মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ৮ মাঘ ১৪৩১ , ২১ রজব ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
গল্প

‘নৈ:শব্দ সংলাপ’

মামুন এলাহী অক্টোবর ২, ২০১৯, ১৪:৩১:০৭

6K
  • ‘নৈ:শব্দ সংলাপ’

ক্লাস সেভেনে থাকতেই ভবিষ্যত বেইজ্জতির কথা চিন্তা করে আমান নিজের নাম আমানত থেকে আমানে রূপান্তর করে ফেলে। অর্থ সুন্দর হলেও আমানত শব্দটা এ যুগের একজন আধুনিক মনস্ক ছেলের নাম হিসেবে ভয়াবহ। তাছাড়া আমান একবার কোন একটা হিন্দি সিনেমায় দেখেছিল সালমান খানকে তার প্রেমিকা খুব আন্তরিক ভঙ্গিতে প্রেমের সুরে আমান আমান বলে ডাকছে। পুরো সিনেমা জুড়ে শুধু এই বিষয়টাই আমানের মনে ধরে যায়। 

তখনই সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে নাম আধুনিকায়নের। তাছাড়া কোন কালে প্রেম ভালবাসা হয়ে গেল মেয়েটা তাকে লোকজনের সামনে আমানত বলে ডাক দিলে ইজ্জত থাকবে? একটা সুন্দরী মেয়ে যদি বলে, “আমান একটু শোন তো” তাহলে কত্তই না ভালো শুনাবে। কিন্তু যদি বলে বসে, “আমানত একটু শোন” তাহলে কী বিশ্রী অবস্থা দাঁড়াবে? সেই থেকে বহু সাধ্য সাধনা করে আমান নিজের পরিবর্তিত ডাকনাম প্রতিষ্ঠিত করেছে।

অথচ সার্টিফিকেটের কারণে ম্যানেজার সাহেব সেই শুরু থেকেই আমানত আমানত করেই যাচ্ছেন। আমান দুয়েকবার মৃদু গলায় বলার চেষ্টাও করেছে, “স্যার দয়া করে আমাকে আমান ডাকবেন”। কিন্তু ব্যাটা যুক্তি দেখায়, “আমানত সাহেব, অফিসে সার্টিফিকেট নেম ইউজ করাই তো ভালো তাই না? অফিসিয়াল একটা ট্র্র্যাডিশন আছে না”? আমান মনে মনে রাগে ফেটে পড়ে। শালার ব্যাটা ট্র্র্যাডিশন শিখায়। মানুষকে বেইজ্জতি করে ট্র্র্যাডিশন মেনটেইন করতে হবে? ইজ্জতের চেয়ে কি ট্র্যাডিশন বড়? যত্তোসব।

অডিটটা মোটামোটি ভালোয় ভালোয় পার করেছে আমান। কিছু অবজারভেশন অবশ্য এসেছে। তবে তা ফুলফিল করা যাবে না অফিসিয়াল সিস্টেমের কারণেই। কিন্তু সেসব তো ইন্টারনাল সিক্রেট। তাই আমান নেহায়েত ভালো মানুষের মত অডিটরের সাথে হ্যাঁ হ্যাঁ করে গেল। অডিটের সূত্রে দুপুরের খাওয়াটা হল অসাধারণ। যাকে বলে রাজকীয় ভোজ। হেল্প ডেস্ক সার্ভিসে কয়েকজন মেয়ে কাজ করে। বেশীর ভাগই স্থানীয়। অফিসিয়াল নির্দেশে এদের এক সময় জেনারেল কম্পিউটার নলেজ-এর উপর কিছু কাজ শেখাতে হয়েছিল আমানের। সেকারণে আমান কিছু টাকা সম্মানী হিসেবেও পেয়েছিল। সেটা মাস খানেক আগের কথা। হেল্প ডেস্কের একজন কর্মী রুমানা। প্রশিক্ষণের  সূত্রে রুমানার সাথে পরিচয়টা গাঢ় হয়।

মেয়েটা চাকরীর পাশাপাশি বি.এস.এস পড়ছে। স্থানীয় লোকজন সাধারণত এলাকায় চাকরী বাকরী করলে কাজের চেয়ে অকাজের দিকেই বেশী মনযোগী হয় এটা এদেশের স্বাভাবিক চিত্র। কিন্তু রুমানা একদমই আলাদা। কিছুদিন ধরে আলাপচারিতা নিয়মিত হয়ে আসতে রুমানাই একদিন কৌতুহল বশত: আমানের ব্যক্তি জীবনের কথা জানতে চাইছিল। আমান নিজের ব্যক্তি জীবনের গল্পে খুব একটা স্বস্তি বোধ করে না।

অল্প পরিচয়ের কোন মেয়ের কাছে সেটা আরও বেশী কঠিন। কিন্তু রুমানার মধ্যে আলাদা একটা সরলতা আছে। মেয়েটার আবেদন যেন ফিরিয়ে দেয়াটাও অভদ্রতা। পরিস্কার উপলব্ধি করতে পারে আমান। বাবা মা ভাই বোনের বিষয়ে কথা হয় রুমানার সাথে। পড়াশুনা আর চিন্তা দর্শনের কথাও হয় অল্প স্বল্প।

ছুটি শেষে একদিন যাবার পথে বলেই বসল মেয়েটা, “আপনার জীবনে কোন প্রেম নেই আমান ভাই? কাউকে কখনো ভালো লাগেনি কোনদিন?”।

আমান মহা মুশকিলে পড়ে যায়। কথায় কথায় একটু সখ্যতা হয়েছে ঠিকই; তাই বলে এ রকম একান্ত ব্যক্তিগত পর্যায়ের কথাবার্তা চালাবার মত এমন কোন বোঝাপড়া হয়েছে বলেতো আমানের কাছে কখনো মনে হয়নি।

আমান ইতস্তত জবাব দেয়, “একথা কেন জানতে চাইছেন?”।

রুমানা বলল, “সেটা বলছি। কিন্তু আপনি আবার আমার প্রশ্নে কিছু মনে করেননি তো?”। নির্ঘাত আমান মনে করেছে কিন্তু সেটা মুখে স্বীকার করল না। বলল, “না না মনে করিনি। কিন্তু এসব কেন জানতে চাইছেন বলুন তো? আপনি কি আসলেই সিরিয়াস”?

রুমানা বলল, “না মানে আপনাকে প্রায়ই খুব মনমরা দেখায়। মাঝে মাঝে অফিসের বাইরে গিয়ে মাঠে অনেকক্ষণ ধরে ফোনে নাক মুখ সিরিয়াস করে কথা বলতে দেখি। সদ্য পাস করে চাকরিতে জয়েন করেছেন জানি। এ অবস্থায় এসব সিম্পটম দেখা গেলে  এমন কিছুই তো মনে আসা স্বাভাবিক। হয় পরিবারে কোন সমস্যা নয়তো প্রেম ট্রেমই হবে তাই না?”

আমান হেসে ফেলল, “ও আচ্ছা তাই বলুন, আপনার পর্যবেক্ষণ শতকরা একশ ভাগ ঠিক আছে, তবে ব্যাখ্যা পুরোই ভুল। আপনি যেহেতু প্রেমের কথা জানতে চাইছেন তাই আপনাকে একটা মজার অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করতে পারি যদি আপনার আগ্রহ এখনও অবশিষ্ট থাকে।”

রুমানা বলল, “আমার আগ্রহের কমতি নেই। কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে আপনি খুব সতর্কভাবে ইচ্ছে করেই প্রসঙ্গটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন।”

আমান বলল, “প্রসঙ্গ ঘুরাচ্ছি না। পুরোপুরি প্রেম না হলেও আপনার আগ্রহের সাথে আমার এই অভিজ্ঞতার সামান্য সম্পর্ক আছে, তাই ইচ্ছে করলে শুনতে পারেন। বলব?”।

রুমানা বলল, “হ্যা বলুন, প্লিজ”।

ওরা হাঁটছে...।

আমান তার গল্প শুরু করল, “আমি তখন অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। আমাদের ক্লাসের মেয়েদের মধ্যে চারটা মেয়ে সবসময় একসাথে একজোট হয়ে চলাফেরা করত। ওদের ঘনিষ্ঠতা ছিল ডিপার্টমেন্টের অন্যতম আলোচ্য বিষয়। চারটে মেয়েই অসাধারণ। প্রথমজন কলি। কিছুটা বেটে তবে গায়ের রং যথেস্ট ফর্সা। পড়াশুনায় মোটামোটি আর সাজগোজে এক্সপার্ট। কলির চলা ফেরা ছিল খুবই স্টাইলিশ। ও সাথের তিনজন বাদে মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের সাথেই মিশত বেশী। তবে মিশত কিন্তু ধরা দিত না টাইপ। ক্লাসের এবং ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র অনেকেই চেষ্টা করে ওকে বড়শিতে গাথতে ব্যার্থ হয়েছে। সম্ভবত পারিবারিকভাবে কোন কাজিনের সাথে ওর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। ঠিক নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

দ্বিতীয়জন শান্তা। রোগা পাতলা। খুবই নিরীহ ধরনের চেহারা। অনেক লম্বা চুল ছিল। আর একটু ন্যাকামী করে কথা বলতে পছন্দ করতো। তৃতীয়জন তনিমা। উচ্চতা পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চির কম হবে না। মাঝারি স্বাস্থ্য ও ফর্সা গায়ের রঙ। চোখদুটো অসম্ভব সুন্দর ছিল। পড়াশুনায় ভালো। গলার আওয়াজ অনেকটা সেতারের ঝংকারের মত। কানে শোনার পরে বেশ কিছু সময় মাথার ভেতর বাজতে থাকে। সব মিলিয়ে দেখতে হিন্দি সিনেমার একজন নামকরা অভিনেত্রীর মত। অভিনেত্রীর নাম ইচ্ছে করেই বলছি না। চতুর্থ জন পমি। গায়ের রং শ্যামলা কিন্তু চেহারা আকর্ষণীয়। পোশাক আশাকে চলাফেরায় সবসময় মার্জিত। কোন রকম উগ্রতা নেই। হাসি ছাড়া তার কোন কথাই নেই। চারজন চার রকম চরিত্রের হলেও তাদের মধ্যে আষ্টে পৃষ্ঠে মিল।”

রুমানা মাঝপথে কথা বলে উঠল, “এক মিনিট আমান ভাই। আমি ভীষণ অবাক হয়ে গেলাম। মেয়েদের এত গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন আপনি? আর এমন কাব্যিক বর্ণনা। আপনি তো ভাই সাঙ্ঘাতিক পাবলিক”। বাক্যটা শেষ করেই উচ্চস্বরে হেসে উঠল।

আমানের ভাবান্তর নেই, হাসি মুখে বলল, “আরে ভাই, সেসব বিশ্লেষণ পরে করতে পারবেন আগে গল্পটাতো শেষ করে নেই।”

রুমানা বলল, “জ্বি ঠিক আছে আপনি চালিয়ে যান, আমার কাছে খুব ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে। সামনে নিশ্চয়ই আরও জটিল ক্লাইমেক্স অপেক্ষা করছে।”

আমান বলে চলল, “গ্রাজুয়েশন কোর্সে আমার অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল পল্লব। পল্লবের কাছে একদিন শুনতে পেলাম আমাদের ক্লাসের সফিকের করুন কাহিনি। বিষয়টা এরকম। সফিক ও তনিমা একই হাইস্কুলে পড়ত এবং ক্লাস সেভেন/এইট থেকেই সফিক তনিমাকে পছন্দ করতো। বেচারা সফিক কোনভাবেই পাত্তা পায়নি।

স্কুলের ছেলেরা সফিককে এস.এস.সি পর্যন্ত ক্ষেপিয়ে বেড়িয়েছে। ইন্টার মিডিয়েটে আলাদা কলেজে পড়ায় বিষয়টা বেশী আর ঘনিভূত হয়নি। কিন্তু অনার্স কোর্সে একই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ায় আবার ঝামেলা বেঁধেছে। তবে তনিমার তরফ থেকে নাকি ক্লীয়ার কোন জবাবও কখনো পাওয়া যায়নি। হ্যাঁ অথবা না কোনটাই নয়। তাই সব মিলিয়ে সফিক কাহিল হয়ে পড়লেও একেবারে আশা ছেড়ে দেয়নি। মোটামোটি ছয় বছরের পুরাতন একপেশে প্রেম আর বিরহ জ্বালার ঘটনা। শুনে আমি বেশ কৌতুহল বোধ করলাম।

 

পল্লব আমাকে মাঝে মাঝেই বলত আমান সফিকের কাছে বিস্তারিত শুনে দেখ বেচারা এখনও আশায় বুক বেঁধে আছে। সফিকের সাথে আমার তেমন ঘনিষ্ঠতা ছিলনা। তবে এসব জানার পরে আমার আগ্রহেই সফিকের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। জানতে পারি বিস্তারিত ঘটনা। তনিমা পরিবারের একমাত্র মেয়ে। মোটামোটি ধনী পরিবারের মেয়ে। ওর বড় দুই ভাই। একজন উচ্চপদে সরকারী চাকরী করে। আরেকজন বছর পাঁচেক যাবত বিদেশে আছে। পারিবারিকভাবে এ জাতীয় সম্পর্ক সেটেল করা প্রায় অসম্ভব। তখনই তনিমার জন্য যোগ্য পাত্র খোঁজা হচ্ছে।              ( চলবে... )

 

 

নিউজজি/এসএফ

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন