বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৭ ফাল্গুন ১৪৩১ , ২০ শাবান ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
প্রবন্ধ

রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ

ফারুক হোসেন শিহাব আগস্ট ৬, ২০১৯, ১৪:০৫:১৯

12K
  • রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য ও ভাবগভীরতা প্রগতিচেতনায় সুদৃঢ়। তার রাজনৈতিক দর্শন অত্যন্ত জটিল ও উচ্চতর। সাম্রাজ্যবাদ ও উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করলেও তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দকে সমর্থন জানিয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ ‘জাতি’ শব্দের চেয়ে ‘দেশ’ শব্দটি বেশি পছন্দ করতেন। তার কাছে জাতিগত শব্দের গভীরতর অর্থ ছিল সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্রয়। যেজন্য তিনি ‘নেশন’কে কিছুটা মানতে পারলেও ‘ন্যাশনালিজম’কে গ্রহণ করতে পারেননি। ‘Nationalism’ নামক বইয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন- কিভাবে জাতীয়তাবাদ মানুষের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করে। জাতীয়তাবাদ পশ্চিমের হাতিয়ার, যা রাষ্ট্র তার স্বার্থে নিয়োগ করলে শান্তি বিনষ্ট হয়, হানাহানি সৃষ্টি হয়, মানুষে মানুষে ও সভ্যতা পড়ে যায় সংকটে। 

তাই বলে কি রবীন্দ্রনাথ স্বদেশপ্রেমী (Patriot) ছিলেন না? তাঁর কাছে জাতীয়তাবাদ, আর স্বদেশপ্রেম ভিন্ন উপলব্ধি। ১৯২০ সালে ফ্রান্স থেকে একটি ইংরেজিতে লেখা চিঠিতে তিনি বলেন, ‘আমি ভারতকে ভালোবাসি। সেই হিসেবে আমি প্যাট্রিয়ট। কিন্তু ভারতবর্ষ আমার কাছে একটি আদর্শ ও একটি ধারণামাত্র। ভৌগোলিক কোনো বিষয় নয়। সেই অর্থে আমি প্যাট্রিয়ট নই। সমস্ত বিশ্বমানব নিয়েই আমাদের পৃথিবী হতে হবে।’

ভারতের ধ্রুপদি ও লৌকিক সংস্কৃতি এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞানচেতনা ও শিল্পদর্শন তার রচনায় গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নিজ মতামত প্রকাশ করেছিলেন। তিনি সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নিজ মতামত প্রকাশ করেছিলেন। গ্রামীণ উন্নয়ন ও গ্রামীণ জনসমাজে শিক্ষার বিস্তারের মাধ্যমে সার্বিক সমাজকল্যাণের তত্ত্ব প্রচার করতেন তিনি। 

পাশাপাশি সামাজিক ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধেও তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৮৯০ সালে প্রকাশিত মানসী কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি কবিতায় রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনের রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়। হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলার তথ্যপ্রমাণ এবং পরবর্তীকালে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ গদর ষড়যন্ত্রের কথা শুধু জানতেনই না, বরং উক্ত ষড়যন্ত্রে জাপানি প্রধানমন্ত্রী তেরাউচি মাসাতাকি ও প্রাক্তন প্রিমিয়ার ওকুমা শিগেনোবুর সাহায্যও প্রার্থনা করেছিলেন।

আবার ১৯২৫ সালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে স্বদেশী আন্দোলনকে ‘চরকা-সংস্কৃতি’ বলে বিদ্রুপ করে রবীন্দ্রনাথ কঠোর ভাষায় তার বিরোধিতা করেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তাঁর চোখে ছিল “আমাদের সামাজিক সমস্যাগুলির রাজনৈতিক উপসর্গ”। তাই বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে বৃহত্তর জনসাধারণের স্বনির্ভরতা ও বৌদ্ধিক উন্নতির উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি। ভারতবাসীকে অন্ধ বিপ্লবের পন্থা ত্যাগ করে দৃঢ় ও প্রগতিশীল শিক্ষার পন্থাটিকে গ্রহণ করার আহ্বান জানান রবীন্দ্রনাথ।

রবীন্দ্রনাথের এই ধরনের মতাদর্শ অনেককেই বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ১৯১৬ সালের শেষ দিকে সানফ্রান্সিসকোয় একটি হোটেলে অবস্থানকালে একদল চরমপন্থী বিপ্লবী রবীন্দ্রনাথকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ উপস্থিত হওয়ায় তাদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছিল।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতার ভূমিকা অনস্বীকার্য। কবিগুরুর লেখায় গীতিধর্মিতা, চিত্ররূপময়তা, অধ্যাত্মচেতনা, ঐতিহ্যপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, রোম্যান্টিক সৌন্দর্যচেতনা, ভাব, ভাষা, ছন্দ ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্য, বাস্তবচেতনা গভীরতম রাজনৈতিক উপলব্ধিরই প্রমান মিলেছে।

রবীন্দ্রনাথ অসংখ্য বক্তৃতায় ধর্ম, জাতি, সমাজ, শিক্ষা, স্বদেশ, মুক্তি, সভ্যতা নানা বিষয়ে তাঁর দর্শন ব্যক্ত করেছেন। ১৯১৭ সালে জাতীয়তাবাদের ওপর একটি ইংরেজি বক্তৃতায় রাষ্ট্র সম্পর্কে তার বক্তব্য ছিল- ‘রাষ্ট্রের কাজ ডিমের খোসার মতো। এই ডিম ও খোসার উপযোগিতা একেকজনের কাছে একেক রকম। ডিমের খোসাটি ডিমের ভেতরে থাকা ছানাটিকে নিরাপত্তা দেয়। আর সকালের প্রাতরাশকারীর কাছে এই খোসার কোনো মূল্য নেই।’

১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি নাইটহুড বর্জন করেন। নাইটহুড প্রত্যাখ্যান-পত্রে লর্ড চেমসফোর্ডকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমার এই প্রতিবাদ আমার আতঙ্কিত দেশবাসীর মৌনযন্ত্রণার অভিব্যক্তি।’ রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’ ও ‘একলা চলো রে’ রাজনৈতিক রচনা হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।

‘একলা চলো রে’ গানটি গান্ধীজির বিশেষ প্রিয় ছিল। যদিও মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল অম্লমধুর। হিন্দু নিম্নবর্ণীয় জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে গান্ধীজি ও আম্বেডকরের যে মতবিরোধের সূত্রপাত হয়, তা নিরসনেও রবীন্দ্রনাথ বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ফলে গান্ধীজিও তার অনশন কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন।

শুধু তাই নয়, তার অধিকাংশ নাটক ও গল্পে সুক্ষ ও সুদৃঢ়ভাবে তার মত ও দর্শন প্রকাশ পেয়েছে। তার নাট্য সংলাপের ভাঁজে ভাঁজে শাসকগোষ্ঠীর অনৈতিক প্রভাব, অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে তেজদীপ্ত উচ্চারণ প্রতিয়মান হয়েছে। তিনি শাসকগোষ্ঠীর একজন হয়েও অকপটে সত্য প্রকাশে অবিচল ছিলেন।  ‘রাজা’, ‘অচলায়তন’, ‘মুক্তধারা’, ‘রক্তকরবী’, ‘তাসের দেশ’, ‘কালের যাত্রা’সহ অন্যান্য নাটকে একই চিত্রের উন্মেষ ঘটেছে।

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি বর্তমানে কবির নামাঙ্কিত রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষাপ্রাঙ্গন জীবদ্দশাতেই ইউরোপ উত্তর আমেরিকা ও পূর্ব এশিয়ায় প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ইংল্যান্ডে ডার্টিংটন হল স্কুল নামে একটি প্রগতিশীল সহশিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপনে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তিনি। অনেজ জাপানি সাহিত্যিককে তিনি প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে ইয়াসুনারি কাওয়াবাতার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

ব্রিটিশ শাসন আমলে ব্রিটিশবিরোধি আন্দোলনে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন রকম আন্দোলনে বিক্ষোভসহ বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত ছিলেন কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে সরাসরি কোন বিশেষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা যায়নি বলে জনশ্রুতি রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথ সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন না। 

কিছু কিছু বিশেষ ঘটনা ছাড়া শাসক শ্রেণি সব সময় তার এই সংশ্লিষ্টতার কথা গোপন করে গেছে, অথবা আলোচনার বাইরে রেখেছে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন যুগাতিক্রমী দার্শনিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক ছিলেন; তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং দর্শনসমৃদ্ধ প্রবন্ধ, ভাষণ পড়লে এটা বোঝা যায়। এ কারণেই বাঙালির ক্ষোভ, বিক্ষোভ এবং বাঙালির সংকট মুক্তির পথ প্রদর্শক রূপে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তাঁর সৃষ্টিশীল সত্তা বিশেষভাবে গুরুত্ব বহন করে। 

তার মত এতো বিদগ্ধ চিন্তক, গভীরতর দৃষ্টির পর্যবেক্ষক এবং প্রগাঢ় বিশ্লেষককে  জানার মতো মনোজগৎ কি আমাদের মধ্যে আদো তৈরি হয়েছে? এমন প্রশ্নও থেকে যায়। বলা যায়, নন্দন ও দর্শন মিলেই রবীন্দ্রনাথ। ঐশ্বর্য্যমণ্ডিত সুবিশাল সাহিত্যভাণ্ডারে সুগভীর উপলব্ধি বা দর্শন এবং বোধতাড়িত নান্দনিক সৃজনের জন্যই যুগ যুগ গণমানুষের মাঝে বেঁচে থাকবেন রবীন্দ্রনাথ। তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।

নিউজজি/এসএফ

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন