শনিবার, ৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ , ৫ জুমাদাউস সানি ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
প্রবন্ধ

ঐশ্বরিক অক্ষরে শহীদুল্লাহ ফরায়জী

সাইফুল ইসলাম অক্টোবর ১৬, ২০২১, ১৯:২৩:৪৭

6K
  • ঐশ্বরিক অক্ষরে শহীদুল্লাহ ফরায়জী

শহীদুল্লাহ ফরায়জী গানে, গীতিকবিতায় নিজস্ব ধারায় যখন প্রজন্মকে, বেঁচে থাকা মানুষদেরকে মোহাবিষ্ট করে রেখেছিলেন ঠিক তখনই  ‘ঐশ্বরিক অক্ষর’ গ্রন্থে তাঁর প্রকাশিত কবিতামালায় ভক্তকুল, বোদ্ধা মহলের হৃদয়ে তুমুল আলোড়নের সৃষ্টি হলো । তিনি তাঁর সৃষ্টিকর্ম ‘ঐশ্বরিক অক্ষর’ এ নিজের বৃহত্তর প্রতিভার সন্ধান দিলেন। সহজ কথায়, ভাববাদী সনাতন ধারা থেকে বেড়িয়ে দর্শনের সাগরসম জগতে  অবগাহন  করে তাঁর থেকে সঞ্চিত  মুক্তামালা উপহার দিয়ে নিজেকে নিজে অতিক্রম করে গেলেন।

‘ঐশ্বরিক অক্ষর’ কাব্যগ্রন্থে তিনি জয়গান গেয়েছেন মানবতার, আকাঙ্ক্ষা করেছেন মানুষের চিত্তের বিকাশ ও আত্মার জাগরণের।  দার্শনিক ভাবনায় কামনা করেছেন অসুন্দরের বিলয় ও সুন্দরের জাগরণ, মিথ্যার বিনাশ ও সত্যের উত্থান, হিংসার অবসান ও শান্তির বিজয়। অসংখ্য উত্তীর্ণ সৃষ্টির  বিপরীতে অবশেষে কবিতাকে বেছে  নিলেন  তাঁর কাঙ্ক্ষিত সমাজ বদলের হাতিয়ার হিসেবে।

বইটি বুঝতে হলে বইয়ের শেষাংশে সংযোজিত আত্মকথন অংশটিই যথেষ্ট। আত্মকথন পর্বে  তিনি কবিতা নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ও তাঁর  সৃজনকর্মের বৈশিষ্ট্যের মেলবন্ধন ঘটাতে গিয়ে বলেছেন, “আত্মশুদ্ধির সর্বোচ্চ  উচ্চতায় পৌঁছতে, স্রষ্টার সুগন্ধ নিতে, দেবদূতের সাক্ষাৎ পেতে এবং মহামানবদের  মনোযোগ আকর্ষণে বিস্ময়কর চেতনা অনুসন্ধান করার প্রয়োজনে কবিতা। কবিতায়  ‘সত্য’ ও ‘মহৎ’কে রূপায়িত করতে চেয়েছি।” আর কবির  এ ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে বইয়ের অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি কবিতায়। 

কাব্যগ্রন্হের শিরোনাম কবিতা  ‘ঐশ্বরিক চুক্তি’তে কবি  অলৌকিক প্রার্থনায় বলেছেন,

‘আমাকে শেখাও

বৈরী বাস্তবতার মোকাবেলা

শোক সংগীতের নীরবতা

আমাকে শোনাও

স্বর্গীয় সংগীতের সুরধারা…’

 

কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতায় বিধাতা থরে থরে কবির প্রার্থনা মঞ্জুর করেছেন।  কবি একের পর এক জীবনবোধ, মৃত্যুতাড়না, মানুষ- মানবিকতা, চিরকালীন আক্ষেপ- বিষাদের স্বরলিপি, সত্যের মহত্তম রূপ নিয়ে লিখেছেন। কোনো কোনো কবিতা তুলে ধরেছেন শোষিতের ইশতেহার। 

তাঁর ‘ইশতেহার’ কবিতায় তিনি উপস্হাপন করেছেন এক জগত জয়ী নির্দেশনা,

‘নরখাদক বানানোর

কারখানা নিয়ে

কোনো রাষ্ট্র  আর হবে না

দুঃশাসন মনুষ্যত্বের অসম্মান নিয়ে

ভবিষ্যতে আর কোনো রাষ্ট্র হবে না

এ নির্দেশ উত্থাপন করছি।’

দুইশ সত্তর পৃষ্ঠার বইয়ে সর্বাধিক ব্যবহৃত শব্দটি হচ্ছে ‘আত্মা’। কবি তাঁর জীবনচর্চায়, যাপিত সময়ে যেমন আত্মার শুদ্ধতার চর্চা করেন, ঠিক কবিতায়ও  কামনা করছেন আত্মার অসীম বৈভবের। তিনি বলেছেন,

লাভ  কী তোমার ওহে প্রভু

অসীম অসীম প্রশংসায়

আমার আত্মা থাকে যদি

বিপুল শূন্যতায়?

গীতিকার শহীদুল্লাহ ফরায়জী যতটা বেদনা আশ্রয়ী কবিতায় ততটা নন। কবিতায় তিনি বেদনার সৌরভ মেখে আলোকিত হওয়ার প্রয়াসী। কবিতায় বেদনার সৌরভ মেখে নিজেকে ঐশ্বর্যবান করার দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা থেকে কবি লিখেছেন,

‘দুঃখ তুমি আমার

আশীর্বাদ হও

আকাশ ভেঙে

বৃষ্টির মতো

বিরতিহীন ঝরে পড়ো

আমার উপর

নরকের উৎসমূল খুলে

তরল আগুন ঝরুক আমার উপর

তুমি আমার আনন্দ হও।’

কাব্যগ্রন্থটিতে কবি কবিতার প্রচলিত কাঠামোকে ভেঙেছেন সাহসিকতার সাথে। প্রতিটি কবিতার শরীর একেক ধরনের- কোনোটি অণুকবিতা, কোনোটি দীর্ঘ প্রবহমান পঙক্তিমালা। তবে ভাবের গভীরতায় প্রতিটি কবিতাই নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর।

তিনি কবিতাকে অযথা দুর্বোধ্যতায় ভারাক্রান্ত করতে চাননি। অর্থহীনভাবে প্রকৃতি কিংবা নারীর আশ্রয়ী করে তাৎপর্যহীন করে তোলার প্রয়াসী হননি। কবিতাকে তিনি করেছেন সত্য-সুন্দরের প্রতীক। তিনি কবিতাকে বাণীরূপে অমর দর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার কবিতা সুন্দর, সত্য ও মহানুভবতাকে ধারণ করে হয়েছে অলৌকিকতার আধার। এ বিষয়ে কবির যে মত তা হলো- কবিতার ছন্দমিল, অন্ত্যমিল- এসবের প্রতি আমার তেমন কোনো আকর্ষণ নেই। কারণ কবিতা শুধু শব্দ বা ছন্দের কোষাগার নয়। কবিতা উচ্চতম নৈতিক সৌন্দর্যের ভাণ্ডার।  “উল্লিখিত  নৈতিক সৌন্দর্য  কবি তাঁর বিশ্বাসে,  মননে ধারণ করেন। এ জন্যই তিনি একাধিক কবিতায় আত্মার স্বরূপ উদ্ঘাটনে প্রয়াসী হয়েছেন, নিজেকে শোষিত মানুষের প্রতিনিধি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। আবার কখনো করেছেন সাধনে ব্যর্থ হওয়ার পরিতাপ প্রকাশ। তাঁর কবিতা ‘ঐশ্বর্যময় আত্মা’য়  আমরা তার বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাই,

‘আমার আত্মার গভীরে

সত্য জন্ম নেয়

আমি সেই সত্য উন্মোচন করি

কিছু দিতে পারিনি।’

তবে শ্রদ্ধাভাজন কবির কবিতাভাণ্ডারে ভালোবাসা কিংবা নারীর স্থান হয়নি এমনটা বলাও কঠিন। বোদলেয়ারের চেতনায় আমরা যেমন দেখতে পাই তারই অনুরণন দেখি কবির ‘অবিরাম খুনি’ কবিতাটিতে তার কাঙ্ক্ষিত নারীর জন্য নিজেকে খুনি সত্তা হিসেবে উপস্হাপন করেছেন। নারীর ভালোবাসা পেতে গিয়ে পৃথিবীর আর সকল সৌন্দর্য উপভোগে ব্যর্থ কবির আক্ষেপ,

‘অনুভুতিতে আমি দুর্ধর্ষ খুনি

জগৎজোড়া শ্রেষ্ঠতর খুনি আমি।

আকাশ খুন করি

নক্ষত্র খুন করি

সময় ও পারিপার্শ্বিকতা খুন করি

বিরতিহীন খুনি আমি তোমার জন্য।’

সবকিছু ছাপিয়ে যে বোধ কবি ধারণ করেন, যাপিত জীবনে চর্চা করেন তার উপস্হাপন আমরা দেখতে পাই কবির ‘মহৎ সুন্দর’ কবিতায়। কবি তাঁর চতুঃপার্শ্বের দুঃখ, তাপ, জীর্ণতা জয় করে লিখেছেন,

‘জীবন দুঃখে দুঃখে জর্জর

তবু বেঁচে থাকা কী ভয়ঙ্কর সুন্দর

জীবন ভেঙে চুরমার

তবু বেঁচে থাকা কী আশ্চর্য   সুন্দর!’

এ কবিতাটি পাঠে পাঠক হৃদয়ে জীবনের প্রতি  ভালোবাসার বোধ জন্মায় তার বিকল্প চোখে পরে না। প্রকৃতপ্রস্তাবে এ অতুলনীয়  গ্রন্থটির প্রতিটি পরতে পরতে যে অলৌকিক সৌন্দর্য  সুষমা, যে বাণী ছড়িয়ে আছে তার জুড়ি মেলা ভার।

ছোট্ট  পরিসরে এ মহামূল্য গ্রন্থটির সব কবিতার বর্ণনা উপস্থাপন করা অসম্ভব। আর এ প্রচেষ্টা  আমার জন্য ধৃষ্টতাও হবে হয়তো। যারা কবিতার পাঠক, ভক্ত তাঁদের জন্য একটা নতুন আস্বাদে আপ্লুত হওয়ার আহ্বান রেখে যেতে পারি।

 

সবশেষে পাঠকদের আশ্বাস দিতে পারি, একজন বহুমাত্রিক কবি এখানেই থেমে থাকার নন। বাংলা কবিতা তাঁর কাছে অনেক কিছু পাওয়ার বাকি আছে। কবির তৃষ্ণাও অনন্ত, অসীম। এতকিছুর পরও এক দুর্নিবার হাহাকার রেখে গেছেন, আমার যতটুকু আত্মোপলব্ধি,  নৈতিকতার যতটুকু তৃষ্ণা,  আত্মার শুদ্ধতায় পৌঁছানোর জন্য যতটুকু আকাঙ্ক্ষা এবং  আমার ভাবজগতের  যতটুকু তাণ্ডব তা ভাষার অক্ষমতায় প্রকাশ করতে পারিনি- মাত্র ভগ্নাংশ দিয়ে তা প্রকাশ করেছি। কবির এ দুর্নিবার  তৃষ্ণা যতটুকু কখনো মিটবে কিনা জানি না। কারণ তিনি যে পারলৌকিক ভাবজগতের বিস্তীর্ণ আকাশে ডানা মেলে দিয়েছেন তার সীমাপরিসীমা  ভাবনার অতীত।  তিনি যে মানস ধারণ করেন তার গণ্ডিও সুবিশাল আকাশের মতোই সীমাহীন। তারপরও বলি, কবির দহনের তৃষ্ণা যতটা দুর্নিবার তাকে পাঠ করার মানস আর দশটা মানুষের মতো আমারও নেই।

লেখক: কবি ও সম্পাদক

 

 

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন