রবিবার, ২ এপ্রিল ২০২৩, ১৮ চৈত্র ১৪২৯ , ১১ রমজান ১৪৪৪

সাহিত্য
  >
প্রবন্ধ

কবি হাসান মাহমুদ–এক ব্যতিক্রমী কবির নাম

অমিত গোস্বামী জুলাই ২০, ২০১৭, ১৪:২৭:৪২

21K
  • ছবি- মাসুক হেলাল

১৯ জুলাই  সবে পঞ্চাশ পেরোলেন কবি হাসান মাহমুদ। এই শুভক্ষণে তার প্রতি আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য।

‘স্থবিরতার মধ্যেই এই রূপান্তর এনে দিলে, হে কাকপাখি

কাজলের রং থেকে সামান্য দূরে আমার চোখের যেই সামাজিক রেখা 

তারই পাশে দূর আর দূরান্বয়ের বেখাপ্পা আহ্লাদ- কীযে মাখামাখি! 

তাই, পুলক বিলালে খুব বসন্ত হাওয়ায়- 

অথচ এখন বৈশাখী তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড জানালা-দুয়ার...

সমস্ত চরাচরে বিলাপের করুণ গুঞ্জন। ও কাজল সুন্দর!

রূপান্তরের নামে এ কোন অভিধা তুমি লিখে দিলে চিঠির ভাষায়?

মরু ঝড়ে ধ্বস্ত যে জীবন তাকে আজ গোলাপের গন্ধ দিয়ে 

সাজাও নাগর। হায় উপহাস! দেখ, উপাচারে ভরে উঠছে গৃহ

বিবমিষাকালে কত কী জানবে এই সাধের জনম...’

সালটা বোধহয় ২০১৪। কবিতাটা পড়ে চমকে গিয়েছিলাম। কে লেখে এমন কবিতা? হাসান মাহমুদ। প্রোফাইল ছবি দেখে চিনলাম। আরে, এ তো। তারা মিউজিকে মাঝে মাঝেই গান গায়। বন্ধু অনিন্দিতা কাজীকে ফোন করলাম। এই তোমাদের চ্যানেলে যে হাসান মাহমুদ গান গায় সে কি কবিতাও লেখে? 

হ্যাঁ, অমিত’দা, কবিতাটা বেশ ভালো লেখে, লক্ষ্য কর। 

সেই চিনলাম হাসান মাহমুদকে। বন্ধুত্বের অনুরোধ পাঠালাম। সে গ্রহণ করল দ্রুত। বাংলাদেশে তখন আমার কবিতা বেশ প্রকাশ হচ্ছে। একদিন হাসান লিখল– অমিত’দা, তুমি গীতিকবিতা লেখো তোমার কবিতা থেকে গান মন্দ হবে না। বাংলাদেশের অবস্কিওর ব্যান্ডের সায়িদ হাসান টিপু তখন আমার পিছনে লেগে আছে- গান লেখো বলে। আমি গানের গ জানি না। কী করে লিখব? কিন্তু হাসান মাহমুদের ম্যাসেজটা আমায় বেশ উদ্বুদ্ধ করল। হাসান কলকাতায় এলো। দেখা হলো আমার সাথে। আমি ওর কবিতায় তখন বেশ মজে আছি। 

একটা কবিতা–

চুল

মেঘের অদূরে আছে নদী- তার বিস্তীর্ণ দুকূল

জুড়ে আছড়ে পড়ছে ঢেউ... বিভ্রান্ত সন্ধ্যায় আশ্চর্য চুল! 

না কি খোঁপা? মহিমার মতো ফুটে আছে- মুগ্ধ-শান্ত- নামহীন তারা

চারপাশে এত জল- তবু, বুকজুড়ে মরু সাহারা- 

সব জেনে প্রিয়তমা- মানবীও হাসে; রোদের মতই দোলাচল 

নিকষ আঁধারেও সে তুমুল জোছনা; ঘন-কালো কেশের মতই উজ্জ্বল

চারদিকে বিভ্রান্তির মেঘ- টর্নেডোর খেলা

মমতারা রুষ্ট এখন- জলপানে দিশেহারা, ঊর্মির মেলা

মেঘের ওপাশেই নদী; তেতুলিয়া, মেঘনা আরো- আরো নদী

খোপার মহিমা নিয়ে তুমি থাক- আমি চলি, জীবন অবধি।

তার কবিতার সবচেয়ে স্বাভাবিক অবলম্বন হলো সময়। তার কবিতা পড়তে পড়তে আমাদের চারপাশের সব প্রকাশ্য টানাপড়েন আমরা ছুঁয়ে ফেলতে পারি। যা-কিছু আমাদের জীবনকে বাইরের দিকে যুক্ত করছে, সমবেত মহাপৃথিবীর অংশ হয়ে উঠছে আমাদের বেঁচে-থাকা যে-সমারোহময় মুহূর্তে, সেইসব মুহূর্তের সব উত্তেজনা হাসান মাহমুদ কবিতায় ধরে রাখতে পারেন। তার কবিতা আলাদা এক মননভঙ্গির গভীরতা নিয়ে কথা বলে। এমনকি যখন কৌতুক বা ব্যঙ্গের ধরন রাখেন তিনি কবিতায়, তখনও ভাষা তার স্বাভাবিক মন্দ্রতা হারায় না। লক্ষ্যণীয় কবিতাটিতে তার অস্বস্তি রূপ নিয়েছে সব্যঙ্গ অথচ নিঃশব্দ প্রত্যাখ্যানের। সময় তার সব রহস্য আর সম্ভাবনা নিয়ে নানা গমকে তার কবিতায় উঠে আসতে চাইছে। এই গমকটা খুব বড়ো ব্যাপার। কে কীভাবে কথা বলবেন কবিতায়, তার মাত্রা বা বহরের ওপর নির্ভর করে তার কবিতা কাকে, কতটা, কতদিন ছুঁতে পারবে। 

হাসান মাহমুদ কি নিছক একজন কবি? নাকি কেবল একজন সাহিত্যসেবক? বৈদগ্ধ আর সমাজচেতনার অপূর্ব সমন্বয় তার দার্শনিক ভূগোলের দুনিয়াকে প্রলম্বিত করেছে। দর্শনের দিগন্তকে প্রসারিত করতে গিয়ে তিনি কিন্তু একটিবারের জন্যও বাস্তবের মাটি ছেড়ে হাওয়ায় ভেসে অজানার সওয়ারি হননি। বাস্তববোধের এই পরাকাষ্ঠাই তাই তার চেতনলোককে কানায় কানায় পূর্ণতা দিয়েছে।

বৈদগ্ধতার এই কানায় কানায় ভরা পূর্ণকুম্ভ কি জীবনবিমুখ এক শুষ্ক পণ্ডিত?

এর পরে পড়লাম তার আরেকটি কবিতা। উত্তর পেয়ে গেলাম।

নিবিড় যাপন

সহজকে খুঁজে পেতে কত পথ দিয়েছি উড়াল...

মুগ্ধতা মুছে ফেলে বনে বনে কাটালাম কত দীর্ঘ রাত

পাখিদের খুনসুটি ভুলে গিয়ে ঝরাপাতা তুলে এনে

শুনেছি বিবর্ণ রীতি- চোখ বরাবর নিঃসঙ্গ বৃক্ষ এক

আরও পিছে অর্ধমৃত ডাল...

পাখিদের এত হাহাকার! সবুজের শোকার্ত আদল!

শুনে, দেখে পুনরায় বিভ্রান্ত হই

কোনদিকে যাব, কোন অক্ষে নিবিড় যাপন।

এক অনিকেত বিষণ্নতায় কবির এই রচনা আমাদের পৌঁছে দেয় তার মননলোকের গভীর থেকে গভীরতম স্পন্দনে। যেখানে অনুভূত হয় সহজ পথের খোঁজে তার দীর্ঘশ্বাস। বাঙ্ময়তার উদ্দামতায় মূক হয়ে যান কবি। বাঙালির স্পর্ধিত ইমেজকে আকাশের উচ্চতায় তিনি পৌঁছে দিয়েছেন। কিছুটা বা নীরবে, নিভৃতে একমনে নিজের একতারায় একটি তান বাজাতে পছন্দ করেন। বন্ধুদের নিয়ে তরজায় মাতার সময়েও তিনি মৃদু হাসি আর মৃদু কণ্ঠের শঙ্খধ্বনি ছড়িয়ে দেন।

হাসান মাহমুদের কোন কবিতা নিয়ে কথা বলব ?

কমল

তোমাকে শনাক্ত করি কথামুগ্ধ সান্ধ্য অভিমানে

তোমাকে বিবিক্ত করি—সম্পর্কের শাখা নিরূপণে

তোমাকে নেপথ্য ভাবি অগ্রসর পাঠকের মন

তোমাকে প্রচ্ছদ মানি, গ্রন্থমেলা—কাব্য আয়োজন

তোমাকে সঙ্গীত মানি উদারতা—উপমার বাণ

তোমাকে আশ্রয় জানি, মুঠোফোন—হৃদয় অভিধান

তোমাকে বিকল্প করে ঘরে ও আসরে—খুঁজি পত্র-ধ্যান

তোমাকে শরণ মেনে কাছে টানি—মুক-অনাথের জ্ঞান

তোমাকে বিধেয় করি—প্রকল্প আর গল্পের পথ

তোমাকে শনাক্ত করি—মায়াপুর, দূর—আগুন-দ্বৈরথ 

তোমাকে আড়াল ভাবি সঞ্চারীর ক্ষীণ অভিমানে

তোমাকে নিয়েই যাব অন্তরাদের বাড়ি—অভিযানে

তোমাকে নির্ণয় শেষে খুঁজে নেব—একা পয়ার-ভূগোল

তোমার পুকুরে দেখ—ফুটে আছে হায়! অভিমানী রক্তকমল।

ইতিহাস নির্মাণের কাঠকুঠরো হয়ে ওঠা এই কবিতাটির গঠনরীতির মৌলিকত্ব নিয়ে সাহিত্যের ছাত্ররা বিচার-বিশ্লেষণে আনন্দ পাবেন। টমাস হুডকে কেন কবি তার এই কালজয়ী সৃষ্টির শীর্ষমুখে রাখলেন, তা নিয়েও বন্ধুরা তরজাতে মাততেই পারেন। কবিতার সুষমা বজায় রেখে এখানে সমাজমনস্কতার যে জলছবি হাসান মাহমুদ এঁকেছেন, সেটাই জীবনশিল্পীর জীবনের যাপনচিত্র। গভীর মানবপ্রেম, তীব্র সমাজবোধ অথচ উপস্থাপনায় এতটুকু প্রপাগান্ডিজ ফর্ম নেই। রবীন্দ্র-উত্তর কাব্যচর্চায় তিরিশের কবিদের পরে এই কাজটি বাংলা কবিতায় একমাত্র পেরেছেন শঙ্খ ঘোষ আর শামসুর রাহমান। তীব্র সমাজবীক্ষণ না থাকলে এমনটা সম্ভব হয় না। 

এবার দেখা যাক হাসান মাহমুদের সাম্প্রতিক একটি কবিতা।

অবদমন

অবদমনের মতো এই মগ্নতা। সুশীল প্রাণীর মতো ধূতি ও পাঞ্জাবী। 

এইখানে রাখা আছে বিশ্বসংবাদ- সাথে কিছু জাগতিক দাবী

লেলিনের বাঁকা ক্যাপ, ক্যাস্ত্রোর মুখভরা দাড়ি

সংশয় সব খায়--! পুতিন যেমন খায় ওবামার আড়ি

কাছের বাড়ির দিদি, মমতা ব্যানার্জি নাম, সংক্ষেপে প্রিয় প্রিয় কত কথা কন

আমার তো কেউ নাই, স্বদেশ-বিদেশ মিলে বন্ধুসকল- আদতেই অবদমন!

সখা হে, নরেন্দ্র বাবু, অবিরাম পথে পথে ঘুড়ি

প্রজ্ঞার অন্দরে সহস্র মন, সলাজ ঠাট্টা করে হিরে আর নুড়ি...

বিনয়-বিষাদ থেকে ছুটি নেই। সন্তানের কাছে রাখি কলাকৌশল

আমার নয়ন কূলে- তুমিই ভরসা- আর কালের বিপরীতে ক্রিয়া পদ- সম্বল!

অপর পাড়ার দিকে এই চোখ। কুহক বান্ধব, শিশিরের কান্নাতোয়া প্রাণ

প্রদেশ-প্রণয় খেলা-! ভুলে গেছি জন্মভূমি! আমার কণ্ঠে আছে জীবনের গান!

আধুনিক বাংলা কবিতা গভীরতর অর্থে ঐতিহ্যের পরম্পরা এবং সংস্কৃতির রূপায়ণের ফল। বাংলা কবিতার আধুনিকতা কোনোভাবেই উল্লম্ফনের বিপরীতে ঐতিহ্যিক পরম্পরাকে মান্য করে। স্বপ্নচারিতার সীমা অনির্দিষ্ট হলেও স্বপ্নের গন্তব্য সীমিত। মানুষ স্বপ্নের জগতেও মূলত তার পরিচিত পরিমণ্ডলে বিচরণ করে।

অভিজ্ঞতার বাইরে মানুষ খুব বেশি সফল হতে পারে না, পারে জোরালো কোনো স্বপ্ন দেখতেও। মৌলিক শিল্পী বুদ্ধি নয় আবেগে সমর্পিত। চিন্তা ও কর্মের প্রতিমুহূর্তে আপন কর্মের পক্ষে পটভূমি ও ব্যাখ্যা রচনা করা তার স্বতঃসিদ্ধ অভিপ্রায় ও অভ্যাস। তারুণ্যের স্বভাব—যে বিষয়ে ব্যক্তি বিশেষের বিশেষ আসক্তি, ওই বিষয়শ্লিষ্ট চিন্তায় আচ্ছন্ন থাকা। এমনকি ওই বিষয়ে চিন্তার পৌনঃপুনিক প্রকাশেও সে অকুণ্ঠ। ফলে দেখা যায়, চিত্রশিল্পী কেবল ছবি আঁকার মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেন না, সঙ্গীতশিল্পী কেবল সঙ্গীত পরিবেশন করেই তৃপ্ত থাকেন না, চিত্রশিল্পী নিজের কর্মের ভাষ্য লিখতে এবং সঙ্গীতশিল্পী নিজেও গান রচনা ও সুরারোপে মনোনিবেশ করেন। কবিও তার চিন্তারও অধিকাংশ অঞ্চল কবিতাত্মক। তাই রাজনীতি এখানে এসেছে কবিতার আঙ্গিকে। 

শব্দের যুক্তিগ্রাহ্য ও নান্দনিক চিত্ররূপ আঁকতে গিয়ে হাসান মাহমুদ প্রায়ই মানবধর্মকে আশ্রয় করেছেন। এই প্রবণতা তাকে বিশিষ্ট এবং বিশ্লিষ্ট করেছে তার পূর্ববর্তী এবং সমসাময়িক অন্য কবিদের কাব্যভাষা থেকে। তার কবিতায় কেবল গ্রাম নয়, নগরও সমান গুরুত্বে অঙ্গীভূত। এ ক্ষেত্রে নাগরিক জীবনের গ্লানি এবং শেকড়ের প্রতি আকর্ষণ নিয়ে পঞ্চাশ পার করছেন কবি হাসান মাহমুদ। তার শতায়ূ কামনা করি।

নিউজজি/এসএফ

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন