বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১ , ৯ শাওয়াল ১৪৪৫

অন্যান্য
  >
নারী দিবস

আমিই দুনিয়া

জান্নাতুল ফেরদৌসী সনি ৭ মার্চ , ২০১৯, ১৪:৪৪:০৪

  • আমিই দুনিয়া

রাস্তায় বিশাল ভিড়। হচ্ছে হয়তো কোনো গোল। রাস্তাগুলো আমার নয়, আমাদের নয়। তবে ওদের হাত ধরে গেলে আমরাও যেতে পারি। ওদের বলে যাদের আলাদা প্লেটে খেতে দিচ্ছি তারাই আমাদের জন্য ভিন্ন একটা কামরা প্রস্তুত করে দেয়। ওদেরকে আমরা এই অচেনা নগরে খুব অবলম্বন করি। ঠিক নবকুমার যেমন বাঘের চামরায়-পাতা বিছানায় ঘুমিয়েছে, আর অপেক্ষায় ছিলো কখন সেই আলগানো রূপসী আসবে! তেমন করে আমরা অপেক্ষায় থাকি সেই আলাদা ঘরে বসে। তারপর ওরা একজন নয়, দুজন নয়, অনেকেই নয়, সকলেই আসে। শুধু এক এক করে আসে। এই শুধু ব্যবধান।

ওদের হাত ধরে না যেয়ে নিজেই যদি নিজের রাস্তা চিনে নিতে চাইতাম। তখন ওরা আসতো একসঙ্গে সবাই। সবাই ধরে টানতো একটা দড়ি, একটা গর্তে একসঙ্গে সবাই ঢোকার জন্য মারামারি করতো। ওদের মারামারি কাটাকাটির চোটে গর্ত এবং গর্তের আশপাশের কয়েকটি সড়ক ছিঁড়ে ছিবলে লণ্ডভণ্ড হয়ে যেতো। বন্ধ হয়ে যেতো কোনো কোনো যাতায়াত।

তাতে কী হতো?

কিছু হারিয়ে কিছু পাওয়া যেতো। আর এটাই নতুন নতুন নগর পত্তনের ইতিহাসের মূলে রয়েছে। তবু আমাদেরও রাস্তা তো হতো। একেবারেই আমাদের রাস্তা।

এমন একটি রাস্তা খুঁজতে যেদিন দুনিয়া প্রথম ঠোঁটে কড়া করে লিপস্টিক নিচ্ছিলো তখন অনেক রাত, অনেক গভীর কোনো ক্ষণ, বাইরের দূরে অচেনা কুয়াশা ঢাকা রাতের বিছানায় থেকে থেকে কুকুরগুলো আড়মোড়া ভাঙ্গছে, কঠিন পরিশ্রমী সময় পার করে যেমন শরীরকে ছেড়ে দিই কয়েক ন্যানো সেকেন্ডের জন্য হাতের উপর। ঘেয়ো কুকুরগুলোও গা ঘষছিলো একেবারে তার বন্ধ দুয়ারের দেয়ালের গায়ে। এই শব্দগুলো তার পরিচিত ছিলো, তার জন্যই হাহাকার করছে এরা, বেরুলেই হামলে পড়বে। একে ঘেয়ো কুকুর, তার উপর চেনাজানা, তাই সহজ একটি প্রস্তুতি ছিলো, কেমন করে বন্দিত্ব ঘুচাবে আর খোলা দরজার চিপায় ওদের লোলঝরা ঘৃন্যমুখগুলো দুমড়ে মুচড়ে ভেঙ্গে দেবে এবং দিয়েছে তখনই।

তারপর নদীর মতো রং ঠোঁটে, সে দর্প ভরে হাঁটছিলো এপার ওপার, সকাল হলেই মায়ের কাছে যাবে। মা!!! সেসব স্বপ্ন নেমে এলো চোখে কুচকাওয়াজ করতে করতে-

কী অইলো মা?

-কী?

-আঁইডা ফানিগিন শইল্লের মইধ্যে হালাও কেন?

-কী কইরবো? গোলাপজল ছিডায়া ধুইবো নাই? এই শরীল দিয়া কী অইবো। কুনো কাজে লাগে না, হুদা হুদা পইসা নষ্ট। কষ্টের কামাই ঠেং তুলি খাইতে বহুৎ মজা তো। বুইজবি কী?

-মা, তুমি মোরে ছাইড়া থাইকবা, আমার শরীলডা প্রত্তি রাইত কতোজনে আই ঘাইডবো আর তোমার বুঝি ভালা লাইগবো?

-অইছে অইছে, আর কুয়ারা দেয়ান লাইগদোনো। শরীল খাউইন্না জিনিস, একজনে খাইলেও খাইবো চাইরজনে খাইলেও খাইবো। একজনে খাইলে তোর একলার সুখ, দশজনে খাইলে সংসারের বেগ্গুন মাইনষে তিনবেলা কিছু খাই বাঁইচতাইরবো। হেগিন তোরেকে বুজাইবো? তোর তো তিন দিনের ইসকুলের গিয়ান অখন পিসকুল দিয়া বাইর অইতাছে।

সর ইয়ানতেন, যা কর কর।

-মা সইবো গো, কিন্তুক কইলজাডা জইলবো মোর। মোর কইলজাডা কেরুম জানি মুচরাইতাছে মা। তুমার মতন মুই এগিন কেমনে সইজ্জো করুম? তুমার মতন মুইও রাস্তাত থাকুম মাইয়া পোলাইন লই? কোনোদিন কি মুইও কইতাইরুমনা পোলাইনেরে কে হেগুনের বাপ। মা এগিন তুঁই কেমনে মোরে কও?

-কেমনে কই বুজচ্ছা? হারাডা জীবন গতর বেচি নিজের পেট চালাইছি। একলা পেট, একলা কষ্ট, তোরে আর তোর ভাইরে দিই হেতেরা যার যার মতন চলি গেছে, কুনোদিন টোগাইনি ফাইছি, ফাইলেও কোনো লাভ নি অইতো জীবনে? বড় বড় অবিছারেরা, বেশ্যার গর্ভের পোলাইনেরে কোনোদিন বুঝি নিতো? নিতো না লা নিতো না। কিন্তুক গর্ভ তো মোর, মোর রক্ত, মুই কই হালামু?

আর ফারিনা। এইবার নিজেগোডা নিজেরা দেই ল..... 

এক দুয়ার আর কতোদিন খুলি থুম? কলকব্জা সব জং ধরি গেছে, আইয়ে সব ভালা ভালা মানুষ, এই ফুরান দুয়ারের আর দাম নাই গো মা, নিজের পত নিজে না ধইরলে উয়াস থাইকতো অইবো।

-মা হেই বেডারা মোগো বাপ কিল্লাই মা?

পেট তোয়ার, রক্ত তোয়ার, বাইর অইছি তোয়ার পেডের নিচে দি। তইলে হিয়ারা কিয়ারছে?

-অ, মা বেডারা তোর মার লগে থাইকছে দেই তো তোর মার গর্ভে তোরা আইছত। হিয়ারা কিয়াইরছে অনো বুজচ্ছা?

-না মা, মুই বুজি না। বুইজদাম চাই মা।

-যা, হর ইয়ানতেন। বুজোন লাইগদোনো।

-ভাইরে তো কও না তার শরীল বেইচতো, কেন মা? ভাইর শরীলের কি কোনো দাম নাই? ভাইতো মোর বড়, ভাইতো ত আরো টিয়া দিছে হেদিন রূপালিরে হিগ্গারলগে হোওনের লাই?

-আরে বেশ্যার ঝি, খানকি মাগি এগিন কী ক? হাই হাই, হাগল অই গেছে অয়।

-কিল্লাই মা? দুইন্নাইত কি খালি বড়লোক বেডা থায়ে?বড়লোক মাতারি থায়ে না মা? হেতিরাও তো টিয়া দিলে ভাইর শরীল কিনতারে। ভাই আরো গরীব মাইয়ারে টিয়া কিল্লাই দে?

-পিছা দি পিডান লাইগবো ত অরে,অর মাতার তার বেগ্গিন ছিড়ি গেছে। দুইন্নার মাতারিরা কী তোর মার লাইন খানকি নাই? তোর ভাই আইজ আইয়ুক ঘরে খাইতো। অর এতো ধাপ,অয় রূপালিরে টিয়া দে না?

-বড়লোক বেডারা তইলে মোর মার মতন খনকি, কেন মা?

-হাই হাই! মোর জাইত ইজ্জত ব্যাক শেষ এই খানকিরে লই কই যামু???

-মোর আর খানকি অইতে কষ্ট নাই মা, দুইইন্নার বড়লোক বেডারা খানকি অ, আর মুই গরিব অইয়াও খানকি অবো।মোর ত খুশির শ্যাষ নাই।

মা কী বুঝলেন দুনিয়ার জানা নেই, সেদিনই  রাত আটটার দিকে একটা খয়রি রংয়ের গাড়ি এলো হাইকোর্টের মোড়ে দুনিয়ার মার খুপড়ির ঘরের পাশে।অনেকদিন হলো আজকাল আর মাকে নিতে চকচকে গাড়ি আসেনা, কিন্তু আজ আবার আসলো। দুনিয়া চোখ মেলে চাইলো,পলিথিনের কাগজ দিয়ে বানানো দরজাটা গাড়ির আগমনী বাতাসে উড়ছে টালমাটালভাবে।

-দুনিয়া, মা গো আমার তোমারে নিতে আইছে দেখো তোমার ভাইজান।

-কোন ভাইজান মা?

-চিনবা ফরে, উডো উডো, দেইখলেই চিনবা। দেহো কত্তো ডকের গাড়ি ফাডাইছে তোমার জইন্য। ইডাত চড়ি তুমি যাইবা। উডো ঢক করি সাজ করো। মা সাজাই দিমু, উডো উডো!

দুনিয়া জেগে উঠলো। মা সাজিয়ে দিতে হলোনা। নিজেই চুল, লাল টিপে কপাল ও গোলাপি আভায় কপোল সাজালো। দৃষ্টিরাও রঙ্গিন হয়ে উঠলো তার। দর্পভরে সে বের হলো খুপরি ঘরটি থেকে, উঠলো চারচাকার বিএমডব্লিউতে। দুনিয়ার রূপ অন্য কোথাও নয়, এখানেই ঠাঁই পায়।

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন