বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫, ২৬ আষাঢ় ১৪৩২ , ১৪ মুহররম ১৪৪৭

ফিচার
  >
বিশেষ দিবস

আজ পহেলা শ্রাবণ

নিউজজি ডেস্ক ১৬ জুলাই , ২০২৪, ১১:০৪:২৫

394
  • ছবি : সংগৃহীত

ঢাকা: কবি শ্রাবণকে আমন্ত্রণ জানান এভাবে, ‘আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে/দুয়ার কাঁপে ক্ষণে ক্ষণে,/ ঘরের বাঁধন যায় বুঝি আজ টুটে॥/ধরিত্রী তাঁর অঙ্গনেতে নাচের তালে ওঠেন মেতে,/ চঞ্চল তাঁর অঞ্চল যায় লুটে/ প্রথম যুগের বচন শুনি মনে/ নবশ্যামল প্রাণের নিকেতনে।/ পুব-হাওয়া ধায় আকাশতলে, তার সাথে মোর ভাবনা চলে/ কালহারা কোন্ কালের পানে ছুটে॥’

আষাঢ়ে কদম ফুলের মতো হাসি হেসে যে প্রকৃতি সাজতে শুরু করে নতুন সাজে, সেই প্রকৃতি সাজে তুলির শেষ আঁচড় পড়ে শ্রাবণে। বাদলা দিন আর থৈ থৈ পানিরাশির উত্তরাধিকার শ্রাবণেরই কোমল রূপ ‘শাওন’। অতি সাধারণের মুখে, কাব্যকথায় এ নামটি বহুল প্রচলিত। শুনতেও বেশ মিষ্টি লাগে বৈকি।

‘শ্রাবণ’তারার নামে নামকরণ হয়েছে এ মাসের। বর্ষার অংশীদার হিসেবে এ মাসেও ঝড়ো বাতাস বয়ে যায়। শ্রাবণ বৃষ্টির ছোঁয়া পেয়ে কদম, হিজল, কেয়া ও যুথিকা ফুল ফুটবে আপন মহিমায়। বর্ষার ঐশ্বর্য শাপলা, মরালেরা প্রস্তুতি নিচ্ছে নিজে ফোঁটার, প্রকৃতিকে সাজাবার।

আম, কাঁঠাল, আনারস ছাড়াও বাজারে আমড়া, লটকন, পেয়ারা, করমচা, জাম্বুরা, কামরাঙ্গা, বিলিম্ব, বিলাতী গাব ইত্যাদি ফলের সমারোহ। এসব মওসুমী ফল এখন অনেকটাই নাগরিক ফল হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বার) তালিকায় যেসব ফল স্বল্প প্রচলিত, সেগুলো সময়ের বিবর্তনে ‘দামি ও অভিজাত’ফলে পরিণত হয়েছে।

‘শাওন রাত’, ‘শাওন ও বৃষ্টি’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’সাহিত্যে এসেছে নানা প্রেক্ষিতে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, নোবেলজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ আরো অনেক কবি-সাহিত্যিকের সাহিত্যকর্মে শ্রাবণ- প্রকৃতি অংকিত হয়েছে ভাষার সুনিপুণ বুননীতে। শ্রাবণ মাসে বেশকিছু মেলা-পার্বণ অনুষ্ঠিত হয়।

এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো সিলেট ও ময়মনসিংহের ঝুলনমেলা, মানিকগঞ্জের জগন্নাথ মিশ্রের মেলা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় খড়মপুর উরশ মেলা। এসব মেলা-পার্বণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে আরো অটুট করে সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধনে।

বর্ষাবন্দনার পথপ্রসারি কবি কালিদাস তার মেঘদূত কাব্যে বর্ষায় শ্রাবণরাগ বর্ণনা করেছেন এভাবে- ‘প্রাণ তার অদূরে উদ্যত শ্রাবণে/ যদি- না জলধরে বাহন করে আমি পাঠাই মঙ্গলবার্তা?/ যক্ষ অতএব কুড়চি ফুল দিয়ে সাজিয়ে প্রণয়ের অর্ঘ্য/ স্বাগত-স্বভাষ জানালে মেঘবরে মোহন, প্রীতিময় বচনে।’

প্রথম নারী ঔপন্যাসিক স্বর্ণকুমারী দেবী তার এক কাব্যে শ্রাবণবন্দনা করেছেন, ‘সখি, নব শ্রাবণ মাস/ জলদ-ঘনঘটা, দিবসে সাঁঝছটা/ ঝুপ ঝুপ ঝরিছে আকাশ!/ ঝিমকি ঝম ঝম, নিনাদ মনোরম,/ মুর্হুমুর্হু দামিনী-আভাস! পবনে বহে মাতি, তুহিন-কণাভাতি/ দিকে দিকে রজত উচ্ছ্বাস।’

হিন্দু পরম্পরায় শ্রাবণ এক শুভ মাস, এই মাসে কিছু আচার পালন করলে নাকি যাবতীয় মনস্কামনা পূর্ণ হয়- এমন ধারণা কালনিরবধি মনের মধ্যে বহন করে আসছেন হাজার হাজার মানুষ। শ্রাবণ শিবের মাস হিসেবে খ্যাত। এই মাসের প্রতিটি সোমবার শিবের ব্রত ধারণ করেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। ব্রতের উদ্দেশ্য একটাই, মনস্কামনা পূরণ। শিবমূর্তির প্রতি দুধ নিবেদন শ্রাবণ-শিবব্রতের অন্যতম প্রধান আচার।

হিন্দু পুরাণ অনুসারে শ্রাবণ মাসেই ঘটেছিল সমুদ্র মন্থন। মন্থনের ফলে ইঠে আসা হলাহল বিষকে নিজ কণ্ঠে ধারণ করে মহাদেব সৃষ্টিকে রক্ষা করেন।

এই কারণেই এই মাস শিবের প্রতি উৎসর্গীকৃত। এই মাসের প্রতিদিন স্নানের পরে শিবস্তোত্র পাঠকে আবশ্যক মনে করেন শিবভক্তরা। শ্রাবণসন্ধ্যায় হরপার্বতীর আরতি অবশ্যকর্তব্য।

শ্রাবণে আমন ধান রোপণ এবং পাট জাগ দেয়া, আঁশ ছাড়ানো গ্রাম-বাংলার অতি পরিচিত দৃশ্য।

খনার বচনে রয়েছে, ‘শ্রাবণের পুরো, ভাদ্রের বারো/ধান্য রোপণ যতো পারো’, ‘আষাঢ় কাড়ান নামকে/ শ্রাবণে কাড়ান ধানকে’, ‘পান পুঁড়লে শ্রাবণে/ খেয়ে না ফুরায় বারণে’, ‘বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ হলুদ রুইবে/ অন্য কাজ ফেলিয়া থুইবে? আষাঢ়-শ্রাবণে নিড়াই মাটি/ ভাদরে নিজাইয়া করবে খাঁটি’ ইত্যাদি। শ্রাবণে ওলের প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যায় বলেও বারোমাসীতে উল্লেখ পাওয়া যায়।

প্রাচীনকালের প্রবাদ বিশারদগণ গাছে ‘কলম’-এর ব্যবহার জানতেন। এ মাসের বৃষ্টিপাতের পরেই তারা গাছে ‘কলম’নিতে বলেছেন, ‘শোনরে মালি বলি তোরো/ কলম কর শাওনের ধারে’।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রকৃতিতে কত না প্রভাব স্বত্ত্বেও অনেকটা স্বাভাবিক আবহেই ‘রিম-ঝিম্-ঝ্মি বৃষ্টির’ স্মারক মাস আষাঢ় বিদায় নিয়েছে। সময়ের সিঁড়ি বেয়ে এক সময় পশ্চিম দিগন্তে অস্তরাগ ছড়িয়ে বিদায় নেবে শ্রাবণও। আসবে শারদীয়া ভাদ্র, ছড়াবে কাশফুলের কমনীয় সাদারবরণ আর অনিন্দ্য সুন্দরের পসরা।

 

নিউজজি/ পি.এম

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন