বৃহস্পতিবার, ৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ , ৩ জুমাদাউস সানি ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
প্রবন্ধ

রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের প্রয়াণবার্ষিকী আজ

ফারুক হোসেন শিহাব অক্টোবর ২২, ২০১৯, ১৫:৩১:১২

6K
  • রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের প্রয়াণবার্ষিকী আজ

‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায়

হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে’

-অনবদ্য এই পঙক্তি এই উপমহাদেশের অন্যতম পরাবাস্তব আর উত্তর আধুনিক ধারার বাঙালি কবি জীবনানন্দ দাশ-এর লেখা। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি, গল্পকার, উপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও গীতিকার  ছিলেন জীবনানন্দ দাশ। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃৎদের মধ্যে অগ্রগণ্য।

রবীন্দ্র-পরবর্তীকালে বাংলা ভাষার প্রধান কবি হিসাবে তিনি সর্বসাধারণ্যে স্বীকৃত। তাকে বাংলা ভাষার শুদ্ধতম কবি অভিধায় আখ্যায়িত করা হয়েছে। মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষ ধাপে তিনি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন। 

জীবনানন্দ দাশ প্রধানত কবি হলেও বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা ও প্রকাশ করেছেন। তবে ১৯৫৪ সালে অকাল মৃত্যুর আগে তিনি নিভৃতে ২১টি উপন্যাস এবং ১০৮টি ছোটগল্প রচনা করেছিলেন যার একটিও তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি। বাংলা সাহিত্যের শক্তিশালী কবি ও লেখকের জীবন কেটেছে চরম দারিদ্রতার মধ্য দিয়ে। 

আজ ২২ অক্টোবর বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শীর্ষ কবি জীবনানন্দ দাশের ৬৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। বিশ্ব কাব্যসাহিত্যের অসাধারণ মেধাবী এই বাঙালি কবি কলকাতায় ট্রাম দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৯৫৪ সালের ২২ অক্টোবর মারা যান। জীবনানন্দ দাশ ১৮৯৯ সালে ১৭ ফেব্রুয়ারি বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন।

তার মা কবি কুসুম কুমারী দাশ ও পিতা সত্যনানন্দ দাশ। তাঁর পূর্বপুরুষেরা ছিলেন মুন্সীগঞ্জ জেলার বিক্রমপুর পরগনা নিবাসী। জীবনানন্দের পিতামহ সর্বানন্দ দাশগুপ্ত (১৮৩৮-৮৫) বিক্রমপুর থেকে বরিশালে নিবাস স্থানান্তরিত করেন। সর্বানন্দ দাশগুপ্ত জন্মসূত্রে হিন্দু ছিলেন; পরে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেন। তিনি বরিশালে ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে অংশগ্রহণ করেন এবং তাঁর মানবহিতৈষী কাজের জন্যে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হন।

জীবনানন্দের মাতা কুসুমকুমারী দাশ ছিলেন গৃহস্থ, কিন্তু তিনিও কবিতা লিখতেন। তাঁর সুপরিচিত কবিতা “আদর্শ ছেলে’’ (আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/ কথায় না বড় হয়ে কাজে বড়ো হবে) আজও শিশুশ্রেণীর পাঠ্য। জীবনানন্দ ছিলেন পিতামাতার জ্যেষ্ঠ সন্তান; তার ডাকনাম ছিল মিলু। তার ভাই অশোকানন্দ দাশ এবং বোন সুচরিতা দাশ। সম্ভবত মা কুসুমকুমারী দাশের প্রভাবেই ছেলেবেলায় পদ্য লিখতে শুরু করেন জীবনানন্দ। স্কুল জীবনেই জীবনানন্দ বাংলা ও ইংরেজিতে লেখালেখি শুরু করেন। 

জন্মসূত্রে তাঁর পদবী “দাশগুপ্ত” হলেও তিরিশের দশকের শুরুতে জীবনানন্দ “গুপ্ত” বর্জন করে কেবল দাশ লেখা শুরু করেন। ১৯০৮ সালের জানুয়ারিতে আট বছর বয়সে তাঁকে ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি করানো হয়। সে সময়েই তাঁর বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায় রচনার সূচনা হয়। এছাড়া তখন ছবি আঁকার দিকেও ঝোঁক ছিল তাঁর। ১৯১৫ সালে ব্রজমোহন বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন (মাধ্যমিক) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। দুবছর পর ব্রজমোহন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট (উচ্চ মাধ্যমিক) পরীক্ষায় পূর্বের ফলাফলের পুনরাবৃত্তি ঘটান; অতঃপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার উদ্দেশ্যে বরিশাল ত্যাগ করেন। 

১৯১৯ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। অতঃপর ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে দ্বিতীয় শ্রেণিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি আইন পড়া শুরু করেন, কিন্তু অচিরেই তা পরিত্যাগ করেন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯১৯ সালে তিনি ইংরেজিতে অনার্সসহ বিএ পাশ করেন। ওই বছরেই ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার বৈশাখ সংখ্যায় তার প্রথম কবিতা ছাপা হয়। 

কবিতাটির নাম ছিল বর্ষ আবাহন। তিনি বাংলার রূপমুগ্ধতায় এই ভূ-খণ্ডকে দেখেছেন রূপসী বাংলা রূপে। দেশের বৈচিত্র্যে প্রাণিত হয়ে লিখেছেন অসংখ্য কবিতা। যা আমাদের দেশ ও সাহিত্যকে আসীন করেছে অনন্য উচ্চতায়। জীবনানন্দ দাশ বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার অনন্য পথিকৃৎ।

১৯২২ সালে জীবনানন্দ কলকাতার সিটি কলেজে টিউটর হিসেবে অধ্যাপনা শুরু করেন এবং আইনশাস্ত্র অধ্যয়ন ছেড়ে দেন। যৌবনের প্রারম্ভেই জীবনানন্দের কবিপ্রতিভা বিকশিত হতে শুরু করে। ১৯২৭ সালে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’ প্রকাশিত হয়। সেসময় থেকেই তিনি তাঁর পারিবারিক উপাধি ‘দাশগুপ্তের’ বদলে কেবল ‘দাশ’ লিখতে শুরু করেন।

চাকরি না থাকায় এ সময় তিনি চরম আর্থিক দুর্দশায় পড়ে গিয়েছিলেন। জীবনধারণের জন্যে তিনি গৃহশিক্ষক হিসেবে কাজ করতেন এবং লেখালিখি থেকে সামান্য কিছু রোজগার হতো। সাথে সাথে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তিনি চাকরির সন্ধান করছিলেন। ১৯২৯ সালের ডিসেম্বরে তিনি দিল্লির রামযশ কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। এখানে তাঁর চাকরির মেয়াদ মাত্র চার মাস। 

১৯৩০ সালের ৯ মে তারিখে তিনি লাবণ্য দেবীর সাথে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ে হয়েছিল ঢাকা শহরে, পুরোনো ঢাকায় সদরঘাট-সংলগ্ন ব্রাহ্ম সমাজের রামমোহন লাইব্রেরিতে। লাবণ্য গুপ্ত সেসময় ঢাকার ইডেন কলেজে লেখাপড়া করছিলেন। জীবনানন্দ দাশের বিয়েতে কবি বুদ্ধদেব বসু, অজিতকুমার দত্ত প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। বিয়ের পর আর তিনি দিল্লিতে ফিরে যাননি। চাকরির প্রয়োজনে বরিশালে প্রত্যাবর্তন করলেও কলকাতা জীবনানন্দকে খুব টানতো। কলকাতার সুবিস্তৃত পরিসর তিনি উপভোগ করতেন। 

১৯৪৭-এর দেশভাগ পূর্ববর্তী ওই সময়টিতে বাংলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বিভৎসরূপে দেখা দেয়। জীবনানন্দ সবসময়ই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির স্বপক্ষে সোচ্চার ছিলেন। ১৯৪৭-এ দেশ বিভাগের কিছু পূর্বে সপরিবারে বাংলাদেশ অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করেন এবং কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।

কলকাতায় তিনি “দৈনিক স্বরাজ” পত্রিকার রোববারের সাহিত্য বিভাগের সম্পাদনা করেন। কিন্তু এই চাকরির স্থায়ীত্ব ছিল মাত্র সাত মাস। এরই মধ্যে জীবনানন্দ কলকাতার সাহিত্যিক সমাজে নিজস্ব একটি অবস্থান তৈরি করে নিয়েছিলেন। ১৯৫২ সালে তাঁর জনপ্রিয় কবিতার বই ‘বনলতা সেন’ সিগনেট প্রেস কর্তৃক পরিবর্ধিত আকারে প্রকাশিত হয়। ১৯৫৪ সালের মে মাসে প্রকাশিত হয় ‘জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা’। 

তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে- ঝরা পালক (প্রকাশের কাল ১৯২৭) ধূসর পাণ্ডুলিপি (১৯৩৬), বনলতা সেন-(১৯৪২)। বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থের কবিতা সমূহ পরবর্তীতে কবিতা গ্রন্থ মহাপৃথিবী (১৯৪৪) এ প্রকাশিত হয়। জীবনানন্দের জীবদ্দশায় সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ ‘সাতটি তারার তিমির’ (১৯৪৮)। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর কিছু আগে প্রকাশিত হয় জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা। 

কবির মৃত্যু পরবর্তী প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ হলো প্রকাশিত রূপসী বাংলা (১৯৫৭) এবং ১৯৬১ তে প্রকাশিত হয় বেলা অবেল কালবেলা। তাঁর অগ্রন্থিত কবিতাবলী নিয়ে প্রকাশিত কবিতা সংকলনগুলো হলো- সুদর্শনা (১৯৭৩), আলো পৃথিবী (১৯৮১), মনোবিহঙ্গম, হে প্রেম তোমার কথা ভেবে (১৯৯৮) অপ্রকাশিত একান্ন (১৯৯৯) এবং আবছায়া (২০০৪)। 

ইংরেজি ছাড়াও ফরাসিসহ কয়েকটি ইউরোপীয় ভাষায় তাঁর কবিতা অনূদিত হয়েছে। তাঁর মৃত্যুর পর আবিষ্কৃত হয় অজস্র গল্প ও উপন্যাস। এর মধ্যে প্রথম সংকলন ছিল ‘জীবনানন্দ দাশের গল্প’ (১৯৭২)। বেশ কিছুদিন পর প্রকাশিত হয় ‘জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ গল্প’ (১৯৮৯)। পরবর্তীতে আবদুল মান্নান সৈয়দ ১৯৮৬ সালে ‘জীবনানন্দ দাশের পত্রাবলী’ প্রকাশ করেন এবং ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয় ১০১টি চিঠির সংকলন ‘জীবনানন্দ দাশের চিঠিপত্র’।

কবি লিখেছিলেন- 

‘পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন

তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;

সব পাখি ঘরে আসে-সব নদী-ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন;

থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।’

সাহিত্য-সৃজনে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিসরূপ ১৯৫৫ সালে ভারত সরকার কর্তৃক তিনি সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। এর আগে, ১৯৫২ সালে নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলন পরিবর্ধিত সিগনেট সংস্করণ ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থটি বাংলা ১৩৫৯-এর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ বিবেচনায় পুরস্কৃত করা হয়। কবির মৃত্যুর পর ১৯৫৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করে।

নিউজজি/এসএফ

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন