শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ , ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

সাহিত্য

একজন সব্যসাচী

নিউজজি ডেস্ক ২৭ সেপ্টেম্বর , ২০২১, ১১:১৯:০৭

446
  • একজন সব্যসাচী

ঢাকা: কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প, চলচ্চিত্র, গান, অনুবাদসহ সাহিত্য-সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার সাবলীল পদচারণার জন্য তাকে ‘সব্যসাচী’ লেখক বলা হয়ে থাকে। ‘কবিতার ধ্বনিসঙ্গীতে, নাটকের আলো আঁধার মঞ্চে, গল্পের অবিরাম বয়নে, এই দেশ ও মানুষের কথা বলেছেন তিনি। বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের আবেগ-অনুভূতি-বিকার সবই খুব সহজ কথা ও ছন্দে উঠে এসেছে তার লেখনীতে। তিনি নির্মল কথাশিল্পী, সব্যসাচী লেখক, কবি ও নাট্যকার সৈয়দ শামসুল হক। সৈয়দ শামসুল হক বহুমাত্রিক সাহিত্য-সৃজনের এক বিস্ময়।    

১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর সৈয়দ শামসুল হক কুড়িগ্রাম মহকুমায় (বর্তমানে জেলা) এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা সৈয়দ সিদ্দিক হোসেন ছিলেন একজন হোমিওপ্যাথ ডাক্তার। মায়ের নাম হালিমা খাতুন। এ লেখকের শিশু ও কৈশোরকাল এই কুড়িগ্রামে কেটেছে। তার বাবা চাইতেন ছেলে ডাক্তারি পড়বে। কিন্তু তিনি ডাক্তারি পড়ার চাপ এড়াতে ১৯৫১ সালে ভারতের মুম্বাই পালিয়ে যান। সেখানে তিনি বছরখানেক একটি সিনেমা প্রোডাকশন হাউসে সহকারী হিসেবে কাজ করেন।  

এরপর দেশে ফিরে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজের মানবিক শাখায়। পরে ১৯৫৪ সালে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। তবে ইংরেজি বিভাগে তার পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনায় ইস্তফা দেন সৈয়দ শামসুল হক। এর কিছু দিন পরেই প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘দেয়ালের দেশ’।

পুরোদমে সাহিত্য চর্চায় নিমগ্ন হওয়ার আগে সৈয়দ হক ঝুঁকেছিলেন চলচ্চিত্র জগতে। বাবার মৃত্যুর পর ১৯৫৬-৫৭ সালে বেশ অর্থকষ্টে পড়ে যান সৈয়দ হক। ওই সময় অর্থের জন্যই তিনি শুরু করেন চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য রচনা। ১৯৫৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সৈয়দ হক ৩০টির মতো চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য রচনা করেন। সৈয়দ হকের লেখা ‘মাটির পাহাড়’, ‘তোমার আমার’, ‘রাজা এল শহরে’, ‘শীত বিকেল’, ‘সুতরাং’, ‘কাগজের নৌকা’ ইত্যাদি চলচ্চিত্র ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা লাভ করে।

সৈয়দ হক চলচ্চিত্রের জন্য গানও রচনা করেন। ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘তোরা দেখ দেখ দেখরে চাহিয়া’, ‘এমন মজা হয় না গায়ে সোনার গয়না’, ‘এই যে আকাশ এই যে বাতাস’, ‘তুমি আসবে বলে কাছে ডাকবে বলে’ ইত্যাদি গান সমৃদ্ধ করেছে বাংলা চলচ্চিত্রকে। 

চলচ্চিত্র অঙ্গনে তার এ ব্যস্ততার মধ্যেও থেমে থাকেনি সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা কিংবা ছোটগল্প রচনা। ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয় তার কাব্যগ্রন্থ একদা এক রাজ্যে। ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত লেখা তার ছোটগল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘তাস’, ‘শীত বিকেল’, ‘রক্ত গোলাপ’ প্রভৃতি।

সৈয়দ শামসুল হকের উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘এক মহিলার ছবি’, ‘অনুপম দিন’, ‘সীমানা ছাড়িয়ে’, ‘নীল দংশন’, ‘স্মৃতিমেধ’, ‘মৃগয়া’, ‘এক যুবকের ছায়াপথ’, ‘বনবালা কিছু টাকা ধার নিয়েছিল’, ‘ত্রাহি’, ‘তুমি সেই তরবারি’, ‘কয়েকটি মানুষের সোনালী যৌবন’, ‘নির্বাসিতা’, ‘খেলারাম খেলে যা’, ‘মেঘ ও মেশিন’, ‘ইহা মানুষ’, ‘বালিকার চন্দ্রযান’, ‘আয়না বিবির পালা’ প্রভৃতি।

সৈয়দ হকের লেখা কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘বৈশাখে রচিত পঙ্‌ক্তিমালা’, ‘বিরতিহীন উৎসব’, ‘প্রতিধ্বনিগণ’, ‘পরানের গহীন ভিতর’ উল্লেখযোগ্য।

প্রায় ৬২ বছরের লেখকজীবনে বাংলা মঞ্চ নাটকেও শক্তিমান এক পুরুষ হিসেবে নিজের লেখনীর প্রমাণ দিয়েছেন সৈয়দ হক। তার লেখা নাটকগুলোর মধ্যে ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ এবং ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ সমকালীন অভিপ্রায়ের এক দৃপ্ত প্রকাশ। সৈয়দ হকের লেখা অন্যান্য নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘গণনায়ক’, ‘ঈর্ষা’, ‘নারীগণ’, ‘উত্তরবংশ’ ইত্যাদি।

অগণিত পাঠকের ভালোবাসার পাশাপাশি দেশের প্রায় সব সেরা পুরস্কারই তার করতলে শোভা পাচ্ছে। পেয়েছেন সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদক। প্রাপ্ত পুরস্কারগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো- বাংলা একাডেমি পদক, আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, পদাবলি কবিতা পুরস্কার, জাতীয় কবিতা পুরস্কার, আইএফআইসি ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার প্রভৃতি।

বাংলা সাহিত্যের এই সব্যসাচী লেখক ২০১৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর রাজধানী ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এর আগে, তিনি প্রায় ৪ মাস লন্ডনের রয়্যাল মার্সডেন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ফুসফুসের সমস্যা দেখা দিলে ২০১৬ সালের ১৫ এপ্রিল তাকে লন্ডন নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তার ফুসফুসে ক্যানসার ধরা পড়ে।

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন