শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ , ১২ জুমাদাউস সানি ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
প্রবন্ধ

লালন সাঁই : মরমি মৃত্তিকার ফসল

ডক্টর আবুল আহসান চৌধুরী অক্টোবর ১৮, ২০১৭, ১৭:০১:৩৩

6K
  • লালন সাঁই : মরমি মৃত্তিকার ফসল

১৬ অক্টোবর (পহেলা কার্তিক) ছিল বাউল সম্রাট লালন সাঁইজির ১২৭তম তিরোধান দিবস। মহামতি লালন সাঁইয়ের জীবন ও দর্শন নিয়ে অসাধারণ একটি প্রবন্ধ রচনা করেছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর আবুল আহসান চৌধুরী। নিউজজি২৪ডটকমের পাঠকদের জন্য প্রবন্ধটি দুটি পর্বে প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আজ যার প্রথম পর্ব প্রকাশ করা হচ্ছে। আগামীকাল প্রকাশিত হবে প্রবন্ধের দ্বিতীয় পর্ব।
 
বাউল অজান-ধারার মরমি-সাধনপথের পথিক। গুরুর নির্দেশে দেহসাধনার পথ ও পন্থা জেনে নিয়ে তার যাত্রা হয় শুরু। মহাজন-বাক্য সুরের আশ্রয়ে গান হয়ে দিশা দেয় তাকে- গোপন-আঁধার পথের সুলুক-সন্ধান মেলে তারপর- আলোকিত হয়ে ওঠে তার মনের পৃথিবী। জীবন ও জগতের মরমি-রহস্য ক্রমে উন্মোচিত হয় যখন সে দেহের ভাষা পড়তে পারে। বাউলের গান তাই একদিকে দেহজরিপের গান, স্বরূপ-অণ্বেষার গান, ‘গভীর নির্জন পথে’ ‘মনের মানুষ’ কে খুঁজে ফেরার গান- অপরদিকে এই গান নিম্নবর্গের মানুষের দ্রোহের গান- প্রতিবাদের গান- শ্রেণিচেতনার গান- শুভ্র-সুন্দর জীবনস্বপ্নের গানও।
বাউলের জন্ম দ্রোহ থেকে। তার সাধনা প্রচলিত শাস্ত্র ও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে অগ্রাহ্য-অস্বীকারের স্পর্ধার প্রতীক। তার দর্শন বর্ণশোষণ ও জাতপাতের বিরুদ্ধে ‘মানুষসত্যে’র উদার মানবিকতার দর্শন। তার গান রূপক-প্রতীকের আড়ালে প্রবল প্রতিবাদের গান- প্রচলিত আচার-প্রথা-বিশ্বাসকে চূর্ণ করা নবজীবনের গান। বিশ্বাসের বদলে যুক্তি, প্রথার শাসন থেকে মুক্তি, সংস্কার-আচারকে মুক্তবুদ্ধি দিয়ে প্রতিস্থাপন- বাউলের জীবনচেতনার মূল কথা। বাঙালির লোকধর্ম হিসেবে বাউলের মত ও সাধনার ধারা যথেষ্ট প্রাচীন হলেও গুরুবাদী সংগীতাশ্রয়ী এই মরমি সম্প্রদায়ের রচিত আদি গানের সন্ধান পাওয়া যায় না। যদিও মরমি সাধনা ও সংগীতের অনুরাগী ক্ষিতিমোহন সেন কিছু প্রাচীন বাউলগান সংগ্রহ করে প্রকাশ করেন, রবীন্দ্রনাথের কল্যাণে তা বেশ প্রচারও পায়। লালন সাঁই বাউলসাধনার সিদ্ধপুরুষ। তাঁর সাধনার ভেতর দিয়েই বাউলমতের সর্বোচ্চ বিকাশ। লালন তাঁর অতুলনীয় সংগীত-প্রতিভা ও তত্ত্বজ্ঞানের সমন্বয়ে বাউলগানের একটি স্বতন্ত্র ‘ঘরানা’ নির্মাণ 
করেছিলেন। তাঁর গানে বাউলের তত্ত্ব ও সাধনার গভীর পরিচয় প্রতিফলিত। লালনের গানে দেহবিচার, মিথুনাত্মক যোগসাধনা, গুরুবাদ, মানুষতত্ত্ব- বাউলসাধনার এইসব বিষয় সংগতভাবেই বারবার ঘুরেফিরে এসেছে। বাউলের সাধনার মূল অবলম্বন মানবদেহ ও মানবগুরুর নির্দেশনা। দেহজরিপ ও গুরুবন্দনার অনুষঙ্গে এসেছে সৃষ্টিতত্ত্ব, সাধনতত্ত্ব, মানুষতত্ত্ব, খোদাতত্ত্ব, নবিতত্ত্ব, কৃষ্ণতত্ত্ব বা গৌরতত্ত্ব। দেহকে কেন্দ্র করেই বাউলের সাধনা। ‘ভা--ব্রহ্মা-’-তত্ত্বের নিরিখে এই দেহেই ‘পরম পুরুষে’র বাস। তাই দেহবিচারের মাধ্যমে আত্মস্বরূপ নির্ণয় করতে পারলেই সেই পরম প্রত্যাশিত ‘মনের মানুষে’র সন্ধান মেলে। বাউলসাধনার সঙ্গে ‘মিথুনাত্মক যোগসাধনা’র রয়েছে গভীর সম্পর্ক। ‘চারিচন্দ্র’-ভেদ কিংবা ‘মীন’-
ধরা- এই রূপকের ভেতর দিয়ে সাধনার এই বিষয়টি বাউলগানে এসেছে। যৌন-সম্ভোগ নয়, যৌন-সংযম ও কাম-নিয়ন্ত্রণই বাউলের মোক্ষের সঠিক পথ। গুরু বা মুরশিদের মাহাত্ম্য-কথা এই ধর্মসাধনার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। গুরুর হাত ধরেই জ্ঞানরিক্ত শিষ্যের নতুন মরমি-জ্ঞানের প্রত্যাশায় সাধন-ভজনের জগতে প্রবেশ। বাউলসাধনায় গুরুই সার্বভৌম শক্তি। গুরুর মূল্য-মর্যাদা ও প্রয়োজন-গুরুত্বের কথা তাই লালনের গানে বারবার এসেছে। বাউল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মরীতি ও শাস্ত্রকথাকে মান্য বা অনুমোদন করে না। তাই সে বেদ ও ব্রাহ্মণ্যআচারের ঘোর বিপক্ষে। বাউলসাধনার মর্ম জুড়ে আছে মানুষতত্ত্বের ভূমিকা। ‘আরশিনগরের পড়শি’ যিনি, তিনিই লালনের ‘মনের মানুষ’, তিনিই ‘অচিন মানুষ’, ‘অলখ সাঁই’, ‘সাঁই নিরঞ্জন’।
এই ‘মানুষে’র অন্বেষণেই বাউলের সাধনার দিন বয়ে যায়। ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’ আর ‘মানুষতত্ত্ব ভজনের সার-এই জ্ঞানকে অন্তরে ধারণ করেই লালন বলেন : মানুষতত্ত্ব যার সত্য হয় মনে  সে কি অন্য তত্ত্ব মানে ॥ বাউলগান বাংলার একটি প্রধান লৌকিক ধর্ম-সম্প্রদায়ের সাধনসংগীত। তাদের রহস্যময় অধ্যাত্ম-সাধনার গূঢ়-গুহ্য পদ্ধতি কেবল দীক্ষিতজনের কাছে প্রচারের জন্যেই এই গানের জন্ম। শিল্প-সৃষ্টির সচেতন প্রয়াস এখানে অনুপস্থিত। লালনও তাই বিশুদ্ধ শিল্প-প্রেরণায় তাঁর গান রচনা করেন নি, বিশেষ উদ্দেশ্যসংলগ্ন হয়েই তাঁর এই গানের জন্ম। তবে প্রায় ক্ষেত্রেই উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনকে অতিক্রম করে লালনের গান অনায়াসে শিল্পের সাজানো বাগানে প্রবেশ করেছে স্বমহিমায়। লালনের গান তাই একাধারে সাধনসংগীত, দর্শনকথা ও শিল্পশোভিত কাব্যবাণী। দীর্ঘজীবী লালন প্রায় পৌনে এক শতাব্দী ধরে গান রচনা করেছেন।
 
তাঁর গানের সঠিক সংখ্যা জানা যায় না। তবে এ-যাবত সংগৃহীত তাঁর প্রামাণ্য গানের সংখ্যা কোনোমতেই সাতশো ছাড়িয়ে যাবে না। কিছু গান হয়তো লিপিবদ্ধ হয়নি, কিছু বা হারিয়েও গেছে লালন ছিলেন নিরক্ষর, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের কোনো সুযোগই তাঁর হয় নি। কিন্তু তাঁর সংগীতে বাণীর সৌকর্য, সুরের বিস্তার, ভাবের গভীরতা আর শিল্পের নৈপুণ্য লক্ষ করে তাঁকে নিরক্ষর সাধক বলে মানতে দ্বিধা থেকে যায়। আসলে লালন ছিলেন স্বশিক্ষিত। তাঁর গান লৌকিক ভক্তম-লির গণ্ডি পেরিয়ে শিক্ষিত সুধীজনকেও গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। তাই তাঁর গানের যোগ্য কদরদানি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
উত্তরকালে লালনের গান দেশের ভূগোল ছাড়িয়ে বিদেশেও স্থান করে নিয়েছে। এই গান উচ্চাঙ্গের শিল্প-নিদর্শন এবং তা তর্কাতীতরূপে কাব্যগীতিতে উত্তীর্ণ। লোকপ্রিয় লালনের গান আজ তাই সংগীত-সাহিত্যের মর্যাদা পেয়েছে। লালনের কবিত্ব-শক্তির পরিচয় তাঁর অনেক গানেই পাওয়া যায়। বহুল উচ্চারিত তত্ত্বকথা ও সীমাবদ্ধ বিষয়ের অনুবর্তন সত্ত্বেও লালন তাঁর সংগীতে সেই গতানুগতিক ধারাকে অতিক্রম করে নতুন ভাব-ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করেছেন।
 
তত্ত্বকথার দুরূহ ও ক্লান্তিকর বদ্ধ আবহে এনেছেন শিল্প-সৌন্দর্যের সুবাতাস। তাই বাংলার মরমি কবিদের মধ্যেই যে কেবল তিনি শ্রেষ্ঠ তাই নয়, বাংলার সংগীতসাহিত্যের ইতিহাসেও তিনি এক কালোত্তীর্ণ স্মরণীয় শিল্পি-ব্যক্তিত্ব। মূলত লালনের গানের অসামান্য শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য, উচ্চাঙ্গের দর্শন ও প্রবল মানবিকতাবোধের জন্যে এদেশে রবীন্দ্রনাথ থেকে অন্নদাশঙ্কর রায় এবং বিদেশে চার্লস ক্যাপওয়েল থেকে ক্যারল সলোমন- এঁরা লালনের গানের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। 
বাউলগান লৌকিক সমাজের মরমি অধ্যাত্মসাধনার অবলম্বন হলেও লালনের হাতে তা অধিকতর সামাজিক তাৎপর্য ও মানবিক বিশ্বাসে সমৃদ্ধ হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। লালনের গানে ধর্ম-সমন্বয়, সম্প্রদায়সম্প্রীতি, মানব-মহিমাবোধ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, আচারসর্বস্ব ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধতা, বর্ণশোষণজাতিভেদ ও ছুঁতমার্গের প্রতি ঘৃণা, সামাজিক অবিচার ও অসাম্যের অবসান-কামনা- এইসব বিষয় স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত। লালনের গান মানব-বন্দনা ও মানব-মহিমারও গান। 
 
 
 

নিউজজি/এসএফ

 

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন