বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪, ২৫ আশ্বিন ১৪৩১ , ৬ রবিউস সানি ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
প্রবন্ধ

কাকাবাবু ফিরে এলেন?

প্রশান্ত ভৌমিক নভেম্বর ২৬, ২০১৮, ১৩:৩৭:২৬

12K
  • কাকাবাবু ফিরে এলেন?

বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান লেখকদের প্রত্যেকেরই সৃষ্ট সিরিজ উপন্যাস রয়েছে। যেমন- হুমায়ূন আহমেদের হিমু, মিসির আলি, শুভ্র। আনিসুল হকের গুড্ডা বুড়া, ফরিদুর রেজা সাগরের ছোট কাকু, মোস্তফা মামুনের তণু কাকা, দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের হরিপদ টিম ইত্যাদি।

আবার পশ্চিম বাংলার সাহিত্যিকদের মধ্যে সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা আর প্রোফেসর শঙ্কু, নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদা, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদা, বুদ্ধদেব গুহর ঋজুদা, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গোয়েন্দা বরদাচরণ আর শবর দাশগুপ্ত, শরবিন্দু মুখোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ, সমরেশ মজুমদারের অর্জুন, মতি নন্দীর কলাবতী, সুচিত্রা ভট্টাচার্যের মিতিন মাসি, ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের পান্ডব গোয়েন্দা ইত্যাদির পাশাপাশি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নীললোহিত ও কাকাবাবুও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। 

কাকাবাবু বিখ্যাত বাঙ্গালি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সৃষ্ট একটি অনবদ্য চরিত্র। কাকাবাবুর সব অভিযানে সঙ্গী ভাইপো সন্তু। যার ভালো নাম সুনন্দ রায় চৌধুরী। আর কাকাবাবুর ভালো নাম রাজা রায় চৌধুরী। অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় কাকাবাবু ভারত সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের একজন সাবেক কর্মকর্তা। কিছুদিন তিনি সিবিআই-এও কাজ করেছিলেন। তিনি মধ্যপ্রদেশে এক বন্ধুকে দুর্ঘটনার কবল থেকে বাঁচানোর সময় পঙ্গু হন।

তারপর থেকে ক্র্যাচ কাকাবাবুর সার্বক্ষণিক সঙ্গী। কাকাবাবু শারীরিক ভাবে প্রতিবন্ধী হলেও তার অদম্য সাহস, মনের জোর আর নানা বিষয়ে অভূতপূর্ব জ্ঞান থাকায় তিনি সব সমস্যার সমাধান করতে পারেন। ভাইপো সন্তু ছাড়াও সন্তুর বন্ধু জোজোও বেশ কয়েকটি অভিযানে কাকাবাবুর সঙ্গী হয়েছেন। কাকাবাবু যদিও কিশোর সন্তুর বয়ানে বর্ণিত তবু কাকাবাবু সিরিজকে কিশোর উপন্যাস ক্যাটাগরিতে ফেলা যাবে না। আবার কাকাবাবু ঠিক প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য আলাদাভাবে রচিত হয়নি। তাহলে কাকাবাবু কি? কাকাবাবুর স্রষ্টা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তো বলেছেন কাকাবাবু প্রাপ্ত-মনস্কদের জন্য লেখা। 

রফিক উল ইসলাম সম্পাদিত ‘সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জীবন ও গ্রন্থপরিচয়' (প্রতিভাস, ২০০৩) গ্রন্থে এক সাক্ষাৎকারে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে প্রশ্ন করা হয়েছিল- “কাকাবাবু চরিত্রটিকে ক্র‍্যাচ নির্ভর একজন খোঁড়া মানুষ হিসেবে সৃষ্টি করলেন কেন?” উত্তরে সুনীল বলেছিলেন- “কাকাবাবু সিরিজের লেখাগুলি গোয়েন্দা গল্প নয়, সেরকম আমি লিখতেও চাইনি। সবকটিই রোমাঞ্চকর অভিযান কাহিনী। কিশোর- কিশোরীদের কল্পনা উদ্দীপ্ত করাই এর উদ্দেশ্য। সাধারণত গোয়েন্দা কাহিনীর নায়ক সর্বগুণান্বিত হয়। চেহারা সুন্দর, মারামারি ঘুসোঘুসি ভালো পারে, লড়াইতে অকুতোভয়। আমার কাকাবাবু অনেক সাধারণ এবং কাছের মানুষ। তিনি ক্র‍্যাচ নির্ভর করে হাঁটেন, তাতে বোঝা যায় তার মনের জোরটাই অসাধারণ। আমার ছোটদের গল্পগুলিতে এই মনের জোরটার ওপরেই জোর দেয়া হয়েছে।’’

কাকাবাবু নানান অ্যাডভেঞ্চারে জড়িয়ে পড়েন। ঘুরতে বেরিয়ে যান দেশ- বিদেশে। তবে কাকাবাবুর বেশিরভাগ কাহিনিই ভারত বর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে। আর কাকাবাবুর কাহিনি পড়তে পড়তে আমরা অনুধাবন করি, লেখক সুনীলের চেয়ে ট্যুরিস্ট সুনীলও কম শক্তিশালী নন। কাকাবাবুর একেকটি কাহিনিতে আমরা পর্যটক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কেই খুঁজে পাই। কাকাবাবু যেসব জায়গায় গিয়েছেন সুনীল সশরীরে সেসব জায়গা ঘুরে এসেই বর্ণনা করেছেন।

‘কাকাবাবু’ সিরিজে মোট ৩৬ টি উপন্যাস আর ৩ টি ছোটগল্পের উল্লেখ পাই আমরা। সবগুলো বইয়ের প্রকাশকই কলকাতার স্বনামধন্য আনন্দ পাবলিশার্স। বই আকারে প্রকাশের আগে প্রায় সবগুলো অভিযানই ‘আনন্দমেলা' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কিছু কিছু অভিযান ধারাবাহিকভাবে পাক্ষিক ‘আনন্দমেলা’ পত্রিকায়। আর অধিকাংশই শারদীয়া ‘আনন্দমেলা’য়। এছাড়া কয়েকটি অভিযান শারদীয়া কিশোর জ্ঞান- বিজ্ঞান, শারদীয়া সন্দেশ, শারদীয়া শুকতারা এবং শারদীয়া কিশোর ভারতীতে প্রকাশিত হয়েছে বলে আমরা দেখতে পাই। ‘কাকাবাবু’ সিরিজের বইগুলো প্রথম প্রকাশের সময় নাম ছিল ‘সন্তু- কাকাবাবু সিরিজ'।

কিন্তু পরবর্তীতে যখন সমগ্র আকারে প্রকাশিত হয় তখন ‘সন্তু- কাকাবাবু সিরিজ' এর পরিবর্তে ‘কাকাবাবু সমগ্র' নামে প্রকাশিত হয়। এখন পর্যন্ত ‘কাকাবাবু সমগ্র'র ৬টি খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। তবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুর আগে রচিত সর্বশেষ ৩টি কাকাবাবুর অভিযান কোনো সমগ্র গ্রন্থভুক্ত হয়নি। কাহিনি তিনটির শিরোনাম হল- আরবদেশে সন্তু- কাকাবাবু, কাকাবাবু ও জলদস্যু, গোলকধাঁধায় কাকাবাবু। অর্থাৎ ‘ভয়ংকর সুন্দর' দিয়ে যে অভিযানের শুরু তা শেষ হয় ‘গোলকধাঁধা’য়। 

কাকাবাবুর কাহিনি লেখার অনুপ্রেরণা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কোথায় পেয়েছিলেন? ‘কাকাবাবু সমগ্র-১' গ্রন্থের ভূমিকায় নিজের বয়ানেই জানিয়েছেন- “একবার আমি একজন খোঁড়া মানুষকে খুব উঁচু পাহাড়ে উঠতে দেখেছিলাম। তার যেন একটুও কষ্ট হচ্ছিল না। তখন আমি ছোট, সন্তুরই বয়েসী। সেই মানুষটিকে দেখে বুঝতে পেরেছিলাম, অসাধারণ তার মনের জোর, আর এরকম মনের জোর থাকলে মানুষ যে- কোনো বাধাকেই জয় করতে পারে। সেই মানুষটিই কাকাবাবু। সন্তুও কাকাবাবুর কাছ থেকে তেমনই মনের জোর পেয়েছে, যে জন্য কোনো বিপদেই সে ভয় পায় না। কাকাবাবু ডিটেকটিভ নন, খুন- ডাকাতির তদন্তও করেন না। রহস্যময় দু:সাহসী অভিযানেই তার আগ্রহ, সন্তুও তাতেই মেতে ওঠে।“

কাকাবাবু কোথায় কোথায় চলে যান নানা রকম অ্যাডভেঞ্চারে! সুনীলের বয়ানে (কাকাবাবু সমগ্র-২ এ) – “কাকাবাবু আর সন্তু রহস্যের সন্ধানে ভারতের নানা অঞ্চলে চলে যায়। কখনো দুর্গম পাহাড়ের চূড়ায়, কখনো গভীর জঙ্গলে, কখনো সমুদ্রের দ্বীপে। একবার ওরা একটি অভিযানে গেছে ভারতের বাইরে, আফ্রিকার কেনিয়ায়। সেরিংগেটি অরণ্যে হোটেলের তাঁবুতে শুয়ে শুয়ে শোনা যায় সিংহের গর্জন। রাত্তির বেলা খুব কাছ দিয়ে চলে যায় জলহস্তী আর হাতির পাল। কাকাবাবুরা যে তাঁবুতে ছিলেন, কিছুদিন পর ঠিক সেই তাঁবুতে আমি থেকে এসেছি কয়েকদিন। কাকাবাবুর কথা সেখানকার অনেকেই মনে রেখেছে।’’

কাকাবাবুকে নিয়ে ছোটগল্প লেখা হয়েছে তিনটি মাত্র। তিনটি ছোটগল্প কেন? কৌতূহলী পাঠকের এই কৌতূহল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মিটিয়েছেন ‘কাকাবাবু সমগ্র-৩' এর ভূমিকায়। তাঁর নিজের ভাষায়- “এই খণ্ডে কাকাবাবু ও সন্তুর কয়েকটি উপন্যাসের সঙ্গে তিনটি ছোট গল্পও রয়েছে। কাকাবাবু এমনই বড় মাপের মানুষ যে তাকে ছোটগল্পে ঠিক আঁটানো যায় না। সেই জন্য এ পর্যন্ত মাত্র তিনটি গল্পই লেখা হয়েছে কাকাবাবুকে নিয়ে।“

কাকাবাবুকে নিয়ে পাঠকমনে নানা প্রশ্ন উঁকি দিয়ে যেত। তেমনই কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর পাই ‘কাকাবাবু সমগ্র- ৪’ এর ভূমিকায়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভাষায়- “কাকাবাবু কেন খোঁড়া কিংবা কীভাবে তার পায়ে আঘাত লেগেছিল, এ নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন আছে। আগের কয়েকটি বইতে কাকাবাবুর এক পা খোঁড়া হবার কারণ বিভিন্ন রকম দেওয়া আছে, যা পরস্পর বিরোধী। আসলে কাকাবাবু এই ঘটনাটা কখনও পরিষ্কার করে খুলে বলতেন না, তার একটা সঙ্কোচ ছিল। এই খণ্ডে ‘কাকাবাবুর প্রথম অভিযান'- এই আসল ঘটনা দেওয়া আছে, সেটা পড়লেই বোঝা যাবে, কেন তিনি এতদিন নিজের মুখে তা বলতে চান নি।  জোজো অদৃশ্য' বেরুবার পর অনেকে জানতে চেয়েছে, চট্টগ্রাম- কক্সবাজারে গরিবদের বাড়িতে কিংবা ফাঁকা কোনও দ্বীপে বড় বড় সাদা রঙ্গের চারতলা বাড়ি সত্যিই আছে, না আমার বানানো? বানানো নয়, এই রকম স্টর্ম সেন্টার বা ঝড়ের আশ্রয় সত্যিই আছে।’’

১৯৭৯ সালে শারদীয়া আনন্দমেলা থেকে ২০১২ সালের শারদীয়াও আনন্দমেলা। দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে কাকাবাবু আর সন্তুকে নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অ্যাডভেঞ্চার চলছে। শুধু অ্যাডভেঞ্চার নয়, মনুষ্যত্বের শিক্ষা ছিলো সুনীলের লেখার ভিতরে। যেমন- ‘কাকাবাবু বনাম মূর্তিচোর' গল্পে তিনি লেখেন- “যারা মানুষ মারে, অন্যের সম্পত্তি ছিনিয়ে নেয়, কোনো দেবতা কি তাদের সমর্থন করতে পারেন? আজকাল দেখবি যারা খাদ্যে ভেজাল দেয়, জোচ্চুরি করে, গরিবদের ঠকায়; তারাই আবার মন্দির বানায়, ঢাক ঢোল বাজিয়ে পুজো দেয়। এ সবই মিথ্যে। মানুষকে ভালোবাসাটাই সবচেয়ে বড় পুণ্যের কাজ।’’

কাকাবাবুর একটি বিশেষ শখ ছিলো ম্যাপ দেখা। তিনি সময় পেলেই টেবিল ছড়িয়ে ম্যাপ দেখতে ভালোবাসেন। তার একটি ম্য্যাপের বইও রয়েছে। কোনো জায়গায় যাওয়ার আগে তিনি প্রচুর পড়াশোনা করতেন সেই জায়গা সম্পর্কে।

কাকাবাবু আমাদের মাঝে জীবন্ত হয়ে আছেন ৩৬টি উপন্যাস আর ৩টি গল্পে। ষাটোর্ধ কাকাবাবু আর নতুন কোনো অভিযান নিয়ে আসবেন না আমাদের কাছে। কিন্তু পাঠকের কাছে কাকাবাবুর আবেদন চিরকালীন। প্রতিটি ভোরেই এক- একটি কাকাবাবুর বই হাতে নিলেই মনে হয়- আবার নতুন অ্যাডভেঞ্চার! তবে কি কাকাবাবু ফিরে এলেন?

নিউজজি/এসএফ

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন