বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৭ ফাল্গুন ১৪৩১ , ২০ শাবান ১৪৪৬

ফিচার
  >
পাঠক বিভাগ

নরসিংদীর পুত্রবধু অধ্যাপক ডা. জোহরা বেগম কাজী

আরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া ২৬ ফেব্রুয়ারি , ২০২৩, ১১:২৩:০৩

3K
  • নরসিংদীর পুত্রবধু অধ্যাপক ডা. জোহরা বেগম কাজী

 

অধ্যাপক ডা. জোহরা বেগম কাজী। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক, বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিবেদিত, নারী প্রগতির অন্যতম পথিকৃত, চিকিৎসাবিদ, উপমহাদেশের তথা অখণ্ড ভারতের প্রথম মুসলিম নারী চিকিৎসক। পর্দা প্রথার কারণে একসময় বাংলার নারীরা লেখাপড়া দুরের কথা, ঘরের বাইরে বের হওয়া দুরুহ ছিল। সে সময় নারীদের লেখাপড়া ও জীবন-যাপন খুবই চ্যালেঞ্জিং ছিল। জোহরা কাজি সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন এবং সকল নেতিবাচক প্রথা ভেঙে বাঙালি নারীর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য এক অনন্য উদাহরণ উপহার দিয়ে গেছেন। পরবর্তীতে সে উদাহরণ মুক্তির, সে উদাহরণ সাফল্যের, সে উদাহরণ ভালোভাবে বেঁচে থাকার দাওয়াই হিসাবে কাজ করেছে।

১৯১২ সালের ১৫ অক্টোবর ডা. জোহরা বেগম কাজীর জন্ম হয় ভারতের মধ্য প্রদেশের রাজনানগাঁও (বর্তমানে ছত্তিশগড়) অঞ্চলে। পৈত্রিক বাড়ি বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলার কালকিনী উপজেলার গোপালপুর গ্রামে। তার পিতা প্রয়াত ডা. কাজী আবদুস সাত্তার একজন প্রখ্যাত চিকিৎসক এবং উপমহাদেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য ছিলেন। মহাত্মা গান্ধী, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, মাওলানা শওকত আলী, জওহরলাল নেহেরু, বল্লভ ভাই প্যাটেল, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, কাজি নজরুল ইসলাম, মোজাফফর আহমেদ এবং সেই সময়ের অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। মা আঞ্জুমান আরা বেগমের পৈত্রিক বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলায়। তিনি শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের খালাতো বোন।

একজন প্রতিবেশী সন্তান প্রসবের সময় চিকিৎসার অভাবে মারা গেলে সেই দুঃখজনক ঘটনার কথা পিতা আব্দুস সাত্তারকে এতটাই বিব্রত ও দুঃখ ভারাক্রান্ত করেছিল যে, মহিলা চিকিৎসকের অভাব দূর করার জন্য তিনি জোহরাকে একজন নারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হওয়ার প্রতিজ্ঞা করিয়ে ছিলেন। বাবার ইচ্ছা পূরণে জোহরা কাজি চিকিৎসা বিদ্যা শিক্ষা পূর্ণ করেছিলেন ধাত্রী বিদ্যায় উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করার মাধ্যমে। জোহরা যখন মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন, তাদের নিকটাত্মীয়রা তাকে তিরস্কার করে এবং মন্তব্য করে যে, ডা. সাত্তারের এই মেয়ে খ্রিষ্টান হবে। উত্তরে উচ্চমনা পিতা বললেন, ‘আমার মেয়েরা হবে খাঁটি মুসলমান’।

ডা. জোহরা কাজির শিক্ষা জীবন অতিবাহিত হয়েছে মধ্যপ্রদেশ ও এর নিকটবর্তী  কয়েকটি এলাকায়। তিনি ১৯৩৫ সালে দিল্লী দ্যা লেডী হার্ডিঞ্চ মেডিকেল কলেজ (এশিয়ার মহিলাদের জন্য প্রতিষ্ঠিত প্রথম মেডিকেল কলেজ) থেকে এমবিবিএস পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করে ‘ভাইসরয়’ পদক লাভ করেন। পরবর্তী পর্যায়ে লন্ডন থেকে এফআরসিওজি ডিগ্রি অর্জন করেন।

ডা. জোহরা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে তার উজ্জ্বল শিক্ষাজীবন জুড়ে বৃত্তি পেয়েছেন। তখনকার দিনে এই একাডেমিক ক্যারিয়ার ছিল খুবই বিরল। একজন নারীর জন্য কল্পনার বাইরে। অধ্যাপক জোহরার সহপাঠী ছিলেন ডা. সুশীলা নায়ার যিনি একসময় ভারতের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন। তার অন্য সঙ্গীরা ছিলেন ডা. শিলা হালদার এবং ডা. উষা হালদার।

ডা. জোহরা বেগম কাজীর পিতার রাজনীতি সংশ্লিষ্টতার কারণে নিজ পরিবারের সংঙ্গে মহত্মা গান্ধী পরিবারের  বিশেষ সখ্য ছিল। সেই সময়ে একজন রাজনৈতিক বাবা থাকা মানে ভারতের ঔপনিবেশিক বিরোধী আন্দোলনের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পরিবারের সংযোগ থাকা। জোহরার পিতা কাজী সাত্তারের পরিবার বৃটিশবিরোধী সংগ্রামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। যেমন—মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী বা মহাত্মা গান্ধী। কাজি আবদুস সাত্তারের মাধ্যমে জোহরা কাজী এবং তার ভাইবোনরা প্রায়ই গান্ধীর সেবাগ্রাম (সেবার জন্য গ্রাম) আশ্রমে যেতেন, যেখানে তারা গান্ধীর কথা শুনতেন এবং তার সংস্পর্শে থাকতেন।

জোহরা কাজী মহত্মা গান্ধীর সেবাশ্রমে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ হিসাবে তার পেশাগত কর্মজীবন শুরু করেন। এটি একটি দাতব্য সংস্থা যা দরিদ্র লোকদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেয়। তিনি একইভাবে মহাত্মা গান্ধীর স্ত্রীর নামানুসারে কস্তুরবা ন্যাশনাল মেমোরিয়াল হাসপাতালের অনারারি সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং হাসপাতালের উন্নতির জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন।

জোহরা কাজী তার বইয়ে লিখেছেন, ‘যখনই আমরা মহাত্মা গান্ধীর সেবাশ্রমে যেতাম তিনি আমাদের দেখে খুশি হতেন। তিনি আমাদের পাশে বসিয়ে খাবার পরিবেশন করতেন। আমরা খেতে না চাইলে তিনি বাসায় যাওয়ার জন্য খাবার প্যাক করে দিতেন’। তিনি মহত্মাজীর বহু উপদেশ বাণীর মধ্যে একটি উপদেশ তাদের প্রায়ই শোনাতেন। এমবিবিএস পাশ করে মহত্মা গান্ধীর আশির্বাদ নিতে গেলে তিনি জোহরা কাজীকে বলেছিলেন—‘জোহরা কখনো ভয় পাবে না। অন্যায়ের কাছে মাথা নত করবে না। মানুষের মতো মানুষ হয়ে বাঁচতে চেষ্টা করবে। তোমার শত্রুরা তোমাকে কী করবে? খুব বেশি হলে তোমার জীবনটা নিবে। মনে রাখবে বেঁচে থাকতে হলে জিবনের সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো তোমার আদর্শ’।

জোহরা কাজীর সংঙ্গে মহত্মা গান্ধীর সন্তান রামদাস গান্ধীর ছোটবেলা থেকেই বন্ধুত্ব ছিল। একসময় গান্ধী পুত্র রামদাস গান্ধীর সংঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। কিন্তু বাধা হয়ে দাড়ান স্বয়ং গান্ধী। তিনি আপন ছেলেকে নিবৃত করতে ব্যর্থ হলে মহত্মা গান্ধীর অনুরোধে জোহরা কাজি স্বেচ্ছায় রামদাস গান্ধীর সংঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিন্ন করেন। তিনি প্রথম জিবনে গান্ধীর সংস্পর্শে এসে যেসব মানবিক গুণাবলির সাথে পরিচিত হয়েছিলেন তার কর্মজীবনে সেসব মানবিক গুণাবলি মানুষের কল্যাণে ও সেবায় প্রয়োগের চেষ্টা করতেন।

জোহরা কাজী ১৯৪৮ সালের আগস্ট মাসের পর  পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশে চলে আসেন। তার আগ পর্যন্ত তিনি ব্রিটিশ ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালে কাজ করেন। ১৯৪৯ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্ত্রীরোগ বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগদান করেন। সেই সময়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগ ছিল না। তিনি বিভাগটি খোলার উদ্যোগ নেন। ঢাকার মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রসূতি বিভাগ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তিনি বিশেষ ভূমিকা রাখেন।

জোহরা কাজী একজন অধ্যাপক হিসাবে অনেক ছাত্রের শিক্ষক ছিলেন, যারা পরবর্তীতে উল্লেখযোগ্য চিকিৎসক এবং জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেন। বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, জাতীয় অধ্যাপক ডা. সাহলা খাতুন তার শিক্ষায় ডাক্তার হওয়া বিখ্যাত ছাত্র ও ছাত্রী। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একজন উদ্যমী সাইক্লিস্ট, টেবিল টেনিস এবং ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় ছিলেন।

একজন বিশিষ্ট চিকিৎসক পেশাজীবী এবং উপমহাদেশের একজন অগ্রগামী নারী হিসেবে মর্যাদার কারণে তিনি সমাজের উঁচু পর্যায়ের নাগরিকদের খুব কাছাকাছি ছিলেন। এক সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরিবারের পারিবারিক চিকিৎসক হিসেবেও কাজ করেছেন।

১৯৪৯ সালের অব্যবহিত পর নরসিংদী জেলার মনোহরদী উপজেলার হাতিরদিয়া রাজিউদ্দিন ডিগ্রি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা বিলাগী গ্রামের তৎকালীন জমিদার পুত্র, নিবেদিত প্রাণ সমাজকর্মী ও রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব তৎকালীন এম.এল.এ. রাজিউদ্দিন ভূঞার (বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদ সদস্য ১৯৪৬ এবং পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ১৯৬২) সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৬৩ সালে জোহরা কাজীর বয়স যখন ৫১ বছর তখন তার স্বামী মারা যান এবং তিনি পুনরায় বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯ বছরের সংসার জিবনে দুর্ভাগ্যবশত তাদের কোনো সন্তান ছিল না। নিঃসন্তান হওয়ার জন্য তাকে প্রকাশ্যে কোনো আফসোস করতে দেখা যায়নি। তিনি তার ছাত্র এবং রোগীদের সন্তান বলে মনে করতেন। অন্য যেকোনো নারীর মতো সন্তান না থাকার বিষয়টি জোহরা কাজীর জন্য নিঃসন্দেহে দুখঃজনক ব্যাপার ছিল। হয়ত সেকারণেই তিনি দরিদ্র পরিবারের শিশুকে দত্তক নিতেন এবং লেখাপড়া শেখানোর দায়িত্ব নিতেন। যদিও বয়স্ক ও শিশুদের সেবা করার অভিজ্ঞতা ও ইচ্ছা তার ছেলেবেলা থেকেই প্রাপ্ত। জোহরা কাজি বিশ্বাস করতেন মানুষের সেবাই শান্তির পথ। ‘শুধুমাত্র মানুষের সেবা করেই আপনি সত্যিকার অর্থে সন্তুষ্ট হতে পারেন। মানুষকে ভালোবাসা সব ধর্মেই একটি আদর্শ’। অভাবী মানুষের সেবায় নিবেদিত একজন চিকিৎসক হিসেবে খ্যাতির জন্য তিনি ‘ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল অব ঢাকা’ নামে পরিচিতি লাভ করেন।

ডা. জোহরা কাজী একুশে পদক প্রাপ্ত ভাষাসৈনিক। সদ্য আলাদা হওয়া পাকিস্তান রাষ্ট্র পরিচালনা, কাঠামো ও ভাষাসহ অন্যান্য বিষয়ে আলোচনার জন্য ঢাকায় রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক কর্মী, বুদ্ধিজীবী, ছাত্রনেতা, সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয় নরসিংদী জেলার বিশিষ্ট সমাজকর্মী ও রাজনীতিবিদ রাজিউদ্দিন ভূঞার দোতলা বাড়ির বিরাট হল রুমে। সেখানে অন্যান্য বিষয়ের সাথে ভাষার প্রশ্নটিও আলোচিত হয়। উক্ত বৈঠক অনুষ্ঠানের ব্যাপারে নরসিংদীর কৃতি সন্তান রাজিউদ্দিন ভূঞার সাথে ডা. জোহরা বেগম কাজীর ভূমিকাও ছিল অনবদ্য।

ডা. জোহরা  তৎকালীন সময়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের আবাসিক (স্ত্রীরোগ) চিকিৎসক ছিলেন। একুশের ছাত্র হত্যাকাণ্ডের পর তিনি রাস্তায় নেমে আসেন এবং আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন। তিনি প্রিন্সিপালকে হত্যাকাণ্ডস্থল ঘুরে ঘুরে দেখান এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পরবর্তী ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনে অংশ নেন ও পুলিশের গুলিতে আহত ছাত্রদের চিকিৎসা দেন।

ডা. জোহরা কাজীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক দাদী- নাতি। অর্থাৎ তিনি আমার বড় দাদী হন। রাজিউদ্দিন ভূঞা, হাতিরদিয়া ছাদত আলী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা জমিদার ছাদত আলী ভূঞা আমার পূর্ব পুরুষ। ছাদত আলী ভূঞা জোহরা কাজীর চাচা শ্বশুর। এই মহীয়সী নারীর সাথে আমার দুইবার সাক্ষাতের সৌভাগ্য হয়। যতদূর মনে পরে ১৯৮৬ সালের কোনো একদিন তাঁর স্বামী রাজিউদ্দিন ভূঞা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কলেজে সম্বর্ধিত হন। এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. আব্দুল মান্নান। বক্তৃতায় জোহরা কাজী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন,‘মানবিক হও, মানুষের সেবায় নিজেকে আত্মনিয়োগে কখনো পিছপা হবে না’।

আনুমানিক ২০ বছর আগে আমি হাতিরদিয়া কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ তোফাজ্জ্বল হোসেন ভূঞা শাহজাহান স্যারের সঙ্গে তার গুলশানস্থ বাসভবনে গিয়েছিলাম। বাসায় প্রবেশের পরপরই গৃহপাচারিকাকে আমাদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করতে নির্দেশ দেন। সে সময় তিনি বলতে গেলে অশীতিপর বৃদ্ধা। বয়সের ভারে অনেকটা মুহ্যমান। তিনি বহুভাষী ছিলেন। হিন্দি, উর্দু, আরবি এবং ইংরেজিতে সাবলীলভাবে পড়তে, লিখতে এবং কথা বলতে পারতেন। আমাদের সাথে কথা বলার সময়ও কখনো বাংলা, কখনো হিন্দি, কখনো উর্দু আবার কখনো ইংরেজি ভাষা ব্যাবহার করেছেন। আমি সেসময় কলেজ পড়ুয়া ছাত্র। আগে এত ভাষা জানা কারো সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়নি। তাই আমি বেশ আগ্রহ ভরে তাদের কথা শুনছিলাম। সে সময়ে শাহজাহান স্যার বিএনপি দলটির মনোহরদী উপজেলার শীর্ষ নেতা। এই কারণেই বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে অপসারণের বিষয়টিতে তাঁর মর্মাহত হবার কথা জানিয়েছিলেন।

তার শেষ ইচ্ছা ছিল বিলাগী গ্রামে স্বামীর ভিটায় একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা। জমিদার বাড়ির একটি বিরাট দালান তখনও টিকে ছিল। এই দালানের রং ছিল লাল। তাই দালানটি লাল দালান নামে পরিচিতি পেয়েছিল। এই দালানকে প্রধানত প্রসূতী এবং স্ত্রীরোগ হাসপাতালে রূপান্তরিত করার ইচ্ছা ছিল তার। তিনি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বেশ কয়েকবার স্বামীর বাড়িতে এসেছিলেন। এলাকার, বংশের সকলের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ—আলোচনা করেছিলেন। এই মোতাবেক দালানের প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজ করা হয়। আশেপাশের অপ্রয়োজনীয় গাছ কেটে পরিষ্কার করা হয়। তার সঙ্গীদের মধ্যে ডাক্তার, রাজনীতিবিদ ও সমাজকর্মী ছিলেন। যতদুর মনে পরে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের সহধর্মিণী মিলি রহমান তার সংঙ্গে এসেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে অজানা কারণে কিছু দুষ্টু মানুষের অসহযোগিতায় তা আর আলোর মুখ দেখেনি। একরকম অতৃপ্তি নিয়েই তিনি ৭ নভেম্বর ২০০৭ সালে মারা যান।

ডা. জোহরা কাজী পেশাগত উৎকর্ষের সর্বোচ্চ ডিগ্রিসহ সৎ, আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান ছিলেন তার পবিত্র দায়িত্বের প্রতি অত্যন্ত সময়নিষ্ঠ ছিলেন। তাঁর দর্শন ছিল ‘মানবীয় আচরণ, পরোপকারী দৃষ্টিভঙ্গি’। যা তিনি তার দীর্ঘ পেশাগত জীবন জুড়ে করে গেছেন, শিখিয়েছেন এবং বজায় রেখেছেন। তিনি বৃটিশ ভারতের ভাইসরয় পদক, তগমা-ই-পাকিস্তান পদক, একুশে পদক (মরণোত্তর), বেগম রোকেয়া পদক, বিএমএ স্বর্ন পদকসহ অনেক পুরস্কারে ভূষিত হন। এছাড়াও তিনি গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র কতৃক ‘প্রিয় শিক্ষক’ সম্মাননায় ভূষিত হন।

অন্ধকার দিনে পিছিয়ে পড়া বাঙালি নারী জাতিকে আলোকিত করতে তিনি আলোর রশ্মির মতো এসেছিলেনতার নিঃস্বার্থ, নিবেদিত এবং নিরলস প্রচেষ্টা তাকে খ্যাতির শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল। অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য জাতি তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।

আমি জোহরা কাজীর জন্য অত্যন্ত গর্বিত। এই জন্য যে, তিনি আমাদের ভূঞা বাড়ির পুত্রবধূ ।

 

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন