শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ , ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

সাহিত্য
  >
প্রবন্ধ

কবি ও কবিতা

সাঈদ সাহেদুল ইসলাম জুন ৭, ২০১৭, ১৬:১৩:৪২

9K
  • কবি ও কবিতা

দেকার্তের বুদ্ধিবাদে মানুষের থাকে innate quality যা মাতৃগর্ভে আসার সাথে সাথে অর্থাৎ জন্ম হওয়ার দশ মাস নয় দিন কয়েক ঘণ্টা পূর্বে একজন অর্জন করে। সেদিক থেকে পিতামাতার দোষ-গুণ, সংযম, অসংযম, ভালো-মন্দ, স্বভাববোধ- সার্বিকভাবে সবকিছু নিয়েই মানুষের জন্ম। চিকিৎসাবিজ্ঞানও তাই বলে। যেমন, পিতামাতার কোনো কোনো বালাই বংশ সূত্রে পরবর্তী বংশধরদের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। তার মানে এই নয় যে, অকবির পুত্র-কন্যা কবি হতে পারেন না, বা কবির পুত্র-কন্যা অবশ্যই কবি হবেন।
 
তাহলে কবি কে? তিনি কেন কবি? কোন কোন স্বভাব-গুণ তাকে কবি বলায়? পল এলুয়ার বলেন, কবিরা হচ্ছেন- “men among men.” অর্থাৎ মানুষের মধ্যে মানুষ, তবে আলাদা মানুষ। রোমান্টিক কবি William Wordsworth-এর মতে “Poet is a man spoken to men.” কবি একজন মানুষ, যিনি মানুষদের সাথে কথা বলেন। দু-বক্তার সারমর্মে বলা যায়, কবিমাত্রই মানুষ কিন্তু মানুষমাত্রই কবি নাও হতে পারেন। আর কবিত্বগুণের কারণেই আবেগ, অনুভূতি, অনুভব, উচ্ছ্বাস, স্মৃতিভাব, উন্মত্ততা, অভিজ্ঞতা, সুখ-দুঃখ, বিরহ-বিচ্ছেদ, চিন্তাচেতনা, ধারণা, রীতিনীতি, চিত্রকল্প, ছন্দ, শব্দ, রূপক, উপমা- ইত্যাদি উপলব্ধির প্রতি একজন কবি বেশি শ্রদ্ধাশীল। কবি তার নিজস্ব জগতে তাই প্রাণবন্ত ও বোধশক্তিসম্পন্ন। কবির রয়েছে মানবীয় স্বভাব এবং তিনি মমতাসম্পন্ন বটে। শুধু তাই নয় কবিমাত্রই মানবীয় স্বভাবে অধিক জ্ঞানসম্পন্ন। তাঁর রয়েছে ব্যাপক সংবেদনশীল আত্মা। তিনি গভীর আবেগ ও অনুভূতি সম্পর্কে সচেতন। জীবনের উচ্ছ্বাসে তিনি অন্যান্যদের চেয়ে বেশি উচ্ছ্বসিত হন। তাঁর তীক্ষ্ণ কল্পনাশক্তির কারণেই তিনি যেকোনো বিষয়কে এমনভাবে ভাবতে পারেন বা উপস্থাপন করতে পারেন যেন তা তাঁর সামনে ঘটে যাওয়া কোনো বাস্তব প্রতিমা। আর সে প্রতিমা নির্মাণে কবির দৈহিক চোখের প্রয়োজন নেই- একমাত্র তৃতীয় চোখই যথেষ্ট। স্বভাবতই, কবির তৃতীয় চোখ অপার সৌন্দর্যের মহিমায় উদ্ভাসিত। সত্য ও সৌন্দর্যের পূজারী তিনি।
 
শ্রীশচন্দ্র দাশের মতে “বাহিরের জগতের রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ-শব্দ বা আপন মনের ভাবনা-বেদনা কল্পনাকে যে লেখক অনুভূতি-স্নিগ্ধ ছন্দোবদ্ধ তনুশ্রী দান করিতে পারেন তাহাকেই আমরা কবি নামে বিশেষিত করি।” বঙ্কিমচন্দ্র বলেন “কবিরা জগতের শিক্ষাদাতা কিন্তু নীতি ব্যাখ্যার দ্বারা তাঁহারা শিক্ষা দেন না। তাঁহারা সৌন্দর্যের চরমোৎকর্ষ সৃজনের দ্বারা জগতের চিত্তশুদ্ধি বিধান করেন।” বঙ্কিমচন্দ্র আরো বলেন “কাব্য গড়ে, বিজ্ঞান ভাঙে ।” মানুষ প্রযুক্তির জন্ম দিতে পারে, সভ্যতা গড়ে তুলতে পারে কিন্তু কবিতা লিখতে পারে না। শুধু কবির মাধ্যমেই কবিতার জন্ম সম্ভব। সুতরাং মনুষ্য প্রযুক্তি কবিতার অভিভাবক নয়, কবিতার অভিভাবক শুধুই কবি। তবে প্রযুক্তিগত সত্য যখন কবিসত্তায় আসন লাভ করে তখন তা কাব্য হতে পারে। এজন্য William Wordsworth বলেন “Poetry is the impassioned expression which is in the countenance of all science.”
 
প্রশ্ন জাগে তাহলে কবিতা কী? বিভিন্ন লেখক বিভিন্নভাবে কবিতার সংজ্ঞা দিয়েছেন।
১.Samuel Tailor Coleridge বলেন- “Best words in the best order.”
২. Ezra Pound এবং Malarm-এর মতে “Poetry is written not with ideas but with words.”
৩. William Wordsworth বলেন- “Poetry is the spontaneous overflow of powerful feelings.”
4. Mathew Arnold-এর মতে “Poetry is at bottom a criticism of life under the conditions fixed for such a criticism by the laws of poetic truth and poetic beauty.”
5. Caudwell বলেন- “Poetry is the nascent self consciousness of man not as an individual but as a sharer with others of a whole world of common emotion.”
৬. মোহিতলাল মজুমদার কবিতার সংজ্ঞায় বলেন- “কাব্যলক্ষ্ণীর সঙ্গে আত্মার রতিসুখ-সম্ভোগকালে রস মূর্চ্ছিত মানবের দিব্যভাব বিধুর গদগদ ভাব।”
৭. শ্রীশচন্দ্র দাশের ‘সাহিত্য সন্দর্শন’-এ পাই “অপরিহার্য শব্দের অবশ্যম্ভাবী বাণী বিন্যাসকে কবিতা বলে।” আর সে অবশ্যম্ভাবী শব্দই তো ভাবকল্পনা ও অর্থব্যঞ্জনার বাহন।
৮. রবীন্দ্রনাথ বলেছেন “অন্তর হতে আহরি বচন/ আনন্দলোক করি বিরচণ/ গীত রসধারা করি সিঞ্জন/ সংসার ধূলিজালে।”
৯. ফিলিপাইনের জাতীয় কবি হোসে ভিলিয়া বলেন ‘কবিতা হবে ঘুণ্টির মতো ছিমছাম/ কবিতা হবে পাখির পালকের মতো বিমূর্ত গোপন/ কবিতা হবে নববধূর মতো বিনম্র লাজুক।’
১০. অগাস্টিন বলেন “কবিতার সংজ্ঞা যদি জিজ্ঞেস না করা হয়, আমি জানি। যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আমি জানি না।”
১১. হুমায়ুন আজাদ-এর মতে “যা পুরোপুরি বুঝে উঠব না, বুকে ওষ্ঠে হৃৎপিণ্ডে রক্তে মেধায় সম্পূর্ণ পাব না; যা আমি অনুপস্থিত হয়ে যাওয়ার পরও, রহস্য রয়ে যাবে রক্তের কাছে, তার নাম কবিতা।”
 
বিভিন্ন লেখক আলোচক যেভাবেই বলুন না কেন, আর যাই হোক- কবিতা স্বপ্নে অর্জিত কোনো সম্পদ নয়- কবিতা নিজেই স্বপ্ন ও সম্পদ। আর সে স্বপ্ন সম্পদকে কবিই উপভোগ করতে পারেন, সাধারণ মানুষ পারেন না। কবিতা তো আকাশ, বাতাস, ঝর্না, সাগর থেকে পাপ্ত কোনো অংশ নয়- কবিতা নিজেই এরূপ বৃহৎ সত্তা- যা কবির থাকে, সাধারণ মানুষের থাকে না। কবি একজন চিকিৎসক আর কবিতা চিকিৎসক কর্তৃক প্রদানকৃত ব্যবস্থাপত্র বা পথ্য। কবি একটি আসন বা শাসক, আর কবিতা শাসনব্যবস্থা যা কেবল কবি নামের শাসক কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। কবি একটি মূর্তি আর কবিতা সে মূর্তির ছায়া যাকে ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না- তবে কবি সে ছায়াতে দেহ দান করেন। কবির আত্মাই কবিতা আর কবিতার আত্মাই কবি। তাই বোধ করি, কবি যা লিখতে পারেন তাই কবিতা। কবিতার সে শব্দগুলো বোঝা যায় ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। কবিতা হচ্ছে কবির অন্তর্দ্বন্দ্বের ফসল কিংবা কবি যা দেখেন, লেখেন তার চেয়ে বেশি কিছুর নাম কবিতা।
 
কবির কবিতা লেখার ধরনটাও একটা বিস্ময়। জ্যামিতিক, গাণিতিক, প্রযুক্তিগত, কোনো কৌশলের মাধ্যমেই কবিতা লেখা যায় না। আর সূত্রহীন এ বিস্ময় থেকে কবি জন্ম দেন কবিতার। মানুষ তো নয়ই বরং কবি নিজেও জানেন না কীভাবে কবিতা লিখতে হয়। তাই এটা সবার কাছে রহস্যাবৃত। প্রাণী কত কিছুর স্বাদই না গ্রহণ করে- ব্যাখ্যা করতে পারে না। সকল প্রাণীর কথা বাদ দিয়ে সহজভাবে মানুষকে উদাহরণ হিসেবে নেয়া যেতে পারে। মানুষ মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করে বটে কিন্তু সে স্বাদের ব্যাখ্যা অসম্ভব। কবির ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। কবি কবিতা লেখন- ব্যাখ্যা দিতে তিনি অক্ষম।
 
কিছু মানুষ (স্বঘোষিত কবি) কখনো কোথাও চট করে গর্বের সাথে বলে ফেলেন- ‘এই মুহূর্তে আমি বেশ কটি কবিতা লিখে দিতে পারি।’ চট করে আপনিও একটু হেসে ফেলে বলুন তো তিনি যে, কত বড় মাপের একজন অকবি তার বিশ্লেষণ আর প্রয়োজন আছে কি? আর আধুনিক কবিতা তো আরো কঠিন ব্যাপার। প্রতিটি যুগ তার নিজস্ব সময়ে আধুনিক। আজ আমরাই তাকে বিভিন্ন নামে বা যুগে ভাগ করে ফেলেছি। তাই দুদিন পরেই তো আজকের আধুনিকতা পেরিয়ে অতি আধুনিক আসবে। আসবে তার পরবর্তী যুগ, পরবর্তী কাল- আরো কত কী! তবে আজকাল শুধু কাকের ঠ্যাঙের সাথে পোয়াতি কিছু শব্দ সেঁটে দিয়ে কোনো কোনো মানুষ কবিতা লিখছেন। ল্যাঙড়া শকুনের বুকে যৌবনা উড়োজাহাজ ঢুকিয়ে দিয়ে বিশ্ব ভ্রমণে ব্যস্ত রয়েছেন কেউ। তারপর কী হবে খুব জানতে ইচ্ছে করে...।
 
কবি শাসক হেতু মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতার হস্তক্ষেপ করে না সে। সে কারণে যে যার মতো করে কবিতা লেখেন, গ্রন্থের পর গ্রন্থ প্রকাশে সর্বদা আত্মনিয়োগ করে থাকেন। তার শব্দ বাক্যগুলো সত্যি যদি কবিতা হয়ে থাকে তবে কোনো না কোনো সময়ে সে কবিতা অবশ্যই তাকে কবি হিসেবে হেফাজত না করুক কিন্তু মর্যাদা দেবে।

 

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন