রবিবার, ৩ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ কার্তিক ১৪৩১ , ১ জুমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
প্রবন্ধ

সৈয়দ শামসুল হক বাংলা সাহিত্যের এক নির্ভীক বাতিওয়ালা

ফারুক হোসেন শিহাব সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৮, ১৫:০২:৪৮

9K
  • সৈয়দ শামসুল হক বাংলা সাহিত্যের এক নির্ভীক বাতিওয়ালা

যাঁদের নাম কণ্ঠে উচ্চারিত হলে সমগ্র বাংলাদেশ শ্রদ্ধায় নতজানু হয়ে ওঠে, যাঁদের সৃজন-মননে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি অনন্য-উজ্জ্বল। সৈয়দ শামসুল হক সেই সব কীর্তিমানদেরই একজন। তাঁর দৃষ্টির গভীরতায়, সৃষ্টির উদ্দামতায়, শব্দের মোহনরূপে মুগ্ধ হননি এমন পাঠক বোধকরি আমাদের দেশে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প, চলচ্চিত্র, গান, অনুবাদসহ সাহিত্যে-সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর সাবলীল পদচারণার জন্য তাঁকে ‘সব্যসাচী’ লেখক বলা হয়ে থাকে। ‘কবিতার ধ্বনিসঙ্গীতে, নাটকের আলো-আঁধার মঞ্চে, গল্পের অবিরাম বয়নে, এই দেশ ও মানুষের কথা বলেছেন তিনি। বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের আবেগ-অনুভূতি-বিকার সবই খুব সহজ কথা ও ছন্দে উঠে এসেছে তাঁর লেখনীতে। তিনি সৈয়দ শামসুল হক। নির্মল কথাশিল্পী, সব্যসাচী লেখক, কবি ও নাট্যকার; বাংলা সাহিত্যের এক নির্ভীক বাতিওয়ালা। 

সৈয়দ শামসুল হক বহুমাত্রিক সাহিত্য-সৃজনের এক বিস্ময়। আজ ২৭ সেপ্টেম্বর কীর্তিমান এই লেখকের দ্বিতীয় প্রয়াণদিবস। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিসহ দেশব্যাপী বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন দিবসটিকে নানা কর্মসূচির মধ্যদিয়ে পালন করছে। সোনার বাংলা স্বপ্নের বাংলা সংগ্রামী বাংলার কথা বলার মধ্য দিয়ে বিশ্বের সকল মানুষেরই কথা হয়ে রয়েছে তার রচনায়। ফুসফুসের সমস্যা দেখা দিলে ২০১৬ সালের ১৫ এপ্রিল তাকে লন্ডন নিয়ে যাওয়া হয়। 

সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার তার ফুসফুসে ক্যানসার ধরা পড়ে। বাংলা সাহিত্যের এই সব্যসাচী লেখক গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর রাজধানী ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। এর আগে, তিনি প্রায় ৪ মাস লন্ডনের রয়্যাল মার্সডেন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। 

মৃত্যুর আগে আশিতম জন্মদিনের বক্তৃতায় সৈয়দ শামসুল হক বলেছিলেন, ‘কতটুকু গেলে স্বর্গ মেলে, আর কতদূর যেতে হবে? ইতিহাসের নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে আমার জীবন গেছে। এ দীর্ঘ পথচলার উপলব্ধি হচ্ছে, জীবন সবার ওপরে। জীবনের স্বাদ হচ্ছে বেঁচে থাকায়। অর্থপূর্ণ বেঁচে থাকায়। লড়াইয়ের ভেতর দিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা।’

১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর সৈয়দ শামসুল হক কুড়িগ্রাম মহকুমায় (বর্তমানে জেলা) এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা সৈয়দ সিদ্দিক হোসেন ছিলেন একজন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। মায়ের নাম হালিমা খাতুন। এ লেখকের শিশু ও কৈশোরকাল এই কুড়িগ্রামেই কেটেছে। তাঁর বাবা চাইতেন ছেলে ডাক্তারি পড়বে। কিন্তু তিনি ডাক্তারি পড়ার চাপ এড়াতে ১৯৫১ সালে ভারতের মুম্বাই পালিয়ে যান। সেখানে তিনি বছরখানেক একটি সিনেমা প্রডাকশন হাউসে সহকারী হিসেবে কাজ করেন।

এরপর দেশে ফিরে নিজের ইচ্ছাতেই ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজের মানবিক শাখায়। পরে ১৯৫৪ সালে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। তবে ইংরেজি বিভাগে তাঁর পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনায় ইস্তফা দেন সৈয়দ শামসুল হক। এর কিছু দিন পরেই প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দেয়ালের দেশ’।

বাবার মৃত্যুর পর ১৯৫৬-৫৭ সালে বেশ অর্থকষ্টে পড়ে যান সৈয়দ হক। ওই সময় অর্থের জন্যই তিনি শুরু করেন চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য রচনা। ১৯৫৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সৈয়দ হক ৩০টির মতো চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য রচনা করেন। সৈয়দ হকের লেখা ‘মাটির পাহাড়’, ‘তোমার আমার’, ‘রাজা এল শহরে’, ‘শীত বিকেল’, ‘সুতরাং’, ‘কাগজের নৌকা’ ইত্যাদি চলচ্চিত্র ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা লাভ করে।

সৈয়দ হক চলচ্চিত্রের জন্য গানও রচনা করেন। ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘তোরা দেখ দেখ দেখরে চাহিয়া’, ‘এমন মজা হয় না গায়ে সোনার গয়না’, ‘এই যে আকাশ এই যে বাতাস’, ‘তুমি আসবে বলে কাছে ডাকবে বলে’ ইত্যাদি গান সমৃদ্ধ করেছে বাংলা চলচ্চিত্রকে। তবে চলচ্চিত্র অঙ্গনে তাঁর এ ব্যস্ততার মধ্যেও থেমে থাকেনি সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা কিংবা ছোটগল্প রচনা। ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত লেখা তাঁর ছোটগল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘তাস’, ‘শীত বিকেল’, ‘রক্ত গোলাপ’ প্রভৃতি।

সৈয়দ শামসুল হকের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একদা এক রাজ্যে’ প্রকাশিত হয় ১৯৬১ সালে। তাঁর ভাষা আর আঙ্গিকের উজ্জ্বল নিরীক্ষার পরিচয় উৎকীর্ণ হয়ে আছে ‘বিরতিহীন উৎসব’, ‘অপর পুরুষ’, ‘বৈশাখে রচিত পঙ্‌ক্তিমালা’, ‘পরানের গহীন ভিতর’সহ বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থে। ম্যাকবেথ, টেম্পেস্ট, শ্রাবণ রাজাসহ বিশ্বসাহিত্যের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ রচনাও তিনি বাংলায় অনুবাদ করেছেন।

সব্যসাচী লেখক হিসেবে স্বীকৃত  সৈয়দ শামসুল হকের অসংখ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘খেলারাম খেলে যা’, ‘এক মহিলার ছবি’, ‘নীল দংশন’, ‘মৃগয়া’, ‘এক যুবকের ছায়াপথ’, ‘সীমানা ছাড়িয়ে’, ‘অনুপম দিন’, ‘আয়না বিবির পালা’, ‘এক মুঠো সুন্দরী’ ইত্যাদি। তাঁর লেখা মঞ্চনাটক ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ ও ‘নূরল দীনের সারা জীবন’ মঞ্চনাটকের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে আছে। যা সমকালীন অভিপ্রায়ের এক দৃপ্ত প্রকাশ। প্রায় ৬২ বছরের লেখকজীবনে বাংলা মঞ্চ নাটকেও শক্তিমান এক পুরুষ হিসেবে নিজের লেখনীর প্রমাণ দিয়েছেন তিনি।  সৈয়দ হকের লেখা অন্যান্য নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘গণনায়ক’, ‘ঈর্ষা’, ‘নারীগণ’, ‘উত্তরবংশ’ ইত্যাদি।

বাংলা সাহিত্যের এই দিকপালকে নিয়ে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘কবি-সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হক একজন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। গান, কবিতা ও উপন্যাসসহ সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় পদচারণার পাশাপাশি তিনি সাংবাদিকতা করেছেন, চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকায় কাজ করেছেন, এমনকি চলচ্চিত্রের জন্য চিত্রনাট্যও লিখেছেন। আধুনিকতার দিক দিয়ে সৈয়দ শামসুল হক ছিলেন অন্য সবার চেয়ে এগিয়ে। তাঁর মত শৃঙ্খল মানুষ আমি জীবনে খুব কমই দেখেছি। হক ভাইকে আমি প্রবলভাবে অনুভব করি একজন অভিনয় শিল্পী হিসেবে বিশেষ করে মঞ্চ অভিনেতা হিসেবে। আমি তাঁর রচিত নুরলদীনের সারাজীবন, খাট্টা তামাশা ও মুখোশ নাটকে অভিনয় করেছিলাম।’ 

নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘সংশয়ে, বেদনায়, আনন্দে যাঁর কাছে যাওয়া যেত, আশার বাণী শোনা যেত সেই মানুষটি গেল দুবছর ধরে আমাদের মাঝে নেই। তাঁর সঙ্গে সময় কাটানো মানেই নতুন কিছু জানা, আনন্দ লাভ করা। হালকা চালের রসিকতার মধ্যেও অনেক গুরুত্ব বিষয়ের ইঙ্গিত থাকতো। বড় মাপের লেখক ছিলেন সৈয়দ হক। রচনাশৈলী, বাক্যগঠন প্রক্রিয়া, নতুন নতুন শব্দ গঠন দিয়ে নিজস্ব গদ্য ভাষার জন্ম দিয়েছেন। বাংলা সাহিত্যে তিনি অমর হয়ে আছেন।’

কবি মুহাম্মদ সামাদ বলেন, ‘সৃজনশীল সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরে আমাদের পুরোধা ব্যক্তি বুদ্ধদেব বসু ও সৈয়দ শামসুল হক। তিনি সাহিত্যের শিক্ষকও বটে। তাঁকে হারানো মানে জাতির অভিভাবককে হারানো। তবে তিনি তাঁর রেখে যাওয়া সৃজন-ঐশ্বর্যের মাঝেই বেঁচে থাকবেন।’ 

গোলাম কুদ্দুছ বলেন, ‘সৈয়দ শামসুল হক বাংলা ভাষায় তাঁর সমসাময়িককালের সর্বশ্রেষ্ঠ লেখক ছিলেন। দেশের যেকোনো ক্রান্তিকালে তিনি অভিভাবকের মত পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।’

বাংলা সাহিত্যের আলোকিত এই পথিকৃৎ সম্পর্কে তাঁর সহধর্মীনি আনোয়ারা সৈয়দ হক বলেন, ‘আমি কখনও ভাবিনি তিনি আমার আগে চলে যাবেন, তাঁকে নিয়ে আমাকে স্মৃতিচারণ করতে হবে। তাঁর জীবনীশক্তি আমার চেয়েও অনেক বেশি ছিল। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তিনি লিখে গেছেন। ‘ভাবনার ডানা’ শিরোনামে তিনি কবিতার নতুন সিরিজ লিখেছিলেন। শেষ এক মাস যখন তিনি লিখতে পারছিলেন, তখন আমি অনুলিখন করেছি। যেদিন তিনি আইসিইউতে গেলেন, সেদিন তিনি শেষ গল্পটি লিখেছিলেন। যা উৎসর্গ করেছিলেন আমাকে। তিনি বলেন, সৈয়দ হক ঘোরের মধ্যে ছিলেন। ঘুমের ঘোরে নিজের প্রিয় কবিতা পাঠ করতেন। তাঁর মাথায় প্রচুর গল্প, কবিতা ছিল। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মাত্র ১৭ দিনে তিনি ‘হ্যামলেট’ নাটক অনুবাদ করেছিলেন।’

পিতা সম্পর্কে দ্বিতীয় সৈয়দ হক বলেন, ‘সব্যসাচী অভিধা থেকে কবি সৈয়দ শামসুল হক আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বাবাকে সর্বদাই আমার কাছে কবি মনে হয়েছে। কারণ তিনি বারবার কবিতার কাছে ফিরে গেছেন। সাহিত্যের আদিম শাখা কবিতা। সে কবিতা লিখতে গিয়ে তিনি জেনেছেন মানুষের পথ চলার ছন্দ, তাল, মাত্রা। যার প্রয়োগ তিনি সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় দেখিয়েছেন। বিখ্যাত ভাস্কর হেনরি ম্যুরের শিল্পের অন্যতম দিক ছিলো এবসেন্স বা শূন্যতা। শূন্যতাকেই আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। আমরা বাবার শূন্যতাকে সেভাবে অনুভব করবো।’

সৈয়দ শামসুল হককন্যা বিদিতা সৈয়দ হক বলেন, ‘বাবাকে খুব মনে পড়ছে। আমার শোক দুই ভাগে। এক ভাগ সৈয়দ শামসুল হক নামে একজন বড় লেখকের জন্য, যাকে মানুষ ভালোবাসে। আরেক ভাগ আমার বাবার জন্য; যিনি আমাকে হাঁটতে শিখিয়েছেন, আমাকে জীবন চিনিয়েছেন, যাকে আমি আর কখনো দেখবো না।’

অগণিত পাঠকের ভালোবাসার পাশাপাশি দেশের প্রায় সব সেরা পুরস্কারই তাঁর করতলে শোভা পাচ্ছে। তিনি পেয়েছেন সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা স্বাধীনতা পদক ও একুশে পদক। এছাড়াও তাঁর প্রাপ্ত পুরস্কারগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে- বাংলা একাডেমি পদক, আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, পদাবলি কবিতা পুরস্কার, জাতীয় কবিতা পুরস্কার, আইএফআইসি ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার প্রভৃতি। বাংলা সাহিত্যাকাশের ঝলঝলে এই নক্ষত্র তাঁর অনন্য সাহিত্য-সৃজনের মধ্য দিয়ে বাঙালির মননে উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন অনন্তকাল। তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।

নিউজজি/এসএফ

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন