শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ , ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

অন্যান্য
  >
নারী দিবস

চেনা অচেনা

সিনথিয়া ইসলাম সিলভি ৭ মার্চ , ২০১৯, ১৪:৪৫:৩৬

  • চেনা অচেনা

শায়লার মন আজ খুবই অস্হির। বারবার ব্যাগ থেকে ফোন বের করে সময়টা দেখে নিচ্ছে। এখন রাত সাড়ে ন'টা বাজে। বাসায় পৌঁছতে কমপক্ষে দশটা বাজবে। আজ অফিসের কাজ শেষ করতে একটু বেশিই সময় লাগল। আবার রাস্তায়ও আজ অনেক জ্যাম। বাসায় যাওয়ার পর শফিকের অভিব্যক্তিটা কেমন হবে সেটাই ভাবছে। শফিক শায়লার স্বামী। আজ সে বাসায় একটু তাড়াতাড়ি ফিরেছে। ইতোমধ্যে শফিক শায়লাকে ২-৩ বার ফোন করে ফেলেছে। ফোনে কথা বলেই শায়লা বুঝতে পারল আকাশে আজ কালো মেঘের ঘনঘটা, প্রবল ঝড়ের আশঙ্কা।
 
কিন্তু কেন? আমি কী করেছি, আমার অপরাধটা কী? সেসব প্রশ্নের উত্তর শায়লা কখনো পায় নাই। শায়লা তো ইচ্ছে করে দেরি করে নাই। যেদিন কাজের চাপটা একটু বেশি থাকে সেদিন একটু দেরি হয়ে যায়। শফিক তো প্রায় সবসময় দেরি করে ফেরে, শায়লা তো কখনো বিরক্তির চোখে তাকায়নি, বরং তার জন্য জেগে বসে থাকে। হাসিমুখে দরজা খুলে দেয়, তাকে খাবার বেড়ে দেয়। তাহলে শায়লাকে কেন এত কথা শুনতে হয়। শায়লার খুব ইচ্ছা করে অফিস থেকে ফেরার পর দুজন একসাথে কিছুক্ষণ গল্প করবে, অফিসে কী কী মজার, বিরক্তির ঘটনাগুলো ঘটল সেগুলো বলবে, শফিকের কথা শুনবে। কিন্তু... ম্যাডাম পৌঁছে গেছি। ড্রাইভারের কথায় সম্বিত ফিরে পেল শায়লা।
 
 
 
দরজা খুলেই প্রশ্নের বাণে জর্জরিত হতে হলো শায়লাকে।
 
শফিক : আসার দরকার ছিল কি, আজ রাত অফিসেই থেকে যেতা। তোমার বসও খুশি হতো, আর তুমিও। তোমার তো পাঙ্খা গজিয়েছে, উড়ো উড়ো ভালো করে উড়ো, তোমার সাথে ওড়ার মানুষেরও তো অভাব নাই। জানি না এত রাতে কই থেকে ফিরলেন তিনি। আমি আজ স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছি আমার সাথে থাকতে হলে এত রাতে বাসায় ফেরা চলবে না। দরকার হলে তোমার চাকরি করা বন্ধ। আমি যেভাবে বলব সেভাবে তোমাকে চলতে হবে। এখন তোমার পোষাইলে থাকো, না পোষাইলে যাওগা।
 
শফিকের কথার সাথে সাথে আরো একজনের কথা যুক্ত হলো। পাশের ঘর থেকে শায়লার শাশুড়িও বলছে, ‘আমি আগেই কইছিলাম, বউরে চাকরি করতে দিস না, মাইয়া মানুষের বাইরে যাওয়াই ঠিক না, এরা শুধু সংসার শামলাবে আর বাচ্চাকাচ্চা মানুষ করবে। বাড়ির বউ এত রাতে বাড়ি ফিরলে মানুষ কী বলবে। আরো বিভিন্ন ধরনের নোংরা নোংরা কথার পিনগুলো একের পর এক বিদ্ধ করল শায়লার মনে। শায়লা একটা কথাও বলল না, সোজা বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে দিলো। শাওয়ারের পানি আর চোখের পানি কতদিন যে এ রকম মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে তা শুধু শায়লাই জানে। পরদিন সকাল- কলিং বেলের শব্দটা শুনে দরজা খুলে দিতেই কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল রাবেয়া। ওর হাতে, কপালে, ঠোঁটের কাছে কাটা দাগ। রাবেয়া শায়লাদের বাসায় কাজ করে।
 
শায়লা : কিরে কাঁদছিস কেন? আর তোর হাতে কপালে কি হইছে? আজকেও কি তোর স্বামী তোকে মারছে?
 
রাবেয়া: হ, ম্যাডাম আইজকা আমারে আবার মারছে। ট্যাকা চাইছিল, আমি কইছি তুমি জুয়া খেইলা ট্যাকা সব শেষ কইরা ফালাও, আমি তুমারে ট্যাকা দিমু না। আর হে ট্যাকার লাইগা আমার এত ছোডো মাইয়ারে এক বুইড়ার সাথে বিয়া দিবো। আমি কইছি আমি আমার মাইয়ারে ওহন বিয়া দিমু না, আমার মাইয়ারে আমি লেহাপড়া শিখামু। হে কিছুতেই রাজি না। কই মাইয়াগো এত লেহাপড়া শিকাইয়া কি হইবো। এসব লইয়া আমার সাথে রাগারাগি কইরা গাছের শুকনা ডাল দিয়া আমারে মারছে।
 
শায়লা : তোকে তো কত বলেছি থানায় যা, কেস কর তোর স্বামীর নামে তুই তো রাজি হোস না।
 
রাবেয়া : কি কন ম্যাডাম আমি গরিব মানুষ, আর আমার তো কেউ নাই, এসব থানা পুলিশের ঝামেলা ক্যাডা করবো? আর এসব করতে ম্যালা ট্যাকাও লাগে।
 
শায়লা : তাই বলে এসব অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করবি? অন্যায় করা আর অন্যায় সহ্য করা সমান অপরাধ। শোন অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে আমি এখন যাই, অফিস থেকে এসে তোর সাথে কথা বলব।
 
আজ অফিসে শায়লার কাজে মন বসছে না। নানারকম চিন্তা মাথায় ঘুরছে। রাবেয়ার কথাটাও ভাবছে। শায়লা যে রাবেয়াকে বলল অন্যায় সহ্য করাও সমান অন্যায়। অথচ সেও তো কত অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করে আসছে। প্রথম প্রথম প্রতিবাদ যে করে নাই তা নয়। কিন্তু এতে আরো দ্বিগুণ কথা শুনতে হয়েছে। যখনি শায়লা প্রতিবাদ করেছে তখনই তাকে শুনতে হয়েছে, ‘মুখে মুখে তর্ক করবা না, মুখে মুখে তর্ক করা আমার একদম পছন্দ নয়। আসলে মেয়েদের বেশি পড়ালেখা করানোই উচিত না, একটু পড়ালেখা শিখলেই তারা নারীবাদী হয়ে ওঠে। এদের আসলে দাসী বানিয়ে পায়ের তলায় রাখা উচিত। গ্রামের একটা মূর্খ মেয়ে বিয়ে করতাম, থাপ্পড় দিয়ে বসায় রাখতাম বসে থাকতো।’
 
আরো কত কত কথা। রাবেয়া মার খেয়ে শরীরে কতটা ব্যথা পেয়েছে জানে না শায়লা, কিন্তু প্রতিনিয়ত তার মনে যে নোংরা কথাগুলোর পিন ফুটানো হয়, সেটার যন্ত্রণাও মার খাওয়ার চেয়ে কোনো অংশে কম না। আসলে সব লেভেলের মেয়েরাই নির্যাতনের স্বীকার হয়, তবে একেকজনের নির্যাতনের পদ্ধতি একেক রকম।
 
মাঝে মাঝে শায়লা ভাবে চাকরি ছেড়ে দেবে, কিন্তু চাকরি ছেড়ে দিলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? আগে তো চাকরি করত না, তখনো তাকে অনেক কথা শুনতে হতো। শায়লাকে ফেসবুক ব্যবহার করতে হতো শফিকের নির্দেশনা অনুযায়ী। কোন ছবি দেয়া যাবে, কোন ছবি নয়, স্ট্যাটাসে কী লিখা যাবে, কী লিখা যাবে না, চ্যাট তো সম্পূর্ণ নিষেধ, বাইরে কাজে গেলেও প্রতিটা মিনিটের হিসেব দিতে হতো। কার সাথে মেশা যাবে, কার সাথে না, সবকিছু ঠিক করে দিতো। এখন তো অফিসের সময়টুকু অন্তত এসব শুনতে হয় না। এসব ভেবে শায়লা আর চাকরি ছাড়ে না।
 
তাছাড়া ওর মিলি আপুর কথাও মনে পড়ে। মিলি আপুও তো একজন শিক্ষিত মানুষ, উনি চাকরি করেন না। তাতেও তো মিলি আপুর কম কষ্ট সহ্য করতে হয় না। মিলি আপু জানে তার স্বামীর একাধিক মেয়ের সাথে সম্পর্ক, বউয়ের সামনেই অন্য মেয়েদের সাথে ফোনে কথা বলে, ঘুরে বেড়ায়, দেশের বাইরেও ঘুরতে যায়। এতসব জেনেও মিলি আপুকে সব সহ্য করতে হয়। টাকার কোনো অভাব নেই মিলি আপুর, কিন্তু শান্তির ছিটেফোটাও কি কিছু আছে? অথচ বাইরে থেকে বোঝার কোনো উপায়ই নাই সে এতটা অসুখী। ঐ যে কষ্ট সব লেভেলেই আছে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত। কিন্তু একেকজনের কষ্ট একেক রকম। এতসব কষ্ট পাওয়ার একটাই কারণ। কারণ তারা মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়েছে। ‘জন্মই যেন আজন্ম পাপ।’
 
দুপুরে খাওয়ার বিরতিতে কলিগরা এক সাথে গল্প করছে। রিতা আপাকে সবাই নিউজ চ্যানেল বলে ডাকে। সব মানুষের সংসারের খবর সে রাখে।
 
রিতা : জানো শায়লা কাল জলিকে দেখলাম শর্ট একটা ড্রেস পরে রাস্তায় একটা লোকের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। অথচ স্বামীর সাথে সারাক্ষণ ঝগড়া করে, ওর স্বামী নাকি অন্য মেয়েদের সাথে চ্যাট করে, পার্টিতে যায়, ড্রিংকস্ করে। আরে পুরুষ মানুষ তো একটু আধটু এসব করবেই তাই বলে সারাক্ষণ ঝগড়া করতে হবে। যত যাই বলো মেয়েদের একটু সহ্য করতেই হয়, পুরুষ মানুষের সামনে একটু নরম থাকতেই হয়। আরে তোর স্বামী অন্য মেয়েদের কাছে যায় কেন, নিশ্চয়ই তোর কোনো কমতি আছে, তোর স্বামীকে তুই ধরে রাখতে পারিস না এটা তোর ব্যর্থতা।
 
শায়লা: আপা কিছু মনে করবেন না। একই কাজ যদি জলি করত তাহলে আপনি কখনো বলতেন না জলির স্বামীর দোষ, আপনি বলতেন জলি নোংরা মেয়ে, খারাপ মেয়ে। এটাই আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। পুরুষদের সাত খুন মাফ, আর মেয়েদের পায়ে পায়ে দোষ। কাকে কী বলব- আমরা মেয়েরাই তো মেয়েদের সম্মান করতে পারি না, পুরুষদের কাছ থেকে কীভাবে আশা করি? মেয়েদের সামান্য ছেলেদের সাথে কথা বলতে দেখেই এক কথাই তাকে বিচার করে ফেলি খারাপ মেয়ে হিসেবে। তাদের পোশাক দেখে এক কথায় তার চরিত্র বলে দিই। আমরা মেয়েরাই আমদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে পারি না। সমাজটা কীভাবে বদলাবে?
 
 

শায়লা : এটাই আপনাদের পুরুষদের সমস্যা। কোনো যৌক্তিক কথা বললেই আপনারা বলেন নারীবাদী, নেত্রী, বক্তৃতা ইত্যাদি ইত্যাদি। আর নারী দিবস কেন? নারী দিবসেও লাখ লাখ নারী অবহেলা, নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছে। সবচেয়ে কষ্টের বিষয়- মেয়েরা সবচেয়ে বেশি পরিবার থেকেই নির্যাতিত হচ্ছে। জন্ম থেকেই তাদের দেখা হয় বোঝা হিসেবে। আমরা নারীরা কোনো আলাদা করে দিবস চাই না। আমরা আলাদা করেও কোনো সুযোগ সুবিধা চাই না। আমরা চাই পুরুষদের প্রতি সমাজের যে দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের প্রতিও সেই একি দৃষ্টিভঙ্গি থাকুক। প্রাপ্য সম্মানটুকু দিলেই হবে, আলাদা করে কোনো কিছু চাই না। তখন আর নারী কোঠা, নারী দিবসের আলাদা করে প্রয়োজন হবে না। হঠাৎ করে সবাই কেমন চুপ হয়ে গেছে। শায়লা আজ অজান্তেই অনেক কিছু বলে ফেলেছে। কিন্তু কথাগুলো বলার পর খুব হালকা লাগছে তার। এক মিনিট পর নীরবতা ভেঙ্গে সবাই যে যার কাজে গেল। আজ শায়লা অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়িই বের হলো।

 

আজ ৮ মার্চ। রাস্তায় কয়েক জায়গায় সভা সমাবেশ দেখল। বিভিন্ন ব্যানারে নারীদের নিয়ে বিভিন্ন ভালো ভালো কথা। সেসব দেখলে ভালোই লাগে। কিন্তু রূপকথার মতো মনে হয়। তবে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে সমাজে। যেমন কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ আগের চেয়ে অনেকটা বেড়েছে। সব সেক্টরেই এখন মেয়েরা কাজ করছে। যদিও অনেক প্রতিবন্ধকতাও আছে। সব জায়গায় মেয়েরা নিরাপদও নয়। হয়তো আস্তে আস্তে পরিবর্তন আসবে।

 

বাসায় ঢুকতেই শফিক বলল, তাড়াতাড়ি রেডি হও নারী দিবসের একটা আলোচনা অনুষ্ঠানে যেতে হবে, তোমাকেও নিয়ে যেতে বলেছে। অনুষ্ঠানে দেখলাম মিলি আপু ও মিলি আপুর স্বামীও আছে। মিলি আপু কী যে হাসিখুশি একজন মানুষ, তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই তার ভেতরটা। একেকজন করে বক্তৃতা দিচ্ছেন, কত কত ভালো ভালো কথা, কথাগুলো শুনে মন জুড়িয়ে যায়। নারীরা কেউ কেউ তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছে। এক পর্যায়ে শফিককে ডাকা হলো কিছু বলার জন্য। শফিক প্রথমেই বলল, নারীদের অধিকার নিয়ে। নারীদের পুরুষের মতো সমান অধিকার থাকা চাই, নারীদের প্রথমে পরিবার থেকে সম্মান করা উচিত তাহলে সমাজও নারীদের সম্মান করবে। পুরুষের যেমন স্বপ্ন দেখার অধিকার আছে নারীদেরও আছে আরো অনেক অনেক নারী অধিকার মূলক কথা। শায়লা মনোযোগ দিয়ে শফিকের কথাগুলো শুনছে। আজ শফিককে তার বড্ড অচেনা লাগছে, বড্ড অচেনা।

 

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন