মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ৮ মাঘ ১৪৩১ , ২১ রজব ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
গল্প

‘নৈ:শব্দ সংলাপ’

মামুন এলাহী অক্টোবর ১০, ২০১৯, ১১:৪৬:৫৪

6K
  • ‘নৈ:শব্দ সংলাপ’

সফিক খুবই সাধারণ পরিবারের ছেলে। একেতো তনিমার কাছে কোন পাত্তা পাচ্ছে না, তারওপর একই ক্লাসে পড়া ছেলে মেয়ের সম্পর্ক মফস্বলের পরিবার ইহজীবনে মেনে নেবে বলে মনে হয় না। তবুও যদি তনিমাটাকে ম্যানেজ করা যেত, তাহলে হয়তো একটা চেষ্টা করে দেখা যেতে পারত।

সফিকের বর্ণনা শুনে আর করুণ চেহারা দেখে আমার খুবই খারাপ লাগল। পল্লব আমাকে খুব করে ধরল আমি যেন সফিকের ব্যপারে তনিমার কাছে ওকালতি করি। কারণ ক্লাসের সব ছেলেদের মধ্যে তনিমা আমার সাথেই বেশী কথা বার্তায় স্বচ্ছন্দ বোধ করত আর এটা সবাই জানে। তা সে যে কারণেই হোক। আমাদের বোঝাপড়া শুধুই সহপাঠি পর্যায়ের ছিল না। বন্ধুত্বের পর্যায়ে ছিল। আইডিয়াটা আমার কাছেও মন্দ মনে হয়নি। তবে পল্লব কি সফিকের ভাল চেয়ে এসব আমার কাছে বলেছিল নাকি আমাকে জব্দ করে মজা দেখতে চেয়েছিল তা অবশ্য আমার কাছে আজও পরিস্কার নয়। 

ভাবলাম প্রায়ই ওদের চার কন্যার সাথে ক্যাম্পাসের খেজুর গাছের তলায় ঝালমুড়ি বা বুট বাদাম আমার আর পল্লবের খাওয়া হয়। একটু বাজিয়ে দেখার মত অবস্থান আর পরিবেশ আমার হাতে আছে। দেখি ট্রাই করে কী হয়। তাছাড়া কলি, শান্তা আর পমিও জানত তনিমা-সফিকের বিষয়টা। তাই ওদের সামনেই একদিন কথাটা তুললাম আমি। আগেই ঝালমুড়ি খাওয়াব বলে ব্রেক পিরিয়ডে ওদের ডেকে গাছতলায় নিয়ে এসেছিলাম। 

তনিমাকে বললাম, “দেখ তনিমা, আমি সত্যিই সফিকের বিষয়টা আগে জানতাম না। কয়েকদিন আগে জেনেছি। তোমার পরিবার বিষয়টা কীভাবে নেবে বা কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে সেটা পরের বিষয়। আগে তোমার অবস্থাটা জানতে চাই যদি তুমি কিছু মনে না কর। কথাগুলি অনধিকার চর্চা মনে হতে পারে তোমার কাছে। তবে যা বলছি বন্ধু হিসেবেই বলছি।” 

তনিমা পুরো বিষয়টাকে ফাজলামী ঢঙে নিল। চোখ মুখ ত্যাড়া ব্যাকা করে বলল, “সফিকের বিষয়টা মানে কী? তাছাড়া সফিকের বিষয়ে সফিকের সাথে আলোচনা করগে আমার কাছে জানতে চাচ্ছ কেন?”

অন্য মেয়েগুলি আমার প্রাথমিক পরাজয় দেখে মুখ টিপে হাসছিল। 

আমি হতোদ্যম না হয়ে বললাম, “সফিক তোমাকে ভালোবাসে সেটা তুমি খুব ভালো করেই জান। অন্তত আমার চেয়ে ছয় বছর আগে থেকেই জান। আমি জিজ্ঞেস করছি কেন তুমি তাকে গ্রহণ করছ না? তার অপরাধ বা অযোগ্যতাটা কোথায়?”

তনিমা বলল, “সফিকের বিষয় নিয়ে তোমার এত আগ্রহ কেন শুনি? তোমার সাথে আমার বন্ধুত্ব আছে বলেই এখন পর্যন্ত রাগ করিনি তবে ওসব বাদ দিয়ে তোমার অন্য কিছু বলার থাকলে বল। ওসব বিষয় নিয়ে আমি কোন কথা চালাচালি করতে চাচ্ছি না। প্লিজ”। 

কথাটা সেদিন আর তেমন অগ্রসর হলো না। আমার ঝালমুড়িগুলি একদমই অপচয় হল। এই আলাপ ছাড়া আমি ওদের মোটেও ঝালমুড়ি খাওয়ানোর পক্ষে ছিলাম না। 

যাই হোক আমি নিয়মিত একথায় সেকথায় সফিকের পক্ষে তৎপরতা চালিয়ে যেতে লাগলাম আর যথারীতি দুর্বোধ্য ভাষায় তনিমার উত্তর পেতে থাকলাম যার আসলে কোন অর্থই হয় না। ইতোমধ্যে একটা জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গেল। হঠাৎ করেই শুনলাম সফিকের পুলিশে চাকরী হয়েছে। যশোরে পোস্টিং। সফিক কখন কীভাবে চাকরীর চেষ্টা করেছিল আমাদের কিছুই জানায়নি। পড়াশোনা শেষ না করে সফিকের আচমকা যশোর যাওয়াটা আমার কাছে যেন একটা অব্যক্ত অভিমান মনে হল। ছেলেটা পরিচিত পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে উঠার জন্য একটা ছলনার আশ্রয় নিল নাতো?

সফিক চলে যাওয়ার পর আমার মনটা আরও বেশী খারাপ হয়ে গেল। ওর জন্যে আমার খুব মায়া হল। তনিমার প্রতি আমার একটু রাগও হল। ভেবে দেখলাম এখনতো সফিক সরকারী চাকরীজীবি। পারিবারিকভাবে ওকে মেনে নেওয়ার সমস্যা অনেকটাই কমে গেল। তনিমা এখনতো একটু ভেবে দেখতে পারে। আমি নির্লজ্জের মত আবারও তনিমার কাছে সফিকের কথাটা তুললাম। 

তনিমা আমাকে সাফ জানিয়ে দিল এসব সফিক মার্কা ঘ্যানর ঘ্যানর তার আর সহ্য হচ্ছে না, তাই আগামী রবিরার সে আমাকে এসব বিষয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবে। আমি যেন একাডেমিক ভবনের দোতলায় সবচাইতে উত্তরের ক্লাসরুমে তনিমার সাথে দেখা করি। সেখানে তনিমা একা আমার অপেক্ষায় থাকবে। দেখলাম ওর কথা মত দেখা করলে আমার একটা ক্লাস মিস দিতে হয়। কিন্তু আমিও মরিয়া হয়ে উঠেছি তাই রাজি হয়ে গেলাম। 

বুধবার থেকে শনিবার পর্যন্ত আমি কোন কিছুতেই মন বসাতে পারলাম না। অস্থিরতার মধ্যে চারটা দিন আমার কাটল। আমার আচার আচরণেও মনে হয় কিছুটা প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছিল। এ কয়দিন তনিমাও কথা বলার সময় আমার দিকে তাকিয়ে কৌতুকের হাসি হাসত। কিন্তু আমি শুধু আল্লা আল্লা করছিলাম কবে রবিবারটা আসবে। ক্যাম্পাসের অবসর বা বিনোদনের সময় আমি সাধারণত পল্লবকে ছাড়া থাকি না। কিন্তু রবিবারে আমি ঠিকই ক্লাস ফাঁকি দিয়ে একা একা মূল একাডেমিক ভবনে চলে এলাম। এই ক্লাসটা শেষ হলেই মধ্য বিরতি। 

দোতলার উত্তরের শেষ রুমটায় কোন ক্লাস হয় না বলে খালিই পড়ে থাকে। তনিমা হয়তো জায়গাটা সেজন্যেই বেছে নিয়েছে। রুমে কয়েকটা বেঞ্চি এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বেলকনি দিয়ে কয়েকটা আমগাছের ডাল দরজার কাছে চলে এসেছে। তাছাড়া বেলকনির গ্রিলে একটা লতা গাছ জড়িয়ে আছে। আমি কোন শব্দ না করে পা টিপে টিপে রুমের দরজার কাছে চলে আসলাম। বাইরে থেকে দেখি তনিমা একটা লো বেঞ্চে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে। ওকে একটুও চিন্তিত মনে হচ্ছে না। বইয়ের ব্যাগটা কোলের উপর নিয়ে কী একটা সুর গুন গুন করে গলায় তোলার চেষ্টা করছে। মেয়েটার স্নায়ুর জোর দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। 

আমি রুমটায় ঢুকলাম। তনিমা আমাকে দেখে হেসে উঠল। 

বলল, “কেমন আছ আমান?”। 

যেন অনেক দিন পরে দেখা এমন একটা ভাব। আমি ওর কথায় অবাক হলেও সেটা বাইরে প্রকাশ করলাম না। 

বললাম, “ভাল আছি। তুমি ভালো আছ তো?”। 

তনিমা বলল, “হ্যা। বসো”। 

আমি ওর মুখোমুখি আরেকটা বেঞ্চে বসে পড়লাম। তনিমা গাঢ় বেগুনি রঙের একটা পোশাক পড়ে এসেছে। ওকে অনেক সুন্দর লাগছিল।

তনিমা বলল, “বল আমান, তুমি যেন কী জানতে চাইছিলে”। 

আমি ওর কথায় যথেষ্ট বিরক্ত হলাম কারণ তনিমাই বলেছিল রবিবারে সে আমাকে সিদ্ধান্ত জানাবে কিন্তু এখন এমন ভাব করছে যেন আলাপটা আগে কখনোই হয়নি, বরং এই মাত্র শুরু হল। 

বিরক্ত হয়ে আমি সোজাসোজি বাক্যে প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম, “সফিক তোমাকে ভালোবাসে, কেন তাকে তুমি গ্রহণ করছ না? তোমার আপত্তিটা কোথায়?”। 

তনিমা হেসে হেসে বলল, “আচ্ছা আমান শুধু সফিকই কি তোমার বন্ধু আমি কি তোমার বন্ধু নই?”। 

আমি বললাম, “অবশ্যই তুমিও আমার বন্ধু। আর সেজন্যেই বন্ধুত্বের দাবিতেই আমি তোমাকে এসব কথা বলছি। নইলে কখনোই বলতে আসতাম না।” 

তনিমা বলল, “আমি যদি তোমার বন্ধু হয়ে থাকি, তাহলে কেন তুমি শুধু সফিকের দিকটাই দেখছ? আমার দিকটা দেখছ না কেন?”

আমি বললাম, “তোমার কোন দিকটা দেখছি না? কী বলতে চাচ্ছ?”

তনিমা বলল, “সফিক আমাকে ভালোবাসে বলে তুমি বন্ধু হয়ে তার জন্য আমার কাছে এসেছ বন্ধুকে সাহায্য করতে তাই না? কিন্তু আমিও তো তোমার বন্ধু; আমিওতো কাউকে না কাউকে ভালোবাসতে পারি। সেটা কেন তোমার একবারও মনে হল না? তোমার কি উচিত না সফিকের মত ঠিক একইভাবে আমাকেও সাহায্য করা যাতে আমি আমার ভালোবাসাকে পেতে পারি?”

আমি চমকে গিয়ে বললাম, “উচিত হ্যাঁ। কিন্তু তুমি কি তাহলে সফিককে গ্রহণ করছো না?” 

তনিমা বেশ জোড় দিয়ে বলল, “না।” 

আমি বললাম, “তনিমা তুমি আসলে কী বলতে চাচ্ছ? তুমি কি অন্য কাউকে ভালোবাস? কাকে?”। 

তনিমা বলল, “বলছি; তবে আগে বল আমার ভালোবাসাকে পেতে তুমি আমাকে সাহায্য করবে। ঠিক সফিককে যতটা আন্তরিকভাবে সাহায্য করতে চেয়েছো সেভাবে।” 

আমি একটু থমকে গিয়ে বললাম, “করব। বল কাকে ভালোবাস তুমি।”। 

এতক্ষণ বইয়ের ব্যাগে তনিমার ডান হাতটা ঢোকানো ছিল। আচমকা সে হাতটা ব্যাগ থেকে বের করে আনল। হাতে ধরা অর্ধ প্রস্ফুটিত একটা গাড় রঙের গোলাপ আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে হাসিমুখে বলল, “আমি তোমাকে ভালোবাসি আমান। বিশ্বাস কর।” 

তনিমার চোখের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল ও ঠাট্টা করছে না। যা বলছে বুঝে শুনেই বলছে। ওই মুহুর্তে ওর চোখের দৃষ্টি অসম্ভব গভীর আর শান্ত। জীবনে কাছে থেকে বজ্রপাত বেশ কয়েকবার দেখেছি। মানুষের উপর পড়ে বলেও শুনেছি। কিন্তু পড়লে কেমন লাগে তা জানতাম না। কিন্তু তনিমার কথা শুনে ঠিক ঠিক বুঝে গেলাম। 

আমার বাড়ি ক্যাম্পাস থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে। প্রথমে বাসে যেতে হয়। তারপরে খানিকটা রিক্সায়। আমি তনিমার কথা শুনে ঘোর লাগা মানুষের মত ওই অবস্থাতেই এক দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে দোতলা থেকে নিচে নেমে ক্যাম্পাসের মেইন গেট দিয়ে বাইরে চলে আসলাম। বিরামহীন গতিতে হাটতে হাটতে হাইওয়েতে এসে বাসে চড়লাম। তারপর বাড়ীতে ঢুকে ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে কাপড় না বদলেই প্যান্ট শার্ট পড়া অবস্থায় পুকুরে নেমে পড়লাম। আমার মাথা তখনও দপদপ করছে। আধাঘণ্টান্টা একটানা গলাপানিতে দাঁড়িয়ে রইলাম। পরে আম্মার ডাকে সম্বিত ফিরে পেয়েছি।

এতটুক পর্যন্ত বলে আমান চুপ করে রইল।

তখন রুমানা জিজ্ঞেস করল, “তারপর কী হল?”

আমান বলল, “তার আর পর নেই। ঘটনা এখানেই শেষ।”

রুমানা জোড় গলায় প্রতিবাদ করল, “না না। এইখানে কোন ঘটনা শেষ হতে পারে না। আমি জানতে চাই শেষ পর্যন্ত কী হল। আপনি আপনার বান্ধবীকে পরে কী জবাব দিয়েছিলেন।”

আমান বলল, “ঘটনা এখানেই শেষ। আজ তাহলে আসি। ভালো থাকবেন।”

বলেই আমান রুমানাকে রেখে মেসের পথে হাঁটা ধরল। বিস্মিত রুমানা অবাক চোখে আমানের গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইল। ভাবল আশ্চর্য লোক তো।          (চলমান...)

নিউজজি/এসএফ

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন