মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ৮ মাঘ ১৪৩১ , ২১ রজব ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
গল্প

নীরব উত্তর

কৌশানী চ্যাটার্জী জুন ৯, ২০২০, ০০:২৫:০১

3K
  • নীরব উত্তর

ঘড়িতে পাঁচটা বাজতেই ঘুম ভেঙে গেল অপরাজিতাদেবীর। কোনো অ্যালার্মের প্রয়োজন হয় না আর তার। দীর্ঘ আটত্রিশ বছর ধরে এটাই তার অভ্যাস। ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে পূজো করে নিলেন অপরাজিতাদেবী। সাতটা নাগাদ কাজের মেয়ে পুঁটি এলে আবার জলখাবারের প্রস্তুতিতে লেগে পড়তে হবে। ইতিমধ্যেই অবিনাশবাবু ঘুম থেকে উঠে পড়েছেন। ঘুম থেকে উঠে চা আর খবরের কাগজ না পেলে তার মেজাজ আবার সপ্তমে চড়ে যায়। একটু দেরী হলেই অপরাজিতাদেবীকে প্রায়ই শুনতে হয়, ‘দিনরাত তো বাড়িতেই থাকো। আমার মতন তো কাজের চাপ নেই। সুখের জীবন। করোটা কি যে চা দিতেও দেরী ?’

ঘুম থেকে রোজ পাঁচটায় ওঠার মতন স্বামীর গঞ্জনা শোনাটাও অপরাজিতাদেবীর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কখনও কাজ-কর্ম নিয়ে তো কখনও ইংরাজি না জানা নিয়ে। কোনোদিন অপরাজিতাদেবীর পরিচয়টুকুও তিনি দেননি তার কর্মক্ষেত্রে। কোথাও কোনো অফিসের অনুষ্ঠানে নিয়ে যাননি। পাছে ইংরাজি না জানা স্ত্রীকে নিয়ে গিয়ে নিজের মর্যাদাক্ষুণ্ণ হয়, সেই হেতু।

অবিনাশবাবু ও অপরাজিতাদেবীর একমাত্র ছেলে অর্জুন বিদেশে থাকে বউ আর নাতিকে নিয়ে। বছরে একবার হয়তো আসে।একাকীত্ব তাই সর্বক্ষণের সঙ্গী অপরাজিতাদেবীর। মাঝেমধ্যে নেহা এলে অপরাজিতাদেবী তাও কথা বলার কাউকে পান। একটু প্রাণ খুলে গল্প করেন। 

নেহা হল অপরাজিতাদেবীর বোনের মেয়ে। পাশের পাড়াতেই থাকে। বয়স ২৫-২৬। ‘ইচ্ছে দোয়াত’ নামক একটি ম্যাগাজিনের অফিসে চাকরী করে। সেদিনও নেহা এসেছিল। নেহার সঙ্গে কথা বলতে বলতে অপরাজিতাদেবী ওনার আলমারিটা পরিষ্কার করছিলেন।

হঠাৎ একটা পুরনো ডায়েরী দেখে নেহা জিজ্ঞেস করল, ‘কী গো এটা রাঙা মাসি?’

-‘ও কিছু না রে। আমার ছোটোবেলার খাতা। হিজিবিজি লেখা সব।’

কিছুটা উল্টেপাল্টেই দেখতে দেখতে নেহা বলল-

-‘হিজিবিজি কি বলছ? এ তো দারুণ সব কবিতা। রাঙা মাসি তুমি তো আবার কবিতা লেখা শুরু করতে পারো তো। সত্যি বলছি তুমি দারুণ লেখো।’

-‘ধুর পাগলী মেয়ে। কি যে বলিস?’

- ‘রাঙা মাসি তুমি আমার ম্যাগাজিনের জন্য একটা কবিতা লিখে দাও না। প্লিজ।’

-‘অনেকদিন আর লিখি না রে। ওসব আর পারব না।’

-‘সব পারবে। প্লিজ। প্লিজ। প্লিজ রাঙামাসি।’

-‘আচ্ছা। সে নয় পরে দেখা যাবে।’

বহুদিন পর আবার কলম ধরলেন অপরাজিতাদেবী তার আদরের নেহার অনুরোধে। একটা ছোটো কবিতাই লিখেছিলেন। সেই লেখা ম্যাগাজিনের সম্পাদকের এতই পছন্দ হয়ে গেল যে অপরাজিতাদেবী "ইচ্ছে দোয়াত" ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখিকায় পরিণত হলেন। অপরাজিতারদেবীর লেখা গল্প, কবিতা, উপন্যাস সবই বেরোতে লাগল প্রতিমাসে। শুধু "ইচ্ছে দোয়াত" নয়,ধীরে ধীরে ছোটো বড় অনেক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হতে লাগল অপরাজিতাদেবীর লেখা। বহু সাহিত্যসভায় ডাক পড়তেও লাগল তাঁর। লেখিকা অপরাজিতা রায় চৌধুরীর নাম এখন অনেকের কাছেই পরিচিত। 

অনেক কিছু বদলে গেলেও বদলালেন না শুধু অবিনাশবাবু। অপরাজিতাদেবীর লেখা একটি ছোটো কবিতাও পড়ে দেখেননি এখনও অব্দি তিনি। কোনোরকম উৎসাহই নেই তার অপরাজিতাদেবীর সাহিত্যচর্চা নিয়ে। তার কাছে অপরাজিতাদেবী আগের মতন অবহেলিতই। এখনও চলতে ফিরতে সেই একই রকম গঞ্জনা সহ্য করতে হয় অপরাজিতাদেবীকে।

এদিকে, অবিনাশবাবুর রিটায়ারমেন্টের সময়ও উপস্থিত হল। তার অবসর উপলক্ষে একটি বিদায়সভার আয়োজনও করা হয়েছে। ফেয়ারওয়েলের দিন অবিনাশবাবু সকাল থেকেই ব্যস্ত কী বক্তৃতা দেবেন সেই খসড়া রচনায়। অপরাজিতাদেবীকে বললেন, "ওখানে সবাই ইংরাজিতে কথা বলবে। তুমি তো সেটাও পারবে না। তোমার না যাওয়াই ভাল।’

ক্রমে সকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হল। ফেয়ারওয়েলের নির্ঘন্ট উপস্থিত। কোর্টপ্যান্ট পরে সভায় গিয়ে অবিনাশবাবু উপস্থিত হলেন। বেশ গর্বিত হাবভাব প্রকাশ পাচ্ছে তার মধ্যে। পরিকল্পনা মতন ইংরেজিতে নিজের বক্তব্যও পেশ করলেন। তারপর অবিনাশবাবুর এক অনুজ ঘোষণা করল, ‘আজ অবিনাশ রায় চৌধুরীর বিদায়সভায় আমাদের অতিথি হয়ে এসেছেন প্রখ্যাত লেখিকা অপরাজিতা রায় চৌধুরী। অবিনাশবাবুকে বিদায় স্মারকটি দিয়ে উনি সম্মানিত করবেন।’

কথাটা শোনা মাত্র মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল অবিনাশবাবুর। যাকে কখনও গুরুত্বই দেননি, সে কি না দেবে তার সারাজীবনের মর্যাদা?? কি করে এ সম্ভব?? তবুও সকলের সামনে উঠে স্মারক গ্রহণ করলেন। কিছু তো করারও নেই সকলের সামনে।

কিন্তু কি অদ্ভুত, অপরাজিতাদেবী কাউকেই বলছেন না যে তিনি তাঁর স্ত্রী হন। কেউ তো জানেনও না।

অপরাজিতাদেবীকে ডেকে অবিনাশবাবু বললেন, ‘বলছ না কেন তুমি আমার কে?’

-‘না অবিনাশ। তুমি তো কোথাও আমায় নিয়ে যাওনি। কখনই চাওনি আমার পরিচয় কাউকে দিতে। আজ নয় তারই পুনরাবৃত্তি হল।’

উত্তর দিলেন অপরাজিতাদেবী।

বহুদিনের একরাশ চাপা অভিমান প্রকাশ পেল অপরাজিতাদেবীর কথায়। কিন্তু অবিনাশবাবুর উত্তর দেওয়ারও কিচ্ছু নেই। প্রখ্যাত লেখিকা যে নিজের স্ত্রী সে কথা বলবেনই বা অন্যদের কোন মুখে। এতদিন তো কাউকে স্ত্রী এর পরিচয়টুকুও দেননি। 

এদিকে, অপরাজিতাদেবীর কাছে বহু অনুরাগীর ভিড় হয়েছে অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য। অবিনাশবাবুর বিদায়সভা হলেও যেন একরাশ শূন্যতা গ্রাস করেছে তাকে। সমস্ত উৎসাহ,উদ্দীপনা লেখিকা অপরাজিতাদেবীই নিয়ে। মনে হচ্ছে জীবনপ্রান্তে এসে ইংরেজি না জানা অবহেলিতা স্ত্রী যেন তাঁকে হারিয়ে দিয়েছে। তার সারাজীবনের ব্যবহারই প্রতিদান হিসাবে ফেরত দিয়েছে তার স্ত্রী। নিরুপায় অবিনাশবাবু নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন প্রখ্যাত লেখিকা অপরাজিতা রায় চৌধুরীর পাশে।

-সমাপ্ত-

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন