ওদের সুন্দর পবিত্র মুখ দেখে এরপর বসার ঘরে এসে সোফার মতো চেয়ারের একদিকে হেলান দিয়ে বসে। পাশে তখন মনিও বসে।

নিউজজি/এস দত্ত

 

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন