শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ , ১৯ রমজান ১৪৪৫

অন্যান্য
  >
ইয়োগা

যোগ কী

এস এম শহীদুল হক ভূঁইয়া  ১৭ অক্টোবর , ২০১৮, ১৩:২২:৩৪

  • যোগ কী

YOGA- যোগ

যোগ কি: সংস্কৃত যোগ শব্দটি ইংরেজীতে  YOGA । YOGA -যোগ মানে ব্যায়াম নয়। শরীর, মন, ও আত্মার ক্রম উন্নয়নের যে পদ্ধতি (Method) সমাধী  স্তরে পৌঁছায় তাই যোগ- YOGA। শরীর, মন, বুদ্ধি ও অহংকার আত্মারই বিভূতি বা শক্তি। যোগ বুঝতে হলে নিজের সংকীর্ন গন্ডি ছেড়ে সৃষ্টির মূলের দিকে তাকাতে হবে। যোগ মানে আদির সংগে প্রান্তের যোগ, বৃহতের সংগে ক্ষুদ্রের যোগ, জীবাত্মার সংগে পরমাত্মার যোগ, সৃষ্টির সংগে  স্রষ্টার যোগ। ‘যোগসূত্র’ গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ের দ্বিতীয় সূত্রে মহর্ষি পতঞ্জলি যোগের বর্ননা দিয়েছেন-‘চিত্তবৃত্তি নিরোধ’। চিত্ত এখানে ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত। মন, বুদ্ধি ও অহংকার এই তিনের সামূহিক অর্থে এবং এই তিনটিকে বিক্ষিপ্ত হওয়া থেকে অর্থাৎ বিপথগামী হওয়া থেকে নিবৃত্ত করাই যোগ।

সৃষ্টির মূলতত্ত্ব ক্রম বিকাশ। ভাব থেবে বস্তু, অরূপ থেকে রূপ, এক থেকে বহুকে এনে যখন  স্রষ্টা জগৎ সৃষ্টি শুরু করে ছিলেন তখন থেকেই এই ক্রম বিকাশের গোপন ক্রিয়া শুরু। মতভিন্নতায় ১৩৭০ কোটি বছর আগে সৌরজগত তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়। ৫০০ কোটি বছর আগে সৌরজগত তৈরি হয়। ৪৬০ কোটি বছর আগে পৃথিবী তৈরি হয়। যোগের প্রশ্ন এসেছে অনেক পরে, ক্রমে ক্রমে। প্রথমে ছিল শুধু জড়বস্ত, তারপরে এল প্রান, তাও ৫৭ কোটি বছর আগে। প্রানের পূর্নতা প্রাপ্তির পরে এল মন। মন হল অপূর্ব চেতনাময় এক অদৃশ্য যন্ত্র। মনের বিশেষ কাজ ভাবের সঙ্গে বস্তুর মিলনের সেতু স্বরুপ হওয়া।

শুধু পার্থিব বস্তু নিয়ে মন চলতে পারে না। পার্থিব বস্তুকে নিয়ে মন ছুটতে চায় ভাবের আর্দশের দিকে। শিল্পী, কবি, দার্শনিক ও বিজ্ঞানীরা স্থুল বাস্তবের মধ্যে থেকে ও কিছু সূক্ষ্ম আদর্শ খুঁজে বেড়ান। মনের সার্থকতা হচ্ছে অস্তিত্বের মূল সমস্যা আঁকড়ে ধরে উৎপত্তির গোড়ায় উপস্থিত হয়ে মীমাংসায় পৌঁছানো।

মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ যে সব কিছুর মূলে, সব কিছুর উৎপওি যে  তাঁর থেকেই, অনেক সময় আমরা তা বুঝতে পারি না। আমরা দেখি প্রত্যেকেই আমরা স্বয়ংসম্পূর্ন এক স্বতন্ত্র সত্ত্বা। সংসারের সংগে আমাদের যোগ রয়েছে বটে, বস্তু ও বিশ্বের সঙ্গেও যোগ রয়েছে, কিন্তু যাকে বলা হয় মূল সত্ত্বা তার সংগেই কোনো যোগ নেই। শুধু বস্তুযোগ নিয়ে জীবন কাটালে জীবন হয় গতানুগতিক, অর্থহীন। মন চায়, গতানুগতিকতার উর্ধ্বে বৃহত্তর চেতনা লাভ করতে। সংসার, অর্থ ও বস্তু সম্পদের সঙ্গে যোগ প্রকৃত যোগ নয়। প্রকৃত যোগ হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে মিলন। এই মিলন ঘটানোর প্রচেষ্টার নাম হচ্ছে, যোগ সাধনা। এক কথায় পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার সংযোগের উপায় বিধানের নামই যোগ।

সৃষ্টিকর্তা এক ও অভিন্ন, তিনিই সব, তিনি ছাড়া আর কিছুই নেই। তিনি সকল সংজ্ঞার অতীত। তিনি এক হয়েও বহু, অরূপ হয়েও রূপময়, অব্যক্ত হয়েও চরাচরে ব্যক্ত। তিনি বিশ্বাতীত তিনি প্রতিপালক, তিনি আরো অনেক কিছু। তাঁর অস্তিত্ব, চেতনা ও আনন্দ অনন্ত, এমন যে সৃষ্টিকর্তা শেষ পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে চাই যোগ। আমার মন, প্রান, দেহ, বুদ্ধি, ইচ্ছা সমস্তই চাইবে সেই যোগ।

যোগের পথে প্রয়াস , কেমন করে ধ্যেয় বস্তুকে চিত্তের আশ্রয়ে অধিষ্ঠিত করা যায়, কেমন করে সেই পরম তন্ময়তা লাভ করা যায়, যাতে মনের দর্পনে সুস্পষ্টভাবে জেগে থাকবে শুধু ধ্যেয় বিষয়ের ছবি। যোগ দৃষ্টি দিয়েছে আশ্রয়ের দিকে, আঁধারের দিকে এবং তাকে নিখুঁত ও নির্দোষ করে তোলার জন্যেই সমস্ত প্রয়াস কেন্দ্রীভূত করেছে। চিত্ত চিরচঞ্চল তাই তাতে কোনো কিছুর সুস্পষ্ট ছায়া ধরা পড়ে না। এই চলমান, অস্থির আশ্রয় স্বরুপ চিত্তকে কেমন করে শান্ত, সুস্থির করে তোলা যায় এটিই হল সাধারণ পদ্ধতি। সংস্কৃত ভাষায় বলা যায় ‘ক্লেশ তিমির বিনাশো যোগ প্রদীপ’ যার অনির্বান অকম্প প্রভায় সব উজ্জ্বল হয়ে উঠবে, অজ্ঞানের ক্লেশ ও অপরিচয়ের অন্ধকার দূর হয়ে যাবে। যোগ বলে কাম, ক্রোধ, মোহ, অনুরাগ, স্নেহ এই পাঁচটি চিত্তবৃত্তি পরিহার করতে পারলে মানুষের মুক্তি লাভ হয়। যিনি অহিংসাব্রত পরায়ন হয়ে নাভি, মস্তক, কন্ঠ, হৃদয়, বক্ষ, চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা প্রভৃতি স্থানে জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার যোগ করাতে পারেন তিনিই মুক্তি লাভ করতে পারেন।

যোগের প্রকারভেদ:

যোগ ৪টি মার্গে বিভক্ত। মন্ত্র যোগ, লয়যোগ, বাজযোগ ও হঠযোগ। যোগ মার্গের চারটি পথ হলে ও সাধারন লক্ষ্য এক, স্রষ্টার সন্তুষ্টি, সমাধি এবং অনন্ত মুক্তি।

১.            মন্ত্রযোগ:  স্রষ্টার নাম জপ করতে করতে যে মনের লয় হয় তা-ই  মন্ত্রযোগ।

২.            লয়যোগ: শরীরের নবচক্রে অর্থাৎ নাড়ি গ্রন্থিস্থানে চিত্তলয় করে যে যোগ সম্পদ ও মোক্ষ লাভ হয় তা-ই লয় যোগ।

৩.           রাজযোগ: মন ও শরীর নিশ্চল, স্থির সমাধিপ্রাপ্ত হওয়াই রাজযোগ।

৪.            হঠযোগ:  ‘হ’ অর্থ সূর্য আর ‘ঠ’অর্থ চন্দ্র। সূর্যকে বলা হয় ডান দিক আর চন্দ্রকে বলা হয় বাঁ দিক। দেহের উপর যেমন সূর্যের প্রভাব আছে তেমনি চন্দ্রেরও প্রভাব আছে। হঠযোগে দেহের দুদিকের মিলন হয়। অন্যমতে ‘হ’অর্থ  সূর্য মানে পিঙ্গলা নাড়ি । আর ‘ঠ’অর্থ ইড়া নাড়ি। ইড়া ও পিঙ্গলাকে অবলম্বন করে যে সাধনা  সে সাধনাকে হঠ যোগের সাধনা বলে। মেরুদন্ডের ডান দিকে পিঙ্গলা এবং বাঁদিকে ইড়া এবং মধ্যখানে সুষুম্মা নাড়ী অবস্থিত। যোগের অঙ্গ ৮টি- যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারনা, ধ্যান ও সমাধি। শরীর বিশুদ্ধ না হলে হঠযোগ সাধনের উপযুক্ত হয়না। হঠযোগে সপ্তবিধ সাধনা বিধি বিবৃত হয়েছে-শোধন, দৃড়তা, স্থৈর্জ, ধৈর্য, লাঘব, প্রত্যক্ষ ও নির্লিপ্তি। ধৌতি, বস্তি, নেতি, নৌলিকী, ত্রাটক, কপালভাতি-এই ষটকর্ম আচরণে শরীর চৈতন্য সম্পন্ন হয় অর্থাৎ দেহ শুদ্ধি হয়। দেহ শুদ্ধির পর আসনসিদ্ধ হলে মুদ্রা অভ্যাস করতে হয়। মুদ্রা অভ্যাসে কুলকুন্ডলিনী শক্তি জাগরিত হয়। ষটচক্রস্থিত পদ্ম বিকশিত হয়,  হৃদয়ের গ্রন্থিসকল ভেদ হয়। ষটকর্মদ্বারা ধেতি সিদ্ধ হলে প্রাণায়াম যোগের অনুষ্ঠান করতে হয়। প্রাণায়াম সিদ্ধ হলে ধ্যান। প্রথমে গুরুর ধ্যান, পরে, তেজোময় স্রষ্টার চিন্তা, পরে জ্যোতির (নূর) ধ্যান। বিন্দুময় জ্যোতি(স্রষ্টার) ধ্যানে জাগরিত কুলকুন্ডলিনী শক্তির প্রভাবে স্রষ্টার জ্যোতির (নূর) দর্শন উন্মেষ। ধ্যান যোগ সিদ্ধির পর সমাধি। যোগী শরীর থেকে মনকে পৃথক করে পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হবেন এ-ই হলো সমাধি। সমাধি দ্ধারাই মুক্তি লাভ সম্ভব হয়।

হঠ যোগী অহিংস পরায়ন, সত্যাশ্রয়ী, স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস সম্পন্ন, জিতেন্দ্রিয়, ব্রম্মচারী, ক্ষমাদয়া, দানশীল, সর্বজীবে প্রেমময়, মিতাহারী, শৌচ সম্পন্ন, মিতাচারী, তপোনিষ্ট, ধর্মীয় শাস্ত্রে আস্থাবান।

মায়ার তুল্য বন্ধন নেই, জ্ঞানের তুল্য পরম বন্ধু নেই, অহংকারের তুল্য জগতে দ্বিতীয় শক্র নেই, তেমনি যোগ বলের তুল্য সম্পদ জগতে আর নেই।

যোগের অঙ্গ:

মহর্ষি পতঞ্জলির পাতঞ্জল যোগ দর্শনে অষ্টাঙ্গ যোগের যে ব্যাখা দিয়েছেন তা শ্বাশ্বত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি।

অষ্টাঙ্গ যোগের ৮টি অঙ্গ:

(১)যম (২)নিয়ম (৩)আসন (৪)প্রানায়াম (৫)প্রত্যাহার (৬)ধারনা (৭)ধ্যান (৮)সমাধি।

অষ্টাংগ সাধনার পর্যায় তিনটি। ১) বহিরঙ্গ সাধনা (২) অন্তরঙ্গ সাধনা (৩) অন্তরাত্মা সাধনা।

১. বহিরঙ্গ সাধনা: যম আর নিয়মে সাধকের ভাব আর আবেগ নিয়ন্ত্রিত হয়, জগতের অন্য সব মানুষের সংগে তার একটা ঐকতান সৃষ্টি হয়। আসনে দেহ ও মন সুস্থ সবল ও সতেজ হয়, তখন সাধন প্রকৃতির সংগে তার একটা ঐকতান অনুভব করেন। শেষে তার দেহ সচেতনতা লুপ্ত হয়ে যায়। দেহকে তিনি জয় করে আত্মার বাহন হিসেবে প্রস্তুত করেন। যম নিয়ম আসন তাঁর স্রষ্টানুসন্ধানের যাত্রা পথে তিনটি ধাপ। একে বলে বহিরঙ্গ সাধনা।

২. অন্তরঙ্গ সাধনা: পরের দুটি ধাপ অর্থাৎ প্রাণায়াম ও প্রত্যাহার সাধকের শ্বাস প্রশ্বাস নিয়মিত করে আর মনকে বশে আনে। তাতে তাঁর ইন্দ্রিয় সমূহ বৈষয়িক আকাংখার দাসত্ব বন্ধন থেকে মুক্ত হয়। এ দুটি সাধনাকে বলা হয় অন্তরঙ্গ সাধনা।

৩. অন্তরাত্মা সাধনা: ধারনা, ধ্যান ও সমাধী সাধককে তাঁর আত্মর অন্তরতম প্রদেশে নিয়ে যায়। সাধক তখন স্রষ্টানুসন্ধানে স্বর্গের দিকে তাকান না। তখন তাঁর উপলদ্ধি হয়, তাঁর স্রষ্টা আছেন অন্তরে আন্তরাত্মা নামে। শেষ তিনটি ধাপে সাধক তাঁর স্রষ্টার সংগে একীভূত হয়ে যান। এ তিনটি ধাপকে বলা হয় অন্তরাত্মা সাধনা।

যোগের অঙ্গ ৮টি:

১. যমঃ যম অর্থ সংযম। অষ্টাংগ যোগের এই অংগটি গুরুত্বপূর্ণ। যম এর উপাদান ৫টি।

(ক) অহিংসা: অহিংসা মানে কেবল বল প্রয়োগে বিরতি নয়, অভয় এবং অক্রোধও। নিখিল বিশ্বের প্রতিটি বস্তুর প্রতি ভালোবাসা।

(খ) সত্য: সত্যই মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় ধর্ম। মন যদি সত্য চিন্তা করে জিহবা যদি সত্য কথা বলে এবং সমগ্র জীবন যদি সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে স্রষ্টার সঙ্গে মিলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।

(গ) অস্তেয়: অস্তেয় মানে অচৌর্য। কায়মানোবাক্যে লোভ না করা, কোন দ্রব্য চুরি না করা, ন্যায় পথে, সৎপথে থেকে যা পাওয়া যায় তা দিয়ে জীবনযাপন করাই অস্তেয়।

(ঘ) ব্রম্মচর্য: ব্রম্মচর্য অর্থ শাস্ত্রানুশীলন এবং ভোগ কামনা বর্জিত পবিত্র সংযত জীবনযাপন। সকল প্রকার শারীরিক ও মানসিক সংযম এবং কথোপকথনের এমন কি শ্রবণের সংযমই ব্রম্মচর্য। এক কথায় দেহে, মনে ও কথায় মিতাচারই ব্রম্মচর্য। জীবনে ব্রম্মচর্য প্রতিষ্ঠা করলে দেহে শক্তি পাওয়া যায়, মনে সাহস পাওয়া যায়, বুদ্ধি বিকশিত হয়। জ্ঞানের আলো জ্বলে উঠে। স্রষ্টার নৈকট্য পাওয়া যায়।

(ঙ) অপরিগ্রহ: অপরিগ্রহ মানে গ্রহণ না করা। বৃথা দান গ্রহণ না করা, অপরের নিকট থেকে কারণে বা অকারণে কোনো বস্তু বা কোনো প্রকার সাহায্য গ্রহণ না করাই অপরিগ্রহ। পরিগ্রাহিতা সত্ত্বাকে হীন করে, দাতার বশ্যতা স্বীকার করতে হয়। স্রষ্টার প্রতি আস্থা থাকলে পরনির্ভরতা প্রয়োজন হয় না।

২.  নিয়ম: অষ্টাংগ যোগের দ্বিতীয় ধাপ নিয়ম। নিয়ম অর্থ নিয়মানুবর্তিতার দ্বারা আত্মশুদ্ধি। আসলে নিয়ম হচ্ছে, ব্যক্তিগত আচরন বিধি। এর উপাদান ৫টি।

(ক) শৌচ: সর্ব  প্রকার পরিচ্ছন্নতা রক্ষাই শৌচ। যোগীরা এই শৌচকে দু’ভাগে ভাগ করেছেন। বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীক। বাহ্যিক শৌচে বলা হয়েছে, আমাদের বাহিরের শরীর শুধু নয়, আমাদের পোশাক এবং ব্যবহারিক সব কিছুই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার কথা। এমন কি যে পরিবেশে আমরা থাকি, তাকেও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। শরীর গঠনের জন্য সাত্ত্বিক আহারের প্রয়োজন। মনের শোধন বা নির্মলতাই অভ্যন্তরিক শৌচ। শৌচকে ঠিক মত উপলদ্ধি করতে পারলেই একাগ্রতা ও আত্মদর্শনের যোগ্যতা লাভ করা যায়। ঈর্ষা, দ্বেষ, ঘৃনা, ক্রোধ, লালসা, লৌলুপতা, কামুকতা, অহংকার ইত্যাদি মন থেকে দূর করতে না পারলে মন শূচি হয় না। শুচি মনে একাগ্রতা আসলে সাধনা জয় করা য়ায়।

(খ) সন্তোষ: সন্তোষ অর্থ সম্যক তৃপ্তি । চাহিদার সমুদ্রে নিজেকে হারিয়ে না ফেলে আপন অবস্থাতে সন্তুষ্ট থকাই সন্তোষ। সর্ব প্রকার দ্বন্দ্ব থেকে মনকে স্থির রাখাই সন্তোষ। সন্তোষ সুপ্রতিষ্ঠিত হলে প্রশান্তি লাভ করা যায়।

(গ) তপস্যা তপ: হচ্ছে কোন সংকল্পসিদ্ধির উদ্দ্যেশ্য কঠোর সাধনা। সর্ব প্রকার সংযম অভ্যাস। উপবাস এবং অন্যান্য প্রকারে শরীর, মন এবং ইন্দ্রিয় সমূহকে শুদ্ধ রাখাই তপস্যা। বাক সংযম দ্বারা তপস্যা সিদ্ধ হয়। তপস্যার দ্বারা শরীর ও ইন্দ্রিয়ের এবং জড়তা দোষ দূর করতে পারলে সিদ্ধি প্রাপ্তি সম্ভব হয়।

(ঘ) স্বাধ্যায়: স্বাধ্যায় মানে নিজেকে জানা। স্ব-অর্থ স্বয়ং আর অধ্যায় অর্থ অধ্যয়ন। স্বাধ্যায় থেকে যে সব মহান চিন্তার উদ্ভভ হয় তা তাঁর জীবনের ও সত্ত্বায় অঙ্গীভূত হয়। তিনি উপলদ্ধি করেন এই নিখিল সৃষ্টি ভোগের জন্য নয়, ভক্তির জন্য। যে শক্তি তাকে চালিত করছে সে শক্তি বিশ্ব ব্রম্মান্ড চালিত করছে।

(ঙ) স্রষ্টার প্রনিধান: প্রনিধান মানে অর্পন। সমস্ত কর্ম ও ইচ্ছা সৃষ্টিকর্তার উপর অর্পন করার নাম স্রষ্টার প্রনিধান।

৩. আসন: স্থির সুখকর, শরীরিক ও মানসিক অবস্থাই আসন। ঋষিদের আবিস্কৃত আসনের মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা রাখা সম্ভব। দীর্ঘায়ু লাভের জন্য আসন, মুদ্রা অভ্যাস বিশেষ ফলপ্রদ। বিভিন্ন গ্রন্থে চুরাশি লক্ষ আসনের উল্লেখ আছে। তার মধ্যে ষোল শত আসন শ্রেষ্ট। মহর্ষি পতজ্ঞলির যোগ সূত্র গ্রন্থে ১৮৫ টি যোগ সূত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়।

যোগাসন অভ্যাসের উদ্দেশ্য: সাধারনত শরীরকে সুস্থ রাখা, রোগাক্রান্ত শরীরকে রোগমুক্ত করা এবং  পরমাত্মার সংগে জীবাত্মার মিলন সাধিত করা। আসন দুই প্রকার-১. ধ্যান্যাসন ২. স্বাস্থ্যাসন। এ ছাড়া ও অনেক মুদ্রা আছে যা অধিক প্রচলিত, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের অভ্যাসযোগ্য এবং ফলপ্রদ। আসন কেবল যে অরোগ ব্যক্তিরাই করবেন তা নয়। যে কোন ব্যক্তি আসন করতে পারেন। নারী পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, রোগী-অরোগী, যে কোন অবস্থার লোক করতে পারেন। তবে আসনে ফল পেতে হলে চাই নিরলস সাধনা।

৪. প্রাণায়াম: প্রাণায়াম অর্থ প্রাণের আয়াম। প্রান হলো শ্বাসরুপে গৃহিত বায়ু আর আয়াম হল বিস্তার। প্রাণবায়ুকে আয়ত্ত করার জন্য শ্বাস প্রশ্বাসের সংযমকে প্রাণায়াম বলে। অনুশীলনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে গভীর ভাবে ও ছন্দোবদ্ধভাবে শ্বাস গ্রহণ করলে শ্বাসতন্ত্র বলিষ্ঠ হয়, স্নায়ুতন্ত্র শান্ত থাকে এবং কামন বাসনা হ্রাস পায়। মন মুক্ত হয়। অন্তরের কামনা বাসনা লোপ পেলে দেহাভ্যন্তরের দিব্য আগুন মহিমান্বিত হয়ে জ্বলে উঠে। আয়াম তিনটি পর্যায়ে হয়ে থাকে- (১) পূরক (২) রেচক (৩) কুম্ভক। প্রাণায়ামকে আবার চার ভাগে ভাগ করা যায় (১) সহজ প্রাণায়াম (২) লঘু প্রাণায়াম (৩) বৈদিক প্রাণায়াম (৪) রাজ যোগ প্রাণায়াম। যোগ ত্রয়ে উদ্ধৃত অষ্ট কুম্ভকই প্রাণায়ামের মধ্যে মুখ্য, নিরলস অনুশীলনের মাধ্যমে মনকে নিজের দাসত্বে আবদ্ধ করতে পারলেই প্রাণায়ামে কৃতকার্যতা আসে।

৫. প্রত্যাহার: প্রত্যাহার অর্থ ফিরিয়ে নেয়া। বাহ্যিক বিষয়বস্তু থেকে ইন্দ্রিয় সমূহকে ভিতরের দিকে ফিরিয়ে নেয়াকে যোগে প্রত্যাহার বলে। মানুষের মন সর্বদা বিষয় থেকে বিষয়ান্তরের দিকে ধাবিত হয়। এ সব বিষয় ইন্দ্রিয় দ্বারা সঞ্চিত হয়।  ছন্দবদ্ধভাবে শ্বাস নিয়ন্ত্রন করতে পারলে এসব বিষয় থেকে মনকে মুক্ত করে ইন্দ্রিয় সংযম দ্বারা নিয়মিত প্রত্যাহার সাধন করে ইন্দ্রিয় সমূহকে বশে আনতে হয়।

৬. ধারনা: ধারনা অর্থ একাগ্রতা। কোন বিষয় আয়ত্ব করতে হলে চিত্তবৃত্তিকে বিষয়ান্তর থেকে প্রত্যাহার করে ঐ বিষয়ে একাগ্রতা স্থাপন করতে হয়। চোখ বন্ধ  করে স্রষ্টার চিন্তা ও জপ করা বা কোনো একটি বিষয় নিয়ে তার গভীরে প্রবেশ করে একাগ্রভাবে চিন্তা করাকে সূক্ষ উপাসান বলে। প্রত্যাহার ও ধারনা এ দুটি স্তর একে অপরের পরিপূরক। একটি বস্তু বা চিন্তা থেকে মনকে সরিয়ে নেয়ার নাম প্রত্যাহার। পরক্ষণে অন্যকোনো চিন্তা বা বিষয়ে মনকে স্থির রাখার নাম ধারনা। মনকে একাগ্র করতে ধারনা সাহায্য করে। সঠিক ধারনা অভ্যাসে মনের ইচ্ছাশক্তি বাড়ানো সম্ভব। আবার কুলকুন্ডলিনীর শক্তি বৃদ্ধি করতে ধারনা অভ্যাস বিশেষ প্রয়োজন। মানবাত্মা সাধনার পথে চলে পরমাত্মাকে লক্ষ্য রেখে। ধারনা শক্তি ব্যতীত সাধনা অপূর্ণ থেকে যায়। সাধনায় সিদ্ধ হতে প্রতিনিয়ত ধারনা অভ্যাস বিশেষ প্রয়োজনীয়।

৭. ধ্যান: ধ্যান অর্থ নিরবচ্ছিন্ন গভীর চিন্তা। মন যদি নিরবচ্ছিন্নভাবে স্রষ্টার চিন্তা করে তাহলে দীর্ঘ চিন্তনের পর অন্তিমে স্রষ্টার নিকটবর্তী হতে পারে। ধ্যানে দেহ, শ্বাস-প্রশ্বাস, ইন্দ্রিয়, মন, বিচার শক্তি, অহংকার সব কিছু স্রষ্টায় লীন হয়ে যায় এবং তিনি এমন এক সচেতন অবস্থায় চলে যান যার কোনো ব্যাখ্যা দেয়া অসম্ভব। তখন পরম আনন্দ ছাড়া আর কোন কিছু অনুভূত হয় না। তখন তিনি অন্তরের আলো দেখতে পান। তখন তিনি নিজের কাছে এবং অন্যদের কাছে আলোময় হয়ে উঠেন।

ধ্যানের যে কোনো প্রক্রিয়াই মূলত ধারনা। ধারনার মনকে চেষ্টার দ্বারা ধ্যেয় বস্তুতে স্থির রাখা হয়, এই অভ্যাসের ফলে মন যখন নিজেই স্বত:স্ফূর্তভাবে ঐ বস্তুতে স্থির হয়ে যায় তখন ধারনা ধ্যানে পরিনিত হয়। যোগ শাস্ত্রে তিন প্রকার ধ্যানের উল্লেখ আছে। ১) স্থুল ধ্যান ২) সূক্ষ ধ্যান ৩) জ্যোতি ধ্যান।

৮. সমাধীঃ সমাধী অর্থ সম্পূর্নরূপে স্রষ্টায় চিত্ত সমর্পন। ধ্যানের পরিনতি হলো সমাধী। ধ্যান গভীর হলে ধ্যেয় বস্তু ও ধ্যানী অভিন্ন হয়ে উঠে। চিত্ত তখন ধ্যেয় বস্তুতে লীন হয়ে যায়। সেই লয় অবস্থাকে সমাধী বলে। সমাধী প্রাপ্ত হয়ে পরমাত্মার মিলন বা যোগ ঘটে। মন তখন সত্য ও অব্যক্ত আনন্দে ভরপুর হয়ে উঠে। মনের সেই শান্তি বর্ননাতীত। এর সংগে কোন কিছুর তুলনা হয় না। এ অবস্থায় পাপ, পূণ্য, রিপু, দংশন, জরা, মৃত্যু, ব্যাধি থেকে মানবাত্মা মুক্তি লাভ করে।

লেখক: এস এম শহীদুল হক ভূঁইয়া

চেয়ারম্যান ইয়োগা স্টুডিও (বিডি)

আন্তর্জাতিক ইয়োগা প্রশিক্ষক ও রেফারী

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন