রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ , ১৩ জুমাদাউস সানি ১৪৪৬

সাহিত্য

বাঙালির এক চেতনার নাম প্যারীচাঁদ মিত্র

নিউজজি ডেস্ক ২৩ নভেম্বর , ২০২৪, ১৪:২১:০৭

57
  • সংগৃহীত

ঢাকা: বাংলা সাহিত্যের প্রথম ঔপন্যাসিক বলা হয়ে থাকে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী কীর্তিমান সাহিত্যিক ও সাংবাদিক প্যারীচাঁদ মিত্রকে। তিনি ছিলেন বাংলার নবজাগরণের অন্যতম নেতা। তিনি পুলিশি অত্যাচারিতার বিরুদ্ধে লড়েছিলেন এবং সফলও হয়েছিলেন। প্যারীচাঁদ মিত্র নারীশিক্ষা প্রচারে যথেষ্ট উদ্যোগী ও সক্রিয়তার পরিচয় দেন। তিনি বিধবাবিবাহ সমর্থন করতেন এবং বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের বিরোধী ‍ছিলেন।

উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক তিনি। বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস ‘আলালের ঘরের দুলাল’ তারই সৃজনসৃষ্টি। বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে এখনো তিনি স্মরণীয় নাম। একজন ভাষাবিদ্রোহী, নিবেদিত সমাজকর্মী, নিষ্ঠাবান সংগঠক, নব আকাঙ্ক্ষালব্ধ সাহিত্যিক এবং নির্ভীক সাংবাদিক ছাড়াও বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র।

তিনি এমন এক সময়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন, যখন প্রগতিশীল চিন্তা, উদার মানবতাবাদী দর্শন, ব্রাহ্ম ধর্ম-আন্দোলন এবং নাস্তিকতার পাশাপাশি রক্ষণশীল হিন্দুসমাজের দাপট ছিল প্রবাহমান। রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরদের সময়ে বাংলাদেশে আবির্ভূত হয়েছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আর মাইকেল মধুসূদন দত্তের সাহিত্যিক-সাহচর্যে ছিলেন তিনি।  প্যারীচাঁদ মিত্রের কর্মজীবন যেমন বৈচিত্র্যমুখী, তেমনি তাঁর সাহিত্যজীবনও চমৎকারিত্ব আর বিদ্রোহে ঋদ্ধ। সাহিত্যকর্মের জন্যই উত্তরকালের বাঙালির কাছে তিনি সমধিক পরিচিত। একইভাবে বাঙালির কাছে সাহিত্যশিল্পী প্যারীচাঁদ ভাষাশিল্পী হিসেবেও সমধিক স্মরণীয়।

আজ ২৩ নভেম্বর বাংলার নবজাগরণের অন্যতম এই যোদ্ধার প্রয়াণদিন। ১৮৮৩ সালের এই দিনে বাঙালির এই কীর্তিমান পথিকৃৎ মৃত্যুবরণ করেন। প্যারীচাঁদ মিত্র ১৮১৪ সালের ২২শে জুলাই কলকাতার এক বণিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম রামনারায়ণ মিত্র। তিনি কাগজ ও হুন্ডি ব্যবসায়ী ছিলেন। প্যারীচাঁদ মিত্রের ছদ্মনাম ছিল ‘টেকচাঁদ ঠাকুর’। প্যারীচাঁদ মিত্রের শিক্ষাজীবন শুরু হয় পারিবারিক পরিমণ্ডলে।

শৈশবে একজন গুরুমহাশয়ের নিকট বাংলা, পরে একজন মুন্সির নিকট ফারসি শিখেন। ইংরেজি লাভের জন্য ১৮২৭ সালে তিনি হিন্দু কলেজে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলেন। ঐ সময় ডিরোজিও নামে একজন বিখ্যাত অধ্যাপক ছিলেন হিন্দু কলেজে। তিনি তার শিষ্য ও ভাবশিষ্য ছিলেন।

১৮৩৬ সালে প্যারীচাঁদ মিত্রের কর্মজীবন শুরু হয় কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরির ডেপুটি লাইব্রেরিয়ান হিসেবে। পরে তিনি লাইব্রেরিয়ান হিসেবে পদোন্নতি পান এবং আরো পরে প্রতিষ্ঠানটির সেক্রেটারি বা সচিব হন। পাবলিক লাইব্রেরির কাজের পাশাপাশি প্যারীচাঁদ বিভিন্ন ব্যবসার সাথেও জড়িত হয়ে পড়েন।

তৎকালে ইউরোপীয় বণিকদের সঙ্গে সখ্যতা তার ভাগ্য ফিরিয়েছিল। তিনি গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল কোম্পানি লিমিটেড, পোর্ট ক্যানিং র্গ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কম্পনই এবং হাওড়া ড কিং কোম্পানি মতো বিনিয়োগ কোম্পানির অংশীদার ও পরিচালক ছিলেন। ব্যবসায়ী হিসেবেও তিনি ছিলেন সফল।

প্যারীচাঁদ ছিলেন সমাজহিতৈষী ও সংস্কৃতি সেবী। বাঙালি সমাজের কল্যাণে তিনি বহু সংগঠন গড়ে তোলেন। জ্ঞানোপার্জিকা সভা, বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি, ডেভিড হেয়ার মেমোরিয়াল সোসাইটি, রেস ক্লাব, এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড হর্টি কালচারাল সোসাইটি, বেথুন সোসাইটির সাথে তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো, জেল ও কিশোর অপরাধীদের সংশোধন কেন্দ্রের পরিদর্শক, কলকাতা হাইকোর্টের গ্র্যান্ড জুরি, বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য, কলকাতা মিউনিসিপাল বোর্ডের অবৈতনিক ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন।

প্যারীচাঁদ মিত্র বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এবং বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকলেও, পরবর্তীকালে সাংবাদিকতা ও বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্যই বিখ্যাত হয়ে আছেন। তিনি মহিলাদের জন্য একটি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। এক্ষেত্রে তাঁর সহযোগী ছিলেন রাধানাথ শিকদার। প্যারীচাঁদ মিত্র দি ইংলিশম্যান, ইন্ডিয়ান ফিল্ড, হিন্দু প্যাট্রিয়ট, ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া এবং বেঙ্গল সেপক্টেটর পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করতেন। তিনি পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেও সফল হয়েছিলেন। স্ত্রী-শিক্ষা প্রচারেও দিয়েছেন যথেষ্ট সক্রিয়তার পরিচয়।

১৮৫৭ সালে প্রকাশিত হয় তার উপন্যাস ‘আলালের ঘরের দুলাল’। এটি বাংলা ভাষায় প্রথম উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃত। এ-উপন্যাসে তিনি যে-ভাষা ব্যবহার করেছেন, পরে তা আলালী ভাষা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। বলা হয়ে থাকে যে, এই উপন্যাসে তিনি প্রথমবারের মতো বাংলা সাহিত্যের গদ্যরীতির নিয়ম ভেঙে চলিত ভাষারীতি প্রয়োগ করেন। উপন্যাসটিতে তিনি ব্যবহার করেন সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা। উপন্যাসটি ‘দি সপয়েল্ড চাইল্ড’ নামে ইংরেজিতেও অনূদিত হয় ।

‘আলালের ঘরের দুলাল’ ১৯৫৪ সাল থেকে মাসিক পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়ে ১৮৫৮ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশ পায়। কেউ কেউ বলেন আলালের ঘরের দুলাল বাংলা ভাষার প্রথম উপন্যাস গ্রন্থ। আবার করো মতে উপন্যাস নয়, উপন্যাসের লক্ষণাক্রান্ত। অর্থাৎ এটি সার্থক উপন্যাস কিনা এ নিয়ে বিতর্ক আছে অনেক।

অনেকের মতে, আলালের ঘরের দুলাল একটি সামাজিক নকশা। এখানে দেশীয় বন্ধ্যা শিক্ষা ব্যবস্থা, পাশ্চাত্য শিক্ষার অন্ধ অনুকরণ, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিশৃঙ্খলা নিয়ে লেখক নিজের অভিমত প্রকাশ করেছেন। তবে আধুনিক ইংরেজি শিক্ষার আলোকে উচ্চ আদর্শ সম্পন্ন জীবন গঠনকে লেখক স্বাগত জানিয়েছেন। কাহিনী বর্ণনায় কৌতুক আছে। এ গ্রন্থের গদ্য লেখক সচেতনভাবে চলতি ভাষা প্রয়োগ করেছেন। উদ্যোগটি বিশেষভাবে স্মরণীয়। অবশ্য প্যারীচাঁদ নিজের উত্তর জীবনে এ রীতির চর্চা না করে সাধনরীতিতে গদ্য লেখেন।

লেখক বন্ধু রাধানাথ সিকদারের একান্ত অনুরোধে প্যারিচাঁদ মিত্র খুব সহজ সরল ভাষায় এ কাহিনিটি লেখা শুরু করেন। তখন যে কয়টি বাংলা পত্রিকা ছিল সব পত্রিকাগুলো রাশভারী লিখার পিছনে দৌড়াত। সহজ সরল বাংলা ভাষায় কোন লিখা তারা সহজে ছাপাতে রাজী হতো না।

ঠিক সে সময় বন্ধু রাধানাথ সিকদার ও প্যারীচাঁদ মিত্রের যৌথ প্রচেষ্টায় বের হয় ‘মাসিক পত্রিকা’। এই পত্রিকায় তিনি ‘টেকচাঁদ ঠাকুর’ ছদ্মনামে লিখা শুরু করেন- ‘আলালের ঘরের দুলাল’। বইটিতে মোট ত্রিশটি পরিচ্ছদের মধ্যে সাতাশটি পরিচ্ছদ এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিলো।

তিনি লিখেছেন আরো সতেরোটি গ্রন্থ; কিন্তু এই একটি বই-ই বাঙালির কাছে তাঁকে স্মরণীয় করে রেখেছে। নানামাত্রিক বিতর্ক থাকলেও আলালের ঘরের দুলালকেই বলা হয় বাংলাসাহিত্যের প্রথম উপন্যাস। বাংলা উপন্যাস-সাহিত্যের প্রধান সব সমালোচকই আলালের ঘরের দুলালকে, সব সীমাবদ্ধতা আমলে নিয়েই, বাংলা ভাষার প্রথম উপন্যাস বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন।

‘আলালের ঘরের দুলাল’ উপন্যাসে বিশেষত অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে কোলকাতা ও তাঁর নগর কেন্দ্রিক সামাজিক চিত্র আশ্চর্য নিপুণতার সাথে অঙ্কিত হয়েছে। নব্য শিক্ষিত ইয়ংবেঙ্গলদের কার্যকলাপ ও পরিণতি গ্রন্থটির মূল উপপাদ্য বিষয়। প্যারীচাঁদ মিত্র তখন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন যে, ধর্ম ও নীতি হীনতায় উচ্ছৃঙ্খলতার মূল কারণ। শুধুমাত্র জীবনযাত্রার প্রণালীর মধ্যেই রয়েছে এ মরণ দশা থেকে উত্তরণের উপায় ও মুক্তির পথ। নকশার রীতি এই কাহিনির উপর যতটা না প্রভাব ফেলেছে তার চেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে কাহিনির ধারাবাহিকতা, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের বাস্তব চিত্রাঙ্কন।

১৮৬০ সালে স্ত্রী বামাকালীর মৃত্যুর পর প্যারীচাঁদ প্রেততত্ত্ব তথা থিওসফির প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। প্যারীচাঁদের এই মানস-রূপান্তরের প্রতিফলন ঘটেছে গীতাঙ্কুর (১৮৬১), যৎকিঞ্চিৎ (১৮৬৫) অভেদী (১৮৭১), আধ্যাত্মিকা (১৮৮১) – এসব রচনায়। উচ্চাঙ্গসঙ্গীত সাধনার মধ্য দিয়ে আধ্যাত্মিক উন্নয়ন ছিল প্যারীচাঁদের পরম অভীষ্ট।

১৮৮৩ সালের ২৩ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। প্যারীচাঁদ মিত্র বহুমাত্রিক কারণে বর্তমান সময়ে এসেও সবার কাছে প্রাসঙ্গিক বলে বিবেচিত। সমকালীন জীবন ও চলিত ভাষাকে লিখনে নিয়ে আসার দুঃসাহসিক দৃষ্টান্ত প্রথম তিনিই বাংলা সাহিত্যে সংযোজন করেছিলেন। ভাষা ও সাহিত্যের উপনিবেশের বিরুদ্ধে ছিল প্যারীচাঁদ মিত্রের আজন্মের সংগ্রাম। যা আজো বাঙালি সৃজনকামীদের লালিত সংকল্প। তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধার্ঘ্য।

নিউজজি/ পি.এম

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন