মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ৮ মাঘ ১৪৩১ , ২১ রজব ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
গল্প

সেই মেয়েটি (২য় পর্ব)

পি. আর. প্ল্যাসিড আগস্ট ১৭, ২০২১, ১৭:০৪:৪৫

953
  • সেই মেয়েটি

মনির সাথে কথা বলার পর ভাস্কর গাড়ির চালককে কাছেই খোলা রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামাতে বললে চালক গাড়ি নিয়ে এসে বাজারের ভিতর থেকে মেইন রাস্তার উপর গাড়ি এনে থামায়। পুরো এলাকা তখন ফাঁকা। রাস্তার ধারে কয়েকটি দোকান খোলা থাকলেও রাস্তায় কয়েকটি কুকুর ছাড়া কোনো মানুষজনের উপস্থিতি নেই।

কুকুর কয়েকটি রাস্তার উপর জোট বেঁধে লাফালাফি করছে। ভাস্কর কিছুক্ষণ কুকুর গুলোর লাফালাফি করা দেখে গাড়ি থেকে বের হয়ে আসে। এসে গাড়ির চালককে ভাড়া দিতে সামনে দিয়ে ঘুরে চালকের কাছে যায়। ভাড়া দিতে গিয়ে দেখে তার ওয়ালেটে ভাঙ্গতি কোনো টাকা নেই। তাই সামনে এক দোকানে গিয়ে দোকানিকে অনুরোধ করে তাকে টাকার ভাঙ্গতি দিতে। ভাস্করের দিকে তাকিয়ে দোকানি প্রশ্ন করেন, ঢাকা থেকে আসছেন বুঝি?

ভাস্কর কোনো উত্তর দেয় না।

দোকানি আবার প্রশ্ন করলেন, এখানে কার বাড়িতে যাবেন?

দোকানির প্রশ্ন শুনে ভাস্কর পাল্টা প্রশ্ন করে, টাকার ভাঙ্গতি চেয়েছি। আমি কার বাড়ি যাবো তা জেনে কি করবেন? সেটা না জেনে কি টাকার ভাঙ্গতি দিবেন না?

  আসলে তা নয়। আমার কাছে থাকলে আপনাকে ভাঙ্গতি না দেবার কিছু নেই। আপনাকে এই এলাকায় প্রথম দেখছি তো, তাই জানতে চাইলাম। অন্য কোনো কারণে প্রশ্ন করিনি। আপনি মাইন্ড করেছেন মনে হয়। সরি, এভাবে আমার জিজ্ঞেস করাটা মনে হয় ঠিক হয়নি।

  ভাস্কর লোকটির কথায় গুরুত্ব না দিয়ে মনে মনে ভাবে, এভাবে সে হয়তো তার টাকার ভাঙ্গতি দিবে না, তাই ঢাকা থেকে আসার সময় গাড়ির চালকের সাথে কথা বলে তার ব্যক্তিগত কিছু বিষয় জেনে নেয়। যেমন, ঘরে তার ছোট দুইটি ছেলে-মেয়ে রয়েছে। ছেলে-মেয়েদের কথা ভেবেই ভাস্কর তাকে কিছু জিনিস কিনে নিতে বলে। চালক তখন দোকানদারকে কিছু মালের অর্ডার দেন। দোকানদার লোকটি চালকের চাহিদা মিটাতে তার গদি থেকে উঠে একটা বিস্কুটের প্যাকেট আর ছলে মেয়েদের জন্য কিছু জিনিস কাউন্টারের দিকে এগিয়ে দেন।

  এরপর হিসাব করে দেখেন সর্ব সাকুল্যে তার পঞ্চাশ টাকা বিল হয়েছে। পঞ্চাশ টাকা বিল রাখার জন্য একহাজার টাকার একটা নোট দোকানদারের দিকে এগিয়ে দেয় ভাস্কর। দোকানদার একবার টাকার নোটটা উপরে লাইটের দিকে উঁচু করে ধরে দেখে আসল-নকল কিনা? এরপর বিলের টাকা রেখে বাকি টাকা ফিরিয়ে দেন। টাকা ফিরিয়েদিলে ভাস্কর একবার গুনে টাকা বুঝে নেয়। এরমধ্যে এক লোক কাছে এসে গাড়ির চালকের সাথে কথা বলতে শুরু করে। ভাস্কর ওদের কথায় কান না বাড়িয়ে কল করে মনিকে। মনি ফোন রিসিভ করে বলল, এইতো আমি কাছেই চলে এসেছি, তুমি কই?

আমি তো রাস্তার উপরই দাঁড়িয়ে আছি।

  কই তুমি? আমি তো তোমাকে রাস্তার উপর এখানে দেখতে পাচ্ছি না।

  এখানে রাস্তার উপর একটা সাদা প্রাইভেট গাড়ি দাঁড়ানো আছে, তা দেখতে পাচ্ছো? গাড়ির কাছে আসো।

  পাশে যে রেস্টুরেন্ট আছে সেখানে তো তোমাকে দেখছি না, তুমি কই।

  মনির আসতে দেরি হতে পারে মনে করে তখনো ভাস্কর রাস্তার উল্টো পাশের দোকানে দাঁড়িয়ে দোকানির সাথে কথা বলছিল। রাস্তার উপর তখনো কুকুর গুলো লাফালাফি করছিল, তা দেখে ভাস্কর বেশ আনন্দ পায়। দেখে মনে হচ্ছিল কুকুর গুলো নিজেদের মধ্যে ভালোবাসা করছে। এরপর কিছু একটা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে ওরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে। মানুষের মতো করেই কুকুর গুলো একটি আরেকটির উপর লাফিয়ে পড়ছে আবার গলায় জড়িয়ে ধরছে। ভাস্করের কাছে এই দৃশ্য নতুন না হলেও অনেকদিন পর দেখায় একটু মন দিয়ে দেখতে থাকে কুকুর গুলোর এমন খেলা করা। এসময় কালে গ্রামের জন্য এটা খুব স্বাভাবিক দৃশ্য হলেও অনেকদিন পর দেখায় সে কুকুরদের জোট করার দিক থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারে না।

রেস্টুরেন্টের সামনে দুটো লাইট লম্বা তারের মধ্যে ঝুলছে। আলো অনেকটা দুর্বল। লাইটের চারপাশে নানা রকম ছোট ছোট পোকা উড়ছে। রেস্টুরেন্টের ভিতর বসা কিছু লোক চাদর দিয়ে নিজেদের মুখ ঢেকে বসে চা খাচ্ছে। পাশে কেউ আবার এমনি বসে গল্প করছে। লোক গুলোকে দেখে বোঝা যায় এই এলাকায় বেশ শীত পড়েছে। শীত থেকে নিজেদের ওরা রক্ষা করতেই এভাবে চাদর দিয়ে নিজেদের ঢেকে রেখেছে। ভাস্কর ওদের দেখে আর নিজের কথা ভাবে। তার গায়ে কোনো প্রকার শীত অনুভূতি হয় না। যে দেশে সে থাকে সেই দেশের শীতের কাছে মধুপুর পঁচিশমাইল বাজারে লোকদের দেখে যে শীতের কথা অনুমান করে তা যেন কিছুই না। তাই ইচ্ছে করে তার নিজের শরীরে চিমটি কেঁটে বোঝার চেষ্টা করে সে ব্যথা পায় কিনা? না হলে তো শীত তার গায়ে লাগার কথা।

  চারপাশের পরিবেশ দেখে এলাকা সম্পর্কে বুঝতে পারছে না এই এলাকা কি শহর নাকি গ্রাম। যেহেতু মনি বলছে সে বাজারেই আছে তাই ভাস্কর কনফার্ম হতে দোকানিকে আবার প্রশ্ন করে, ভাই এটা তো পঁচিশমাইল বাজার, এতে ভুল নেই?

  তখন দোকানি বলল, না ভুল নেই। আপনার লোককে বলেন আপনি যতীনের দোকানে আছেন। তাহলে অবশ্যই চিনবে।

  যখন বললেন যতীনের দোকান তখন ভাস্কর নিজে থেকে বলল, আমি মনি ম্রং-এর বাড়ি এসেছি। চিনেন আপনি মনি ম্রংকে?

  আরে হ, মনি আমার ভাতিজি হয়। বসেন, আপনি তাকে আমার কথা বলেন, দেখবেন এখনই দোকানে এসে হাজির হবে। বলেই প্রশ্ন করলেন, মিঠুনের মা তো?

  ভাস্কর কথা শেষ করার আগেই মনি আবার ফোন করে। ভাস্কর তখন কথা বলতে বলতে রাস্তায় নেমে আসে। রাস্তায় নেমে এসে দেখে মনি তার সামনে কাছেই দাঁড়িয়েআছে। কিছু সময় এক দৃষ্টিতে ওর দিকে ভাস্কর তাকিয়ে থাকে। গায়ে গারোদের বিশেষ পোশাক। উপর দিকে বেগুনী রঙের ভারি চাদর দিয়ে ঢাকা। মুখটুকু শুধু খোলা। মুখ ফাঁক করে খুলে সাদা দাঁত দেখিয়ে হাসতে থাকে। হাসির সাথে চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে সে ভাস্করের দিকে। মনির সাথে ছোট ছোট দুটি বাচ্চা ছেলে। ছেলে দুটি মনিকে জড়িয়ে ধরে আছে। ভাস্করকে দেখে তার কাছে এগিয়ে আসে। এসে খুব সুন্দর করে ভাস্করের হাত ধরে টানতে শুরু করে, যেন কতকাল আগে ভাস্কর ওদের পরিচিত।

ভাস্কর মনির কাছে জানতে চায়, ওরা কে বা কি হয় তার।

মনি বলল, তার নাতি হয়। ছেলের ঘরে নাতি।

নাতি হয় বলাতে ভাস্কর বেশ অবাক হয়। এতটাই অবাক হয় যে কিছুদিন আগে যখন ভাস্করকে যে প্রথম ফেইসবুকে মনি বলছিল, তার বিয়ে হয়েছে এবং তার ছেলেমেয়ে সবাই বেশ বড় এবং তাদের বিয়েও দিয়েছে এর সবটাই যেন এখন ভাস্কর ভুলে বসে গেছে।

১৯৮০ সালে সে যে মনি ম্রংকে দেখেছে সেই মনিকেই যেন খুঁজছিল তার সামনে দাঁড়ানো মনির চেহারায়। তার সাথে বাচ্চা ছেলে দুটিকে দেখে বুঝতে পারে তাদের শীতের পর্যাপ্ত বস্ত্রের অভাব। গায়ে যে কাপড় জড়ানো তাতে শীত নিবারণ হচ্ছেনা, শীতে কাঁপছে ওরা।

এখানে আসার আগে ভাস্কর ভেবেছিল, মনির সাথে দেখা হলে প্রথম দেখায় তাকে জড়িয়ে ধরবে এবং জড়িয়ে ধরে উল্লাস প্রকাশ করবে কিন্তু শীতের মধ্যে ওদের কাঁপতে দেখে ভাস্করের সেই ইচ্ছে শীতের হালকা মৃদু বাতাসের সাথে মিশে যায়। সব আবেগ নিজের মধ্যে গুটিয়ে রেখে ভাস্কর প্রশ্ন করে মনিকে, কেমন আছ তুমি?

ভালো আসি। তুমি কেমন আসো?

মনি কথা বলার সময় তার বাংলা উচ্চারণে বাংলা আর বাংলার মতো শোনায় না ভাস্করের কাছে। বিদেশিদের মুখে বাংলায় কথা বলার মত মনির মুখে বাংলার উচ্চারণ শোনায়।

মৃদু হেসে আবার প্রশ্ন করে, বাড়ি কি খুব কাছেই তোমাদের নাকি গাড়ি করে যেতে হবে?

হো, কাসেই।

আমি কিন্তু তোমাদের এই পঁচিশমাইল আগে কয়েকবার এসেছি।

আমার সাথে যোগাযোগ করলে না কেনো? তুমি তো আমাকে ভুলেই গেসো। তোমার ফেইসবুক আমি দেখেসি। তুমি অনেক বিখ্যাত মানুষ হয়ে গেছো মনে হয়। তুমি তো এখন কবি মানুষ। আমাদের গরিবের কথা মনে করেসো যে, এতে আমি অনেক খুশি হয়েসি।

ভাস্কর এখন কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। মনির নাতিদের জন্য দোকান থেকে কিছু কিনে নেবার কথা বলে। মনি তাতে নিষেধ করে বলে, ওদের জন্য কিসু লাগবে না। বাড়িতে অনেক কিসুই আছে। চলো যাই বাড়িতে আগে।

এত রাত হয়ে যাওয়ায় সে আবার ভাবে, পরের দিন ওদের হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিবে বা এক সাথে বাজারে এসে ওদেরকে কিছু কিনে দিবে। তাই কথা না বাড়িয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। এমন সময় গাড়ির চালক এসে ভাস্করের সামনে দাঁড়ায়। ভাস্কর তাকে রাতটুকু কোথাও থাকার জন্য আলাদা কিছু টাকা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, পরেরদিন তাকে নিয়ে এলাকায় ঘুরে দুপুরের পর ময়মনসিংহ শহরে যেতে হবে। শহরে ভাস্করের ছোট বোন থাকে তাই তার সাথে দেখা করে রাতের মধ্যে ঢাকা ফিরবে।

গাড়ির চালকের সাথে কথা বলে সে আবার মনির দুই নাতির হাত ধরে সামনে হাঁটতে থাকে। এমন সময় বাজারের উপর মসজিদ থেকে মাইকে আযানের শব্দ ভেসে আসে। আযানের ধ্বনি শুনে ভাস্কর মনে মনে ভাবে, দেশের সর্বত্র এই একই চিত্র। পঁচিশমাইলও যে দেশের অন্য কোনো এলাকা থেকে আলাদা নয়। আযানের শব্দে কিছু সময় দুজন চুপ করে পাশাপাশি হাঁটলেও ভাস্কর আযান শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা না করে এক সময় কথা বলা শুরু করে। 

একসময় আযান শেষ হলে ভাস্কর প্রশ্ন করে, তোমাদের এই এলাকাতেও কি মুসলিম আছে?

কেনো, বাংলাদেশ তো মুসলমানদেরই দেশ। এখানে থাকবে না কেনো? তবে আগে এতো বেশি সিলো না। এখন বাড়তেসে।

ওদের সাথে পাশাপাশি বসবাস করতে কোনো সমস্যা হয় না?

সমস্যা তেমন হয় না। তবে...

মনি তবে বলে থেমে যায়। ভাস্কর বুঝতে পারে কিছু একটা যে তার বলার ইচ্ছে ছিল। কোনো ভীতি বা অন্যকোনো কারণে হতে পারে সে তার কথা আর বলতে চাইছে না। ভাস্কর বিষয়টি অনুমান করে, এ বিষয়ে কোনো কথা আর বাড়ায় না। এরপর রাস্তা থেকে বামদিকে শরু এক অন্ধকার রাস্তায় ঢুকে যায় তারা। মনির হাতে টর্চ লাইট। লাইট জ্বালিয়ে ভাস্করকে সামনে পথ চলতে সহায়তা করে মনি।

চলবে…

 

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন