সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ২৯ আশ্বিন ১৪৩১ , ১০ রবিউস সানি ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
প্রবন্ধ

প্রবল মানবিক অনুভূতির বিরল এক কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক

ফারুক হোসেন শিহাব নভেম্বর ৫, ২০১৯, ১৯:০৫:৪০

3K
  • প্রবল মানবিক অনুভূতির বিরল এক কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক

নন্দিত কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক পেশাগতভাবে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও শিশুসাহিত্য তার সাহিত্য সৃজনের প্রধান ক্ষেত্র। তিনি তার রচনায় মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলো তুলে ধরেন স্বাতন্ত্রিক সাহিত্যালোয়ে। পারিবারিক জীবনে তিনি প্রয়াত সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক-এর সহধর্মিণী।

আজ ৫ নভেম্বর কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হকের ৭৯তম জন্মদিন। ১৯৪০ সালের তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের (বর্তমান বাংলাদেশ) যশোর জেলার চুড়িপট্টি গ্রামের এক মুসলমান পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা গোলাম রফিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন একজন ব্যবসায়ী ও মা আছিয়া খাতুন ছিলেন গৃহিণী। তার বাবা খুবই ধার্মিক মানুষ ছিলেন। তাকে ছোটবেলায় কঠিন পর্দা ও অন্যান্য ধর্মীয় বিধিনিষেধ মেনে চলতে হতো। তার শৈশব ও কৈশোর কাটে যশোরে।

দীর্ঘ জীবনযাত্রায় তিনি অর্জন করেছেন বিচিত্র অভিজ্ঞতা। শিল্পের অগণন পথে যাত্রা করলেও কথাসাহিত্যে তিনি স্থিতি লাভ করেছেন পূর্ণমাত্রায়। আনোয়ারার পাঠদানের হাতেখড়ি হয় মায়ের কাছে। চুড়িপট্টির মোহনগঞ্জ প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। মধুসূদন তারাপ্রসন্ন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক ও ১৯৫৮ সালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত স্কুল ও কলেজ থকে আইএসসি পাস করেন।

১৯৫৯ সালে আনোয়ারা ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ১৯৬৫ সালে তিনি এমবিবিএস পাস করেন। এরপর তিনি তৎকালীন পাকিস্তান বিমানে মেডিকেল কোরে লেফটেন্যান্ট পদে যোগদান করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি বিমানবাহিনীর চাকরী থেকে ইস্তফা দিয়ে লন্ডন চলে যান এবং সেখানে কয়েকটি হাসপাতালের চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সেখান থেকে ১৯৮২ সালে মনোবিজ্ঞানে এমআরসি ডিগ্রী লাভ করে দেশে ফিরেন আনোয়ারা সৈয়দ হক।

১৯৮৪ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে মনোরোগ বিভাগে সহকারী প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮৯ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত তিনি জাতীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। পরে ১৯৯৩ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ছিলেন ঢাকার মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের পরিচালক ও প্রভাষক।

১৯৯৮ সালে আনোয়ারা সৈয়দ হক ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে অবসর নেন। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্য ও স্কটল্যান্ডের বিভিন্ন হাসপাতালে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৬ সাল থেকে তিনি ঢাকার বারডেম হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগের প্রভাষক ও বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত আছেন।

১৯৬৫ সালের ১৯ নভেম্বর তিনি সৈয়দ হকের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। সৈয়দ হক ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ফুসফুসে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এই দম্পতির দুই সন্তান। মেয়ে বিদিতা সৈয়দ হক একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষক। ছেলে দ্বিতীয় সৈয়দ হক একজন আইটি বিশেষজ্ঞ, গল্পকার ও গীতিকার। 

আনোয়ারা সৈয়দ হকের সৃজনসত্তা বহুমাত্রিক। তিনি গল্প, উপন্যাস, ভাষ্য, জীবনীগ্রন্থ, ভ্রমণকাহিনি রচনা করেছেন। সব মিলিয়ে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা একশ’র অধিক। আনোয়ারা সৈয়দ হক প্রবল মানবিক অনুভূতিময় একজন মানুষ। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদীও। তার প্রতিবাদের রূপ ও রূপান্তর ঘটছে তার বিপুল ও বিচিত্র্যময় লেখায়।

১৯৫৪ সালে দৈনিক সংবাদে আনোয়ারার প্রথম ছোটগল্প ‘পরিবর্তন’ প্রকাশিত হয়। ১৯৫৫ সাল থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত তিনি দৈনিক ইত্তেফাকের কচি কাঁচার আসরে নিয়মিত লিখতেন। মাইকেল মধুসূদন কলেজে পড়াকালীন দৈনিক আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী ও গুলিস্তা পত্রিকায় তার লেখা গল্প, কবিতা প্রকাশিত হত। গুলিস্তা পত্রিকায় লিখে তিনি পুরষ্কৃতও হয়েছেন। 

ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়াকালীন সময়ে লেখালেখির পাশাপাশি তিনি কলেজের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে পড়েন। এই সময়ে ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রথম শ্রেণীর পত্র-পত্রিকা ও বিভিন্ন মেডিকেল জার্নালে তার লেখা ছাপা হত। তার প্রথম উপন্যাস ১৯৬৮ সালে সচিত্র সন্ধানীতে প্রকাশিত হয়। তার সেই প্রেম সেই সময় ও বাজিকর উপন্যাসে সাধারন মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ও আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা বর্ণিত হয়েছে।

নরক ও ফুলের কাহিনি উপন্যাসে লিখেছেন তার ছেলেবেলার কথা। বাড়ি ও বণিতা উপন্যাসে চিত্রায়িত হয়েছে মধ্যবিত্ত পরিবারের সামাজিক সমস্যা। উপন্যাস ছাড়া তিনি শিশুদের জন্য সাহিত্য রচনা করেছেন। ১৯৭৭ সালে ছানার নানার বাড়ি, বাবার সাথে ছানা (১৯৮৬), ছানা এবং মুক্তিযুদ্ধ (১৯৮৭), ১৯৯০ সালে তৃপ্তি, আবেদ হোসেনের জ্যোৎস্না দেখা, ১৯৯২ সালে হাতছানি, আগুনের চমক এবং মুক্তিযোদ্ধার মা নামক শিশুতোষ গল্প ও উপন্যাসগুলি প্রকাশিত হয়।

সাহিত্য চর্চায় অবদানের জন্য ২০১০ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ২০০৭ সালে কবীর চৌধুরী শিশুসাহিত্য পুরস্কার, ২০০৬ সালে ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার ছাড়াও মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার, শিশু একাডেমি পুরস্কারসহ বহু পুরস্কার-সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।

নিউজজি/এসএফ

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন