শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ , ১৯ রমজান ১৪৪৫

অন্যান্য
  >
নারী দিবস

নারী ও তার অধিকার

কায়ছুন্নাহার রূপা ৭ মার্চ , ২০১৯, ১৪:৪৮:১৪

  • নারী ও তার অধিকার

নারী অধিকার পরিভাষাটি বলতে বোঝায় এক ধরনের স্বাধীনতা, যা সকল বয়সের মেয়ে ও নারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়। এই অধিকার হতে পারে প্রাতিষ্ঠানিক, আইনানুগ, আঞ্চলিক সংস্কৃতি দ্বারা সিদ্ধ, বা কোনো সমাজের আচরণের বহিঃপ্রকাশ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই অধিকারকে অস্বীকার করতেও দেখা যায়। সীমান্ত পেরিয়ে বিভিন্ন দেশে এই অধিকারের বিভিন্ন রকম সংজ্ঞা ও পার্থক্য দেখা যায়, কারণ এটি পুরুষ ও ছেলেদের অধিকারের থেকে ভিন্ন। এবং এই অধিকারের সপক্ষে আন্দোলনকারীদের দাবি যে, নারী ও মেয়েদের অধিকারের প্রচলনের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক দুর্বলতা রয়েছে।

যেসব বিষয়ের ক্ষেত্রে নারী অধিকার প্রযোজ্য হয়, তা সুনির্দিষ্ট না হলেও এগুলো মূলত সমতা ও স্বয়ংসম্পূর্ণতাকেন্দ্রিক। যেমন: ভোটদানের অধিকার, অফিস-আদালতে একসাথে কাজকর্ম করার অধিকার, কাজের বিনিময়ে ন্যায্য ও সমান প্রতিদান (বেতন ও অন্যান্য সুবিধাদি) পাবার অধিকার, সম্পত্তি লাভের অধিকার, শিক্ষার্জনের অধিকার, সামরিক বাহিনীতে কাজ করার অধিকার, আইনগত চুক্তিতে অংশগ্রহণের অধিকার, এবং বিবাহ, অভিভাবক, ও ধর্মীয়গত অধিকার। নারী ও তাদের সহযোগীরা কিছু স্থানে পুরুষের সমান অধিকার আদায়ের সপক্ষে বিভিন্ন প্রকার ক্যাম্পেইন ও কর্মশালা চালিয়ে যাচ্ছে। 

নারীর অধিকারের প্রশ্নে সাংবিধানিক ও আইনগত জোরালো সমর্থন থাকা সত্ত্বেও পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিদ্যমান থাকার কারণে আমাদের সমাজে নারীদের এখনো সমঅধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। প্রতিদিনই অসংখ্য নারীর মানবাধিকার হরণ হচ্ছে, রাষ্ট্রের সাংবিধানিক নিশ্চয়তা ভুলুণ্ঠিত হচ্ছে এবং নারীর অধিকারহীনতা ও অসহায়ত্ব বেড়ে চলেছে। আমাদের দেশে নারীদের অধিকার সচেতনতার অভাব এবং বিদ্যমান আইনের প্রয়োগগত সীমাবদ্ধতার কারণে নারীরা একদিকে যেমন তাদের ন্যায্য অধিকার ভোগ এবং আইনি সহায়তা প্রাপ্তির সুফল থেকে বঞ্চিত, অন্যদিকে বৈষম্যমূলক আইনের উপস্থিতি তাদের অবস্থাকে আরো বেশি নাজুক করে তুলছে। এই বাস্তবতায় নারীদের মধ্যে অধিকার সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট-বাংলাদেশ যৌতুক, বাল্যবিবাহ, পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ, উত্যক্তকরণসহ নারীর প্রতি সকল প্রকার সহিংসতা বন্ধে ধারাবাহিক প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নারী নেত্রীদের নারীর অধিকার ও আইনবিষয়ক শিক্ষা দিয়ে থাকে।

যেসব আইনি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয় সেগুলো নীচে উল্লেখ করা হলো:

এসিড নিয়ন্ত্রণ আইন – নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন – যৌতুক নিরোধ আইন – মুসলিম বিবাহ ও তালাক আইন – মুসলিম বিবাহ ও তালাক বিধিমালা – মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ – মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন, – বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন – পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ।

এবার আসা যাক, বহুল প্রচলিত একটা বিষয়ে। সেটি হচ্ছে- ইভটিজিং । ইভ অর্থ হচ্ছে ‘নারী’ এবং টিজিং-এর মানে হচ্ছে ‘বিরক্ত বা উত্যক্ত করা’। সহজ ভাষায় বলতে গেলে ইভটিজিং হচ্ছে নারীদের উত্যক্ত করা। ইভটিজিংয়ের সত্যিকার অর্থ হচ্ছে, ‘কেউ নারী বলেই তাকে উত্যক্ত করা’৷ বাক্যটা সামান্য বড় করার ফলে পুরো বিষয়টিতে লুকিয়ে থাকা সবচেয়ে জরুরি কথাটা বের হয়ে আসে। জানা যায়, নারীদের কেন উত্যক্ত করা হয় এবং কেন ঘটনাটিকে একটি ‘টার্ম' দিয়ে প্রকাশ করতে হয়৷ ইভটিজিং বলতে যেমন একটা চিত্র চোখে আসে, কিছু মেয়ে স্কুলে যাচ্ছে আর বখাটে কিছু ছেলে পথে দাঁড়িয়ে দুটো শব্দ উড়িয়ে দিচ্ছে বা শিস দিচ্ছে৷ বাস্তবে ইভটিজিং বিষয়টা এখানেই সীমাবদ্ধ না৷

এর প্রয়োগ এতই ব্যাপক যে, ‘ইভটিজিং’ শব্দটা পুরো ঘটনা ব্যাখ্যা করার সাপেক্ষে অনেক হালকা একটা শব্দ৷ আপনার অফিসে একজন নারীকে হেয় করে কিছু বললেন – সেটা ইভটিজিং৷ পুরুষ শিক্ষক নারী শিক্ষার্থীকে তুচ্ছজ্ঞান করলেন বা কোনো দায়িত্ব থেকে সরিয়ে রাখলেন – সেটাও ইভটিজিং৷ বাসে মহিলা সিট খালি নেই বলে একজন নারীকে কন্ডাক্টর বাসেই উঠতে দিলেন না – সেটাও ইভটিজিং৷ এমনকি পরিবারে বাবা ঠাট্টার ছলে মাকে বললেন, ‘মেয়েলোকের বুদ্ধি কম’ – এটাও ইভটিজিং৷

প্রতিদিনের এ রকম ছোট ছোট অসংখ্য ঘটনা একটি সামাজিক ধারণাতে এনে সমাজকে দাঁড় করায়, তা হচ্ছে — একজন মানুষ নারী বলেই তার শক্তি কম। অপরদিকে, একজন শুধু পুরুষ বলেই তার শক্তি বেশি৷ আর সেই শক্তিবলে পুরুষ চাইলেই নারীকে হেয় করতে পারে, তাকে তুচ্ছ করতে পারে, তাকে নিয়ে উপহাস করতে পারে এবং তাকে অবহেলাও করতে পারে – এর নামও ইভটিজিং! সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে- এমন কোনো মেয়ে পাওয়া যাবে না এদেশে যারা এখনো ইভটিজিং-এর স্বীকার হয়নি।

অথচ কখনো শুনতে পাওয়া যায়নি কোনো পুরুষ কিংবা ছেলে-মেয়েদের কাছ থেকে উত্যক্তের শিকার হয়েছে। আমার এক ফ্রেন্ড-এর সাথে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা আমি শেয়ার করছি- একটা চলন্ত বাসে আমার ফ্রেন্ড এবং তার পাশে একটি ছেলে বসেছিল। ছেলেটি আমার ফ্রেন্ডের সাথে অশালীন আচরণ করে বিধায় সে চিৎকার করে কথা বলতে শুরু করে। অথচ বাসের বাকী সব লোক নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছিল।

সবশেষে, কজন বলে উঠল আপনি মেয়ে হয়ে এত জোরে কথা বলছেন কেন? ভুল হয়ে গিয়েছে । বাদ দিন, চুপচাপ বসে থাকুন । এই একই ঘটনাটা যদি একটা ছেলের ক্ষেত্রে ঘটতো তাহলে এর রেজাল্ট কী হতো? আদৌ কি ছেলেদের সাথে এমন ঘটনা ঘটেছে নাকি ঘটবে কখনও? আবার দেখা গেছে, যেসব পুরুষ নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করছে, স্লোগান দিচ্ছে ঠিক তারাই নারী অধিকার আইন মানছে না।

প্রশ্ন হচ্ছে - নারী অধিকার নিয়ে এত লোক দেখানো মঞ্চ নাটকের কী প্রয়োজন? যেখানে একজন নারী তার পরিবার থেকেই অধিকারটা হারায়! নারী অধিকার নিয়ে কথা বলতে এর সাথে আরো একটি বিষয় সম্পৃক্ত হচ্ছে- নারী নির্যাতন। নারীরা নির্যাতিত হয়। সেই ১৯৭১, ৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকেই নারীরা নিপীড়িত। প্রাচীন থেকে তাদের ঘরবন্দি একটা নিয়মে বেঁধে ফেলা হয়েছে। এখানে অবাক করার বিষয় হচ্ছে- নারীরা শুধু পুরুষ নয়, বরং নারী দ্বারাই বেশি নির্যাতিত। যখন কোনো মেয়েকে যৌতুক দিয়ে বিয়ে দেয়া হয় তখন যৌতুকের টাকা না দিতে পারায় শাশুড়ি, ননদ মিলে বধূদের নির্যাতন করে। বিষয়টা এমন যে নারীরাই নারীদের শত্রু। এই লজ্জা কোথায় রাখি? এই ডিজিটাল বাংলাদেশে দেশ আসলে কতটা, কোন পর্যায়ে এবং কীভাবে আগাচ্ছে সেটিই হচ্ছে প্রশ্ন!

এইসব বিভিন্ন ঘটনা মাঝে মাঝে নিজের বিবেককে প্রশ্ন করে আমরা স্বাধীন তো? আমি কি আদৌ নিরাপদ? তবে আশা করা যায়, দেশের প্রত্যেকে নিজ উদ্যেগ্যে প্রত্যেকের সম্মান বজায় রাখলে তবেই সকলের সৎ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে, প্রতিষ্ঠিত হবে সম অধিকার আইন।

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন