রবিবার, ২ এপ্রিল ২০২৩, ১৮ চৈত্র ১৪২৯ , ১১ রমজান ১৪৪৪

সাহিত্য
  >
প্রবন্ধ

বাঙালি ও বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণের অপ্রতিরুদ্ধ কবি নজরুল

ফারুক হোসেন শিহাব আগস্ট ২৭, ২০১৯, ১৫:০১:০৬

18K
  • বাঙালি ও বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণের অপ্রতিরুদ্ধ কবি নজরুল

দ্রোহ, প্রেম, সাম্য, মানবতা ও শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির বার্তা নিয়ে এসেছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর সাহিত্য-সৃজন বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করেছিল। তিনি বিদ্রোহী কবি হিসেবে আখ্যায়িত হলেও তাঁর প্রেমিক রূপটিও প্রবাদপ্রতিম। জীবদ্দশায় কবি বলেছেন, ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন খুঁজি তারে আমি আয়নায়।’ পৃথিবীতে এমন ক’জন আছেন যিনি প্রেমের টানে রক্তের সম্পর্ককে অস্বীকার করে পথে বেরিয়ে পড়তে পারেন। 

আজ ২৭ আগস্ট জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৩ মহাপ্রয়াণ দিবস। দীর্ঘ দিনের বাকরুদ্ধ থেকে ১৯৭৬ সালের এই দিনে বাংলাদেশের জাতীয় কবি  কাজী নজরুল ইসলাম ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। গল্প, কবিতা, গান, নাটক ও প্রবন্ধের মাধ্যমে মানবিক দর্শনে ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বাঙালির মনোরাজ্যকে জাগ্রত করা এই কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সমাহিত করা হয়। 

বাংলাদেশের জাতীয় কবি এবং বাংলাভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর অতুলনীয় প্রতিভার স্পর্শে সমৃদ্ধ করেছেন কবিতা ও সঙ্গীতের ভুবনকে। বাঙালির স্বাধীন রাজনৈতিক চেতনা গঠনে নজরুলের অবদান অসামান্য। নজরুল একদিকে যেমন শ্যামা সঙ্গীত ও কীর্তন লিখেছেন, তেমনি লিখেছেন ইসলামি ভাবধারার গান। তারুণ্যের আবেগ ও বিদ্রোহের চেতনাকে তাঁর মতো করে আর কেউ চিত্রিত করতে পারেননি। তিনি পরিচিত ছিলেন ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে। 

বাংলা ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ অবিভক্ত ভারতে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামের কাজী পরিবারে কাজী নজরুল ইসলাম জন্মগ্রহণ করেন। নজরুলের পূর্বপুরুষরা সিপাহীবিদ্রোহে অংশ নেয়ায় ইংরেজদের বিরাগভাজন হন। এই বিদ্রোহের বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল নজরুলের ভেতরে। 

কাজী ফকির আহমেদ ও জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান ছিলেন নজরুল। ছোটবেলায় তাঁর ডাকনাম ছিল দুখু মিয়া। ১৯০৮ সালে পিতার মৃত্যুর পর মাত্র দশ বছর বয়সেই রোজগারে নামতে হয় দুখু মিয়াকে। মক্তবের শিক্ষক, মুয়াজ্জিন ও মাজারের খাদেম হিসেবে কাজ করতে হয় তাঁকে। কিছু দিন পর যোগ দেন লেটোর দলে। লেটোর দলের হয়ে গান বাঁধা ও নাটকে অভিনয় করে চলে কিছু দিন।

রেলের ইংরেজ গার্ডের খানসামা, রুটির দোকানের কর্মচারী হিসেবেও কাজ করতে হয়েছে তাকে। রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুল, মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুল, ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে বিভিন্ন সময়ে লেখাপড়া করেন তিনি। কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে প্রায়ই তাকে লেখাপড়া বন্ধ করে কাজে যোগ দিতে হয়। 

সিয়ারসোল রাজ স্কুলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর সেনাবাহিনীতে যোগ দেন নজরুল। প্রথম মহাযুদ্ধের সৈনিক হিসেবে সেনাবাহিনীতে থাকার সময়ই নজরুলের সাহিত্যিক জীবনের সূচনা ঘটে। ১৯২০ সালে কলকাতায় ফিরে নজরুল সাহিত্য সৃষ্টিকর্মে মনোনিবেশ করেন। ‘বিদ্রোহী’, ‘সাম্যবাদী’ ইত্যাদি কবিতার মাধ্যমে তিনি বাংলা সাহিত্যে নতুন ঝড় তোলেন। বিশেষ করে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশের পর বাংলার পাঠকসমাজে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। 

এমন দৃপ্ত ও বলিষ্ঠ ভাব ও ভাষাভঙ্গি এর আগে বাংলা সাহিত্যে ছিল অকল্পনীয়। গানের ভুবনেও তিনি নিয়ে আসেন তারুণ্যের নতুন আবহ। নজরুল পত্রিকা সম্পাদনা ও চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। এ ছাড়া তিনি ধূমকেতু ও লাঙল পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তিনি ব্রিটিশবিরোধী লেখার জন্য কারাবন্দীও ছিলেন। 

তিনি প্রায় ৩০০০ গান লেখেন। অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশী, দোলন চাঁপা, ছায়ানট, ইত্যাদি তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। বাঁধনহারা, মৃত্যুক্ষুধা, কুহেলিকা তার উপন্যাস। ব্যথার দান, রিক্তের বেদন, শিউলিমালা ইত্যাদি তার বিখ্যাত গল্পগ্রন্থ। তিনি সুগায়ক ছিলেন। ধ্রুব নামে একটি চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেন। 

কমরেড মুজাফ্ফর আহমদ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী মোতাহার হোসেন প্রমুখ ছিলেন তার বন্ধু। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে নজরুলকে নিয়ে যান মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। নজরুল যেমন রবীন্দ্রনাথকে তার বই উৎসর্গ করেছেন, তেমনি রবীন্দ্রনাথ তার ‘বসন্ত’ নাটক উৎসর্গ করেন নজরুলকে। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু পর্যন্ত দুজনের সুসম্পর্ক ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ অক্ষুণ্ণ থাকে। ১৯৪২ সালে নজরুল মস্তিষ্কের দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন এবং নির্বাক হয়ে যান। 

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে তিনি তাঁকে জাতীয় কবির মর্যাদায় ভূষিত করেন। বাংলাদেশে তাঁর বসবাসের ব্যবস্থা করেন। ধানমন্ডিতে কবির বসবাসের জন্য একটি বাড়ি প্রদান করেন তিনি। সেই বাড়িটিই এখন নজরুল ইন্সটিটিউট। 

বাঙালির জাতীয় জীবনে নজরুলের সবচেয়ে বড় অবদান হলো তিনি অসাম্প্রদায়িক বাঙালির চেতনায় প্রোথিত করেন স্বাধীনতার বীজমন্ত্র। তিনি সকল প্রকার বৈষম্য, অন্যায়, অত্যাচার, নিপীড়ন ও শোষণের বিরুদ্ধে ছিলেন চিরবিদ্রোহী। তিনি মানবতার জয়গান গেয়েছেন তার প্রতিটি রচনায়। তিনি একাধারে প্রেম ও বিদ্রোহের কবি। তিনি লিখেছেন, ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণতূর্য।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় নজরুলের কবিতা ও গান ছিল প্রেরণার উৎস।

বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা। তিনি বৈচিত্র্যময় অসংখ্য রাগ-রাগিনী সৃষ্টি করে বাংলা সঙ্গীত জগতকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। 

কাজী নজরুল ইসলাম অসাম্প্রদায়িক ও শোষনমুক্ত দেশ ও সমাজ গড়ার মানসে সাহিত্যে বিভিন্ন শাখায় লেখালেখি করেন। এসব ক্ষেত্রে তিনি সংগ্রামী ও পথিকৃৎ লেখক। তাঁর লেখনি জাতীয় জীবনে অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর গান ও কবিতা প্রেরণার উৎস। তাঁর কবিতা ও গান মানুষকে যুগে যুগে শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ দেখিয়ে চলছে। এই যাত্রা নিরন্তর-অপ্রতিরুদ্ধ। বাঙালির প্রাণের কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৩তম প্রয়াণদিনে কবির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।

নিউজজি/এসএফ

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন