রবিবার, ২ এপ্রিল ২০২৩, ১৮ চৈত্র ১৪২৯ , ১১ রমজান ১৪৪৪

ফিচার
  >
পাঠক বিভাগ

একজন নির্মোহ চিকিৎসক ও তার আত্মত্যাগ

কাজী সুলতানা শিমি ৯ জুলাই , ২০১৭, ১৭:৫৪:৪৩

6K
  • একজন নির্মোহ চিকিৎসক ও তার আত্মত্যাগ

ডঃ এড্রিক বেকার একজন চিকিৎসক। জন্ম নিউজিল্যান্ডে। পড়াশোনা ও বেড়ে উঠা নিউজিল্যান্ডের ডোনেডিন শহরে। অথচ জীবন উৎসর্গ করেছিলেন বাংলাদেশের জন্য। ২০১৩ সাল। তিনি পালমোনারী আর্টিলারি হাইপার টেনশান রোগে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুশয্যায়। তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বার বার জোর করা হচ্ছে। তিনি তার শুভাকাঙ্ক্ষীদের অনুরোধ করেন -তাকে যেন কিছুতেই তা না করা হয়। এমনকি কোনোভাবেই যেন লাইফ সাপোর্টেও না রাখা হয়। স্তম্ভিত সবাই। কেন তিনি রাজী হচ্ছেন না! উদাস ও বিষণ্ণ মনে তিনি ফিসফিস করে বললেন, যে সেবা আমি আমার রোগীদের দিতে পারিনি সে সেবা আমি কিছুতেই নিজে নিতে পারবোনা।

নিঃশব্দ, নীরবতায় সুনসান কালিয়াকৈর হেলথ কেয়ার সেন্টার। যা তিনি টাঙ্গাইলের মধুপুরের শোলাকুড়ি ইউনিয়নে নিজের পরিশ্রমে গড়ে তুলেছেন। নিঃশব্দতা ভেঙ্গে তিনি আবারো বলে উঠলেন তাকে যেন খৃষ্টান নিয়মানুযায়ী সমাহিত করা হয়। তিনি কালিয়াকৈরহেলথ কেয়ার সেন্টারে তার কুড়ে ঘরের পাশেই চীরদিনের জন্য থেকে যেতে চান। অথচ নিউজিল্যান্ড গেলে তার মা তাকে জিজ্ঞাসা করতেন, ‘তুমি কবে আবার তোমার দেশে ফিরে আসবে?’ বেকারের উত্তর ছিল, ‘প্রতিবছর এ দেশে অনেক ছেলেমেয়ে চিকিৎসক হচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ না কেউ একদিন চলে আসবেন আমাদের হাসপাতালে। গ্রামের অসহায় দরিদ্র মানুষের সেবা করবেন। সে রকম একজন মানুষের অপেক্ষায় আছি।’

ডঃ এড্রিক বেকারের আর নিউজিল্যান্ডে ফিরে যাওয়া হয়নি। তিনি চীরনিদ্রায় শুয়ে আছেন মধুপুরের কালিয়াকৈর হেলথ কেয়ার সেন্টারে। তার জীবদ্দশার সেই কুড়ে ঘরের পাশে। তার জীবনযাপন ছিল অত্যন্ত সাদামাটা। একটা খাট ও ছিলো না তার। মাটির বিছানায় তিনি ঘুমাতেন। পাড়াগাঁয়ের দরিদ্র মানুষদের সাথে জীবন মিলিয়ে তিনি তার জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছেন। সারা গাঁয়ের মানুষ তাকে ডাকতো ডাক্তার ভাই বলে। তিনি নিজে তা শিখিয়ে দিয়েছেন। স্যার বা ডাক্তার সাহেব বলা তিনি পছন্দ করতেন না। তিনি সব সময় বলতেন, সব মানুষ সমান। যখন কোনো রোগী সময়মত চেকআপে আসতো না তিনি নিজে গিয়ে কিংবা প্যারামেডিক্স পাঠিয়ে তার খোঁজ নিতেন। ঠিক মতো অসুধ খাচ্ছেন কিনা খবর রাখতেন।

উন্নত বিশ্বের যে কোনো দেশে তিনি বিলাসবহুল জীবন-যাপন করতে পারতেন। তা না করে তিনি বেছে নিয়েছিলেন অত্যন্ত সাদাসিদে জীবন। ২০১১ সালে দি ডেইলি স্টার পত্রিকার এক সাক্ষাৎকারে যখন প্রশ্ন করা হয় কেন তিনি দেশ ছেড়ে হাজার মাইল দূরে এসে এ ধরণের একটি জীবন বেছে নিয়েছেন? এতো অজ পাড়াগাঁয়ে কেনই বা তার থাকার ইচ্ছে হল! জবাবে তিনি বলেছিলেন, এখানকার স্থানীয় মানুষেরা অত্যন্ত অমায়িক ও আন্তরিক। তাদের ভালো মানুষী তাকে মোহিত করেছে। ১৩ বছর বয়সে তিনি প্রথম নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তার জীবনটা তিনি অসহায় মানুষদের সেবায় উৎসর্গ করবেন। তখন থেকেই সেবাদানকে জীবনের ব্রত হিসেবে বেছে নিয়েছেন।

ডঃ বেকার নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটনে ইন্টার্নি শেষে নিউজিল্যান্ড সরকারের শল্য চিকিৎসক হিসেবে প্রথম চাকরীতে যোগ দেন। এরপর চলে যান যুদ্ধবিধ্বস্ত ভিয়েতনামে। সেখানে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি কাজ করেন। মাঝে অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডে শিশুস্বাস্থ্যসহ তিনটি বিষয়ে স্নাতকোত্তর কোর্স করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি পাপুয়া নিউগিনি ও জাম্বিয়ায় যান। এর মধ্যে জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে চলে যান যুক্তরাজ্যে। বাংলাদেশে যখন মুক্তিযুদ্ধ চলছিল, তখন ভিয়েতনামে একটি চিকিৎসক দলের হয়ে কাজ করছিলেন তিনি। বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সেনাদের নিপীড়ন, মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী লড়াই- এসব কথা সংবাদ মাধ্যমে জানতে পারেন তিনি। বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে জানা ও দেখা নির্যাতিত মানুষ ও শরণার্থীদের অসহায় চিত্র তাকে কষ্ট দেয়। তিনি মনে মনে ঠিক করেন, এক সময় নিজ চোখে বাংলাদেশে দেখে আসবেন।

১৯৭৯ সালে তিনি প্রথম বাংলাদেশে আসেন। জড়িয়ে পড়েন এ দেশের মায়ার টানে। ঠিক করেন এদেশের দুঃস্থ মানুষের সেবা করবেন তিনি। বেকার প্রথমে মেহেরপুর মিশন হাসপাতালে প্রায় দুই বছর কাজ করেন। পরে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে কুমুদিনী হাসপাতালে আট মাস কাজ করেন। এভাবে কেটে গেল ৩১টি বছর। এর মধ্যে ২৭ বছর ধরে তিনি বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন মধুপুরের শোলাকুড়ি ইউনিয়নের কালিয়াকৈর গ্রামে। এতো তারই করা চিকিৎসাকেন্দ্র। তাতে প্রতিদিন গড়ে বিনামূল্যে চিকিৎসা নিচ্ছে দেড় শতাধিক রোগী।

ডঃ বেকারের কথায়, ‘আমার কোনো বড় হাসপাতালে কাজ করার ইচ্ছা ছিল না। ইচ্ছা ছিল প্রত্যন্ত গ্রামে কাজ করার। সে চিন্তা থেকেই চলে আসি মধুপুর গড় এলাকায়। সাধারণ মানুষদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে মনে হল বাংলা ভাষাটা শিখে নেওয়া দরকার। তাই মধুপুরের জলছত্র খ্রিষ্টান মিশনে এক বছর থেকে বাংলা শিখে নিলাম। যোগ দিলাম স্থানীয় থানারবাইদ গ্রামে, চার্চ অব বাংলাদেশের একটি ক্লিনিকে।’ সেই থেকে পাহাড়ি এলাকায় গরিব ও অসহায় মানুষের স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে আসছেন বেকার। ১৯৮৩ সালে ওই ক্লিনিকে দুজন খণ্ডকালীন ও তিনজন সার্বক্ষণিক কর্মী নিয়ে বেকারের যাত্রা শুরু। দিন দিন বাড়তে থাকে রোগীর সংখ্যা। তখন থানারবাইদের পাশের গ্রাম ১৯৯৬ সালে উপকেন্দ্র খুলে চিকিৎসাসেবা দেওয়া শুরু করেন।

২০০২ সালেকালিয়াকৈর একটি পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করেন তিনি। সেখানেই চলছে তাঁর সেবা কার্যক্রম। বেকার জানান, তিনি দু-এক বছর পরপর নিজ দেশে গিয়ে স্বজন, শুভাকাঙ্ক্ষী ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে এই চিকিৎসাকেন্দ্র চালানোর টাকা জোগাড় করেন। এখানে তিনিই একমাত্র চিকিৎসক হিসেবে রোগী দেখেন। তাঁকে সহযোগিতা করেন স্থানীয় ৮৭ জন তরুণ-তরুণী। সেবা দেওয়ার ব্যাপারে তিনি তাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে নিয়েছেন। চিকিৎসাকেন্দ্রে প্রতিদিন গড়ে দেড় শতাধিক রোগী আসেন। সেখানে জ্বর, ডায়াবেটিস, পেটের পীড়া ও পুষ্টিহীনতায় ভোগা রোগীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে ব্যবস্থাপত্র ও ওষুধ দেওয়া হয়। হাত-পা ভাঙাসহ অন্যান্য জটিল রোগীদের জন্য আবাসিক চিকিৎসাব্যবস্থা রয়েছে। এসব রোগীর ক্ষেত্রে রোগীর জন্য ১০০ টাকা ও রোগীর সহযোগীর জন্য ২০০ টাকা এককালীন নেওয়া হয়। বাকি সব ব্যয় চিকিৎসাকেন্দ্র বহন করে।

ডঃ এড্রিক বেকার জন্মসূত্রে একজন নিউজিল্যান্ডার হয়েও মনেপ্রাণে ছিলেন বাংলাদেশী। যশ ও খ্যাতির প্রতি নির্মোহ তাকে করেছিলো মানুষের হৃদয়ের মধ্যমণি। ফর দ্য পিপল বাই দ্য পিপল”-ছিল তার জীবনের আদর্শ। সকল সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে তিনি জীবন উৎসর্গ করেছেন বাংলাদেশের দুঃস্থ মানুষের কল্যাণে। উন্নত চিকিৎসার একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে বাংলাদেশী চিকিৎসকদের এ উদারতা আজ ভীষণ প্রয়োজন। প্রকাশ ও প্রচারে বিমুখ ডঃ বেকারের আত্মত্যাগী মানসিকতা অনুপ্রাণিত হোক সকল চিকিৎসকের চিন্তা ও মননে।

 

 

নিউজজি/এসএফ

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন