মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ৮ মাঘ ১৪৩১ , ২১ রজব ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
গল্প

ছোটগল্প : পুরস্কার

আমিনুল ইসলাম মামুন  জুন ১৪, ২০২০, ০৩:০১:৩৯

3K
  • ছোটগল্প : পুরস্কার

মাগরিবের আযান হলো অল্প কিছুক্ষণ আগে। রেল লাইনের পাশ ঘেঁষা পাকা সড়ক ধরে স্কুটারযোগে বাসায় ফিরছেন রফিক সাহেব। সঙ্গে তার বৃদ্ধ মামাও। সড়কের ধারে রেল লাইন সংলগ্ন জায়গায় গজিয়ে উঠেছে বস্তি। স্কুটার বস্তির কাছাকাছি আসতেই রফিক সাহেব লক্ষ্য করলেন মটর সাইকেল আরোহী তিন বখাটে যুবক তাদেরকে অনুসরণ করছে। স্কুটার চলছে নিজ গতিতে। রফিক সাহেব ওদের মতি-গতি পুরোপুরি বুঝে ফেললেন। রাস্তার ওপর বস্তির একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে উদাস ভঙ্গীতে। রফিক সাহেব কেন যেন ভাবলেন, একে বিশ্বাস করা যায়। তিনি ছোট্ট একটি প্যাকেট খুব দ্রুত ছুঁড়ে দিলেন ছেলেটির দিকে। ছেলেটি সেটি নিয়ে দ্রুত বস্তির ভেতর ঢুকে পড়ল। বয়স তার নয়-দশ বছরের মত হবে।

বখাটে ছেলেগুলো এ বিষয়টি একটুও খেয়াল করেনি। তারা বস্তি বরাবর রাস্তার শেষ প্রান্তে এসে স্কুটারের সামনে মটর সাইকেল থামিয়ে রফিক সাহেব ও তার মামাকে ধরল। রফিক সাহেবকে বলল, ভালোয় ভালোয় স্বর্ণালঙ্কারগুলো দিয়া দ্যান।

ওরা দুই পাশ থেকে দু’টি ছুরি বের করল। বলল, নইলে পেটের ভুঁড়ি বাহির কইরা ফালামু। রফিক সাহেব বললেন, আমাদের কাছে তো কোন স্বর্ণালঙ্কার নেই।

ছিনতাইকারীদের একজন বলল, এই মিয়া, আমরা বায়তুল মোকাররম মার্কেট থাইকা ফলো কইরা আইতাছি। শয়তানের চোখকে ফাঁকি দিবার পারেন, কিন্তু আমাগো চোখকে না। জলদি বাহির করেন।

রফিক সাহেবের একই কথা। অবশেষে তারা রফিক সাহেব ও তার মামাকে ভালো করে দেখল স্বর্ণালঙ্কারগুলো কোথাও লুকিয়ে রেখেছে কি না। না পেয়ে তারা কিছু নতুন কাপড়-চোপড় ও তাদের হাত ঘড়িসহ সঙ্গে থাকা টাকাগুলো নিয়ে গেল। দু’ দিন পরেই রফিক সাহেবের বড় মেয়ের বিয়ে। তাই তিনি ও তার মামা মার্কেটে গিয়েছেন মেয়ের বিয়ের গয়না কিনতে। অনেক টাকার স্বর্ণালঙ্কার কিনে তারা বাসায় ফিরছিলেন। পথেই ঘটল এই অনভিপ্রেত ঘটনা।

পরদিন সকাল দশটার দিকে ছেলেটি যেখানে ছিল, রফিক সাহেব সেখানে এলেন। ছেলেটিও সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিল আজও। সে রফিক সাহেবকে দেখামাত্রই চিনলো। বলল, আপনি না কাল...

ছেলেটি কথা শেষ করার আগেই রফিক সাহেব বললেন, হ্যাঁ।

: বেশ ভাল করেছেন। অবশ্য ভুলও করেছেন। এভাবে অপরিচিত কারও কাছে এত দামী জিনিস দেওয়া ঠিক না। এই নেন আপনার আমানত।

: আমি দেখেছি ধরা পড়লেই ওরা জিনিসগুলো নিয়ে নেবে। তখন ভেবেছি তোমার মত একটি নিষ্পাপ শিশুই হয়তো তা রক্ষা করতে পারে। তুমি পড়ালেখা কর নাকি?

: জ্বি না। বাবা নাই। মা’রে ছাইড়া চইল্যা গেছে। ঠিকমত দিনে দুই বেলা ভাতও জোটে না, পড়ালেখা করুম কেমনে?

ছেলেটির কথা শুনে রফিক সাহেবের খারাপ লাগল। তিনি প্যাকেটটি খুলে একটি সোনার হার ছেলেটির দিকে বাড়িয়ে বললেন, এই নাও তোমার পুরস্কার।

ছেলেটি বলল, এতো তুচ্ছ জিনিস আমার দরকার নাই। এর চেয়ে বড় জিনিস আমি পাইছি।

: কি?

: আমার প্রতি আপনার বিশ্বাস।

রফিক সাহেব ছেলেটির কথায় অভিভূত হলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমার মা কি করেন?

: মহল্লায় ঘুইরা ঘুইরা ছাই বিক্রি করে।

: তুমি হারটা উনাকে দিও।

: মা তো কিছুতেই নিবে না।

রফিক সাহেব একটু ভাবলেন। তিনি জানতেন নগরীর সকল বস্তি সন্ত্রাসী আর চোর-ডাকাতের আখড়া। এখন দেখছেন ভাল মানুষও বস্তিতে আছে। ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের ঘর কোনটা?

ছেলেটি আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ঐ যে নীল প্লাস্টিক দিয়ে ছাউনি দেওয়া ঘরটা, ওটাতেই আমরা থাকি।

এরপর রফিক সাহেব চলে গেলেন।

বিকেল পাঁচটা। রফিক সাহেব তার স্ত্রীকে নিয়ে বস্তিতে ছেলেটির ঘরে এসে হাজির হলেন। ছেলেটির মা অল্প কিছুক্ষণ আগে ছাই বিক্রি করে ঘরে ফিরেছে। রফিক সাহেব ও তার স্ত্রী বেশ কিছুক্ষণ ছেলেটির মায়ের সাথে কথা বললেন। যাওয়ার সময় রফিক সাহেব খুবই বিনয়ের সাথে মহিলাকে অনুরোধ করে অনেকগুলো টাকা দিয়ে বললেন, আপনি এই টাকা দিয়ে অন্য কোন ব্যবসা করে নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করুন। আমার বিশ্বাস, আপনি সফল হবেন। কারণ সততা আপনি ও আপনার ছেলের প্রধান পূঁজি। এ টাকা আমি আপনাকে করুণা করে দেইনি। এ আমার কর্তব্য। আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি মাত্র, এর বেশি কিছু নয়।

অবশেষে তারা বিদায় নিলেন। ছোট্ট ছেলে ফাহিম আর তার মায়ের চোখ মুখে ফুটে উঠে নতুন জীবন গড়ার স্বপ্নের হাসি।

নিউজজি/এসএফ

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন