মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ৮ মাঘ ১৪৩১ , ২১ রজব ১৪৪৬

খেলা
  >
অন্যান্য

সরকার পতনের প্রভাব ক্রীড়াঙ্গনে, দুর্ণীতিবাজদের বিচারের দাবি

শামীম চৌধুরী ৬ আগস্ট , ২০২৪, ২২:৫৯:১০

331
  • সরকার পতনের প্রভাব ক্রীড়াঙ্গনে, দুর্ণীতিবাজদের বিচারের দাবি

সোমবার দুপুরে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার পতনের পর তত্বাবধায়ক সরকার গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ফলে ক্রীড়া মন্ত্রানালয়ের মন্ত্রী এবং জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের চেয়ারম্যান নাজমুল হাসান পাপনেরও বিদায় হয়ে গেছে।

অন্তবর্তীকালীন সরকারের একজন পাবেন ক্রীড়া মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব। বিগত প্রতিটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ক্রীড়া ফেডারেশন সমূহে পরিবর্তন এসেছে। সে কারণেই  ছাত্র গণ অভ্যুন্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের রেশটা বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনেও পড়ার শঙ্কা প্রবল।

আর্থিক কেলেঙ্কারীতে অভিযুক্ত পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজির আহমেদ এখনও দাবা ফেডারেশনের সভাপতি পদে বহাল আছেন। ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত হয়েও আওয়ামী লীগের টিকিটে মতিঝিলের সাবেক কাউন্সিলর হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মুমিনুল হক সাইদ চেয়ারে বসেছেন।

শেখ কামালের বন্ধুর পরিচয়ে দেশের বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের নেতৃত্বে ১৬ বছর ধরে বহাল আছেন কাজি সালাউদ্দিন, বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনের মহাসচিব পদে ১২ বছর ধরে বহাল আছেন সৈয়দ শাহেদ রেজা।
সাঁতারু কিংবা সাঁতার সংগঠক পরিচয় না থাকার পরও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পরিচয়ে এম বি সাইফ মোল্লা সাঁতার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে বহাল আছেন। শুটিং স্পোর্টস ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক পদে উপর্যুপরি ৩ মেয়াদে আছেন বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রী নসরুল হামিদের ছোট ভাই ইন্তিখাবুল হামিদ। অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদকের চেয়ারেও আছেন আওয়ামী লীগ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আব্দুর রকিব মন্টু। 
গণ অভ্যুন্থানে বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের আশির্বাদপুষ্ঠ এইসব ক্রীড়া সংগঠকরা এখন স্ব স্ব ফেডারেশনের উপেক্ষিত সংগঠকরদের তীব্র রোষাণলে পড়তে পারেন। দেশে এখন আওয়ামী লীগ বিরোধী জনস্রোতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত সংগঠকরা নিজেরাই এখন আতঙ্কগ্রস্থ। বর্তমান পরিস্থিতিতে এইসব ক্রীড়া সংগঠকরা ফেডারেশনসমূহের দাপ্তরিক কাজ স্বস্তিতে করতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না।   
দীর্ঘ ১৫ বছর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় থাকায় দেশের প্রতিটি ক্রীড়া ফেডারেশন, জেলা এবং বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার নির্বাচন হয়েছে প্রভাবিত। আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা নেই যাদের, তাদের কেউ ক্রীড়াঙ্গনে সম্পৃক্ত হতে পারেননি।শীর্ষ ক্রীড়া ফেডারেশনসমূহের চিহ্নিত গোষ্ঠী আর্থিক দুর্ণীতিতে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে।  
 নির্বাচনের নামে প্রহসন নীরবে সহ্য করেছে ক্রীড়াঙ্গন। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে আর্থিক অনিয়ম নিয়ে গণমাধ্যমে অজস্র রিপোর্ট প্রকাশ পেলেও তার বিচার করেনি এদেশের ক্রীড়া প্রশাসন।
 ক্রীড়া প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিসিবি নিজেদের খেয়ালখুশি মতো তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে। দেশের সকল ক্রীড়া স্থাপনা নির্মাণ, সংস্কার শোভাবর্ধন এবং রক্ষণাবেক্ষনের এখতিয়ার জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের হলেও বিসিবি এই নিয়মের তোয়াক্কা না করে নিজেদের তহবিল থেকে অর্থ খরচ করে ক্রীড়া প্রশাসনের প্রতিপক্ষ হয়েছে ইতোমধ্যে। 
 ১১০০ কোটি টাকা বাজেটে পূর্বাচলে শুরু করেছে শেখ হাসিনা ক্রিকেট কমপ্লেক্স। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং অসহযোগ আন্দোলনের মুখে  আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ায় তার নামে স্টেডিয়াম নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে বিসিবিকে পড়তে হবে প্রতিবন্ধকতার মুখে, তা বলাই বাহুল্য।
বিসিবির ব্যবসায়ী পরিচয়ে ক'জন পরিচালক কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট করে বাজারমূল্যের চেয়ে কম মূল্যে টিভি সত্ব বিক্রি করায় ক্রীড়াঙ্গনে যে চাপা ক্ষোভ ছিল, তা বিস্ফোরিত হতে পারে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের মিডিয়া রাইটস থেকে শুরু করে আর্থিক আয়ের সকল উৎস, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল)-এর মতো আসরের ফ্রাঞ্চাইজি পর্যন্ত বিসিবির ব্যবসায়ী পরিচয়ের পরিচালকদের ভাগাভাগি করার ইস্যুটিও অন্তবর্তীকালীন সরকারের আমলে উপেক্ষিত সংগঠকরা জনসমক্ষে আনতে পারেন।    
ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটকে গলা টিপে হত্যা করা, বছরের পর বছর পক্ষপাতদুষ্ট আম্পায়ারদের দিয়ে পছন্দের ক্লাবের পক্ষে জয় নিশ্চিত করে প্রতিপক্ষ ক্লাব সমূহের রোষানলে এমনিতেই পড়েছে বিসিবি। তৃতীয় বিভাগ বাছাই ক্রিকেট লিগের এন্ট্রির পথ রুদ্ধ করে মাত্র ২টি দলকে এন্ট্রির সুযোগ দিয়ে টসে'র মাধ্যমে চ্যাম্পিয়ন-রানার্স আপ নির্ধারণ করা হয়েছে বছরের পর বছর। 
 আইসিসি, এসিসি এবং বিভিন্ন পৃষ্ঠপোষকদের অর্থায়নে তহবিল উপচে পড়া বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা কখনও গণমাধ্যমকে প্রকাশ করেনি।এখানেই আর্থিক অনিয়ম এবং দুর্ণীতির গন্ধ পাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে বিসিবির বাইরে থাকা পরীক্ষিত সংগঠকরা।
তবে চাইলেই অন্তবর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে), বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি), বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনের (বিওএ) নির্বাচিত কমিটি ভেঙ্গে দিতে পারবে না। 
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারশের (বাফুফে) কার্যনির্বাহী কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা এ বছরের অক্টোবর মাসে। সে মাসে নির্বাচন সম্পন্ন করতে চান বলে সম্প্রতি গণমাধ্যমকে ঘোষণা দিয়েছেন বাফুফে সভাপতি কাজি সালাউদ্দিন। ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফা যেহেতু সরকারের হস্তক্ষেপের বিপক্ষে, তাই বাফুফের নির্বাচিত কমিটির মেয়াদ পূর্তি পর্যন্ত ক্রীড়া প্রশাসনকে অপেক্ষায় থাকতে হবে।
সম্প্রতি শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাচিত কমিটি ভেঙ্গে দেয়ায় আইসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের স্বাগতিক মর্যাদা থেকে শ্রীলঙ্কাকে বাদ দিয়েছে। সে কারণেই বিসিবির নির্বাচিত কমিটি ভেঙ্গে দেয়ার আগেও ভাবতে হবে বিসিবিকে। বিসিবির চলমান নির্বাচিত কমিটির মেয়াদ ২০২৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত থাকায় সে পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হবে ক্রীড়া প্রশাসনকে।
তবে নিরাপত্তাহীনতায় যদি বিসিবির কার্যক্রম পরিচালনা করা অসম্ভব মনে করে গণপদত্যাগ করলে ক্রীড়া প্রশাসনের পক্ষে অন্তবর্তীকালীন কমিটি গঠন করা সম্ভব। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এই ফর্মুলা প্রয়োগ করেই সে সময়ে বিসিবির নির্বাচিত কমিটি ভেঙ্গে দিয়েছিল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি)।
বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনের (বিওএ) বর্তমান কার্যনির্বাহী কমিটির মেয়াদ পূর্ণ হবে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে। সুতরাং গণপদত্যাগ ছাড়া এই কমিটি মেয়াদ পূর্তির আগে ভেঙ্গে দিলে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির নিষেধাজ্ঞাদেশের ঝুঁকিতে পড়বে বিওএ।    
আগামী ৩ থেকে ২০ অক্টোবর মিরপুর এবং সিলেটে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা আইসিসি উইমেন্স টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। অন্তবর্তীকালীন সরকারের আমলে ১০ দলের এই মেগা আসর আয়োজন ক্রীড়া প্রশাসনের জন্য চ্যালেঞ্জ।তার আগে গঠন করতে হবে লোকাল অর্গানাইজিং কমিটি (এলওসি)। বাংলাদেশে চলমান সংকটময় পরিস্থিতিতে আইসিসি নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বিকল্প ভেন্যুর কথাও ভাবছে।
সে কারণে দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত ক্রীড়া সংগঠকদের ক্রিকেট বোর্ডে দ্রুত ফিরে আসার পথ মসৃন নয়। তবে সময় এসেছে দুণীতিমুক্ত ক্রীড়াঙ্গন প্রতিষ্ঠায় অন্তবর্তীকালীন সরকারের বিশেষ উদ্যোগ গ্রহন।
দুর্ণীতি দমন কমিশনকে এক্ষুণি ক্রিকেট বোর্ড, ফুটবল ফেডারেশন, অলিম্পিক এসোসিয়েশনসহ ধনাঢ্য ক্রীড়া ফেডারেশনসমূহের দুর্ণীতির প্রকৃত চিত্র জনসমক্ষে আনা এখন সময়ের দাবি। আর্থিক অনিয়ম-দুর্ণীতিতে অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা দেয়ার দাবিটা জোরালো হচ্ছে।

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন