শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ , ১৯ রমজান ১৪৪৫

সাহিত্য
  >
প্রবন্ধ

না পেয়ে তোমার দেখা

প্রশান্ত ভৌমিক মে ৯, ২০১৯, ১৪:২২:২৮

9K
  • না পেয়ে তোমার দেখা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র। মৃত্যুর প্রায় ৭০ বছর পরেও রবীন্দ্রনাথ অনেকটাই প্রাসঙ্গিক। রবীন্দ্রনাথ এক জীবনে যা লিখেছেন বাংলা সাহিত্যের আর কোনো লেখক পারেননি সেই উচ্চতায় উঠতে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এখনকার সাহিত্যিকরা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কী ভাবছেন? বিভিন্ন সাহিত্যিক বিভিন্নভাবে রবীন্দ্রনাথকে খোঁজার চেষ্টা করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন রবীন্দ্রনাথের গানের ভক্ত, কেউ বা ছোটগল্পকার রবীন্দ্রনাথকেই মনের মণিকোঠায় ঠাঁই দিয়েছেন বড় আদরে। 

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথকে বাংলা সাহিত্যের ঈশ্বর বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আমি আর নতুন করে কী বলব বল? রবীন্দ্রনাথ আমাদের রক্তের মধ্যে আছেন। আমাদের চারদিকে ঘিরে রেখেছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ প্রভাব হয়তো আমার ওপর নেই। কিন্তু তাঁর মনোভঙ্গি, তাঁর আদর্শ, তাঁর বাকভঙ্গি, তাঁর কবিতা, তাঁর সবকিছুই আমাদের মনকে প্রভাবিত করে। অতএব তাঁর প্রত্যক্ষ প্রভাব না থাকলেও পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে আমার ওপরে। থাকবেই। কারণ এরকম একটা চরিত্র তো খুব কম জন্মায় পৃথিবীতে। ওরকম একজন মানুষ জীবনে এত লিখেছেন এবং এত বিষয়ে লিখেছেন, অসাধারণ লিখেছেন যে তাঁর কোন তুলনা হয় না। রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে ঈশ্বরতুল্য বলতে পার।’

রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়- রবীন্দ্রনাথের জীবনকে উপজীব্য করে লিখে যাচ্ছেন একের পর এক উপন্যাস। বিষয় যদি হয় রবীন্দ্রনাথ- রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলম যেন হয়ে ওঠে খাপখোলা তলোয়ার। রবীন্দ্রনাথের জীবনের অন্য দিকটা যেদিকে অন্ধকারের পরিমাণ বেশি, কিংবা আলো-অন্ধকারের মাঝামাঝি ধূসর রঙের বেশি প্রাধান্য সে দিকটাতেই রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় বেশি আলোকপাত করেন তাঁর লেখায়। রবীন্দ্র প্রেমীদের কাছে নিন্দিত হলেও সাধারণ মানুষের কাছে নন্দিত তিনি বাস্তবের চরিত্রকে নায়ক করে উপন্যাস লেখার কারণে। 

সেই তিনিই রবীন্দ্রনাথকে লালন করেন অন্তরে। তিনি অকপটে বলেন, ‘বাংলাদেশের গায়কদের মতো রবীন্দ্রসংগীত কলকাতার গায়কেরা গাইতে পারেন না। আর তাই তিনি বারেবারে বাংলাদেশে ছুটে যান রবীন্দ্রসংগীত শোনার জন্য। তিনি বলেন- ‘যারা রবীন্দ্র ভক্ত, তারা অনেকেই মনে করেছেন আমি বোধহয় রবীন্দ্রনাথকে ছোট করেছি, রবীন্দ্রনাথকে নিন্দার জায়গায় নিয়ে গেছি। আমি বললাম- আমি তো তা করিনি। আমি বাস্তব মানুষটাকে দেখবার চেষ্টা করেছি। 

বুদ্ধদেব বসু একটি অসামান্য কথা বলেছিলেন, সেটা রবীন্দ্রনাথের যে প্রামাণ্য জীবনী, প্রশান্ত কুমার পালের লেখা রবিজীবনী - তার ব্যাকপেজে এই কোটেশান ছিল। বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন- ‘আমরা রবীন্দ্রনাথকে তো বেদির উপরে প্রতিষ্ঠা করেছি এবং দেবতা হিসেবেই তাকে পূজো করেছি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একদিন ঐ মূর্তি থেকে প্রলেপগুলো খসে পড়বে। এবং ভেতর থেকে আসল মানুষটি বেরিয়ে আসবেন। তখনই রবীন্দ্রনাথকে আমরা চিনতে পারব এবং জীবনী লেখা সম্ভব। আমার মনে হয় যে আমার লেখায় সে প্রলেপগুলো খসে পড়েছে। এবং আসল রবীন্দ্রনাথ বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু নিন্দার্থে নয়। এই রবীন্দ্রনাথকেই আমরা চাই। আমার মনে হয়েছে রবীন্দ্র সাহিত্যকে বুঝতে হলেও এই প্রলেপহীন মানুষটিকে বুঝতে হবে।’

আবার বাংলাদেশ এবং রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক নিয়ে তিনি বলেন ‘বাংলাদেশের রবীন্দ্রচর্চা আমাকে খুব সন্তুষ্ট করেছে। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের গান। বাংলাদেশের গায়করা খুব ভালো রবীন্দ্রনাথের গান করেন। আমি বাংলাদেশে যাই রবীন্দ্রনাথের গান শোনার জন্য অনেকটা। আমার ভালো লাগে বাংলাদেশ, পদ্মা পাড়। আমি দু'টো বই লিখলাম। একটা হল রবীন্দ্রনাথ ও ইন্দিরা- দিবা রাত্রির কাব্য। সেটা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ দশ বছর ছিলেন বাংলায় পদ্মার ওপারে। সেটা নিয়ে একটা উপন্যাস। আরেকটা উপন্যাস লিখেছি পদ্মাপাড়ে রবীন্দ্রনাথ। সেটা এই বই মেলায় বেরোবে। দু'টো বই-ই আমি লিখলাম বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথের থাকা নিয়ে। বাংলাদেশের কাছে রবীন্দ্র ঋণ নিয়ে।’

পশ্চিম বাংলার লেখক স্মরণজিৎ চক্রবর্তী রবীন্দ্রনাথকে দেখেন আবার ভিন্ন ভাবে। তাঁর কথায়- ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে বলতে গেলে আমি বলবো, রবি ঠাকুরের গান আমার খুব পছন্দের। কিন্তু আমি প্রচুর যে রবি ঠাকুর পড়েছি তা নয়। কেননা, আমি রবি ঠাকুরের সঙ্গে শুধু এখন নয়, কোনদিনই রিলেট করতে পারি না। যারা পারেন তাঁদের নিশ্চয়ই খুব ভালো লাগে। কিন্তু আমি কোনদিনও রবি ঠাকুরের চিন্তা, ভাবনা, তাঁর বেঁচে থাকার মধ্যে নিজেকে রিলেট করতে পারি না। কিছু কিছু গান আছে তাঁর- খুব ভালো লাগে আমার। কেন ভালো লাগে? আমি স্পষ্ট বুঝি না। শুনলেই কেমন অদ্ভুত লাগে! কিন্তু বাকি উপন্যাস পড়ে আমি খুব একটা আপ্লুত- এমন নয়। কিছু কবিতা আছে- ধরে ধরেই বলি- ‘‘বাঁশি’’ একটি কবিতা আছে, ‘‘ক্যামেলিয়া’’ আছে, তারপরে ‘‘ক্ষণিকা’’র যে কবিতা, ছোট ছোট কবিতাগুলো আছে, সেগুলো পড়ে আমার মন এক অদ্ভুত ভালোলাগায় ভরে যায়। কিন্তু সামগ্রিকভাবে প্রতিদিন সকালে আমি রবীন্দ্রনাথ পড়ি না। আমি প্রতিদিন সকালে নিয়ম করে রবীন্দ্রনাথের গান শুনি না। একদম শুনি না। কেননা রবি ঠাকুরের কিছু কিছু জিনিস আমার খুব ভালো লাগে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে যে রিলেট করা, সেটা আমি করতে পারি না।’

তিনি বলেন, ‘আমি রবি ঠাকুরের ছোটগল্প সব পড়েছি। ছোটগল্প আশ্চর্য লেগেছে আমার কাছে। উপন্যাস আমার খুব ভালো লাগেনি পড়ে। খুব আপ্লুত হয়েছি তা নয়। সব কবিতা যে ভালো লেগেছে তা নয়। কারণ, ভাষা নিয়ে মাঝে মাঝে কেমন যেন লাগে আমার! কেননা, সেই সময়কার ভাষা। সেই ভাষাটা ভেঙে ভেঙে ভাষার ভেতরে যেতে ইচ্ছে করে না আমার। পরের দিকের লেখাগুলি, যেগুলি অনেক বেশি কথ্য ভাষায় লেখা, সেগুলি আমার অনেক কাছের মনে হয়। ফলে রবি ঠাকুরের সঙ্গে আমার একটা মেলানো-মেশানো সম্পর্ক বলতে পারেন। আমি যে তাঁর প্রতি ‘‘আহা! আহা! কী মুগ্ধ! কী মুগ্ধ!’’ এমন- তা নই। আমি আমার মতো করে বেছে নিয়েছি রবি ঠাকুরকে। যেমন- ‘‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’’ গানটা আমার খুব পছন্দ। এরকম কিছু কিছু গান আছে। আমি একটা বললাম। এছাড়া বাকি সব কিছু আমার তেমন একটা পছন্দ নয়। যেহেতু এত লিখেছেন মানুষটি, সেজন্য আমার মতো লোকেদের বেছে নিতে খুব সুবিধে হয়েছে।’ 

আবার রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় যে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বা রবীন্দ্রনাথের জীবনের অন্ধকার দিকগুলো নিয়ে উপন্যাস লিখছেন তাতেও কোনো সমস্যা দেখেন না স্মরণজিৎ চক্রবর্তী। তাঁর ভাষ্যে- ‘রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা একটি বই আমি পড়েছিলাম। তাতে ছিলো, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর স্তন স্পর্শ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। একবার তিনি বুকে হাত দিয়েছিলেন। এটা হয়তো কেউ সহজে মেনে নিতে পারবেন না। কিন্তু রবি ঠাকুরেরওতো অনেকগুলো সন্তান ছিলো। সেগুলো তো ওয়াই-ফাই সিস্টেমের মাধ্যমেও হয়নি, ব্লুটুথের মাধ্যমেও হয়নি। আদি অনন্তকাল ধরে যেভাবে মানুষের সন্তান হয়ে এসেছিলো, তাঁরও সেভাবেই হয়েছিলো। তাঁর একটা যৌনতার দিক ছিলো জীবনে। না হলে এরকম লেখা লিখতে পারতেন না। একটা মানুষ, যার জীবনে যৌন অভিজ্ঞতা নেই, সে মানুষের অত মনের গভীরে যেতে পারবে না। যার যৌনতা বোধ নেই, যৌন জ্ঞান নেই, সে এরকম লিখতে পারবে না। আমার মনে হচ্ছে, রবি ঠাকুরের যৌন জীবন প্রকাশের মধ্য দিয়ে কোথাও তাঁর মহিমা ক্ষুন্ন হচ্ছে না। তাঁর লেখা, তাঁর লেখাই।’

বাংলাদেশের এই সাহিত্যিক ও সাংবাদিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে বলেন, “নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প আমাকে সবচেয়ে বেশি টানে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঐ সময়ে যেসব ছোটগল্প লিখেছেন, মানে এখনো ভাবতে অবাক লাগে। এত স্মার্ট গদ্যে তিনি লিখেছেন ঐ সময়ে, আমি মুগ্ধ। যেটা দীর্ঘদিন পর্যন্ত আমি আবিষ্কার করতে পারিনি সেটা হল রবীন্দ্রনাথের গান। দীর্ঘদিন পর্যন্ত আমার কাছে মনে হয়েছিলো যে, রবীন্দ্রাসঙ্গীত তত উঁচু মানের সাহিত্য নয়। কিন্তু বেশ বড় হওয়ার পরে, আমি যখন গ্র্যাজুয়েশন শুরু করে দিয়েছি, তখন এসে নতুন করে রবীন্দ্রসংগীত শোনা শুরু করি। আমি উপলব্ধি করি পূজা পর্বের, প্রার্থনা পর্বের গানগুলোর সাহিত্যমূল্য, জীবনবোধের কথা। নিজেকে বিলীন করে দেওয়ার যে কথা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, তাতে করে আমার মনে হলো, ফিলোসফিক্যালি বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে সমৃদ্ধ লেখক তিনি। এবং তাঁর ছোটগল্প তো শুধু ফিলোসফিক্যাল নয়, সাহিত্য মূল্যের দিক থেকেও ছোটগল্প সবার উপরে থাকার কথা। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস সম্পর্কে যদি বলি, তাঁর উপন্যাস আমার খুব ভালো লাগে নি।’

এই কয়েকজন সাম্প্রতিক সময়ের লেখকের মতামত থেকেই আমরা রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মত পাই। কিন্তু এই ভিন্ন মতের কোথাও কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে এড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপার নেই। বরং একেকজন একেকভাবে আবিষ্কার করছেন রবীন্দ্রনাথকে, তাঁর সাহিত্যকে। এটাই বোধহয় রবীন্দ্রনাথের মহিমা।

নিউজজি/এসএফ

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন