সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ২৯ আশ্বিন ১৪৩১ , ১০ রবিউস সানি ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
প্রবন্ধ

রবিউল হুসাইন ছিলেন শিল্প-সাহিত্যের বহুমাত্রিক প্রতিভা

ফারুক হোসেন শিহাব নভেম্বর ২৬, ২০১৯, ১২:৪৫:১৭

3K
  • রবিউল হুসাইন ছিলেন শিল্প-সাহিত্যের বহুমাত্রিক প্রতিভা

একুশে পদকজয়ী কবি ও স্থপতি রবিউল হুসাইন। একাধারে তিনি স্থপতি, কবি, শিল্প-সমালোচক, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক ও সংস্কৃতিকর্মী। পেশা স্থাপত্যশিল্প হলেও সম্পৃক্ততা ছিল বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে। কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস মিলিয়ে দুই ডজনেরও বেশি বই রয়েছে তার। স্থপতি, কবি, শিল্প-সমালোচক, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক ও সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে তার সরব পথচলা ও সাফল্য ঈর্ষণীয়।  

আজ মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) মধ্যরাতে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দীর্ঘদিন ধরেই তার শরীরে রক্ত তৈরি হচ্ছিল না। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। দীর্ঘদিন ধরেই রবিউল হুসাইনের শরীরে রক্ত তৈরি হচ্ছিল না। এর কারণেই তিনি বিএসএমএমইউতে ভর্তি হয়েছিলেন। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। 

ঝিনাইদহের শৈলকূপার সন্তান রবিউল হুসাইনের জন্ম ১৯৪৩ সালে। কুষ্টিয়ায় মেট্রিক আর ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে তিনি ভর্তি হন ইস্ট পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং টেকনোলজির (বর্তমান বুয়েট) আর্কিটেকচার ফ্যাকাল্টিতে। সেই সঙ্গে তার লেখালেখিও চলে। স্থপতি হওয়ার পাশাপাশি ষাটের দশক থেকেই তিনি লেখালেখির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন৷ 

বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা ছাড়াও ষাটের দশকের পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রবণ ছোট কাগজে লেখালেখি করতেন৷ কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস ও শিশুতোষ গোটা পঁচিশেক বইয়ের লেখক তিনি। একটা সময় হয়ে ওঠেন দেশের শিল্প-সাহিত্যের একজন বহুমাত্রিক শিল্পী। শিল্প-সাধনার জায়গায় তার অবস্থান ছিল দৃঢ়তর।

তার মতে, ‘কবিতা- মানুষের প্রতিধ্বনি, মানুষ ও কবিতার প্রতিভূ। কবিতা স্বপ্ন, সংগ্রাম, ভালোবাসা, জীবন ও বাস্তবতার ভাষ্যরূপ দেয়। বিভিন্নভাবে মানুষ ও দেশকে বিভক্ত করা হয়, তার বিপরীতে কবিতা সবাইকে শান্তি ও কল্যাণে এবং শ্রেয়বোধে উজ্জীবিত করে। রোহিঙ্গাসহ বিশ্বের বাস্তুহারা ও দেশহারা মানুষের পক্ষে একাত্ম হয়ে গেল বছর জাতীয় কবিতা উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কবি রবিউল হুসাইন বলেছিলেন, ‘দেশহারা মানুষের সংগ্রামে কবিতাই পারে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তি ও স্বাধীনতা তোরণ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গেইট, ভাসানি হল, বঙ্গবন্ধু হল, শেখ হাসিনা হল, খালেদা জিয়া হল, ওয়াজেদ মিয়া সায়েন্স কমপ্লেক্স, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটরিয়াম ও একাডেমিক ভবন কমপ্লেক্স নির্মিত হয়েছে রবিউল হুসাইনের নকশায়।

জীবদ্দশায় ভবন নির্মাণে স্থাপত্যবিদের পরামর্শ নেওয়া সত্ত্বেও অপরিকল্পিত নগরায়ণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘Floor Area Ratio (FAR) তত্ত্ব মোতাবেক মোট যতখানি জায়গার ওপর ভবন নির্মাণ হবে, তার অন্তত অর্ধেক জায়গা ফাঁকা রাখার নিয়ম। যেন পর্যাপ্ত আলো-বাতাস চলাচল বা বিশেষ জরুরি প্রয়োজনে যাতায়াত করা যায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আমরা পেশাদার স্থাপত্যবিদেরা রাজউকের এই নিয়ম মেনে নকশা করলেও ভবন নির্মাণের সময় মালিকেরা এই নিয়ম পুরোপুরি মেনে চলেন না। এ জন্যই ঘিঞ্জি আর অপরিকল্পিত নগর গড়ে উঠেছে এবং ঢাকা শহর দিনে দিনে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে।’

তার মতে, ‘দিনে দিনে আবাসনের চাহিদা বদলেছে এবং লোকে নতুন জীবনধারার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। একটা সময় ছিল, একটা প্লটে একটা বাড়ি ছিল। সেখানে যথেষ্ট ফাঁকা জায়গা রাখা সম্ভব হতো। কিন্তু এখন একটা প্লটে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে এবং একই পরিমাণ জায়গায় থাকছেন অনেক বেশি মানুষ। এই চাহিদা মেটাতে গিয়ে স্থাপত্যেও পরিবর্তন আসছে। এভাবে স্থাপত্য পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনযাপন এবং আচরণেও পরিবর্তন আসছে। বড় বড় পরিবার ভেঙে ছোট ছোট পরিবার হচ্ছে। মানুষে মানুষে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। সব কিছুই জীবনের অংশ। নবীন-প্রবীণ স্থাপত্যবিদদের হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের স্থাপত্যশিল্প। এভাবেই একদিন বদলে যাবে ধূলি-মলিন দেশের চেহারা। আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের মিশেলে তৈরি হবে নতুন আবাস।’

স্বনামধন্য স্থপতি হয়েও তিনি কবি হিসেবে অনেক পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তার দায়বদ্ধতা এবং কর্ম প্রশ্নাতীত। গুণী এই কবি কাজ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণের জন্যও। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ কেন্দ্রের ট্রাস্টি, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী পরিষদ সদস্য এবং শিশু কিশোর সংগঠন কেন্দ্রীয় কচি কাচার মেলার যুগ্ম পরিচালক।

একইভাবে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ট্রাস্টের নির্বাহী সদস্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরের পরিচালনা বোর্ডের সদস্য, বাংলা একাডেমির জীবন সদস্য, সহযোগী সদস্য কলকাতা আন্তর্জাতিক শিল্প- সাহিত্য ও সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন, সভাপতি ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ক্রিটিক অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, সাহিত্য পত্রিকার উপদেষ্টা, সদস্য আই এ বি, সদস্য রাজউক, সাবেক সভাপতি স্থপতি অ্যালামনাই পরিষদ, সাবেক সভাপতি (দু'বার) জাতীয় কবিতা পরিষদ, সাবেক সভাপতি (চারবার) বাংলাদেশ স্থপতি ইন্সটিটিউট (আইএবি) সহ বহু প্রতিষ্ঠানে নানা সময়ে দায়িত্ব পালন করেছেন।

রবিউল হুসাইনের লেখা উল্লেখযোগ্য বই হলো- ‘কী আছে এই অন্ধকারের গভীরে’, ‘আরও ঊনত্রিশটি চাঁদ’, ‘স্থিরবিন্দুর মোহন সংকট’, ‘কর্পূরের ডানাঅলা পাখি’, ‘আমগ্ন কাটাকুটি খেলা’, ‘বিষুবরেখা’, ‘দুর্দান্ত’, ‘অমনিবাস’, ‘কবিতাপুঞ্জ’, ‘স্বপ্নের সাহসী মানুষেরা’, ‘যে নদী রাত্রির’, ‘এইসব নীল অপমান’, ‘অপ্রয়োজনীয় প্রবন্ধ’, ‘দুরন্ত কিশোর’, ‘বাংলাদেশের স্থাপত্য সংস্কৃতি’, ‘নির্বাচিত কবিতা’, ‘গল্পগাথা’, ‘ছড়িয়ে দিলাম ছড়াগুলি’ ইত্যাদি।

ভাষা ও সাহিত্যে অবদান রাখায় ২০১৮ সালে একুশে পদক পান। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষকও ছিলেন তিনি। রাষ্ট্রীয় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্বীকৃতি একুশে পদক ছাড়াও তিনি পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার, কবিতালাপ সাহিত্য পুরস্কার, আইএবি পুরস্কারসহ বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিপত্নীক ছিলেন। তার একমাত্র সন্তান রবিন হুসাইন। 

নিউজজি/এসএফ

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন