শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ , ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

সাহিত্য
  >
প্রবন্ধ

শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে নারী চরিত্র

ফারুক হোসেন শিহাব সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৯, ১৪:০৯:৫২

201K
  • শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে নারী চরিত্র

বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য নাম শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাকে বলা হয় বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতে শরৎ সাহিত্যের প্রভাব অত্যন্ত গভীর ও ব্যাপক। কখনো কখনো তিনি অনিলা দেবী ছদ্মনামে লিখতেন। শরৎচন্দ্রের নায়িকা বলতে তার উপন্যাসের প্রধান চরিত্রকে বলা হচ্ছে। এসব চরিত্র অনেক চরিত্রের ভিড়েও নিজস্ব প্রবণতা এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের কারণে স্বতন্ত্র।

তার সময়ে নতুন প্রজন্মের উত্তরসূরি শরৎচন্দ্র নারী অধিকার আর মর্যাদা রক্ষায় সমাজ ব্যবস্থার মূল রক্ষণশীল ধারাকে তীক্ষ্ন বিদ্রুপে কটাক্ষ করেছেন। তার বড়দিদি উপন্যাসের নায়িকা বড়দিদি ‘মাধবী দেবী’ কিংবা ‘দেবদাস’-এর ‘পার্বতী’সহ সাড়া জাগানো উপন্যাসের নায়িকারা আজও পাঠক সমাজের হৃদয়ে স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিয়েছে। এই লেখায় নায়িকা চরিত্রের স্বরূপ উন্মোচনে শরৎচন্দ্রের দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা করা যেতে পারে। 

শরৎচন্দ্র পঁচিশ বছর (১৯১৩-১৯৩৮) একটানা মেয়েদের কথা লিখে অবিস্মরণীয় যেসব নারী চরিত্র সৃষ্টি করেছেন, তা আজও জনপ্রিয়। সেসব নারীর কেউ কেউ সাধারণ মেয়ে, কেউ বা মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান, আবার কেউ বা নিম্নবর্গ কিংবা সমাজের দৃষ্টিতে ভ্রষ্টা। অবিরত লিখে গেছেন প্রেমাকুল মেয়েদের গল্প। শুধু নারীই নয়, সকল মানুষের অন্তরের নিগূঢ় রহস্যে ডুব দিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র।

পতিতা, বিধবা, বৈষ্ণবী, সতী, অরক্ষণীয়া অথবা বিয়ে-বহির্ভূত প্রেম- তা সে যেমনটাই হোক না কেন, শরৎচন্দ্র অভিভূত হয়ে থাকতেন তাদের প্রেমে। নারী চরিত্র রূপায়ণে তার আখ্যানগুলো সহজ-সরল ভাষায় এবং আটপৌরে রোমান্টিক ভাবাদর্শে বিবৃত হয়েছে। 

শরৎচন্দ্রের মনে হয়েছিল নারীসুলভ বলে তার যথার্থ মূল্য নির্ধারণ আদৌ সম্ভব নয়। তার মতে, যেদিন নারী হয়ে যাবে দুর্লভ, সেদিনই সমাজ অনুধাবন করতে পারবে নারীর যথার্থ মূল্য। সমাজ নারীর মূল্য নির্ধারণ করে তার সেবাপরায়ণায়, স্নেশীলতায়, সতীত্বে এবং সহনশীলতায়।

তার দৃঢ় সিদ্ধান্ত- ‘যে ধর্ম বনিয়াদ গড়িয়াছে আদিম জননী ইভের পাপের উপর, যে ধর্ম সংসারের সমস্ত অধঃপতনের মূলে নারীকে বসাইয়া দিয়াছে, সে ধর্ম সত্য বলিয়া যে-কেহ অন্তরের মধ্যে বিশ্বাস করিয়াছে, তাহার সাধ্য নয় নারীজাতিকে শ্রদ্ধার চোখে দ্যাখে।’ 

শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসের নারী চরিত্রগুলো আবেগ ও উচ্ছ্বাসে অসাধারণ ঔজ্জ্বল্যে উপস্থাপিত হয়েছে। ‘বড়দিদি’ (১৯১৪) উপন্যাসের মাধবী এবং মৃত্যুর পর প্রকাশিত‘শেষের পরিচয়’ (১৯৩৯)-এর সবিতা আজো বাঙালির মনে উঁকি দেয়। প্রায় ২৩টি প্রধান উপন্যাসের একাধিক নারী চরিত্র যেন গেঁথে আছে শরৎপ্রেমীদের অন্তরিক্ষে। 

‘গৃহদাহ’র একদিকে অচলা অন্যদিকে মৃণাল, চরিত্রহীনের একদিকে সাবিত্রী অন্যদিকে কিরণময়ী, তবে ‘শেষ প্রশ্ন’র কমল একেবারে আলাদা। ‘পথের দাবী’র ভারতী, তারও আগে‘বিন্দুর ছেলে’র বিন্দুবাসিনী, ‘মেজদিদি’র হেমাঙ্গিনী এবং‘নিষ্কৃতি’র শৈলজা সরল ও স্নেহপ্রবণ নারীদের অন্যতম দৃষ্টান্ত। এসব নারীর পাশে ‘দেবদাস’-এর চন্দ্রমুখী, ‘শুভদা’র কাত্যায়নী এবং ‘আঁধারে আলো’র বিজলীর মতো বারবনিতার আখ্যানও পাঠকদের হৃদয়কে দারুণভাবে স্পর্শ করেছে। 

তিনি মূলত মানুষের মনুষ্যত্বকেই বড় করে দেখেছেন। এ জন্য নারীর জীবনের স্বাভাবিক সুখ-দুঃখকে অপরিসীম সহানুভূতি ও দরদে রাঙিয়ে তুলেছেন। সমাজের মানদণ্ডে যেসব নারী চরিত্রহীন, তাদের মধ্যে তিনি খুঁজে পেয়েছেন মনুষ্যত্ব। সমাজের অন্যায়-অত্যাচারে মানুষের হঠাৎ স্খলন হলে তাকে চিরকালের জন্য সমাজবহির্ভূত গণ্য করা, শরত্চন্দ্রের দৃষ্টিতে নিতান্ত অন্যায়। 

শরৎচন্দ্রের মতে, ‘পাপকে ঘৃণা কর, পাপীকে নয়।’ সমাজের অসহায়-উপেক্ষিত নারীর প্রতি অসীম দরদের পাশাপাশি শোষণ-উত্পীড়নের বিরুদ্ধে শরত্চন্দ্র ছিলেন বরাবরই আপসহীন, খড়্গহস্ত। প্রকৃতপক্ষে এরই মধ্য দিয়ে ‘শরত্চন্দ্র তাঁর গল্প-উপন্যাসে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার চিত্র তুলে ধরেছেন। 

তার উপন্যাসে প্রচলিত নীতি, ধর্ম আচরণ ও সামাজিক অনুশাসনের বিরুদ্ধে একটা বিদ্রোহের ভাব লক্ষ করা যায়। শরত্চন্দ্রের উপন্যাসে মূলত নিম্নমধ্যবিত্ত এবং দরিদ্র নারীর জীবনচিত্র রূপায়িত হয়েছে।  ধনী ও নির্ধনের যে বৈষম্য, তা সামাজিক ক্ষেত্রে নানা সমস্যা ও জটিলতার সৃষ্টি করেছে। 

অর্থাৎ বৈষম্যের ফলেই সমাজে হিংসা-বিদ্বেষ, অবহেলা-ঘৃণা, স্বার্থপরতা, নীচতা-শঠতা ইত্যাদি মানুষের অসহিষ্ণু ও অনুদার নীতি সমাজ-ভাঙনের মূলে দুষ্ট ক্ষতের মতো বিরাজমান। স্বাভাবিক কারণেই উত্পীড়ন ও শোষণের শিকার হয় নিচের তলার অতি সাধারণ দুর্বল মানুষ। সাম্যবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ শরত্চন্দ্র যেখানে দেখেছেন মানুষের লাঞ্ছনা-বঞ্চনা তথা এই ঘৃণ্য ও নগ্ন রূপ, সেখানেই তিনি বিদ্রোহী হয়ে উঠেছেন।’

শরত্চন্দ্র একসময় বহু কুলত্যাগিনী বঙ্গরমণীর ইতিহাস সংগ্রহ করেছিলেন। তিনি দেখতে পান, শুধু বিধবারাই কুল ত্যাগ করেনি; অনেক সধবাও এ পথে এসেছে। অধিকাংশই এসেছে দারিদ্র্য অথবা স্বামীগৃহের অত্যাচার ও উত্পীড়নের কারণে। পুরুষশাসিত সমাজে কেবল নারীরই দোষ দেখানো হয়। শরৎচন্দ্র ‘নারীর মূল্য’ প্রবন্ধে লিখেছেন : ‘সমাজ নারীর ভুলভ্রান্তি এক পাইও ক্ষমা করিবে না, পুরুষের ষোলো আনাই ক্ষমা করিবে।’ মূলত সামাজিক নানা বন্ধনে, ধর্মীয় জীর্ণ আচারে এবং কুসংস্কার জীবনকে যেখানে বিষাক্ত করে রেখেছিল, সেই প্রচলিত হিন্দু সমাজের অনুশাসন মেনে নিয়েই শরৎচন্দ্র উপন্যাসের নারী চরিত্র চিত্রণে অগ্রসর হয়েছেন। 

শরৎ তার উপন্যাসে পতিতা চরিত্র উপস্থাপনে তাদের প্রেম, প্রেমের একনিষ্ঠতা ও সেবাপরায়ণতার চিত্র তুলে ধরেছেন। পিয়ারী বাইজি বাল্যপ্রণয়ের টানে আজীবন শ্রীকান্তনিষ্ঠ হয়ে থাকে, সাবিত্রী-সতীশের মধ্যে চলে প্রেমের নানা খেলা, চন্দ্রমুখী অনুরক্ত হয়ে থাকে দেবদাসের প্রতি, বিজলী সত্যেন্দ্রের প্রেমে বাইজি পেশা ছেড়ে দিয়ে বলে, ‘যে রোগে আলো জ্বাললে আঁধার মরে, সূর্যি উঠলে রাত্রি মরে- আজ সেই রোগেই তোমাদের বাইজি চিরদিনের জন্য মরে গেল।’ 

কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, এই বারবনিতারা ব্যক্তিবিশেষের আস্থাভাজন হয়, কিন্তু সামাজিক সম্মান অর্জন করে না। প্রেমের সামাজিক স্বীকৃতি সম্ভব হয় না বলেই শরৎচন্দ্র লিখেছেন- ‘বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না- ইহা দূরেও ঠেলিয়া ফেলে।’

‘বড়দিদি’র মাধবী, ‘চরিত্রহীন’-এর কিরণময়ী বা‘পথনির্দেশ’-এর      হেমনলিনীর জীবনে শুধু সত্য হয়ে থাকে প্রেম। কিরণময়ীর মতো বুদ্ধিমতী, আত্মনির্ভরশীল নারীর জীবনে যে ভয়ানক বিপর্যয় দেখানো হয়েছে, তা আসলে সামাজিক শাস্তি। সমাজের চোখে যা নিষিদ্ধ সেই পথে এগিয়ে কিরণময়ী ভুল করেছিল। দিবাকরকে বক্ষলগ্ন করেও উপেন্দ্রের ধ্যান করেছে কিরণময়ী; কিন্তু প্রেমের চেতনা ও পাপের চেতনা সব কিছু থেকে উত্তীর্ণ হলো উন্মাদিনীতে পরিণত হয়ে। অন্যদিকে সাবিত্রী দেহমনে পবিত্র জেনেও সমাজের চোখে নিজেকে পাপী মনে করেছে। 

সতীশের জীবনসঙ্গিনী, সহধর্মিণী হওয়ার অধিকার সমাজে তার নেই। কারণ হিন্দু ধর্মে বিধবাবিবাহ পাপ। হিন্দু ধর্মের সনাতন এই মূল্যবোধে বিশ্বাস স্থাপন করেই বিধবা সাবিত্রী বারবার প্রত্যাখ্যান করেছে সতীশের বিয়ের প্রস্তাবকে। এখানে সাবিত্রী মানসিক দ্বন্দ্বে নিপীড়িত চরিত্র নয়। তার চরিত্র কামনা-বাসনা, মননশীলতার জারকরসে সিক্ত না হয়ে সর্বাঙ্গীণভাবে নির্দ্বন্দ্ব। কারণ হিন্দু বিধবার ব্রহ্মচর্যের সংস্কার, নারীর একনিষ্ঠতার শিক্ষা সাবিত্রীকে সমাজশক্তির প্রতিকূলে অবস্থান গ্রহণের জন্য নিরুৎসাহ করেছে।

একইভাবে রাজলক্ষ্মী, কমললতা, অন্নদা দিদি সমাজকে অস্বীকার করে ছিটকে আসতে চেয়েছে, কিন্তু সমাজের তুচ্ছ সংস্কারের মোহ ত্যাগ করতে পারেনি। অবশ্য রাজলক্ষ্মীর বৈধব্য ও জীবিকা নায়ক শ্রীকান্তকে সংস্কারবোধে ও প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধের মাপকাঠিতে বিচার করতে দেখা যায়। 

‘গৃহদাহ’র অচলাকে তিনি নৈতিক হিন্দু সমাজে প্রতিষ্ঠা দিতে পারেননি। কারণ বিবাহোত্তর নারীর প্রেম সমাজবিরুদ্ধ কাজ। স্বামীর প্রতি হৃদয়ের একাগ্রতা হারানো অপরাধ, একনিষ্ঠতার অভাব পাপাচার। রুগ্ণ মহিমকে একা গাড়িতে ফেলে অচলাকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ায় সুরেশ সমাজের চোখে ঘৃণিত। অচলা মৃণালের মতো নিঃস্বার্থ সেবাপরায়ণতার দৃষ্টান্ত রাখতে পারেনি। পারেনি স্বামীর প্রতি দেহ-মন-প্রাণে পূর্ণাঙ্গভাবে সমর্পিত হতে; আর এ কারণে তার শেষ পরিণতি নিরাশ্রয়তায়, সামাজিক রীতিনীতির অস্বীকৃতিতে সমাজ-বিচ্ছিন্নতায়।

‘শেষ প্রশ্ন’ উপন্যাসের কমল চরিত্রে চারিত্রিক দ্বন্দ্বের চেয়ে মতাদর্শের দ্বন্দ্ব প্রকট। অবাধে অনানুষ্ঠানিকভাবে একাধিক পুরুষকে সে পর পর গ্রহণ করেছে জীবনসঙ্গী হিসেবে। আনুষ্ঠানিক বিয়ের প্রয়োজনের অসারতা প্রমাণ করতে গিয়ে কমল শিবনাথকে উদ্দেশ করে নির্দ্বিধায় বলেছে, ‘উনি করবেন আমাকে অস্বীকার, আর আমি যাব তাই ঘাড় ধরে ওঁকে দিয়ে স্বীকার করিয়ে নিতে? সত্য যাবে ডুবে, আর যে অনুষ্ঠানকে মানিনে তারই দড়ি দিয়ে ওঁকে রাখব বেঁধে? আমি? আমি করব এই কাজ?’ বিবাহিত নারীর নৈতিক সংকট সর্বপ্রথম বঙ্কিমচন্দ্রের ‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসে শৈবলিনী চরিত্র চিত্রণে উন্মোচিত হয়। 

নিউজজি/এসএফ

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন