বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৭ ফাল্গুন ১৪৩১ , ২০ শাবান ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
প্রবন্ধ

নজরুলের কবি জীবনে প্রেমের বিচিত্র অধ্যায়

ফারুক হোসেন শিহাব আগস্ট ২৭, ২০১৯, ১৫:২৯:০৭

27K
  • নজরুলের কবি জীবনে প্রেমের বিচিত্র অধ্যায়

‘বিদ্রোহী কবি’ কাজী নজরুল ইসলামের প্রধান পরিচয় হলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি একজন প্রেমিক কবি। আমাদের জাতীয় কবির জীবনে প্রেম এসেছে বহুবার। নারীর প্রেম তার কাব্যে ফেলেছে গভীরতর প্রভাব। যার ফলে তিনি হয়ে উঠেছেন দ্রোহ ও প্রেমের কবি। তার জীবনে এসব প্রেমের ছোঁয়া বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে অনন্যমাত্রা।

যে বিদ্রোহী কবিতার জন্য নজরুল ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে আখ্যায়িত হন সেই কবিতাতেই তিনি বলেছেন- ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি, আর হাতে রণতূর্য’। মূলত, নজরুল সাহিত্যধারায় দ্রোহের পাশাপাশি প্রেমের অপূর্ব সম্মিলন ঘটেছে যে তারুণ্যের জোরে তাঁর শির চির উন্নত-চির দুরন্ত দুর্মদ সেই তারুণ্য বন্ধনহারা ষোড়শী কুমারীর প্রেমেও উদ্দাম, চঞ্চল মেয়ের ভালবাসায় মুখর।

‘বিদ্রোহী’ কবিতাতে কবি আরও বলেন- ‘আমি বন্ধনহারা কুমারীর বেণি, তন্বী নয়নে বহ্নি,/ আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি!/ আমি উন্মন, মন-উদাসীর,/ আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশীর।’ মূলত, তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে প্রেমের জয়গান গেয়েছেন কবি। মহা বিদ্রোহী রণক্লান্ত কবি প্রেমের শাশ্বত আবেদনের কাছে হার মেনে স্বস্তি খুঁজে পেতে চেয়েছেন- ‘হে মোর রাণী! তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে/আমার বিজয় কেতন লুটায় তোমার চরণ-তলে এসে।’

নজরুল রচনায় তেজোদৃপ্ত ও উদ্দীপিত জীবনচেতনার বিপরীতে যে প্রেমচেতনা সেখানে নারীও ভিন্ন মাত্রায় উপস্থাপিত। তাঁর প্রেমমূলক কাব্য ভাবনায় প্রেমিক নজরুলের বিরহী, অভিমানী, অতৃপ্ত ও ক্ষুধার্ত রূপ দেখা যায়। প্রেমের কবিতা ও গানে তাঁর মূল সত্তাটি হচ্ছে বিরহী আত্মার প্রতীক। তবে নজরুলের জীবনে বহুবার প্রেমের উষ্ণ হাওয়া বইলেও বিশেষভাবে তিন নারীর সঙ্গে প্রেমে জড়ানোর ঘটনা ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। প্রথমত, নার্গিস আসার খানম, দ্বিতীয়ত, তার স্ত্রী প্রমীলা দেবী এবং তৃতীয়ত, মিস ফজিলাতুন্নেসা।

নার্গিস: নজরুল জীবনে প্রেমের প্রথম কলিটি হচ্ছে নার্গিস- যার প্রকৃত নাম সৈয়দা খানম (নজরুল তাকে নাম দেন নার্গিস- সৈয়দা নার্গিস আসার খানম, ফার্সি ভাষায় নার্গিস অর্থ গুল্ম, নার্গিস একটি ফুলের নামও বটে)। নার্গিস পুস্তক প্রকাশক আলী আকবর খানের বিধবা বোনের মেয়ে। কলকাতায় ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে আলী আকবরের সাথে পরিচয় ও সখ্যতার সূত্রে নজরুল তার সাথে ১৯২১ সালের মার্চে কুমিল্লা বেড়াতে যাওয়ার সুবাদে নার্গিসের সাথে পরিচয় ও প্রণয়। 

নজরুলকে নিয়ে আলী আকবর খান তার স্কুলের বন্ধু বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায় উঠেন। বীরেন্দ্রকুমারের মা ছিলেন বিরজা সুন্দরী দেবী। চার-পাঁচ দিন সেখানে কাটানোর পর কবিকে নিয়ে যাওয়া হয় দৌলতপুরের খাঁ বাড়িতে। সেখানে কবির উষ্ণ অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করা হয়। বাড়ির জ্যেষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনদের সাথে নজরুল খুব দ্রুতই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেন। তাদের কবিতা শুনিয়ে, অজস্র গান গেয়ে মুগ্ধ করে ফেলেন। দূর-দূরান্ত থেকেও লোকেরা আসত কবিকে দেখতে, তার গান শুনতে। আলী আকবর খানের বোন আসমাতুন্নেসার বিয়ে হয়েছিল খাঁ বাড়ির পাশেই। তার স্বামী মুন্সি আবদুল খালেক একটি মেয়ে সৈয়দা খানমকে রেখে মৃত্যুবরণ করেন। এক রাতে কবি খাঁ বাড়ির দীঘির ঘাটে বসে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন, সেই বাঁশি সুরে মুগ্ধ হন সেই সুন্দরী যুবতি মেয়েটি। এরপর একদিন নজরুলের এই বাঁশি বাজানো সম্পর্কে আলোচনার সূত্রে কবির সঙ্গে তিনি আলাপ করেন। এই আলাপ-পরিচয়ের পরই নজরুল মেয়েটির প্রেমে পড়ে যান। আলী আকবর খানও ব্যাপারটা খেয়াল করলেন।

মূলত, নজরুলকে কুমিল্লা আনবার পিছনেও তার উদ্দেশ্য ছিল নিজ পরিবারের কারো সাথে নজরুলের বিয়ে দিয়ে তাঁকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে প্রকাশনা ব্যবসায় উন্নতি করা। নার্গিসের প্রেমে পাগল কবি তাঁকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন এবং এক পর্যায়ে আলী আকবর খানের কাছে বিয়ের প্রস্তাব উত্থাপন করলে তিনি সুযোগটি লুফে নেন। এরপর নার্গিসের সঙ্গে নজরুলের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা ও আকদ সম্পন্ন হয়। কিন্তু কাবিননামা সম্পাদনার সময় কবিকে ঘর জামাই হয়ে থাকতে হবে- কৌসুলি আলী আকবরের জুড়ে দেয়া এমন একটি শর্তে ক্ষেপে গিয়ে কবি বিয়ের রাতেই নার্গিস কে ছেড়ে চলে যান। নার্গিসকে ছেড়ে চলে আসার পর আলী আকবর খান কবিকে ফেরানোর জন্য আর্থিক প্রলোভন দেখানোসহ নানাভাবে চেষ্টা করেন। এতে নজরুল আরও ক্ষিপ্ত হন। এরপর দীর্ঘ ১৬ বছর নজরুলের সাথে নার্গিসের আর কোন যোগাযোগ হয় নি।

১৯৩৭ সালে নজরুলকে নার্গিস একটা চিঠি লেখেন। চিঠি প্রাপ্তির সময় সেখানে কবি বন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন। নজরুল তাকেই চিঠি পড়তে বলেন। চিঠি পড়া শেষে শৈলজানন্দ নজরুলকে উত্তর লিখতে বলেন। নজরুল একটি গান লিখে দেন- ‘যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই/কেন মনে রাখ তারে/ভুলে যাও তারে ভুলে যাও একেবারে।/আমি গান গাহি আপনার দুখে,/তুমি কেন আসি দাড়াও সুমুখে,/আলেয়ার মত ডাকিও না আর/নিশীথ অন্ধকারে….।’

১৯৩৭ সালের ১ জুলাই নজরুল নার্গিসকে আর একটি চিঠি লেখেন। এর প্রায় বছর খানেক আগেই শিয়ালদহতে নার্গিস ও নজরুলের উপস্থিতিতে উভয়ের আনুষ্ঠানিক বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। কিন্তু প্রথম প্রণয়ী নার্গিস কবির অন্তরে দারুণভাবে রেখাপাত করেছিল। তাকে ত্যাগ করার পরে কবি মনে অপরাধবোধ ও বিষাদ ছিল। নার্গিসকে উদ্দেশ্য করে কবি চক্রবাক কাব্যে বেশ কয়েকটি বিরহের কবিতা লিখেছিলেন। নার্গিসকে উদ্দেশ্য করে কবি লিখেছিলেন, ‘হার-মানা-হার’।

প্রমীলা: কুমারী প্রমীলা সেনগুপ্তা আলী আকবরের সাথে কুমিল্লায় গিয়ে প্রথম যে বাড়িতে নজরুল উঠেছিলেন, সেই বাড়ির কর্ত্রী বিরজা সুন্দরী দেবী কবিকে পূত্রবৎ স্নেহ করতেন, কবিও তাঁকে মা বলে ডাকতেন । নার্গিসের বিয়ে বাসর থেকে পারিয়ে নজরুল এই বাড়িতে ওঠেন এবং পরে আরও কয়েকবার সেখানে যান। এই বাড়িতে যৌথ পরিবারে বিরজা সুন্দরী দেবীর বিধবা জা গিরিবালা থাকতেন। তার কন্যা আশালতার (প্রমীলা) সঙ্গে কবির পরিচয় ও প্রণয় গড়ে ওঠে। তিন বছর পর কবি এই আশা লতাকে বিয়ে করেন এবং তার নাম দেন প্রমীলা। ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল কলকাতায় নজরুল ও প্রমীলার বিবাহ সম্পন্ন হয়।

বিয়েতে বাধা ছিল একটাই, ধর্ম । বিবাহ-আইনের নানা চড়াই-উতরাই পার হয়ে তাঁদের বিয়েটা হয়েছিল স্ব-স্ব ধর্মপরিচয় বহাল রেখেই । তখন প্রমীলার বয়স ছিল ১৪ আর নজরুলের ২৩। বিয়ের পর স্ব ধর্ম-আচরণ বহাল রেখেই প্রমীলা দেবী আমৃত্যু সকল সুখ-দু:খের বোঝা মাথায় নিয়ে কবির জীবন সঙ্গিনী হয়েছিলেন। প্রমীলার প্রতি কবির প্রেমের কথা তাঁর ‘বিজয়িনী’ কবিতায় প্রকাশিত হয়েছিল । ‘বিজয়ীনি’ ছাড়াও নজরুল প্রমীলাকে নিয়ে ‘প্রিয়ার রূপ’, ‘দোদুল দুল’ সহ আরও অনেক কবিতা রচনা করেন। ‘ দোদুল দুল’ কবিতায় কবি প্রমীলার রূপের বর্ণনা এভাবে তুলে দেন- ‘মৃণালু হাত/নয়ানু পাত/গালের টোল,/চিবুক দোল/সকল কাজ/করায় ভুল/প্রিয়ার মোর/কোথায় তুল?/কোথায় তুল?/কোথায় তুল?/কাকঁল ক্ষীণ/মরাল গ্রীব/ভুলায় জড়/ভুলায় জীব,/গমনু দোল/অতুল তুল্।’ দোলন চাঁপা কাব্যগ্রন্থে সবার আগে এই কবিতাটি রয়েছে। এই কাব্যগ্রন্থটি ১৯২৩ সালের ১৫ অক্টোবর মাসে প্রকাশিত হয়।

ফজিলাতুন্নেসা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতকোত্তর মুসলমান ছাত্রী এবং সওগাত পত্রিকার একজন বিশিষ্ট লেখিকা মিস ফজিলাতুন্নেসার প্রতি কবির অনুরাগকে কিংবদন্তী তুল্য বলা যেতে পারে। ১৯২৮ সালে মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় অধিবেশনে যোগ দিতে এসে নজরুল তার বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেনের বাসায় উঠেন। তার মাধ্যমেই ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে নজরুলের পরিচয়। কবি একটু-আধটু জ্যোতিষবিদ্যা জানতেন।

কাজী মোতাহার হোসেন সে কারণে কবিকে নিয়ে যান ফজিলাতুন্নেসার বাসায়। ব্যস ! শুরু হয়ে গেল হাত দেখা। প্রথমে হাতে হাত, পরে চোখে চোখ। কবির মন ফজিলাতুন্নেসার প্রতি প্রেমে টালমাটাল হয়ে উঠল। কিন্তু নজরুল ফজিলতুন্নেসার হৃদয় জয় করতে ব্যর্থ হন। কবি ঢাকা ছেড়ে ফিরে আসেন কলকাতায় তার কৃষ্ণনগরের বাসায়, যেখানে তার পরিবার থাকত। কিন্তু ফজিলাতুন্নেসা থেকে গেলেন তাঁর মন জুড়ে। তারপর নজরুল বন্ধু মোতাহার হোসেনকে ৭টি এবং ফজিলাতুন্নেসাকে ১টি চিঠি পাঠান। বন্ধু মোতাহার হোসেনকে পাঠানো নজরুলের চিঠিগুলো মূলত ফজিলাতুন্নেসাকে উদ্দেশ্য করে লেখা।

মোতাহার হোসেনের কাছে কবির প্রথম চিঠিটি ১৯২৮ এর ২৪ ফেব্রুয়ারি কলকাতা ফিরবার পথে স্টীমারে বসে লেখা। এই চিঠি কবি ফজিলতুন্নেসাকেও দেখাবার অনুরোধ করেন। কাজী মোতাহার বন্ধুর হয়ে ফজিলাতুন্নেসাকে পৌঁছে দিতেন কবির প্রেমময় চিঠিগুলো। শেষ পর্যন্ত নজরুলের একটি চিঠির উত্তর দেন ফজিলাতুন্নেসা। এই চিঠিতে ফজিলাতুন্নেসা নজরুলকে আর চিঠি না লিখবার অনুরোধ করেন। উত্তরে নজরুল কাজী মোতাহার হোসেনকে জানান, তিনি আর চিঠি লিখবেন না। কিন্তু সেই কথা রাখা নজরুলের পক্ষে সম্ভব হয় নি। তিনি ফজিলাতুন্নেসাকে উদ্দেশ্য করে বন্ধু মোতাহারের কাছে তারপরও চিঠি লিখে গেছেন।

ফজিলাতুন্নেসা ‘সওগাত’-এর জন্য একটি গল্প লিখেছিলে-‘শুধু দু’দিনের দেখা’। সম্পাদক সেটা নজরুলকে দেখতে দেন। নজরুল সেখানে কিছু পরিবর্তন করার অনুমতি ও তার ‘সঞ্চিতা’-ফজিলতুন্নেসাকে উৎসর্গ করবার অনুমতি চেয়ে চিঠি লেখেন। ফজিলাতুন্নেসা সেগুলোরও কোন উত্তর কখনই দেননি, বরং তিনি সওগাত সম্পাদক নাসিরউদ্দীন সাহেবকে চিঠি লিখে অনুরোধ করেন, ‘আমার গল্পটি যেমন আছে তেমনই ছাপালে সুখী হব’। এই ঘটনায় কবি আঘাত পান এবং ‘সঞ্চিতা’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উৎসর্গ করেন। এই আঘাত পেয়েও কবির ফজিোতুন্নেসাকে পাবার আকাঙ্ক্ষা শেষ হয় না। তিনি কাজী মোতাহার হোসেনকে উল্লেখ করে আরো তিনটি চিঠি লিখেন। সরাসরি কেন চিঠি পাঠাতেন না, তার কারণও উল্লেখ করেছেন কবি, ‘ঐ এক চিঠি পেয়েই যত দূর বুঝেছি- আমায় তিনি দ্বিতীয় চিঠি দিয়ে দয়া করবেন না’।

নজরুলের লেখা চিঠিগুলো কাজী মোতাহার হোসেনের কাছে দীর্ঘদিন সংরক্ষিত ছিল। পরে এগুলো সংগ্রহ করে সৈয়দ আলী আশরাফ ‘নজরুল জীবনে প্রেমের এক অধ্যায়’ গ্রন্থে প্রকাশ করেন। সৈয়দ আলী আশরাফ এ প্রসঙ্গে ঐ গ্রন্থে বলেন-‘তিনি আসলে সৌন্দর্যের পূজারী, ব্যক্তির উপাসক নন। যে নারীর ভিতর সেই সৌন্দর্যে বিকাশ দেখেছেন এবং সে নারী তার মনে সেই পূজার যে আনন্দের অনুভূতি জাগ্রত করেছেন, তাকে পাওয়ার জন্য ন্যায়-অন্যায়, সমাজের বাধা নিষেধ মানতে তিনি রাজী নন।

স্তবগান রচনা করতে তিনি প্রস্তুত। অর্থাৎ এই প্রণয় হচ্ছে সেই পর্যায়ের প্রণয় যে পর্যায়ে যাকে ভালোবাসা যায় তাকে দেবী বলে মনে হয়, মানুষ হিসেবে গণ্য করা হয় না। তিনি এই প্রেমকে কবি হিসেবে উপলব্ধি করেছেন, উপভোগ করেছেন। তাই এই প্রেমে একদিকে দেখি সাময়িক উচ্ছ্বাস, অন্য দিকে দেহি আত্মতৃপ্তি। দুঃখকে উপভোগ করার জন্যই যেন এই প্রেম। নার্গিস, জাহানারা, ফজিলাতুন্নেসা এদের সঙ্গে তার প্রেম কি একই প্রেমের পুনরুক্ত নয়? শুধু মনে হয় ফজিলাতুন্নেসার প্রতি তাঁর অনুরাগ বেশ গভীর হতে পারত কিন্তু সেই গভীরতা অর্জন করার সুযোগ পায়নি।’

১৯২৮ সালে ফজিলাতুন্নেসার বিলেত গমন উপলক্ষে ‘সওগাত’ কার্যালয়ে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। গণ্যমান্য অতিথিবর্গ ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদগণ এতে উপস্থিত ছিলেন। সভায় উপস্থিত না থেকে কবি ভেতরের ঘরে চুপ করে বসে থাকেন। অনুষ্ঠানের শেষে সভাস্থলে এসে তিনি ফজিলাতুন্নেসার উদ্দেশ্যে একটি গান পরিবেশন করেন-

‘জাগিলে পারুল কিগো ‘সাত ভাই চম্পা’ ডাকে,/উদিলে চন্দ্র-লেখা বাদলের মেঘের ফাঁকে।/চলিলে সাগর ঘু’রে/অলকার মায়ার পুরে,/ফোটে ফুল নিত্য যেথায়/জীবনের ফুল্ল-শাখে।।/আঁধারের বাতায়নে চাহে আজ লক্ষ তারা,/জাগিছে বন্দিনীরা, টুট ঐ বন্ধ কারা।/থেকো না স্বর্গে ভুলে,/এ পারের মর্ত্য কূলে,/ভিড়ায়ো সোনার তরী/আবার এই নদীর বাঁকে।।’

একই উপলক্ষে কবি ‘বর্ষা বিদায়’ কবিতাও রচনা করেন। বর্ষা বিদায় কবিতা সম্পর্কে কাজী মোতাহার হোসেন লিখেন,‘তার বিখ্যাত প্রেমের কবিতাগুলির মধ্যে এটি অন্যতম। কিন্তু কবিতাটি এমন নৈব্যক্তিকভাবে লেখা যে অধিকাংশ পাঠকের পক্ষে এর ব্যঙ্গার্থ কিংবা রূপকের রহস্য ভেদ করা কঠিন। তার শুধু দেখবেন প্রকৃতি কিভাবে বর্ষা ঋতু থেকে শীত ঋতুতে রূপ পরিবর্তন করছে। অথবা অন্য ভাবে বলা যায় যে, তিনি তার অনুভূতি ও অভিজ্ঞতাকে চেতনাশ্রিত কল্পনায় এমন ভাবে জারিত করে নিয়েছিলেন যা থেকে তিনি মুক্তার মত এমন কতকগুলো কবিতা রচনা করেন যা তার অনুভূতিকে বিনয় চারিত্র্য দান করেছে’।

বিলেতে গিয়ে ফজিলাতুন্নেসা তার জীবনসঙ্গীও নির্বাচন করেন এবং দেশে ফেরার পর তাদের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। বিয়ের খবর শুনে নজরুল আর একটি গান রচনা করেন-‘বাদল বায়ে মোর/নিভিয়া গেছে বাতি।/তোমার ঘরে আজ/উৎসবের রাতি।।/তোমার আছে হাসি,/আমার আঁখি-জল/তোমার আছে চাঁদ,/আমার মেঘ-দল,/তোমার আছে ঘর,/ঝড় আমার সাথী।।/শূন্য করি’ মোর/মনের বন ভূমি/সেজেছ সেই ফুলে/রানীর সাজে তুমি।/নব বাসর ঘরে/যাও সে সাজ প’রে,/ঘুমাতে দাও মোরে/কাঁটার শেজ্ পাতি।’

ফজিলাতুন্নেসা প্রতি নজরুলের প্রেম সম্পর্কে কাজী মোতাহার হোসেন লেখেন, ‘ফজিলতের প্রতি নজরুলের অনুভূতির তীব্রতা দু’তিন বছরের সময়সীমায় নিঃশেষিত হয়ে যায়। সমান্তরাল আর একটি স্তবকে লক্ষ্য করা যায় কবি তার আকাঙ্ক্ষিত প্রেমকে সুন্দরতর আর এক জগতে খুঁজে ফিরেছেন যেখানে প্রেমে কোন নৈরাশ্য নেই, কোন বেদনা নেই। প্রেমের জন্য নারীর কাছ থেকে তিনি চেয়েছিলেন পূর্ণ আত্মসমর্পণ কিন্তু কোথাও তিনি তা পান নি। ফলে ধীরে ধীরে তিনি খোদা প্রেমের দিকে ঝুঁকে পড়লেন’। পার্থিব প্রেমকে বিদায় দিয়ে নজরুল লেখেন-

‘পরজনমে দেখা হবে প্রিয়/ভুলিও মোরে হেথা ভুলিও।।/এ জনমে যাহা বলা হ’ল না,/আমি বলিব না, তুমিও বলো না।/জানাইলে প্রেম করিও ছলনা,যদি আসি ফিরে, বেদনা দিও।।/ হেথায় নিমেষে স্বপন ফুরায়/ রাতের কুসুম প্রাতে ঝরে যায়,/ভালো না বাসিতে হৃদয় শুকায়,/বিষ-জ্বালা-ভরা হেথা অমিয়।।/হেথা হিয়া উঠে বিরহে আকুলি,/মিলনে হারাই দু’দিনেতে ভুলি,/হৃদয়ে যথায় প্রেম না শুকায়-/সেই অমরায় মোরে স্মরিও।’

নার্গিস, প্রমীলা, ফজিলাতুন্নেসা এই তিন নারীই নজরুলের কাছ থেকে প্রেম বলতে আমরা যা বুঝি তা পেয়েছিলেন। এছাড়া আরও কয়েক জন নারীর প্রতি নজরুলের দুর্বলতার কথা জানা যায়। তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন-  রানু সোম ,উমা মৈত্র, জাহানারা বেগম, শিল্পী কানন দেবী। তাদেদর সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করা যাক।

রানু সোম: ঢাকার টিকাটুলির মেয়ে রানু সোম যিনি পরবর্তীতে কবি বুদ্ধদেব বসুর সাথে বিবাহ বন্ধকে আবদ্ধ হয়ে প্রতিভা বসু নামে পরিচিতি লাভ করেন। নজরুল ঢাকায় এসে কিছুদিন রানু সোমকে গান শেখাতেন। তাদের মাঝে সুন্দর গুরু-শিষ্য সম্পর্ক গড়ে উঠে। কিন্তু তাদের এই সম্পর্ক নিয়ে নানা কাণা-ঘুষা শুরু হয় । মুসলমান যুবক কবি প্রতিদিন হিন্দু যুবতীকে গান শেখানোর আড়ালে ঘনিষ্ঠ হচ্ছেন, এই অপবাদ চাপিয়ে নজরুলকে হেনস্তা করার উদ্দেশ্যে সজনীকান্ত সেন তার ‘শনিবারের চিঠিতে’ একটি প্যারোডি লেখেন যার নাম ছিল, ‘কে বিদেশী বন-উদাসী বাঁশের বাঁশী বাজাও বনে’।

সজনীকান্তের এই প্যারোডি প্রকাশের কিছুদিন পর একরাতে রানু সোমের বনগ্রামের বাসায় থেকে ফেরার পথে ৭/৮ জন হিন্দু যুবকের দল নজরুলকে আক্রমণ করে। নজরুল তাদের পালটা আক্রমণ করেন, পরে পুলিশ এসে আক্রমণকারী যুবকদের তাড়িয়ে দেন। রানু সোম কবিকে দেবতা জ্ঞানে ভক্তি করেছিলেন। শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতার সঙ্গে মিশেছেন এবং নিষ্ঠার সঙ্গে কবির তুলে দেওয়া গান শিখেছেন। কবির প্রত্যাশা ছিল রানু নজরুল গীতির বড় মাপের গুণী শিল্পী হবে। এজন্য উভয়ের সম্পর্ক গুরু-শিষ্যের পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল। প্রেমের কোন সম্পর্ক এখানে গড়ে উঠেনি বলে সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞমহল মনে করেন।

উমা মৈত্র: ঢাকা কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপাল সুরেন্দ্রনাথ মৈত্রের মেয়ে উমা মৈত্র (ডাক নাম নোটন)। কবি তাকেও গান শেখাতেন। গান শিখাতে গিয়ে নজরুল কি নোটনের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন কিনা তার উত্তর পাওয়া কঠিন। তবে কবি জীবনে নার্গিস-প্রমীলা-ফজিলাতুন্নেসার সাথে সাথে উমা মৈত্রের নামও উচ্চারিত হয়েছে। ধারণা করা হয় উমা মৈত্রের স্মৃতি কবি তার ‘শিউলিমালা’ গল্পটিতে ধরে রেখেছেন।

গল্পটির কিছু অংশ এরূপ- “শিউলি আমার কাছে গান শিখতে লাগল। কিছুদিন পরেই আমার তান ও গানের পুঁজি প্রায় শেষ হয়ে গেল। মনে হল আমার গান শেখা সার্থক হয়ে গেল। আমার কণ্ঠের সকল সঞ্চয় রিক্ত করে তার কণ্ঠে ঢেলে দিলাম। আমাদের মালা-বিনিময় হল না-হবেও না এ জীবনে কোন দিন- কিন্তু কণ্ঠ বদল হয়ে গেল। আর মনের কথা সে শুধু মনই জানে।… একমাস ওদের বাড়িতে ছিলাম। কত স্নেহ, কত যত্ম, কত আদর।

অবাধ মেলা মেশা- সেখানে কোন নিষেধ, কোনো গ্লানি, কোন বাধা বিঘ্ন, কোন সন্দেহ ছিল না। আর এসব ছিল না বলেই বুঝি এতদিন ধরে এত কাছে থেকেও কারুর করে কর স্পর্শ-টুকুও লাগে নি কোনদিন। এই মুক্তিই ছিল আমাদের সবচেয়ে দুর্লঙ্ঘ্য বাধা। কেউ কারো মন যাচাই করিনি। কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসার কথাও উদয় হয় নি মনে। একজন অসীম আকাশ, একজন অতল সাগর। কোন কথা নেই-প্রশ্ন নেই, শুধু এ ওর চোখে, ও এর চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে”।

জাহানারা বেগম: জাহানারা বেগম চৌধুরী ওরফে মীরা পশ্চিমবঙ্গের মেয়ে ‘বর্ষবাণী’ নামে একটি বার্ষিক পত্রিকার সম্পাদিকা। তার সাথে নজরুলের প্রথম পরিচয় হয় ১৯৩১ সালে দার্জিলিং ঘুরতে গিয়ে। সেইবার দার্জিলিং-এ আরো উপস্থিত ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মৈত্রয়ী দেবী, ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র ও তার মেয়ে উমা মৈত্রসহ আরো বিখ্যাত কয়েকজন।

নজরুলের একটি গানের খাতা জাহানারা বেগমের কাছে ছিল যাতে ছিল ৮ টি কবিতা ও ৭ টি গান। নজরুলের জীবনকালে এগুলো অপ্রকাশিত থেকে যায়। জাহানারা বেগম চৌধুরী মৃত্যুর আগে এগুলো প্রকাশের অনুমতি দিয়ে যান। সেখানে কয়েকটি কবিতায় জানাহারাকে নিয়ে রচনা করা কয়েকটি কবিতা পাওয়া যায়। তবে নার্গিস-প্রমীলা বা ফজিলতুন্নেসার মত কবি জাহানারাকেও ভাল বেসেছিলেন কিনা সেই প্রশ্ন আজও প্রশ্নই রয়ে গেছে।

শিল্পী কানন দেবী: শিল্পী কানন দেবীকেও কবি নজরুল গান শিখিয়েছিলেন। তার সঙ্গে নজরুলের সম্পর্ক নিয়েও নিন্দকেরা নানা মুখরোচক কাহিনী রটনা করেছিলেন।কানন দেবীকে নিয়ে একটি সংবাদ রটানো হয়েছিল এমন যে, কবিকে কলকাতার কোথাও না পেলে কানন দেবীর বাড়িতে অবশ্যই পাওয়া যাবে। কলকাতার পত্রিকা ‘শনিবারের চিঠির’ সম্পাদক সজনীকান্ত কানন দেবীকে নিয়েও রসালো কাহিনি প্রচারে পিছিয়ে রয়নি। অথচ, বাস্তব হয়ত ভিন্ন ছিল বলে মনে করা হয়।

ব্যথার দান গ্রন্থের উৎসর্গপত্রে কবি লিখেছেন-‘মানসী আমার, মাথার কাঁটা নিয়েছিলুম বলে ক্ষমা করোনি, তাই বুকের কাঁটা দিয়ে প্রায়শ্চিত্য করলুম।” কবির এই মানসীর পরিচয় আজও রহস্যাবৃত। সত্য-সুন্দর-সৌন্দর্যের পূজারি নজরুল আজীবন বড় প্রেমের কাঙাল ছিলেন। প্রেম নাকি কবিমানসের প্রধান প্রেরণা । প্রেমিক কবি নজরুলের মন তো প্রেমময় হবেই। আর তাই প্রেম তার জীবনে এসেছিল বারবার-কখনো ঝড়ের মতো, কখনো নিভৃতে।

ব্যক্তিগত জীবনে আরাধ্য নারীকে ভালবাসার পাশাপাশি নজরুল দেশকে ভালবেসেছিলেন, মানুষকে ভালবেসেছিলেন, মানবতাকে ভালবেসেছিলেন, ভালবেসেছিলেন সত্য-সুন্দরকে। কিন্তু ব্যক্তি জীবনে প্রেমে ব্যর্থতার পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সমাজ বাস্তবতার বৈপরীত্যে সত্য-সুন্দর-সৌন্দর্যের স্বপ্নপুরীতে যখন কুৎসিত কীটের দংশন প্রত্যক্ষ করেছেন তখন কবি দারুণভাবে আহত হয়েছেন। তাঁর হৃদয়ে যে রক্ত ক্ষরণ হয়েছে তার নিঃসরণ ঘটিয়েছেন তাঁর লেখনীর মাধ্যমে, সুরের বেহাগে, সভা-সমিতির বক্তৃতায়-ভাষণে। তার কাব্যে, গানে, গল্পে, উপন্যাসে বারবার তাই উপজীব্য হয়েছে প্রেম। মানুষের মানবিক অনুভূতির অনন্য ভাষা ভালোবাসা ও প্রেমকে তিনি সাহিত্য অঙ্গনে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়।

বাক ও বোধ শক্তি হারাবার আগে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে নজরুল ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির’ বিশেষ অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে বলেছিলেন- ‘আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম, সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।’ 

বস্তুত এমন অভিমান নিয়েই নজরুল দীর্ঘ ৩৪ বছর নীরবে কাটিয়ে ৭৭ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়েছেন। তবে প্রেমের কাঙাল এই কবি ব্যক্তিগত শত ব্যথা-বঞ্চনা ও দুঃখ-দারিদ্রের মাঝেও এক অপরিমেয় শক্তিবলে জীবনের ভাণ্ড শূন্য রেখে সৃষ্টির ভাণ্ডারকে পরিপূর্ণ করে তুলছিলেন। যার মধ্যদিয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতের ধারা।

নিউজজি/ এসএফ

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন