মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ৮ মাঘ ১৪৩১ , ২১ রজব ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
গল্প

‘নৈঃশব্দ সংলাপ’

মামুন এলাহী সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৯, ১৫:১৩:২৪

3K
  • ‘নৈঃশব্দ সংলাপ’

রাত খুব বেশী হলে সাড়ে আটটা বাজে। কিন্তু চারপাশের পরিবেশে মনে হচ্ছে বারটা একটার কম নয়। গন্ডগ্রামের এই এক দোষ। সন্ধ্যার পরপরই মানুষজনের ঘুমানোর তাড়া পড়ে যায়। ঘরের ভেতর হারিকেনটা মধ্যম শিখায় জ্বলছে। হারিকেনের আলোয় দেয়াল আর ছাদের কোণায় মাকড়সা আর তার ঝুলের ভৌতিক দানবীয় ছায়া পড়েছে। মাকড়সাগুলো সাধারণ সাইজের হলেও স্তব্ধ পরিবেশে সাধারণ মাকড়সাগুলোকেই কত ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। ঘরের দক্ষিণ দেয়াল ঘেষে একটা সেমি ডাবল সাইজের চৌকি পাতা। আমকাঠের চৌকি। সস্তা তোষকের উপর লাল রঙের একটা চাদর বিছানো।

এই অঞ্চলে বাতাসের আর্দ্রতা মনে হয় কখনোই আশি পার্সেন্টের নীচে নামে না। অগ্রহায়ণ মাসেও শরীর যথেষ্ট ঘামে। তারচেয়েও বড় যন্ত্রনা আমকাঠের চৌকির উপরিভাগ ভিজে ভিজে উঠে। যার ফলে তোষকটার নীচের দিকে কয়েক স্তর ছাতা পড়ে এমন অবস্থা হয়েছে যে কেউ দেখলেই ভাববে লর্ড কর্ণওয়ালিসের আমলের। কাঠ আর তোষকের মাঝে একটা পলিথিনের আবরণ অবশ্য দেয়া হয়েছে কিন্তু ফলাফল শূণ্য দশমিক শূণ্য শূণ্য।

মাঝখান থেকে লাভ এই হয়েছে যে আগে তোষকটা চৌকির উপর স্থির হয়ে থাকত এখন সারা চৌকিময় নড়াচড়া করে বেড়ায়। হঠাৎ হঠাৎ আমানের মনে হয় ভেলার উপর শুয়ে আছে। যে মহিলা রান্না করে দিয়ে যায় তার পরামর্শেই চৌকির কাঠ আর তোষকের মাঝে পলিথিনটা দেয়া হয়েছিল। উদ্দেশ্য ভেজা ভাবটা যেন তোষক হয়ে বিছানার চাদর পর্যন্ত না পৌঁছায়। এর আগে আমান পুরো চৌকিটাকে ছাই রঙের এনামেল পেইন্ট দিয়ে মাখিয়ে দিয়েছিল যাতে ময়েশ্চার উপরে না উঠে; কিন্তু বিধি বাম। এনামেল পেইন্টের দুর্গন্ধে পুরো দুই সপ্তাহ নরকের যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে। শুরুর কয়েকটা দিন গন্ধে শ্বাস কষ্টের মত হয়ে গিয়েছিল। তাই রাধুনী মহিলার কথা সে কোন বিচার বিবেচনা না করেই মেনে নিয়েছিল। ভেজা ছাতার হাত থেকে বাঁচা নিয়ে কথা। তা যে এই পরিণতি ডেকে আনবে কে জানত?

চাকরী সূত্রে আমানের এই এলাকায় আসার প্রায় সাত মাস হল। জানালার পাশের দেয়াল ঘেষে মহামূল্যবান সম্পদ কাপড়ের ব্যগটা রাখা। তার ভেতর একান্ত ব্যক্তিগত কিছু জিনিস আছে। আর আছে মাসুদ রানার কয়েকটা বই। বাড়ী থেকে এখান পর্যন্ত আসতে প্রায় এগারো ঘণ্টা লেগে যায়। সেই বিশ্রী সময়টাতে মাসুদ রানা নেপালী রাজকন্যার সাথে হিলটন হোটেলের প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুইটে কী পরিস্থিতিতে থাকে তা বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠে। তাই বইয়ের সংখ্যা প্রতি যাত্রায় বাড়ছে আর মাসুদ রানার লাস্যময়ী প্রেমিকারা দীর্ঘ ক্লান্তিকর বাস যাত্রার একঘেয়েমি ভুলিয়ে দিচ্ছে।

আমান এই মুহুর্তে হারিকেনের আলোয় হাতে ধরা বাঁশের বাঁশিটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এখানে এই ঘরে বাঁশি বাজানোর প্রশ্নই উঠে না; কিন্তু কিছু সঙ্গী আছে যাদের কখনোই কাছ ছাড়া করা যায় না। আমান বাঁশিটার গায়ে আলতোভাবে হাত বুলাচ্ছে। অনেক কথাই মনে আসছে। উচানীচরের মেলা, কালিপূঁজার পাঁঠাবলি, হাউজি-সার্কাসের প্যান্ডেল, চিনি ছাড়া রঙিন রসগোল্লা, লটারীতে মেয়েদের ফেস ক্রীম জেতা আরও কত কী।

ইন্টার মিডিয়েটে পড়ার সময় আবিদ ছিল আমানের প্রিয় বন্ধু। একই গ্রামের হওয়ায় আলাদা একটা টান কাজ করতো উভয়ের। আমান আর আবিদ গিয়েছিল উচানীচরের মেলায়। কলেজ থেকে দুই ক্লাস মিস দিয়ে দুপুরের আগে আগেই বেড়িয়ে পড়েছিল ওরা।

চৌরাস্থা থেকে রিক্সা করে ছয় কিলোমিটার মত। তারপরে ফসলী মাঠ পেরিয়ে মেলা। পৌষ মাসের এক তারিখে শুরু হত মেলা। মূলত কালীভক্ত হিন্দু পুরোহিতদের সমাবেশ ও ধর্মীয় আচারের আয়োজন ছিল উচানীচরে। তাকে কেন্দ্র করেই খেলনা, মণিহারী, কাঠের আসবাব আর লৌহজ জিনিসপত্রের মেলা বসত সেখানে। বড় একটা বট গাছের গোড়ায় গোল করে পাকা বেদী তৈরি করা ছিল। সেখানে পুরোহীতরা গোল হয়ে বসে প্রার্থনা আর সংকীর্তন করতো। দুপুরে পাঁঠা বলি দেয়া হত।

সেবার সার্কাসের দল এসেছিল। লটারী ইউনিটে ঢুকতেই আমান আর আবিদ হতভম্ব। দশ টাকার লটারীতে নূন্যতম পুরস্কার ছিল মেয়েদের রং বেরঙের অন্তর্বাস। উঠতি বয়েসী গ্রাম্য কিশোররা টপাটপ টিকিট কিনছে। কেউ কেউ হঠাৎ লটারী জিতে যাচ্ছে আর ভলান্টিয়ার নির্বিকার ভঙ্গিতে কিশোরদের হাতে মেয়েদের অন্তর্বাস ধরিয়ে দিচ্ছে। বেচারারা লজ্জা লজ্জা মুখে তা গ্রহণ করছে। তবে তাদের অপ্রস্তুত চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল এ জিনিস দিয়ে তারা কী করবে তা ভেবে পাচ্ছে না। নিষিদ্ধ আনন্দের প্রতি আকর্ষিত করতেই হয়ত ধুরন্দর লটারী ব্যবসায়ীরা পুরস্কার হিসেবে মেয়েদের অন্তর্বাস নির্ধারণ করেছিল। প্যান্ডেলের ভেতরে চারপাশে উঁচুতে বাধা রশিতে সারি সারি অন্তর্বাস ঝুলিয়ে রাখা আছে।

দৃশ্যটা ভাবলে আমানের এখনও হাসি পায়। আমান অবশ্য লটারীতে একটা ত্বক ফর্সা করা ক্রীম পেয়ে গেল। ও আশা করেছিল একটা লাক্স সাবান পেলেই খুশি থাকবে। কিন্তু পেয়ে গেল তার চেয়েও মূল্যবান ক্রীম। প্যান্ডেল থেকে বেড়িয়ে ভালমত পরীক্ষা করতেই বোঝা গেল খুশি হবার মত কিছু ঘটেনি; ও পেয়েছে মেয়েদের ক্রীম তাও আবার নকল। গালে একটু মাখতেই চটচটে ভাবটা আর যেতে চায় না। সাবান দিয়ে ধুলেই কেবল যাবে মনে হচ্ছে। পুরোটাই বাটপারী। শেষমেষ যে উদ্দেশ্যে মেলায় আসা সেই বাঁশির দোকানে চলে গেল ওরা।

স্কুল জীবনেই বাঁশির শখ ছিল। আড়াআড়ি ছিদ্রের বাঁশি বাজানোর বিদ্যেটা রপ্ত করা হয়নি বলে আগে কেনা হয়নি। ইদানিং এক বড় ভাইয়ের কাছে দীক্ষা নিচ্ছে। তাই সিদ্ধান্তÍ নিয়ে রেখেছিল মোটা ব্যাসের বাঁশি কিনবে। কারণ মোটা বাঁশিতে ক্ষুদ্র কম্পাঙ্কের ভোতা সুর উঠে। সে আওয়াজের তীক্ষ্নতা কম হলেও তাতে বিরহী আবেদন অনেক বেশী। এ বাঁশি অবশ্য বাজাতে বেশী দমের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু সুর সাধনার পথে হাটতে গেলেতো কষ্টের ভয় করা চলবে না। আমান দুই সাইজের দুইটা মোটা বাঁশি কিনে নিয়ে এসেছিল। সেসব নিয়ে অন্যরা ইয়ার্কি ঠাট্টা কম করেনি। কিন্তু আমান দমে যায়নি।

ফিরতি পথে শখের বসে মেলার মিষ্টির দোকানে গিয়ে অদ্ভুত এক রসগোল্লার সন্ধান পাওয়া গেল। প্রচলিত রঙের রসগোল্লা নয়। রংধনুর সব রঙের রসগোল্লা গামলায় উপস্থিত। একটাকায় চারটা পাওয়া যাচ্ছে। এত সন্তা দেখে আমানরাতো অবাক হয়ে গেল। কিনে খেতে গিয়ে দেখা গেল এখানে চিনি নামক কোন দ্রব্যের ব্যবহার নেই। নেহায়েতই আটার রঙিন দলা চাপকলের পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়েছে। তরল দ্রবণটা আসলে চিনির সিরা নয়। অভিনব প্রতারণা। কিন্তু মেলায় আসা মানুষজনতো বেশ আগ্রহ করেই খাচ্ছে। গ্রামের মানুষদের অদ্ভুত মানসিকতা। ভাল মন্দের দরকার নেই। নতুন কিছু করতে পারলেই ধন্য। কী সব দিনই না ছিল।

জীবনের গতি কি এমনই নির্ধারিত ছিল? আমান ভেবে পায় না।  মেসে রাতের খাওয়া হয়ে গেছে সাড়ে সাতটার দিকেই। এই অঞ্চলে পল্লী বিদ্যুৎ-এর সংযোগ একান্তই প্রতীকি। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সাড়ে একুশ ঘণ্টাই লোড শেডিং হয়। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ আসলে যখন টিউব লাইট জ্বলে উঠে তখন ঘরটাকে খুবই অচেনা অচেনা লাগে। আমান শব্দহীনভাবে দুই ঠোঁট নাড়াতে থাকে। একা একা নিঃশব্দে কথা বলে। কার সাথে? স্কুল জীবন থেকে এই অভ্যেস। কিন্তু দিন দিন অভ্যাসটা কমেনি বরং বেড়েছে। ব্যাগের ভিতর হাফিজের কবিতার ভাবানুবাদ আছে।

কিন্তু আজ আর সেসবে চোখ বোলাতে ইচ্ছে করছে না। একসময় একখণ্ড মাসুদ রানা হাতে নিয়ে শুয়ে পড়ল। হারিকেনের আলোয় মাসুদ রানা পড়তে পড়তে চোখ ভারী হয়ে এলে আস্তে করে আলোটা কমিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে আমান। আগামীকাল অফিসে অডিটর আসার কথা। কোন ধরণের ধকল যাবে কে জানে। শরীরের বরং বিশ্রাম দরকার। সামলে উঠতে কাজে লাগবে।

অডিট ফার্মের নামটাও বিরল প্রকৃতির। বদর এন্ড বশির কোং। লিড অডিটর জনাব আনোয়ার হোসেন এবং সহকারী অডিটর জনাব হালিম শিকদার। ঢাকা থেকে কষ্ট করে এসেছেন। হেড অফিস তাদের পাঠিয়েছে আঞ্চলিক অফিসের হিসাব ও কার্যক্রম নিরীক্ষা করতে। ছয় পদের মাছই শুধু রান্না করা হয়েছে। তাছাড়া গরু, খাশি আর দেশী মুরগীর মাংস তো আছেই। এক সিদ্ধ দেয়া কাটারীভোগ চালের ভাত। কেবল কাজ নয় আপ্যায়ন দিয়েও মুগ্ধ করে দেয়া চাই।

ম্যানেজার সাহেব যত্ন সহকারে সব আয়োজন করেছেন। যেসব অফিসাররা অডিটরদের সাথে কাজ করবেন তিনি তাদের সাথে অডিটরদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। হিসাব বিভাগের সাথে লিড অডিটর আনোয়ার হোসেন নিজে কাজ করবেন। ম্যানেজার সাহেব হিসাব বিভাগের জেষ্ঠ কর্মকর্তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার পর কৃত্তিম হাসি হেসে আমানের সাথে অডিটর ভদ্রলোককে পরিচয় করিয়ে দিলেন; আমানের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ইনি জনাব আনোয়ার হোসেন, আজকের প্রোগ্রামের লিড অডিটর। আর ইনি মিস্টার আমানত উল্লাহ, আমাদের জুনিয়র একাউনটেন্ট”। শুরুতেই আমানের মেজাজটা খিচড়ে গেল। সত্য বটে তার আসল নাম আমানত উল্লাহ, কিন্তু ম্যানেজার সাহেব প্রতিবারই উচ্চারণের সময় এক ধরণের অবজ্ঞা প্রকাশ করেন বলে মনে হয় আমানের। (চলমান...)

 

 

নিউজজি/এসএফ

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন